১
কুড়লতলী গ্রামের লোকের আজকাল বড়োই জ্বালা হয়েছে। মাস কয়েক হল গ্রামে চুরিটা বেড়ে গেছে বড্ড। নন্দু চোরের কথাই সবাই ভেবেছিল, কিন্তু তাকে তো আজকাল গ্রামে দেখাই যায় না। গাঁয়ের জমিদার সে দিন ভাটপাড়া দিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ নন্দুর বাড়ি গিয়ে দেখল নন্দুর অস্থিসার অবস্থা, বিছানাতেই পড়ে সারাদিন রাত। নন্দুর ছেলে গদাই সোমত্থ হয়েছে, ঘরের কোনে উবু হয়ে বসে আছে দেখে মোড়ল বলে গেলেন, “বড়োটি হয়েছিস, কাজকম্মো কিছু করিস না কেন? কাল সকালে আমার কাছারিতে আসবি।”
সে দিন রাতে জমিদার বাড়িতে চুরি হল। পরদিন সকালে হইচই হচ্ছে, লোকে লোকারণ্য, তার মধ্যে ছেলেটা এল কি না কেউ দেখল না।
সন্ধেবেলা নন্দুর বাড়িতে এলেন গ্রামের কালী মন্দিরের ভটচাজ পুরোহিত। উঁকি দিয়ে ডাকলেন, “নন্দু আছিস? গদাই?”
নন্দু বিছানায় শুয়ে। ওখান থেকেই চিঁচিঁ করে বলল, “ঠাকুরমশাই? প্রণাম। ওরে গদাই, ঠাকুরমশাইকে বসার জায়গা দে।”
ঘরের কোনে গদাই উবু হয়ে বসে ছিল, উঠে এসে প্রণাম করল, চটের আসন পেতে বলল, “ভিতরে আসেন, ঠাকুরমশাই।”
ভটচাজ ঢুকলেন না। নাক কুঁচকে বললেন, “বাড়িতে তোরা দুটিই প্রাণী? তোর মা গেল কই?” উত্তরের অপেক্ষা না করেই বলে চললেন, “সন্ধ্যারতির সময় হল। গদাই, আজ মায়ের আরতির পরে তুই আমার সঙ্গে দেখা করবি।” বলে আবার বেরিয়ে অন্ধকার রাস্তা দিয়ে চলে গেলেন মন্দিরের দিকে।
ভটচাজ চলে যাবার পরে খানিকক্ষণ গদাই দাঁড়িয়ে রইল ঘরের দরজায়। তার পরে ফিরে গিয়ে বাবার বিছানার পাশে দাঁড়াল। বলল, “কী করব?”
চিঁচিঁ করেই নন্দু বলল, “যাবি। ও ব্যাটা মহা ছ্যাঁচোর। বামুনদের বিশ্বেস নেই। কিন্তু খুব সাবধান।”
২
সে দিন সন্ধ্যাবেলা, আরতি শেষ করে মন্দির বন্ধ করে ভটচাজ দিনের প্রণামী তুলে রাখছেন, এমন সময় দরজায় টোকা। দরজা খুলে দেখলেন গদাই। ভেতরে ঢুকে আগে মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে দেবীমূর্তিকে, তার পরে ভটচাজকে প্রণাম করল। ভটচাজ মাটির দিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন, “বোস, ওইখেনে বোস।”
গদাই বসল, ভটচাজ সামনে এসে দাঁড়ালেন। বললেন, “তুই তো শহরে গিইচিলি। চাকরি করতে?”
গদাই হাত জোড় করে বলল, “এজ্ঞে, কিন্তু বাবার শরিলটা খারাপ করল…”
ব্রাহ্মণ থামিয়ে দিয়ে বললেন, “তুই কি শহরে গিয়ে ডাক্তার হইচিস?”
গদাই বিনয়ে মাথা নিচু করে বলল, “এজ্ঞে তা নয়, তবে কী, শরিল খারাপ হলে বুড়ো মানুষের ছেলে হাতের কাছে থাকলে…”
এবার ভটচাজকে থামাতে হল না, গদাই নিজেই চুপ করে গেল। ভটচাজ নাক থেকে হুঁঃ জাতীয় একটা শব্দ করে বললেন, “কদ্দিন ফিরেচিস?”
গদাই বলল, “মাস ছয়েক হয়ে গেল, ঠাকুরমশাই।”
“ছ’ মাস!” ভটচাজ অবাক। “ছ’ মাস হয়ে গেল, গাঁয়ের কেউ জানতেই পারল না? বলিস কী রে গদাই?”
গদাই বলল, “গাঁয়ের মানুষেরে জানাইনি ঠাকুরমশাই। কারে কী বলব? বন্ধুবান্ধবও তো কেউ নাই আর, সবাই যে যার মতো। তাই ঘরেই থাকি, ঘরের কাজ করি…”
আবার কথায় বাধা দিলেন ভটচাজ। বললেন, “আর এই ছ’ মাস হল, গাঁয়ে আবার চুরি হতে লেগেছে।”
গদাই চুপ। ভটচাজ খানিক অপেক্ষা করে বুঝলেন গদাই কিছু বলবে না। বললেন, “কিছু বলচিসনে যে বড়?”
গদাই বলল, “ঠাকুরমশাই, কী বলি বলুন, চুরি ডাকাতির বিষয়ে বলা কি আমার সাজে?”
ভটচাজ বললেন, “তুই যে দেশে ফিরেচিস ছ’ মাস হল, থানায় দারোগা জানে?”
“আজ্ঞে না, ঠাকুরমশাই।”
“বটে, তা কেউ যদি তারে খবর দেয়, নন্দু চোরের ছেলে ছ’ মাস হল দেশে ফিরেচে, তার পর থেকেই গাঁয়ে চুরি বেড়ে গিয়েচে, তা’লে তোর কী হতে পারে জানিস তো?”
জানে। কিন্তু সেটা বামুনঠাকুরকে জানানোর দরকার আছে বলে মনে করল না। বলল, “ঠাকুরমশাই, বাবা শয্যেশায়ী। এখনও যদি পুলিশ পাঠান…”
ঠাকুরমশাই সামনে ঝুঁকে পড়লেন। প্রায় ফিসফিস করে বললেন, “ধর খবর পেয়ে পুলিশ তোদের বাড়িতে হানা দিল। কী পাবে?”
প্রায় অবাক গলায় গদাই বলল, “কী পাবে?”
ঠাকুরমশাই বললেন, “অবাক হয়ে যে চোখ কপাল ছাড়িয়ে ছাদে ঠেকালি বাবা, চোরাই মালে তোর বাড়ি ঠাসা পাবে না পুলিশ?”
খুব আস্তে আস্তে নিশ্চিন্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল গদাই। বলল, “না, ঠাকুরমশাই, গরিবের বাড়িতে মালই কোথায়, যে ঠাসা কিছু পাবে?”
“বটে!” রাগে চোখ লাল হয়ে গেল ভটচাজের। “আজই, এখনই যদি পুলিশ তোর বাড়িতে হানা দেয়, জমিদারের বাড়িতে চুরি হওয়া মালকড়ি কিছু পাওয়া যাবে না?”
হাত জোড় করে গদাই বলল, “ঠাকুরমশাই, জমিদারবাড়ির চুরি সম্বন্ধে আমি কিছুই জানি নে। পুলিশ এসে কিছুই পাবে না। কাল সকালে জমিদারবাবু আমারে কয়েচিলেন কাছারি যেতে, কাজের ব্যবস্থা করে দেবেন। আমি গেইচিলাম, কেউ আমাকে কিছু বললইনেকো। সব্বাই চুরি নিয়েই ব্যস্ত।”
“হুঁঃ,” বলে ব্রাহ্মণ গদাইয়ের সামনে থেকে হেঁটে গিয়ে কালী মূর্তির সামনে দাঁড়ালেন। তাকিয়ে রইলেন মূর্তির মুখের দিকে। যেন মা বলে দেবেন কী বলা উচিত।
গদাই বলল, “ঠাকুরমশাই, কোনও দিন একটা কুটো চোরাই মাল কেউ পায়নি বাড়ি থেকে। তবুও আজ কেউ কইলে পুলিশ এক কথায় বিশ্বেস করবে আমি চোর।”
ব্রাহ্মণ বললেন, “করাই উচিত। তোর বাবা ঘাঘু চোর ছিল। কোনও দিন ধরা পড়েনি বলে কি চুরি করেনি? আমি তোর বাবার সঙ্গে বড় হয়েচি, ভুলে গেলি? গাঁয়ে তখন একখানই ইশকুল ছিল, তাতে আমরা একই কেলাসে পড়িনি? আমি জানি তোর বাবা চোর। চোর… পাকা চোর। সেই বয়েস থেকেই।”
গদাই চুপ।
ভটচাজ বললেন, “তোর বাবার সিঁধকাঠিটা আছে এখনও?”
গদাই একটু ভেবে বলল, “খুঁজলে পাওয়া যাবে হয়ত।”
ভটচাজ বললেন, “চোর যদি না হবে, তা’লে সিঁধকাঠি রাখে কেন সে?”
গদাই ঠোঁট উলটে বলল, “ঠাকুরমশাই, সে তো সব বাড়িতেই এমন জিনিস পাওয়া যায় যা লোকে রেখেই দেয় – কেন আছে, কত দিন ধরে আছে, সে কেউ জানেও না।”
ভটচাজ এবারে এগিয়ে এসে গদাইয়ের সামনে আসনপিঁড়ি হয়ে বসলেন। বললেন, “তোর বাবাকে কত করে বলেছিলাম, মন্দিরে পুজো দিবি, পুজো দিবি। তা’লেই দেখবি মা কালী তোকে রক্ষা করছেন। তা বাবু কতা শোনেন? আর, আজ দেখ কী অবস্থা। গাঁয়ের লোক আর পুলিশের মার খেয়ে অদ্দেক হয়ে গেছে।”
গদাই চুপ।
ভটচাজ ঝুঁকে পড়ে বললেন, “কাল থেকে মায়ের পুজো নিয়ে আসবি। যে দিন রাতে গাঁয়ে চুরি হবে, তার পরদিনই পুজো নিয়ে আসবি। নইলে পুলিশের সন্দ হবে – নন্দু চোরের দামড়া ছেলে ঘরে বসে বাপের সেবাই যদি শুধু করে, তা’লে পেট চলে কী করে? খোঁজ করতে আসবে। ভেবে দেখ। এই শরীরে মার খেলে আর বাঁচবে নন্দু? কাল পুজো দিস মায়ের পায়ে, সেই হবে চুরির প্রাচিত্তির, সব ঠিক হয়ে যাবে।”
৩
পরদিন ভোরে অসুস্থ বাবার ঘুম ভাঙলে সব কথা খুলে বলল গদাই। বলল, “আমার মনে হয় পুজো দেওয়াই ভালো। নইলে ওই ভটচাজই পুলিশের কানে লাগাবে।”
সকাল হতে গদাই থালায় করে প্রায়শ্চিত্তর পুজো রেখে এল পুরোহিতের সামনে। পুরোহিত সকালের পুজোর জোগাড় করছিলেন, আড় চোখে থালাটা দেখে নিয়ে বললেন, “সন্ধ্যারতির পর প্রসাদ নিয়ে যাস।”
সন্ধ্যাবেলা আবার একা মন্দিরে ভটচাজ বললেন, “আমার সঙ্গে তামাশা করচিস? এই ক’টা টাকা পেন্নামি? পাপের কামাই, তার দুটো পয়সা পেন্নামি দিতে কিসের এত ন্যাকামি? মনে রাখিস, চুরির পয়সার প্রাচিত্তির যদি চাস, দেবদেবীকেও বেশি ভাগ দিতে হয়।”
সব কথা শুনে নন্দু বিছানায় শুয়ে শুয়েই চিঁচিঁ করে গর্জন করে উঠল।
“এবার বুঝছি। ওই ভটচাজই বার বার পুলিশ পাঠাত, গাঁয়ের লোকেদের উস্কে দিত আমাকে মারধর করার জন্য। বাপরে বাপ, কম ঠ্যাঙানি খেইচি! কত হাড়গোড় ভেঙেছে! একটাও পয়সা ওকে দিবিনি। বলে দিলাম। যা পুজো হবে আমাদের মন্দিরেই হবে।”
গদাই রাজি হল না। গদাই নিজেও মার খেতে মোটেই রাজি না। তার ওপর, থানায় নতুন দারোগা কেমন বুদ্ধি ধরে কে জানে? বাবার আমলের হোঁৎকা দারোগার হাতের জোর ছিল অনেক, বুদ্ধি ছিল একেবারে রদ্দি। তল্লাশি করে কোনও দিনই কোনও চোরাই মাল উদ্ধার করতে পারেনি। মেরে ধরে চলেই গিয়েছে কেবল। এবারের দারোগা যদি ভাল করে খোঁজে? বাগানের কোনের আগাছার লতার নিচে পাথরের চাতালটা যদি সরায়? সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামে? ওরে বাবা! মাটির তলার ঘরের কালী মন্দির আর সেখানে সাজানো জমিদারবাবু আর অন্যান্য চুরির সোনাদানার কথা সবই জেনে যাবে।
তার চেয়ে বরং… সাত পাঁচ ভেবে গদাই একটা বড় থালায় আবার সুন্দর করে পুজো সাজিয়ে মন্দিরে গেল সকাল সকাল।
ভটচাজ সে দিন সন্ধ্যাবেলা পুজোর থালা ফেরত দিয়ে বললেন, “মনে থাকবে? যে দিনই গাঁয়ে চুরি হবে, তার পরদিনই মায়ের কাছে ক্ষমা চেয়ে যাবি। পেন্নামী যেন ভাল রকম থাকে।”
ঘাড় নেড়ে গদাই ফিরে গেল। বাড়ি গিয়ে দেখে নন্দু রেগে রয়েছে। বলল, “খাটবি তুই, আর পেন্নামি পাবে ও? মামার বাড়ির আবদার!”
গদাই বলল, “মারের হাত থেকে বাঁচছ, সেই বা কম কী? আর এ গাঁয়েই চুরি হলে পুজো দিতে হবে। আস-পাশের গাঁয়ে চুরি হলে তো বামুন খবর পাবে না!”
নন্দু বলল, “তবে কাছে আয়, একটা কথা বলি।”
৪
সে দিন থেকে গ্রামে চুরি হলেই গদাই পর দিন সকালে এসে পুজো দিয়ে যায়। পুজোর সরঞ্জাম যাই থাকুক, প্রণামী থাকে জব্বর। রোজই সন্ধ্যারতি শেষ করে ভটচাজ পুরোহিত সবার দেওয়া চালটা, কলাটা, শাড়িটা, ধুতিটা নিয়ে যান বাড়িতে। দরজা বন্ধ করে প্রণামীর পয়সা লুকিয়ে তুলে রাখেন মন্দিরের দেওয়ালের একটা আলগা পাথর সরিয়ে তার পেছনে। বাড়িতে পয়সা নিয়ে যান না। কখনও পয়সার দরকার হলে মন্দিরের দেওয়ালের পাথর সরিয়ে বের করে নেন। মাটির বাড়িতে চোর আসতে পারে। পাথরের মন্দিরে চোর ঢুকতে পারবে না। মায়ের মূর্তির সামনে থেকে চুরি করবে না কোনও চোর। ওঁর আগেও এখানেই প্রণামী রাখতেন ওর বাবা, তার আগে ঠাকুর্দা। কত পয়সা যে ওই পাথরের পেছনে আছে, ভটচাজের কোন হিসেবই নেই।
রাত নিশুত হলে মন্দিরের বাইরের দেওয়ালের কোনার পাথরটা সরিয়ে ভেতরে ঢোকে গদাই। এই পথটা সে দিন নন্দু ওকে শিখিয়ে দিয়েছে। আগে ওর ঠাকুর্দা ওই পথে মন্দিরের পয়সা চুরি করত। ওর বাবা কখনও মন্দির থেকে চুরি করেনি। ভটচাজের লুকোনো ভাণ্ডার থেকে গদাই পয়সা নিয়ে ফিরে যায়। কালী মায়ের মূর্তির সামনেই নেয়। ভয় পায় না। বাড়ি ফিরে নিজের মন্দিরে কালী মায়ের মূর্তির সামনে সেই পয়সা রেখে দেয়। মা তো একই। ভয় কিসের?
সেদিনই নেয় যে দিন ও পুজো দিয়েছে।
ততটাই নেয় যতটা প্রণামী দিয়েছিল।