এমন আবার কোনো ডাক্তারবাবু আছেন নাকি যার কোনো অ্যাটেনডেন্ট নেই?
হয়, হয়। গত দুবছর কোভিডের বাজারে আমার কোনো অ্যাটেনডেন্ট ছিল না। আমি নিজে গিয়েই চেম্বার খুলে পেশেন্টদের নাম লিখতাম।
লোকেরা বাইরে হাসাহাসি করত। অনেকে অবাক হত। ডাক্তারবাবুর কোনো অ্যাটেনডেন্ট নেই? অনেকেই বদনাম করত।
কোনো বয়স্ক পেনসনভোগী সিনিওর সিটিজেন যিনি আমাকে সাবসিটিতে দেখান তিনিও একদিন মন্তব্য করলেন,- “এরা এত টাকা রোজগার করবে অথচ একটা লোককে চাকরি দেবে না? বাইরে এতজন দাঁড়িয়ে মশার কামড় খাচ্ছি। এর সাথে পাশের দোকানটাও কিনে নিতে পারতেন। তাহলে আমাদের বসার সুবিধে হত। তা করবেন না! সব টাকা জমিয়ে রাখবেন!”
কোভিডের সময় যখন চারিদিকে কাজের জন্য হাহাকার চলছে সেইসময় কোনো জনদরদী মানুষের পক্ষে এমন মন্তব্যে আমি কোনো অসঙ্গতি দেখিনি। কিন্তু ওনার মুখে কথাটা শুনে আমার খারাপ লাগল। ওনার অন্তত আমার প্রতি কিছুটা কৃতজ্ঞতা দেখানো উচিত ছিল।
তবু আমি না শোনার ভান করেছি। যেন বাইরের রুগিদের কোনো কথাই আমার কানে আসে না।
এমন একটা সময় ছিল যখন ডাক্তারবাবুদের সাথে তাদের অ্যাটেনডেন্টরাও সমানভাবে চর্চিত হতেন। তারাও ছোটখাটো ডাক্তার ছিলেন। তখন তো এখনকার মতো ভুড়িভুড়ি ডাক্তার ছিল না, বিশেষ করে গ্রামে তো কোয়াক ডাক্তারের কম্পাউন্ডারও ডাক্তারের মর্যাদা পেতেন। এখনো হয়ত পান।
আমরা যখন ছোট তখন ব্যারাকপুরে অমরেশ পাল নামে একজন খ্যাতিমান জনপ্রিয় ডাক্তারবাবু ছিলেন। তার একজন অ্যাটেনডেন্ট ছিল। অনেকে বলত তিনি সম্পর্কে তার ভাই ছিলেন। তিনি নাকি ইঞ্জেকশন দিলে একদম লাগত না। অনেকে আবার আগ বাড়িয়ে বলত তিনি নাকি স্টিচ করলেও লাগত না। আমরা হাঁ করে সেসব গিলতাম। এও হয়!
তবে কথাটা খুব মিথ্যে ছিল না। আমরা তখন প্রাইমারিতে পড়ি। স্কুল থেকে বেরোতে গিয়ে ভাইয়ের মাথা ফেটে গেল। হেড মাস্টারমশাই চ্যাংদোলা করে ভাইকে নিয়ে এলেন সেই অমরেশ পালের চেম্বারে। মাথায় চারটে সেলাই পড়ল। অথচ ওইটুকু ছেলের কোনো কান্না নেই!
আমার প্রথম অ্যাটেনডেন্ট ছিল রাজপুত বংশীয়। মুখে সবসময় হাসি কিন্তু মাথা গরম। রাগলে জ্ঞান থাকে না। একবার এক পেশেন্ট পার্টির সাথে প্রায় হাতাহাতি লেগেই গেছিল। সে ভদ্রলোক এখনো দেখাতে এলে ওর কথা বলে।
পরে এসেছিল শঙ্কর। ও অনেকদিন ছিল। এখনো ওর সাথে আমার নিবিড় যোগাযোগ। সে পারে না এমন কোনো কাজ নেই। সে প্রতিবছর পুজোর সময় বেশ কিছুদিন ছুটি নিত। পুজোর আগে ছুটি নিত অনেক লোকের দলকে বেড়াতে নিয়ে যেতে। পুজোর সময় ছুটি নিত কারণ ও ছিল দুর্গা আর কালিপুজোর পুরুতঠাকুর। কাঠের কাজ জানত। একটা চেম্বারের কাঠের সামগ্রী একার হাতে তৈরি করেছিল। ইলেকট্রিকের কাজ জানত। গাড়ির ড্রাইভারের কাজও করত। এখনো মাঝে মাঝে ড্রাইভার না পেলে ওকে ডাকি। এমন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী অথচ গলা নিচু, রাগ বলে কিছু নেই। প্রায় বছর ছয়েক আমার কাছে কাজ করে না। এখনও লোকেরা ওকে ফোন করে জিজ্ঞাসা করে আমি সেদিন বসব কিনা। ও বাইক দাঁড় করিয়ে বা গাড়ি চালাতে চালাতে নির্দ্বিধায় জবাব দেয়। বিরক্তি বলে কিছু ওর রক্তে নেই।
ও যখন পারল না ও একটি মেয়েকে দিল। সে একটু প্রগলভ। বুদ্ধি কম। মার্জিত রুগিরা ওকে পছন্দ করত না। আমিও তাই ওকে রাখার সাহস পেলাম না।
পরে শঙ্করই আরেকজন বয়স্ক মহিলাকে এনে দিল। দিদি অল্পবয়সে স্বামীকে হারিয়েছেন। দুই মেয়ে। বিবাহিত। সুন্দরী। হাসিমুখী। কিন্তু খুব ব্যক্তিত্বময়ী। রুগিরা অনেকসময় অ্যাটেনডেন্টদের উল্টোপাল্টা কথা বলে। ডাক্তারবাবুকে কিছু বলতে না পেরে তাদের ওপর ঝাল ঝাড়ে। দিদির খুব আত্মসম্মানে লাগত। কখনও রেগে যেতেন। কোভিডের সময় খুব ভয় পেতেন চেম্বারে আসতে। তখন সবে কোভিড শুরু হয়েছে। চরম প্যানিক চলছে। দিদি সোদপুরে মেয়ের কাছে চলে গেলেন। ছেড়ে দিলেন।
সেই থেকে দু বছর আমার কোনো অ্যাটেনডেন্ট ছিল না। কোভিডের সময় কেউ আসতেও চাইত না কারণ তখন ডাক্তারবাবুর চেম্বার ছিল অনেকটা জেলখানার মত। কেউ বাধ্য না হলে সেখানে আসত না।
কোভিড স্তিমিত হতেই যখন লক ডাউন লোকের কাজকর্ম সব খেয়ে নিল তখন সেই আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতিতে একজন মফস্বলের ডাক্তারবাবু হিসেবে দেখেছি লোকেরা কাজের জন্য কিরকম হাহাকার করে। বেশিরভাগ লোকেরাই দিন আনে দিন খায় গোছের। কোভিড তাদের খাবার জোগাড় করাও কঠিন করে দিয়েছিল।
কর্মহীন মানুষগুলোর একটা সুলুকসন্ধান হলো যে বাগচী ডাক্তারবাবুর চেম্বারে একটা অ্যাটেনডেন্টের চাকরি ফাঁকা আছে। কত লোক যে নামধাম ফোন নাম্বার লিখিয়ে গেছে তার ইয়ত্তা নেই। তাদের মধ্যে মহিলাদের সংখ্যা বেশি হলেও কিছু টোটোচালকও ছিল।
পাড়ারই একজন সুন্দরী মহিলা হঠাৎ ফোন করে বললেন তার দুঃখের কথা। তিনি এখন তার মেয়েকে নিয়ে বাপের বাড়ি আছেন কারণ তার স্বামী নাকি তার গয়নাগাটি চুরি করে গা-ঢাকা দিয়েছেন। ভদ্রমহিলা অত্যধিক সুন্দরী। তার স্বামী সম্ভবত কিছুই তেমন করেন না। আমাকে অনেকবারই দেখিয়ে গেছেন। তার কথা শুনলাম কিন্তু ওরকম সুন্দরী ভদ্র মহিলাকে ওই কটা টাকার জন্য অ্যাটেনডেন্ট করা থেকে নিজেকে বিরত রাখলাম।
পাড়ার বৌদি, দিদি, পাশের পাড়ার বৌদি সবাই জানিয়ে গেল কাউকে রাখলে কাজটা যেন তিনি পান। পাশাপাশি একজন দিদি বললেন, দাদার ব্যবসার অবস্থা ভালো নয়। ছেলেটা ভালো কিছু পড়তে চাইছে। আমার চেম্বারের কাজটা পেলে তিনি ছেলেকে ভর্তি করতে পারবেন।
তিনি আমার মা-বউয়ের খুব প্রিয়। তারা তাকে আশ্বস্ত করলেন যে কাজটা তিনিই পাবেন। চিন্তা নেই।
একজন মহিলা তার ছেলেকে নিয়ে দেখাতে আসতেন আর জিজ্ঞাসা করতেন, ডাক্তারবাবু কাউকে রাখেন নি তো? আমি যেন কাজটা পাই।
আরেকজন মহিলা তাকে আমি চিনতাম না। তিনি পরিচয় দিতেন তিনি নাকি আমাদের পূর্ব পরিচিত। কোনোদিন ভিজিট দিয়ে দেখান নি। তাই শেষে আসতেন। তার মেয়ের মাথার সমস্যা আছে। গ্র্যাজুয়েট। খুব জেদ করতেন। ধরেই নিয়েছিলেন তার মেয়েটির কোনো গতি আমার দ্বারাই হবে। যাবার সময় বাইরের লাইট পাখা বন্ধ করে যেতেন। ভাবখানা এমন ছিল যেন কাজ শুরুই হয়ে গেছে।
এমত অবস্থায় আমি লজ্জায় একজন অ্যাটেনডেন্ট রাখতে পারছিলাম না। কাকে রাখব? আমার এই সামান্য কাজের জন্য এত চেনা কাছের লোকজন লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কাউকে নিলে বাকিদের আশাভঙ্গ হবে।
অথচ না নিলেই নয়। যেহেতু আমি সকালে ২০ আর সন্ধ্যেয় ২০ সারাদিনে চল্লিশ জনের বেশি দেখি না, যখন রুগির চাপ বাড়ে খুব সমস্যার সৃষ্টি হয়।
তাই বাধ্য হয়েই সেই লিস্ট থেকে একজনকে নির্বাচন করলাম।
মেয়েটি গ্র্যাজুয়েশন সবে শেষ করেছে। বাচ্চা মেয়ে। টিউশন পড়ায়। আর আমার কাছে নাম লেখার কাজ করে। আমার বউয়ের স্কুলের প্রাক্তন ছাত্রী।
লিস্টের অনেকেই বাড়িতে এসে মা-বউয়ের কাছে কান্নাকাটি করে গেছেন কাজটি তারা পায়নি বলে। আমি অসহায়। আমি তো একজনকেই সুযোগ দিতে পারব। তাই কিছু করার নেই।
আমার রুগিদের আরেকটা সমস্যা আমার ফোনে নাম লেখার ব্যবস্থা নেই। নাম লিখিয়ে দেখাতে অনেক্ষণ বসে থাকতে হয়। কিন্তু আমার কিছু করার নেই। এর ফলে যাদের খুব দরকার তারাই দেখান। দেখানোর সুযোগ সহজ হলে ভিড় বাড়বে। আমি সামলাতে পারব না।
আর আগে যাদের নাম্বারে নাম লেখা হত তারা ছেড়ে দেওয়ায় এখনও লোকে তাদের নম্বরে ফোন করে নাম লেখাতে চায়। সবাই তো শঙ্কর নয়। অনেকে নম্বরই পালটে ফেলেছেন। মাঝে মাঝেই ফোন আসে, নামটা লিখুন তো।
এই মেয়েটিও দেখি কদিন থাকে? বিয়ে হলে কেটে পড়লে তার ফোনেও ফোন যেতে থাকবে। স্থায়ী হলে তখন দেখা যাবে।
তবে এই সামান্য অ্যাটেনডেন্ট নির্বাচনে আমি গত দু বছরে মানুষের হাল কিছু বুঝতে পেরেছি।
আমার মাঝে মাঝে মনে হত একজন লেখক হিসেবে আমি কিছুতেই তাদের মত লিখতে পারব না যারা সেইসব গ্রাম-মফস্বলের অন্ত্যজ লোকদের জীবনের কথা লিখে গেছেন। আমি কিভাবে ইলিয়াস সাহেবের মত লিখবঃ- ‘নাকে যখন গুয়ের গন্ধ আসতে শুরু করেছে তখনই খিজির বুঝল তার বস্তি এসে গেছে’। তবে এখন আমার মনে হয় আমি যাদের চারপাশে নিয়ে বসবাস করি তাদের জীবনের সঙ্কটও কিছু কম নয়।
একজন সাদা চুল বুড়ো হঠাত এসে বলল, বটতলায় আমার বাড়ির পাশেই নাকি তারা ছাপাখানা করেছেন। আমার প্রেসক্রিপশন প্যাডগুলো যদি তাদের ছাপাতে দিই। খুব উপকার হয়।
লোকটিকে দেখে মায়া হল। জরাজীর্ণ দেহ। মেরুদন্ড বেঁকে গেছে। বললাম, প্যাড লাগবে না। তবে বিল আর মেডিকেল সার্টিফিকেট যেন হাজার খানেক ছাপিয়ে দেন। বলল সাতশ টাকা। আমি তিনশ টাকা অ্যাডভান্স দিলাম। চলে গেল।
দুদিন বাদে আবার এল। বলল আর দুশো টাকা বেশি লাগবে। মানে নয়শ। টাকাটা অনেকটাই বেশি। যাই হোক আমি আর তিনশ টাকা অ্যাডভান্স দিলাম।
সপ্তাহ পার হল। মাস পার হল। বুড়োর দেখা নেই। পরে একদিন খুঁজতে গিয়ে দেখি বটতলায় সেই প্রেসেরই কোনো অস্তিত্ব নেই।
লোকেরা অবাক হয়ে বলল, “ডাক্তারবাবু ওনার ফোন নাম্বারও নেন নি?”
সত্যি অমন বৃদ্ধ লোক যে ঠক হতে পারে তা আমার কল্পনাতেও আসে নি।
মালদার কোয়ার্টারের একজন গার্ড একশ টাকা ধার নিয়েছেন তিনমাস হল। প্রতি সপ্তাহেই বলেন, “দিয়ে দেব। কাউকে বলবেন না”।
এই সমাজ যেখানে সত্তরোর্ধ এক ন্যুব্জ বৃদ্ধকে ঝুঁকি নিয়ে ঠকবাজির পথে নামতে হয়। কোয়ার্টারের সিকিউরিটি ইচ্ছে থাকলেও কারো একশ টাকা শোধ করতে পারেন না। সামান্য এক ডাক্তারের চেম্বারে অ্যাটেনডেন্ট-এর চাকরির জন্য পঞ্চাশ জন নাম লেখায়। এই সমাজও সেই অন্ত্যজ সমাজের তুলনায় কিছু কম উল্লেখযোগ্য নয়।
আমি একজন লেখক হিসেবে তাদের কথা যদি না বলতে পারি, তা আমারই ব্যর্থতা।