একটা গল্প দিয়ে শুরু করি,
আমি চিরদিন স্যার-ম্যাডামদের চোখের আড়ালে বসা শেষ বেঞ্চের ছাত্র।
কোনদিন যদি তাদের দুর্ভাগ্যবশত চোখে পড়ে যেতাম, আর আমার দিকে কোন প্রশ্ন ছুঁড়ে দিতেন, তাহলে ধীরে সুস্থে উঠে দাঁড়িয়ে বলতাম “জানিনা”। বেশ কবার এরকম হবার পর, যা হবার তাইই হলো, প্রলয় থেকে আমার নাম “জানিনা” হয়ে গেল। কিন্তু শুধু এটা হলে তো কোন ব্যাপার ছিল না, যেটা হল সেটা আরো সাংঘাতিক।
প্রবালের সাথে আমার নামের মিল থাকলেও স্বভাবে ও ছিল উল্টো চরিত্রের, প্রশ্ন করার আগে থেকেই প্রবাল সব জানা থাকতো।
প্রবালের রোল নাম্বার ছিল সাতাশ,
অনুষ্ণার রোল আঠাশ, আর
আমার উনত্রিশ।
ক্রমে ক্রমে পরিস্থিতি এমন হলো,
প্রবাল হয়ে গেল “জানি” আর অনুষ্ণা “জানি আর জানিনার মধ্যে”।
বেচারি, কোন কিছু না করেই কলেজে বেশ একটা জাঁদরেল নাম বাগিয়ে বসেছিল। অবশ্য আরো কিছুদিন পর আরেকটা নাম ওর কপালে জুটেছিল, কিন্তু সেই আলোচনা আমাদের “সিলেবাসের” বাইরে।
ঘটনাটার সাথে ‘অটিসম’ এর কোন প্রত্যক্ষ
যোগাযোগ না থাকলেও, আমার প্রথমেই এই ঘটনার কথাই মনে এলো। কেন? পরে বলছি।
বললেই হলো? লিখুন বললেই কি আর লেখা যায়? অটিসম খায় না মাথায় মাখে, তার সম্পর্কে একটা স্বচ্ছ ধারণা তো থাকতে হবে?
শুরু হলো অটিসমকে জানার প্রচেষ্টা।
ধুলো ঝেড়ে ঘরের কোণ থেকে সব বইপত্র বের হল।
আচ্ছা ‘অটিসম’টা কি? কেমন তরো রোগ? এটা কি আদৌ রোগ না রোগের উপসর্গ মাত্র?
এই প্রসঙ্গে আরো একটা ঘটনা মনে পরে যাচ্ছে, যেটা না বললে, ‘অটিসম’ সম্বন্ধে কিছুই বলা হবে না। এমনকি এই লেখাটিও শুরুই করতে পারতাম না।
প্রবুদ্ধকে আমি দেখতাম। ওর মা-বাবা, কলকাতার এতো নামীদামী ডাক্তারদের বাদ দিয়ে আমার কাছেই নিয়ে আসতো। আমি দেখতাম। আমার চেম্বারে একটা কাঠের ঘোড়া আছে, ও যেদিন আসতো, চেম্বারে এসেই সটান ঘোড়াটা দখল করে বসে থাকতো। প্রথম দিন থেকেই আমার চেম্বারের ওই ঘোড়াটা ওর মন কেড়ে নিয়েছিল। অনেক সময় এমন হয়েছে, আমি অন্য রোগী দেখছি প্রবুদ্ধ আমার ঘরেই ঘোড়াতে বসে আছে। ও ঘোড়ায় বসে থাকতো আমি রোগী দেখার ফাঁকে ফাঁকে, ওর সামনে গিয়ে বসতাম। ঘোড়াটা হাল্কা করে দোলাতে থাকতাম, এটাই আমাদের খেলা ছিল। এই ঘোড়াটাই আমাদের ‘অসম বন্ধুত্বের’ মূল কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
আসতে আসতে ঘোড়াটার বাইরেও আমাকে মেনে নিতে শুরু করেছিল, তবে সময় লেগেছিল।
আমার দুটো স্টেথোর একটা ওর কানে দিয়ে, তারপর ওর বুকে আমি স্টেথোটা বসাতে পারতাম। যতই ওর বন্ধু হই না কেন, এই নিয়মের বাইরে কখনোই যাওয়া যেত না।
বইয়ের পড়া বইতেই থেকে যেত, যদি না প্রবুদ্ধ আমার ‘বন্ধু’ হতো। বই পড়ে যতোটা না জেনেছি, বুঝেছি, প্রবুদ্ধকে দেখতে গিয়ে, ‘অটিসম’ সম্বন্ধে অনেক বেশী জেনেছি।
কিছু শুকনো তথ্য জানিয়ে শুরু করা যাক।
বর্তমানে প্রতি আটষট্টি জন সদ্যোজাতের মধ্যে একজন অটিস্টিক বলে চিহ্নিত।
ভারতে প্রায় কুড়ি লক্ষ অটিস্টিক রোগী আছে, যা মোট জনসংখ্যার ০.১৫% মাত্র (!!)।
এবং এই সংখ্যা ক্রমাগত বাড়বে বই কমবে না।
উনিশো ষাট-সত্তর-আশি অথবা নব্বইয়ের গোড়ার দিকেও ‘অটিসম’ নামটা আমাদের কাছে খুব পরিচিত ছিল না, ছিলো না এ সম্পর্কে ন্যূনতম সচেতনতা টুকু। সচেতনতা নেই আজকেও, কিন্তু তখন এটুকুও ছিলোনা। কিন্তু রোগ আর রুগী তো ছিলই, আর ছিল, তাদের কপালে দেগে দেওয়া নাম ‘পাগল’, অথবা খুব সফেস্টিকেটেড, ভদ্রতার মোড়কে বলা হতো, অ্যাবনর্মাল।
বহু দিন পর যখন অটিসম নিয়ে পড়াশোনা করতে বসেছি, জানতে চিনতে শিখেছি, বারংবার অনুষ্ণার কথাটা মাথায় এসেছে। যদিও ওদের দুর্ভাগ্যের সাথে অনুষ্ণাকে তুলনায় নিয়ে আসা অনুচিত, কিন্তু অনেকের ভাগ্যেই এইরকম মজার ছলে জুটে যাওয়া নাম গুলো যে কতোটা দগদগে ঘা’র সৃষ্টি করে তা অনুভব করেছিলাম।
‘পাগল’ বলতে আমরা কি বুঝি?
যদিও সত্যি কথাটা হলো কিস্স্যু বুঝি না, তাও, যার ‘ইনার কনসেন্স’ নেই, বিচার বোধ নেই।
তাইই যদি হবে, তাহলে অটিস্টিকদের বোধ আছে, বুঝতে পারে, অনুভূতি আছে। যেটা পারে না তা হল, বোঝাতে, পারেনা নিজের চিন্তা-ভাবনা, অনুভূতিকে অপরের সামনে মেলে ধরতে। সহজভাষায় বলতে গেলে, প্রকাশ বোধটা অদৃশ্য।
কিন্তু আমাদের টাতো অদৃশ্য নয়, না আমাদের বুঝতে কিছু দেরী হয়, না বোঝাতে, অথচ আমরাই বার বার ভুলভুলাইয়ার গোলক ধাঁধায় আটকা পরে যাই।
অটিস্টিক দের মূল সমস্যা হচ্ছে, সংযোগ বা কমিউনিকেশন।
কমিউনিকেশনের মাত্র পঁয়ত্রিশ ভাগ কথার, মৌখিক ভাষার মাধ্যমে হয়, আর বাকি পঁয়ষট্টি ভাগ হয়, চোখের মাধ্যমে, দেহের অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে, মুখের বা ফেসিয়াল এক্সপ্রেশনের মাধ্যমে, অর্থাৎ ননভার্বাল।
এদের মধ্যে ভাষার ব্যবহার বা প্রয়োগগত অসুবিধা তো থাকেই, যদিও কারো কারো ভাষা সাবলীল হলেও, একই কথা বারবার ব্যবহার করে (ডাক্তারি পরিভাষায় বলা হয় ইকোলেলিয়া)। অধিকাংশই নির্দিষ্ট কিছু ভাষার ব্যবহারের মধ্যেই সাধারণত সীমাবদ্ধ থাকে। নন-ভার্বাল কমিউনিকেশনে এরা রীতিমতো অসমর্থ।
আচ্ছা আপনাদের কি এবার এদের কে কিছুটা চেনা চেনা মনে হচ্ছে?
হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন- ডাস্টিন হফম্যানের ‘রেনম্যান’ অথবা শাহরুখ খানের ‘মাই নেম ইজ খান…’ চরিত্র গুলোর প্রেরণা এই রোগের থেকেই।
আর পছন্দ-অপছন্দের ব্যাপারেও ওরা বড্ড স্পর্শকাতর, কোন একটা কিছুকে যে ভাবে দেখে অথবা মেনে এসেছে, তার বাইরে হঠাৎ করে নতুন কিছুকে চট করে মেনে নিতে চায় না, পারে না। এটা হল ব্যবহারগত সমস্যা।
না বুঝে, বোঝার চেষ্টা না করেই এদের গায়ে দেগে দেওয়া হয় একগুঁয়ে, গোঁয়ার, জেদি তকমা গুলো। আরো বেশী করে জোর করে ‘স্বাভাবিক’ বানানোর চেষ্টা চলতে থাকে, দূরত্ব ক্রমাগত বাড়তে থাকে।
সুতরাং অটিসমের সমস্যা প্রধানত দুরকম, সংযোগগত এবং ব্যবহারগত।
হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূর চলে এসেছি। এবার এই রোগের বর্তমান নামটা বলে দেওয়ার সময় হয়েছে। হ্যাঁ, ২০১৩ সাল থেকে একে অটিসম না বলে বলা হয়, অটিসম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার (এএসডি)।
আর এই ‘স্পেকট্রাম’ কথাটার মাঝেই লুকিয়ে আছে সার সত্যটা।
অর্থাৎ অটিসম কোনও একটি নির্দিষ্ট অসুখ নয়, বিভিন্ন আচরণগত সমস্যাকে সমষ্টিগত ভাবে অটিসম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার বলা হয়। সেই কারণেই প্রতিটি বাচ্চারই রোগ, তার বিস্তার, প্রকাশমাত্রা, তার ব্যবহারগত সমস্যা, সংযোগগত সমস্যা, বুদ্ধিবিকাশ আলাদা।
অটিসম মোটেই একটি বংশগত রোগ নয়। সম্পূর্ণ সুস্থ বাবা মায়েরও অটিস্টিক শিশু হতে পারে। শিশুর এএসডি শুনলেই কেমন হতাশ হয়ে পড়েন অধিকাংশ মা-বাবা। আসলে এই রোগের প্রচার এতোটাই কম যে, এএসডি টা তাদের কান হয়ে যখন মাথায় পৌঁছয়, তা নাম পরিবর্তন করে ‘মাথার রোগ’ হয়ে যায়।
অথচ ‘শুরুতে’ ধরা পড়লে আর সময়মতো বাচ্চাটিকে যথাযথ ‘চিকিৎসা’ করলে, ‘স্বাভাবিক’ জীবন যাপন মোটেই অস্বাভাবিক নয়। আমরা ভেবেই ফেলি, এরা ‘বোকা-হাবাগোবা’। অস্বীকার করার উপায় নেই, কারো কারো ব্যাবহারিক বুদ্ধি কিছুটা কম হলেও, এদের অনেকেরই ‘বুদ্ধি’ অনেক বেশি। এদের অনেকেরই কিছু বিশেষ দক্ষতা থাকে। আমরা যদি পুঁথিগত বিদ্যা আর তার নম্বরের পিছনে না ছুটে, শিশুটাকে ‘স্বাভাবিক’ করার চেষ্টা না করে, তার ‘স্বাভাবিক দক্ষতা’কে বিশেষ ভাবে লালন-পালন করতে পারি, তাহলেই অর্ধেক সমস্যার সমাধান হয়ে যায়।
শারীরিক প্রতিবন্ধীদের ভাগ্যে যেটুকু সহমর্মিতা জোটে এদের ভাগে ততটাও জোটে না। হাত গুলো এগিয়ে এসে কোথায় যেন হারিয়ে যায়। জুটে যায় “পাগল” তকমা। এই সেদিন পড়ছিলাম, কোন এক গাড়ির চালক এক অটিস্টিক বাচ্চাকে গালাগালি করেছে, পাগল বলেছে, হাত মুচড়িয়ে ধরেছিল। তবে এ আর অস্বাভাবিক কোথায় যখন, বাড়ির মানুষ, কাছের মানুষরাই হতাশ হয়ে, থমকে দাঁড়িয়ে থাকে।
আমার এক আত্মীয়ের ছেলেটি এই ‘এএসডি’-র অন্তর্ভুক্ত। না বুঝে, ওর উপর ক্রমাগত মানসিক এবং শারীরিক অত্যাচার চালিয়ে গেছে বাবা-মা। বাকী আর পাঁচটা স্বাভাবিক বাচ্চাদের মতো ‘প্রোডাক্ট’ বানানোর বহু চেষ্টা চলেছে। ওর কপালে জুটেছে একের পর এক তকমা আর ঝড়-ঝাপটা।
বহু দিন আগেই সেই আত্মীয়কে জানিয়ে ছিলাম, সম্ভব মতো কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের নাম ঠিকানাও জোগাড় করে দিয়েছিলাম। কিন্তু…
বহুদিন পর ক’দিন আগে তার সাথে দেখা হবার পর ছেলের ব্যাপারে খোঁজখবর নিতে গিয়ে শুনি বলছে, কত কিছুই তো করলাম, অ্যালোপ্যাথি, হোমিওপ্যাথি, আয়ুর্বেদ, ইউনানী, তাবীজ-মাদুলী, কিছুতেই কিছু হল না। আমাদের ‘আর জম্মের ফল’ সম্ভবত।
তথাকথিত এক ‘রীতিমত শিক্ষিত’ পরিবারের যদি এই হাল হয়, তাহলে একজন ‘বাইরের মানুষের’ আর কি দোষ?
আর নতুন করে কিছু বলার সাহস করতে পারিনি সেই আত্মীয়কে।
জানি এই লেখা কোন অভিভাবকেই কোন দিশা দেখাতে অপারগ।
অথচ বহু প্রশ্ন আমার মাথাতেই জমে আছে। উত্তর খুঁজতে গিয়ে আরো কিছু প্রশ্ন বরং মাথায় জমা হল।
তাও, আসুন কতগুলো ‘মিথ’ ভেঙে আর করণীয় কাজ জেনে শেষ করি এই লেখা।
১. মিথ: এএসডি-র বাচ্চারা ‘বন্ধু’ চায় না।
সত্যি: এএসডি-র বাচ্চারা ক্রমাগত লড়াই করতে থাকে, তাদের সীমাবদ্ধ ‘কমিউনিকেশন স্কিল’ নিয়ে। তারা ‘চায়’ না, পারে না। তারা তাদের সীমিত ক্ষমতার কাছে হার মেনে যেতে বাধ্য হয়, আমাদের মতো করে, তাদের ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ করে উঠতে পারে না।
২. মিথ: এএসডি-দের কোন রকম ‘ভালো-খারাপ’ অনুভূতি নেই।
এরা কারো অনুভূতি বোঝে না।
সত্যি: ওদের অনুভূতি আছে। কিন্তু আপনার আমার মতো করে না করে, সেই অনুভূতির প্রকাশ এবং তার ‘মাত্রা’ অন্য রকম। সুতরাং, আমি আপনি না বুঝতে পারলেই তা ‘নেই’ হয়ে যায় না।
এদের মূল সমস্যাই হচ্ছে ‘ননভার্বাল কমিউনিকেশনে’র, বোঝাতে এবং বুঝতে। কেবলমাত্র মুখ দেখে অথবা চেহারা দেখেই আমরা অনেকেই মনের অবস্থার একটা আন্দাজ করার চেষ্টা করি, এই বিশেষ ক্ষমতার ক্ষেত্রে ওরা ভীষণ ভাবে পিছিয়ে। অথচ এই মনের ভাবটাই, দুঃখ বা আনন্দ, ভালো অথবা খারাপ, যদি প্রকট ভাবে প্রকাশ করা যায় বা মুখে বলা যায়, ওরা বোঝে, সংশয়াতিত ভাবে।
৩. মিথ: এএসডি মানেই ‘বোকা’।
সত্যি: না।
বাকী কথা একদম শেষের জন্যে তোলা থাক।
৪. মিথ: সমস্ত অটিস্টিক ‘এক রকম’।
সত্যি: এএসডি অর্থাৎ স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার, অর্থাৎ এই রোগের চরিত্র প্রতিটি রোগীর ক্ষেত্রেই আলাদা। আমি একজন অটিস্টিককে চিনে থাকলে, কেবলমাত্র একজন অটিস্টিককেই চিনি। বাকীদের না। প্রত্যেকের ক্ষমতা এবং সীমাবদ্ধতা আলাদা।
৫. মিথ: ‘বড়ো’ হলেই ‘ঠিক’ হয়ে যাবে।
সত্যি: এএসডি-র বীজ পোতা হয় মায়ের শরীরের মধ্যে, আমাদের মস্তিষ্কের তৈরীর কোন এক সময়। সুতরাং এই রোগকে আজন্মকাল বহন করে যেতে হয়। তবে অনেকেই তার দৈনন্দিন জীবনযাপনে সেই বাঁধা অতিক্রম করতে শিখে যায়।
৬. মিথ: অটিসম কেবল বাচ্চাদেরই হয়।
সত্যি: আর পাঁচজনের মতোই, অটিস্টিক বাচ্চাদের শৈশবকাল শেষ হয়, আসে কৈশোর, আসে তারুণ্য, যৌবন।
৭. মিথ: অটিসমের কারণ ‘ব্যাড প্যারেন্টিং’ ‘খারাপ অভিভাবক’
সত্যি:সর্বৈব মিথ্যা।
ব্যাস, আর কিছু না।
তাহলে কি খাড়াইলো? আমাদের চারপাশের চিরপরিচিত একমাত্রিক চরিত্র গুলোর বদলে, একটু অন্যরকম মাত্র। সে তো রোজ বাজারের থলি নিয়ে বাজার করতে যাওয়া, রোব্বারে ভাত মাংস খেয়ে দিবানিদ্রা দেওয়া, বৈঠকখানায় বসে সব্বজ্ঞানী বাঙালির পাশাপাশি, এভারেস্ট অথবা অ্যান্টার্টিকা অভিযানে চলে যাওয়া ‘পাগল’ মানুষও তো দেখতে পাই। তেমনই এরাও আছে।
অনেক শিশু জন্ম ও স্বভাবগতভাবেই একটু বেশি অস্থির, চঞ্চল, রাগী অথবা জেদি প্রকৃতির হতে পারে। তার মানেই যে শিশুটি অটিস্টিক তা নয়। সাধারণত ১২-১৪ মাস থেকে ৩-৫ বছর সময়ের মধ্যেই এই রোগের লক্ষণগুলো দেখা যায়। অটিজম থাকলে একটি শিশুর কিছু আচরণগত সমস্যা লক্ষ্য করা যায়। সে সামাজিকভাবে মেলামেশা করতে পারে না। শুধু কথা না বলা অটিজমের মধ্যে পড়ে না। তার সাথে তার অন্যান্য আচরণ, সামাজিকতা, অন্য একটি শিশুর সাথে মেলামেশা করতে পারে না অথচ অসম বয়সী মানুষের সঙ্গে হয়তো দিব্যি মানিয়ে নেবে।
তাহলে কাকে বা কখন ডাক্তার বাবুর পরামর্শ নিতে হবে?
১. ৬ মাস হবার পরেও ‘সোস্যাল স্মাইল’ দিচ্ছে না।
২. ৯ মাস হবার পরও, কথা বললে বা হাসলে, প্রত্যুত্তরে হাসছে বা শব্দ করছে না।
৩. ১২ মাস হবার পরও, নাম শুনে ‘সাড়া’ দিচ্ছে না। বা আধো আধো শব্দোচারন করছে না।
৪. ১৪ মাস হবার পরও, পছন্দের জিনিসটার দিকে আঙুল তুলে দেখাচ্ছে না।
৫. ১৬ মাস হবার পরেও কোন প্রকৃত শব্দ উচ্চারণ করছে না।
৩. ১৮ মাস হবার পরও, কাল্পনিক খেলা খেলছে না।
৪. চোখের দিকে চোখ তুলে তাকায় না, একা থাকতে পছন্দ করে।
৫. অন্যদের অনুভূতি যেন বুঝতে অক্ষম হচ্ছে।
৬. কথা বলছে না বা দেরী করে বলছে। আবার একই কথা বারবার বলছে (ইকোলেলিয়া)।
৭. ছোটখাটো পরিবর্তনও মেনে নিতে চায় না।
৮. যেটা পছন্দ করে, সর্বক্ষণ সেটা নিয়েই পরে থাকতে চায় (অবসেসিভ ইন্টারেস্ট)।
৯. অটিজমে আক্রান্ত অধিকাংশ শিশুই দেখা, শোনা, গন্ধ, স্বাদ অথবা স্পর্শের প্রতি অতি সংবেদনশীল অথবা প্রতিক্রিয়াহীন থাকতে পারে।
আমার লেখা গুলো এত্তোটা বড় হয় যে নিজেরই পড়তে ইচ্ছা করেনা। তাই ধৈর্য ধরে হয়তো কেউ পড়েই উঠতে পারবে না। অথচ উত্তর গুলো আমরা সবাই মিলে না খুঁজলে, সমাধানের রাস্তাটা বড়োই দূরুহ হযে উঠবে।
আজ আমার অসুবিধা হবে
কাল আপনার…
আজ যারা ছোট কাল তারাই বড়ো হয়ে উঠবে, অটিস্টিক বাচ্চাদের কৈশোর, যৌবন সবই আসবে সময়ের নিরিখে।
আজতো তাও সে পার পেয়ে যাবে ছোট বলে কাল? কি হবে?
পরিশেষে বলি,
ওনার অনুরোধটা আমার মাথায় থাকলেও, তা খাতায়-কলমে হয়ে উঠছিল না, একটা বড় কারণ, এএসডি সম্বন্ধে সহজভাষায় কিছু লিখে ওঠা, আমার পক্ষে খুব কঠিন হচ্ছিল। ভারী ভারী ডাক্তারী পরিভাষা এসো জড়ো হচ্ছিল আঙুলের ডগায়। বুঝতে পারছিলাম না এর থেকে পরিত্রাণের উপায়। বহু বার লিখে, কেটে, শেষ পর্যন্ত কিছু একটা খাড়া করতে পেরেছি।
কোন উপকার কারো হবে কিনা জানিনা, কিন্তু বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে একটা অদ্ভুত তথ্য ‘আবিস্কার’ করি, আর সেটার পর থেকেই এই লেখাটা নিজের কাছেই একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাই আজ লেখাটা শেষ করে একটা চরম পরিতৃপ্তি বোধ করছি।
রাষ্ট্রসঙ্ঘ দু হাজার আট সাল থেকে এপ্রিল মাসের দু তারিখকে ‘অটিসম সচেতনতা দিবস’ বলে এবং পুরো এপ্রিল মাস জুড়ে অটিসম সচেতনতা প্রসারের উদ্দেশ্যে ঘোষণা করেছেন। এপ্রিলের দু তারিখ আমার নিজের জন্মদিন, সম্ভবত তাই এই লেখাটা লিখতে পেরে, রোগ সম্পর্কে আরো বেশী করে জানতে পেরে, কিছুটা হলেও জানাতে পেরে, একজন মায়ের কাতর অনুরোধ রক্ষা করতে পেরে, ভীষণ একটা তৃপ্তি বোধ করছি। মনের বড্ড কাছের হয়ে থাকবে লেখাটা।
আমার সমস্ত লেখাই একটু দুঃখের হয়, সাধারণত। তাই…
লেখাটা যখন প্রায় শেষ করে এনেছি, আমার স্ত্রীকে পড়তে দিয়েছি। আর আমি মনে মনে চিন্তা করছি, আমার স্বভাবে কয়েকটা অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য আছে, আমিও নিজস্ব গন্ডীর বাইরে কথা বলতে, গল্প করতে পারি না, হাসি ঠাট্টা করতে পারি না, কাঠখোট্টা কেজো মানুষ হিসেবেই পরিচিত, নিজের ঘর-বই-খাতা, জামাকাপড় উল্টো পাল্টা থাকলে বেদম রেগে যাই। প্রায়শই প্রলয়কান্ড দেখা যায়। Jiniaকে প্রশ্নই করে বসলাম “আচ্ছা আমারো কি এএসডি আছে?”
তখন, হঠাৎ আমাদের “লাব-ডুপ” একসাথে বলে বসলো “অবশ্যই, কোন সন্দেহই নেই।”
যাব্বাবা মানুষের মুখের উপর এমন করে সত্যি কথা বলে নাকি!
এবার, একদম শেষের জন্যে তুলে রাখা একটা পর্দা সরিয়ে দেবার সময় হয়েছে। যে পর্দাটা সরালে হয়তো মা-বাবারা আর একটু ঠান্ডা মাথায় ওদের সামলাতে চেষ্টা করবে।
আমার এএসডি আছে কি নেই বড়ো কথা নয়, কিন্তু নীচের নামগুলোর দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিন-
হেনরী ক্যাভেন্ডিস,
হ্যান্স অ্যান্ডারসন,
চার্লস ডারউইন,
লুইস ক্যারল,
নিকোলা টেলসা,
অ্যালবার্ট আইনস্টাইন,
মাইকেল অ্যাঞ্জেলো,
মোৎসার্ট,
পল ডিরাক,
ববি ফিসার,
বিল গেটস,
স্টিভ জোবস,
সুসান বয়েল
আশা করি এনাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে না।
হ্যাঁ, ঠিকই অনুমান করছেন, এদের এএসডি আছে। এবং এরা এএসডি (অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার) নিয়েও খ্যাতির শিখরে পৌঁছেছেন। এমনকি আমাদের আশেপাশেই অনেকেই আছেন যারা এই রোগ, ডিসঅর্ডার নিয়েও দিব্যি স্বাভাবিক। সুতরাং…
একটু প্রাণ খুলে হাসুন।