স্বাস্থ্য ব্যবসার নতুন ক্ষেত্র কি সরকারি হাসপাতাল?
বিগত রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনের আগে, স্বাস্থ্যের ঠিকানা (!!) লেখা দুটো কার্ড নিয়ে বিরাট গোল বেধেছিল। গেরুয়া রঙের কার্ডের বিরুদ্ধে, বিস্তর অভিযোগ আমরা শুনেছিলাম রাজ্যের শাসকের মুখে। ওই কার্ডে চিকিৎসা পেতে বড় বড় এনএবিএইচ ছাপ কর্পোরেট হাসপাতালে যেতে হচ্ছে। প্রান্তিক, প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের পক্ষে কি সম্ভব, হার্নিয়া, হাইড্রোসিল, ফোঁড়া কাটার মত ছোট অপারেশন বা জ্বর,সর্দি,কাশির চিকিৎসার জন্যে লোটা কম্বল বেঁধে, খোরাকি দিয়ে সঙ্গে লোক নিয়ে,শহরের বড় হাসপাতালে চিকিৎসা করানো? কেনই বা যেতে হবে? গেলেও যে চিকিৎসা পাবে তার নিশ্চয়তা কোথায়? প্যাকেজে পোষাচ্ছে না, সরকার বিল মেটাচ্ছে না, এরকম নানা অজুহাতে, রুগী ফিরিয়ে দেওয়ার ভুরিভুরি অভিযোগ তাহলে আসছে কেন? সর্বজনীন স্বাস্থ্য মানে কি লোটা কম্বল বেঁধে শহরে যাওয়া? অভিযোগগুলোর সত্যতা নিয়ে খুব একটা সন্দেহ ছিল না।
প্রকাশিত সংবাদে জানা গেছে, এই ভয়ঙ্কর অতিমারিতে, সরকারি হিসেবে সাড়ে তিন কোটি ভারতবাসী সংক্রমিত হলেও, খুবই ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ মানুষ ওই কার্ডে কোভিড চিকিৎসা পেয়েছে। ১০ কোটি পরিবারের, ৫০ কোটি মানুষকে স্বাস্থ্য দেওয়ার ঘোষণা থাকলেও, গেরুয়া কার্ডের বাৎসরিক বরাদ্দে ৫০ কোটির ৫ শতাংশের চিকিৎসাও সম্ভব নয় বলে বিশেষজ্ঞদের মত। দেড় লাখ “হেলথ এন্ড ওয়েলনেস সেন্টার” গড়ে তোলার সরকারি বিবৃতি থাকলেও, যা বরাদ্দ হচ্ছে, তাতে সেন্টারগুলোর রঙ করা ছাড়া বেশি কিছু উন্নয়ন হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেও চলে। এই প্রকল্পের বাইরে থাকা ৮৯ কোটির ভারতবাসীর স্বাস্থ্যের জন্য ভাবনাও পরিষ্কার নয়।
অন্যদিকে, ২০১৬ সাল থেকে চালু থাকা নীল-সাদা কার্ডের প্রাপক পরিধি বাড়িয়ে, রাজ্যের সমস্ত মানুষ পাবে ঘোষণা করে, গত বিধানসভা নির্বাচনের আগে, মানুষের দুয়ারে পৌঁছাতে উদ্যোগী হয় রাজ্য সরকার। কার্ড সংগ্রহে মানুষের দীর্ঘ লাইন, হুড়োহুড়ি ছিল চোখে পড়ার মত। নির্বাচনে এই কার্ড শাসক দলকে ভালো ডিভিডেন্ট দিয়েছে বলেই মনে হয়। নির্বাচনী ফলাফলের নানা পর্যালোচনাতেও সেই রকম আভাসই পাওয়া গেছে।
নীল-সাদা কার্ড পেতে রাজ্যবাসীর উৎসাহ এবং জীবনপণ দৌড়, দিনের পর দিন ব্রেকিং নিউজ হলেও, ১০ কোটি মানুষ অর্থাৎ ২ কোটি পরিবারকে বছরে ৫ লক্ষ টাকা স্বাস্থ্যের জন্যে দিতে গেলে বাজেটে অর্থের সংস্থান আছে কিনা বা বিনামূল্যে চিকিৎসা, উন্নত চিকিৎসার ফ্ল্যাগ ফেস্টুনে ভরা রাজ্যে, কেন এত মানুষ লাইনে….এরকম বেয়াড়া প্রশ্ন সংবাদমাধ্যমে জায়গা পায়নি।
প্রতিদিনের চিকিৎসা, আউটডোর চিকিৎসা, পরীক্ষা নিরীক্ষার ব্যবস্থা নীল-সাদা কার্ডে রাখা আছে কিনা বহু মানুষ প্রশ্ন তুললেও, সরকার উত্তর না দিয়ে পাস কাটিয়ে গিয়েছে। শাসকের গুণমুগ্ধ সংবাদমাধ্যমও নীরব থাকাই শ্রেয় মনে করেছিল। অবশ্য প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে গেলে কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে আসার ভয় ছিল। সেই ভয় এখনো আছে। শুধু সংবাদ ব্যবসা নয়,আরও অনেকের অনেক ক্ষতির সম্ভাবনা ছিল সত্যিগুলো সামনে এলে।
কার্ড নিয়ে ঝগড়াঝাঁটির সময় আমাদের যে রাগ হয়নি এমন নয়। অনেকেই ভেবেছি দুটো কার্ডই যদি আমরা পাই তাহলে ক্ষতি কি? কিন্তু তথ্য অনুসন্ধান করে বোঝা গেল, বিষয়টা ঠিক সেরকম নয়। দুটো কার্ডের ব্যবসায়ী মালিক এক নয়। কোন কোন মালিক, কে, কোথায় ব্যবসা করবে, গোল সেটা নিয়েই। দেশব্যাপী উৎপাদন শিল্প, পরিষেবা মন্দার কবলে পড়লেও, স্বাস্থ্য ব্যবসার এখন পৌষ মাস। ডাবল ইঞ্জিন!! পাওয়ার সৌভাগ্য আমাদের হয়নি। গেরুয়া কার্ড আপাতত মাঠের বাইরে। সরকারের দাবি সমস্ত রাজ্যবাসীর কাছে পৌঁছে গেছে নীলসাদা কার্ড। কার্ড যুদ্ধে হেরে যাওয়া গেরুয়া কার্ডের নাম “আয়ুষ্মান ভারত”, আর অন্যটার নাম “স্বাস্থ্যসাথী”…
রাজ্যের সাম্প্রতিক আদেশনামা…উঠছে হাজারো প্রশ্ন…
স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্প ভালো জনপ্রিয়তা পেয়েছে এটা অনস্বীকার্য। কর্পোরেট হাসপাতাল সমেত মফস্বলের একাংশ নার্সিং হোমের চিরাচরিত রুগী হয়রানি এবং ঘুরপথে টাকা আদায়ের প্রচেষ্টা চালালেও, কিছু চিকিৎসা মানুষ পাচ্ছিল। শাসকের ভাষ্যে আমাদের ধারণা হয়েছিল, বিনামূল্যের সরকারি হাসপাতালের পাশাপাশি, প্রয়োজনে বেসরকারি হাসপাতাল বা নার্সিং হোম থেকে এই কার্ডের মাধ্যমে চিকিৎসা করিয়ে নেওয়া যাবে। কার্ডে চিকিৎসা না দিলে লাইসেন্স বাতিল করে দেওয়া হবে বলে শাসকের হুমকি সেই ধারণাকে শক্তিশালী করেছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক সরকারি আদেশনামায় মাথায় বজ্রাঘাত হওয়ার জোগাড় রাজ্যবাসীর। বিনামূল্যের সরকারি হাসপাতালে,এখন থেকে ভর্তি হতে স্বাস্থ্যসাথী কার্ড আবশ্যিক বলে সরকার জানিয়ে দিয়েছে। যাদের হেলথ স্কিম বা ইএসআই কার্ড আছে তারাও ভর্তি হতে পারবে। শুধু তাই নয়, কোনো কার্ড না থাকলে, তৎক্ষণাৎ বানিয়ে দেওয়ার নির্দেশও দেওয়া হয়েছে।
তার মানে এখন থেকে কোনো একটি কার্ড ছাড়া সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হওয়া যাবে না। সে আপনি মাটিতেই ভর্তি হন বা ট্রলিতে। এক বেডে দু তিন জনকে থাকতে হলেও লাগবে ওই কার্ড। যদিও বিশেষ সুবিধা, বিশেষ খাবার, বিশেষ যত্ন, নার্সদের বিশেষ নজর, বেড প্যান চাইলে সঙ্গে সঙ্গেই পেয়ে যাওয়া, মায় নতুন না হলেও কাচা বেড সিট বা ছারপোকা ছাড়া বেড পাওয়ার ব্যাপারে কোনো নিশ্চয়তা দেওয়া হয়নি ওই আদেশনামায়। অপারেশনের তারিখ আগে পাওয়া যাবে কিনা, পরীক্ষা নিরীক্ষাগুলো দিনের দিন হবে কিনা বা ট্রলি করে স্ক্যান বিভাগে যেতে হাসপাতালের কর্মচারী পাওয়া যাবে কিনা সুনিশ্চিত করা হয়নি নতুন নির্দেশে। নানা মহলে তাই প্ৰশ্ন উঠতে শুরু করেছে,কার্ডের টাকা খরচ করে তাহলে কি সুবিধা পাওয়া যাবে? যে চিকিৎসা এতদিন বিনামূল্যে পাওয়া যাচ্ছিল, সেটা পেতে গোটা পরিবারের জন্যে কার্ডে বরাদ্দ টাকা শেষ হয়ে যাবে না তো? প্যাকেজের টাকা শেষ হয়ে গেলে কি হবে? ব্রেন বা হার্ট স্ট্রোকের জরুরি চিকিৎসা পেতেও কি দেখা হবে কার্ড আছে কিনা? রাস্তায় দুর্ঘটনা ঘটলে কি হবে? আউটডোর টিকিট করতেই যেখানে ঘন্টা পেরিয়ে যায়, সেখানে স্বাস্থ্যসাথী কার্ড বানিয়ে ভর্তি হতে গেলে রুগীর প্রাণ থাকবে তো? অন্য রাজ্যের যে সমস্ত মেহনতি মানুষ আমাদের রাজ্যে নানা কাজে যুক্ত, পতাদের চিকিৎসা কোথায় হবে? সবচেয়ে বড় প্ৰশ্ন কার্ড না থাকলে সসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হওয়া যাবে না বোঝা গেল, কিন্তু যার কার্ড আছে তার ভর্তিও কি সুনিশ্চিত হবে? বেড নেই বলে ফিরিয়ে দেওয়া বন্ধ হবে? নাকি আগের মতোই এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে মুমূর্ষু রুগী নিয়ে অসহায় দৌড়ে চলতেই থাকবে। তাহলে কি সরকারী হাসপাতালেও স্বাস্থ্য বিক্রি চালু হলো?
বোধহয় ঠিক। কারণ ২০১৬ সালে চালু হওয়া নীল-সাদা কার্ডে অল্প স্বল্প স্বাস্থ্য বিক্রি চলছিল। খবরে প্রকাশ নীলরতন হাসপাতাল নাকি সবচেয়ে বেশি আয় করেছে এই সময়কালে স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্পে স্বাস্থ্য বিক্রি করে। অন্য মেডিক্যাল কলেজ বা হাসপাতাল গুলোও খুব পিছিয়ে ছিল না। এমনকি অন্ধত্ব নিবারণের কেন্দ্রীয় প্রকল্পে ছানি কাটাতেও ওই নীল-সাদা কার্ড চাওয়া হতো বলে অভিযোগ। কার্ড ছাড়া ভর্তির সুযোগ কেড়ে নিয়ে, সরকারি মেডিক্যাল কলেজ এবং হাসপাতালকে পুরোপুরি ব্যবসার কেন্দ্রে পরিণত করা হলো কিনা প্রশ্ন তাই উঠবেই। তবে প্রশ্ন যাই উঠুক, এখন থেকে মাদুলির মত কার্ডটা হয়তো আমাদের গলায় ঝুলিয়ে রাখতে হবে। গুরুজনেরা শিখিয়ে গিয়েছেন “বিপদ কখনো জানিয়ে আসেনা”। হটাৎ বিপদ আসতে পারে মাথায় রেখে, কিছু আগাম প্রস্তুতি রাখাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে….।
কোথায় দাঁড়িয়ে আমারা…কি চাইছে রাষ্ট্র বা রাজ্য…?
আমাদের দেশে স্বাস্থ্য এখনো যথেষ্ট নড়বড়ে অবস্থায় আছে। প্রায় ৪০ শতাংশ ভারতবাসী স্বাস্থ্য পরিকাঠামোতে পৌঁছাতে পারে না। সর্বজনীন স্বাস্থ্য দিতে অঙ্গীকারবদ্ধ দেশগুলির মধ্যে আমাদের স্থান শেষের দিকে। গোটা দেশ জুড়ে রয়েছে ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া, ডায়রিয়া, নিউমোনিয়ার ব্যাপক প্রকোপ। সবচেয়ে বেশি অপুষ্ট শিশুর বাস আমাদের দেশে। সবচেয়ে বেশি টিবি রুগীর বাস যে দেশে সেটাও আমাদের। অনেক স্বাস্থ্য সূচকে আমরা এমনকি প্রতিবেশী নেপাল, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশের থেকেও পিছিয়ে। পাশাপাশি দেশগুলোর মধ্যে স্বাস্থ্য ব্যয় সবচেয়ে কম আমাদের । জিডিপির মাত্র ১শতাংশ। স্বাস্থ্যই যে আমাদের সবচেয়ে বড় বিপদ সেটা হাড়ে হাড়ে বুঝিয়ে যাচ্ছে শতাব্দীর ভয়ঙ্করতম অতিমারি। এমনিতেই স্বাস্থ্যের জন্যে মানুষ নিজের পকেট থেকেই ৭০ শতাংশ খরচ করে এবং শুধু স্বাস্থ্য খরচ সামলাতে, প্রতিদিন হাজার হাজার ভারতবাসীকে দারিদ্র সীমার নীচে চলে যেতে হয়। কোভিডের পাল্লায় পড়ে কত লক্ষ মানুষ যে নিঃস্ব হয়ে গেল তার হিসাব করা মুশকিল। রাষ্ট্র সেই হিসেব রাখতে উৎসাহী বলেও মনে হয় না।
আইবিইএফ সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী ভারতের স্বাস্থ্য বাজার ২০২২ সালে গিয়ে দাঁড়াতে পারে ৩৭২ বিলিয়ন ইউএস ডলারে। এই বাজারে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে কর্পোরেট হাসপাতাল, ফার্মাসিউটিক্যালস, বেসরকারি মেডিকেল কলেজ এবং কর্পোরেট স্বাস্থ্য বীমা। আসলে নয়ের দশক থেকে, নয়া উদারবাদের যুগে একটু একটু করে স্বাস্থ্যকে ব্যবসায়ীদের হাতে তুলে দেওয়া চলছিল। এখন বাজারই স্বাস্থ্যের নিয়ন্ত্রক। আমার আপনার স্বাস্থ্য এখন ইনসিওরেন্স নামে ফড়েদের হাতে। কেন্দ্র বা রাজ্য এখন ঝাড়া হাত পা। আপনি সরকারকে স্বাস্থ্য নিয়ে প্রশ্ন করতেই পারবেন না। মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে ওই বীমা। সারা পৃথিবী যখন দৌড়োচ্ছে সর্বজনীন স্বাস্থ্যের লক্ষ্যে তখন স্বাস্থ্যের সংজ্ঞাই বদলে দিচ্ছে আমাদের সরকারগুলো।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দেওয়া স্বাস্থ্যের সংজ্ঞা “পূর্ণ শারীরিক, সামাজিক এবং মানসিক” সুস্থতা। “সর্বজনীন স্বাস্থ্য” গোটা বিশ্বের বর্তমান স্লোগান। দেশে দেশে নানা কর্মযজ্ঞ চলছে। এই লক্ষ্যে পৌঁছাতে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার কথা প্রাথমিক স্বাস্থ্যে, প্রতিষেধক মূলক স্বাস্থ্যে। দরকার সবার জন্যে পরিশ্রুত জল, দূষণহীন পরিবেশ, মা-শিশুর পুষ্টি, জন্মের পরের পরিচর্যা, টিকাকরণ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশ প্রাথমিক স্বাস্থ্যে নূন্যতম ৭০ শতাংশ রাষ্ট্রীয় ব্যয়, বিনামূল্যে জীবনদায়ী ওষুধ, পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা।
বিজ্ঞানের প্রভূত উন্নতি আমাদের গড় আয়ু বাড়িয়ে দিয়েছে। দেশের এক বিপুল জনসংখ্যার উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হার্টের অসুখ, ফুসফুসের অসুখ, ক্যান্সারও তাই স্বাস্থ্যের অগ্রাধিকার। দেশের চালু থাকা প্রাইভেট বীমার পরিসরে এসব কোনো কিছুই নেই। প্রতিদিনকার চিকিৎসা পেতে জনগণকে যেখানে নিজের পকেট থেকেই খরচ করতে হয়, সেখানে যেটুকু সরকারী বরাদ্দ আছে, সেটাও বীমা নামে ফড়ে বা বাজারের হাতে তুলে দিলে প্রশ্ন তো উঠবেই।
এই ব্যাপারে রাষ্ট্র বা রাজ্য কেউ কম যায় না। বীমা কোম্পানীগুলো কি দানছত্র খুলে বসে আছে? নিশ্চয়ই না, তারা ব্যবসা করতেই এসেছে। লাভ ছাড়া তারা ব্যবসা করবে কেন? একটা উদাহরণ দিলেই বীমা ব্যবসায় লাভ সম্বন্ধে আন্দাজ করা যায়। মহারাষ্ট্রে একটা বীমা কোম্পানী, একটা জেলায়, একটা ফসলে, প্রিমিয়াম পেয়েছিল ১৭৩ কোটি টাকা। কেন্দ্র ৭৭…রাজ্য ৭৭.. আর কৃষকরা নিজে দিয়েছিল ১৯ কোটি টাকা। খরাতে ফসল নষ্ট হওয়ায় ওই বীমা কোম্পানী মোট ক্ষতিপূরণ দিয়েছিল ৩০ কোটি। যদি একটা ফসলেই বীমা কোম্পানীর এত লাভ হয় তাহলে গোটা দেশ, সব জেলা, সব ফসলের কথা ভাবলে লাভের অংকটা মাথা ঘুরিয়ে দেবেই।”স্বাস্থ্যসাথী” বা “আয়ুষ্মান ভারত ” যাই হোক না কেন, বীমা কোম্পানীর টাকার উৎস সরকারি কোষাগার-মানে জনগণের টাকা। যে টাকা সরকার নিজেই খরচ করে আরও অনেক উন্নত স্বাস্থ্য পরিকাঠামো গড়ে তুলতে পারতো। আমাদের রাজ্যের জেলাগুলিতে, ব্যাকওয়ার্ড রিজিয়ন গ্রান্টের টাকায়, কিছু দর্শনীয় বাড়ি তৈরি হয়েছে ঠিকই, কিন্তু পরিষেবা আটকে আছে সেই তিমিরেই। “নিশ্চিত” স্বাস্থ্যর সঙ্গে “বিমার” স্বাস্থ্য গুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সর্বজনীন বীমাকে সর্বজনীন স্বাস্থ্য বলে চালানো হচ্ছে। স্বাস্থ্যের অধিকার কেড়ে নিয়ে অনুদানে রূপান্তরিত করা হচ্ছে। নানা দেশে চালু থাকা কোনো প্রাইভেট বীমাই জনগণের “আউট অফ পকেট এক্সপেন্ডিচার” কমায় না। তাই বহু দেশ বীমার রাস্তা থেকে সরে আসছে। আর আমরা সেই পথেই আরও বেশি করে হাঁটতে চাইছি।
আয়ুষ্মান ভারত এবং স্বাস্থ্যসাথীর সঙ্গেও যুক্ত আছে প্রাইভেট বীমা, কর্পোরেট বীমা কোম্পানী। স্বাস্থ্য সরকারকে বিনামূল্যেই দিতে হবে। এটা জনগণের অধিকারের মধ্যেই পড়ে। মধ্যবর্তী সময়ে, অতি ব্যয়বহুল, উন্নত চিকিৎসা বা আপতকালীন চিকিৎসা সরকার কিনতে পারে বেসরকারি ক্ষেত্র থেকে, কিন্তু সেটা কোনোভাবেই প্রাইভেট বীমার মাধ্যমে নয়। কেন বীমা কোম্পানিকে সরকারী কোষাগার তুলে দিয়ে কোটি কোটি টাকা লাভ করতে দেওয়া হবে, যাদের দায়, দায়বদ্ধতা কোনোটাই নেই।
সব চিকিৎসার যেমন প্যাকেজ হয় না, তেমনই আউটডোর চিকিৎসা পুরোপুরি বীমার বাইরে এবং শুধু আউটডোরের চিকিৎসার জন্যেই জনগণকে সবচেয়ে বেশি নিজের পকেটের টাকা খরচ করতে হয়। বীমার চিকিৎসার আরেক বিপদ, চিকিৎসার মাঝপথে বীমার টাকা শেষ হয়ে গেলে জনগণ কার কাছে যাবেন? অতিরিক্ত টাকা কোথা থেকে পাবেন? আমাদের প্রতিদিনের অভিজ্ঞতা, যাদের মেডিক্লেম বা প্রাইভেট স্বাস্থ্য বীমা আছে তারাও বেশিরভাগ সময় সম্পূর্ণ চিকিৎসা বেসরকারী হাসপাতালে বিনামূল্যে করাতে পারে না। অতিরিক্ত খরচের দায় বীমা কোম্পানী নেয় না। যারা পারে তারা পকেট থেকে দেয়। যারা পারে না তাদের ঘটিবাটি বিক্রি করা বা চিকিৎসার মাঝপথে রুগীকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসাই দস্তুর। তাহলে প্রাইভেট বীমা কোম্পানীকে লাভের গুড় খাওয়ানোর দরকার কি?
আরও আশ্চর্য লাগে আমাদের রাজ্য সরকারের ভূমিকা দেখে। অদ্ভুত দ্বিচারিতা। সরকারী কোষাগার বীমা কোম্পানীর হাতে তুলে দিয়ে, বিনা মূল্যের সরকারী হাসপাতালে জ্বর, জ্বালা, সর্দি কাশি বা হার্নিয়া, হাইড্রোসিলের চিকিৎসা বীমার মাধ্যমে কিনিয়ে, বিনামূল্যে স্বাস্থ্য দিচ্ছি বলে হই হল্লা শুনে। একদিকে বীমা কোম্পানীকে বিপুল লাভের ব্যবস্থা করে দেওয়া, অন্যদিকে ফ্রি চিকিৎসার সরকারী হাসপাতালে প্রান্তিক মানুষকে বীমার চিকিৎসা নিতে বাধ্য করা। ওই মানুষটার বড় বিপদে সরকার পাশে থাকবে তো? প্রশ্ন তাই উঠবেই সরকার ঠিক কার স্বাস্থ্য চাইছে বীমার না জনগণের?
প্রবন্ধটি দৈনিক গণশক্তি পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত।