আমি এই অফিসে বছর খানেক হল বদলি হয়ে এসেছি। আসার পরই বড়বাবু রবিন সিংহ অনেক কাজের সঙ্গে আমাকে যে কাজটা ধরিয়েছেন, তা হল বিশ্বপতি সাহার পেনশন কেসটা।
অফিস থেকে রিটায়ারমেন্টের ছ’ মাস আগেই কাগজপত্র এজিতে পাঠিয়েছি। সেই কাগজ ফেরত এলে বিশ্বপতিবাবু পেনশনটা পাবেন এমনই আশা ছিল। কিন্তু সরকারি অফিসের যা দস্তুর, পেনশন চোখে দেখার আগেই তিনি মারা গেলেন রিটায়ারমেন্টের দু’ মাসের মাথায়। মারাত্মক অসুখ হয়েছিল।
এবার তার ফ্যামিলি পেনশনের বোঝাটা সামলাতে হবে আমাকে।
ভদ্রলোকের স্ত্রী সেই সকাল বেলায় এসে অবধি শুকনো মুখে বসে আছে। সে অত এজি, ট্রেজারি, এত সব বোঝে না। তার ধারণা আমিই চেষ্টা চরিত্র করে পেনশনের ফাইনাল কাগজটা আনিয়ে দিতে পারি।
বিশ্বপতি ষাট বছর বয়সের পর মারা গেছেন। অসময়ে গেছেন বলা যাবে না। এই বিধবাটি বিশ্বপতির দ্বিতীয় স্ত্রী।
এই মেয়েকে আপনি আজ্ঞে করতে পারলেই ভালো হত। কিন্তু বিশ্বপতির একমাত্র ছেলে অমিয়র চাইতেও বয়সে কিছু ছোটো এই মেয়ে। এর সঙ্গে নাকি অমিয় মানে বাবুয়ার প্রেম ছিল। বাবুয়া আমাকে কাকু বলে ডাকে।
মেয়েটা এই অফিসেও এসেছে দু’চারবার বিশ্বপতিবাবুর সঙ্গে ওর বিয়ের আগে। তখন থেকেই আলাপ ওর সঙ্গে।
আমি যখন বদলি হয়ে এলাম, তার বেশ কিছুদিন পর বিশ্বপতিবাবুর কাণ্ড নিয়ে অফিস সরগরম। কী ব্যাপার। না মুনিনাঞ্চ মতিভ্রম।
অথচ, বিশ্বপতি তার এই মা মরা ছেলেকে একলাই মানুষ করেছেন ছোটো থেকে। ছেলেকে উনি চোখে হারাতেন। বাবুয়াও বাবাকে ভালোবাসত খুব। তার প্রেমিকা, মানে কী বলে, একরকম বাকদত্তাই ছিল এই মেয়েটা।
তো মেয়েটা সেই পুরোনো অভ্যেসেই এখনও অন্যদেরকে তো বটেই, আমাকেও বিপুলকাকু ডাকে। না, প্রয়াত সহকর্মীর বিধবা বউ হলেও একে আপনি আজ্ঞে করা আমার পক্ষে সম্ভব না।
যাবার আগে বলে গেল আবারও, – কাকু, ওই পিপিও না কী বললেন এসে যাবে ঠিক, তাই না?
★
– কী বিপুল বাবু, আপনিও কাকু? বেশ বেশ! আপনার কিন্তু বৌদি বলে ডাকা উচিত ওকে। হাজার হোক সিনিয়র কলিগের ইস্তিরি। রসসিক্ত হাসি হেসে বলল পাশের টেবিলের বৃন্দাবন বসু।
এই ধরণের নিষ্ঠুর রসিকতা আমার অসহ্য লাগে।
– আপনাকেও তো কাকু বলেই ডাকছিল মেয়েটা।
কড়া গলায় বললাম।
– তা ডাকবে না তো কী! কত বছর ধরে চেনা।
এই অফিসে গত কয়েকমাস ধরে এই একই গল্প আর আলোচনা।
– আরে বাবুয়াই টিউশনি পড়াত তো মেয়েটাকে একসময়। তার থেকে প্রেম। বিশ্বপতিও মেয়েটাকে ইয়ে করত খুব। প্রথমে বিশ্বপতিকে মেসোটেসো ডাকত বোধ হয়। বাবুয়ার সঙ্গে প্রেমটা পাকার পর ডাকত বাপি বলে। পরেও নাকি…
– পরেও কী বেন্দা দা’? সবটা খুলে বলুন বিপুলকে…
বেচারি নতুন এয়েচে! বলে হ্যা হ্যা করে হাসত ডেসপ্যাচের শ্যামলীদি’। শ্যামলীদি’র কথা বার্তায় রাখঢাক কম।
বেন্দা দা’ বলল, – পরে আবার কী। শালা, ভাবলেও ঘেন্না করে। যা হবার হল। সেই মেয়ের প্রেমে পড়ল বিশ্বদা’। বিশ্বপতি তো না, যেন বিশ্বপ্রেমিক। ওর ছেলে নার্সিংহোমে ভর্তি হল। পেগলে গেল তো।
হ্যাঁ, শুনিচি ওই বিয়ের পরও নাকি বিশ্বপতিকে মেয়েটা বাপি বলেই ডাকত। কী করা! পুরোনো অব্যেস…
গল্পের এই জায়গাটায় এসে গলার স্বর রহস্যঘন ফিসফিসে করে তুলত কেচ্ছাবাজ বৃন্দাবন বসু। যেন অন্য কাউকে শোনানো বারণ। আসলে তো শোনানোর জন্যই বলা। – বাপের এই সব প্রেম পিরীতির কাণ্ড দেখেই বাবুয়াটার মাথায় গণ্ডগোল হল বোধহয়। তারপর তো ঘরেই রাখা গেল না। ভায়োলেন্ট… ঘরের ভেতর ভাঙচুর! ওই পাগলদের নার্সিং হোম আছে না, ভিআইপিতে হলদিরামের কাছে, সেখানেই, হি হি হি…
– ও বাবা, সেকেনে তো খচ্চা অনেক, হ্যাঁ বেন্দাদা’?
শ্যামলী দি’ ফোড়ন কাটত।
– খচ্চা বলো, আর গচ্চাই বলো বিশ্বপতি কিন্তু পেছপা হয়নি। মাসে মাসে কাঁড়ি টাকা দিয়ে চিকিচ্ছে করিয়েছে। আসলে, ওর নিজের দোষেই তো ছেলেটার মাথাটা বিগড়োলো!
এর পরের ইতিহাস আমি জানি। প্রভিডেন্ট ফাণ্ডের টাকা তুলে আর মাইনের টাকায় সিজোফ্রেনিক ছেলের সেই খরচা চালানোর জেরবার দিনগুলোয় বিশ্বদা’কে কেমন অসহায় লাগত। নতুন আসা আমাকে যেন একটু বেশি বিশ্বাস করতেন।
বিদিশাকে বিয়ে করতে চলেছেন, এ’টা অবশ্য আমি আগে জানতে পারিনি।
তারপর বিদিশার সঙ্গে রেজিস্ট্রি বিয়ে হল। সেটাও বেশ তড়িঘড়ি করেই হল। শোনা গেল বিদিশার বাড়ির ঘোর অমতেই নাকি।
সাক্ষী পাওয়া যায় না। শেষে বিশ্বদা’র চাপাচাপিতে আমি আর রবিন বাবু। দুটো করে রসগোল্লা খাওয়ালেন সই করার পর।
কেমন যেন পরাবাস্তব লাগছিল এই বিয়ের পুরো ঘটনাটা। বিদিশার বাড়িরও কেউ হাজির নেই। ম্রিয়মান বিশ্বদা’ বিয়ের পাত্র। একটা ফুলের মালা অবধিও নেই। মেয়েটা কি পাগল?
অফিসে বেন্দাদা’ বলল, – বাবুয়াটাকে দিয়ে বাপের বিয়ের সাক্ষী দেওয়াতে পারলে জমে যেত মাইরি! কেমন বন্ধু আপনারা মশাই? শেষের প্রশ্নটা আমার দিকে ফিরে।
– অ বেন্দাদা’, ছেলে হয়ে বাপের বে নাকি দেকতে নেই?
শ্যামলী এক চোখ ছোট করে ফুট কেটে, হেসে গড়িয়ে পড়ল।
বিয়ে করলেন বটে, কিন্তু ওই যে বললাম, পরাবাস্তব গল্পের মত। বিশ্বপতির নিজের শরীরও খুব ভালো যাচ্ছিল না এরপর থেকে।
শেষের দিকে অফিসেই আসতেন না। এন্তার মেডিকেল লিভ পাওনা। যদিও বা আসতেন, আমার কাছেই। ওই পেনশনের আর ফ্যামিলি পেনশনের নিয়ম কানুন নিয়ে কথা বলতেন।
আমাকে বলতেন, – বিপুল, আপনাকে ভাই লজ্জায় বলতে পারছি না। অদ্য ভক্ষ্য ধনুর্গুণ অবস্থা। ছেলের কথা তো জানেন। বউ ছেলে নিয়ে না খেয়ে মরতে হবে পেনশনটা ঠিকঠাক না হলে।
বউ কথাটা বলার সময় গলাটা একটু কেঁপে যেত কি? কোনও অন্যায় মেশা গ্লানিতে?
খালি মেডিকেল লিভ নিচ্ছিলেন। কাগজপত্র দেখে বুঝলাম, কী নাকি ক্যান্সার ধরা পড়েছে। সারা শরীর হলুদ। অস্থিচর্মসার।
মানছি, ঠিকই, ওঁকে দেখবার লোক দরকার ছিল। তাই বলে নিজের ছেলের প্রেমিকা এক কন্যাসমাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে? সুভদ্র বিশ্বপতির সঙ্গে গল্পটা মিলত না।
এ’দিকে ছেলে তো নার্সিং হোমে। বিদিশা মানে বিন্তিই বিশ্বদাকে নিয়ে দৌড়োদৌড়ি করেছিল শেষ সময়ে। মানে, যে’টুকু করার। কেউ কেউ বলেছিল, টাটা মেডিকেল। বিশ্বপতির জেদেই সরকারি হাসপাতালে। নইলে নাকি খরচায় কুলোবে না। বাবুয়ার খরচা সামলে টাকাপয়সা ত তলানিতে। এখন চলছে বাবুয়ার মায়ের রেখে যাওয়া গয়না বেচে।
বিশ্বপতির মৃত্যুর সময়েও বাবুয়া হাসপাতালে। একদিনের ছুটি করিয়ে মুখাগ্নির জন্য নিয়ে এসেছিল বিন্তি, তার নতুন মা।
অফিসে খোঁজ নিতে বিধবা মেয়েটা আমার কাছেই আসে। বাড়িতে আমার গিন্নিকে ওর কথা বলতে সেও বলেছে, – আহা, পাশে দাঁড়াবার কেউ নেই। না বাপের বাড়ি, না শ্বশুর বাড়ি। তোমরা অফিসের লোকেরাই ওকে একটু দেখো। কী করতে যে মেয়েটা ওই ভীমরতিতে পাওয়া বুড়োকে বিয়ে করতে গেল!
★
– অমিয় সাহার বাড়ির লোক কে আছেন? নার্সিং হোমে রিসেপশন থেকে ডাকতে আমি আর বিন্তি গিয়ে দাঁড়ালাম। একদিনের সিএল নিয়েছি বিদিশার সঙ্গে আসার আর কেউ নেই বলে।
আজ নার্সিং হোম থেকে বাবুয়ার ছুটি। ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলেছি আমরা। নিয়মিত বেশ দামী ওষুধ খেয়ে যেতে হবে। সারা জীবন। ডাক্তার বলেছেন, কোনওমতেই যেন ওষুধ বন্ধ না হয়। রোগ বেড়ে যাবে তাহলে।
ইতিমধ্যে ফ্যামিলি পেনশনের ব্যাপারটা সেটলড হয়ে গেছে। বিধবা স্ত্রী যেটা পায়।
★
ওদের বাড়ি গেছিলাম, আমি আর আমার গিন্নি। আসলে আমাদের নিজেদের মধ্যেই একটা অশ্লীল কৌতূহল ছিল, কেমন রয়েছে এক ছাদের নীচে এই দুই প্রাক্তন প্রেমিক প্রেমিকা?
গিয়ে দেখি বিন্তি নেই। বাবুয়ার ওষুধ কিনতে বেরিয়েছে। পাড়ার দোকানে এ’সব ওষুধ নাকি পাওয়া যায় না। ফিরবে কিছু পরে।
বাবুয়াকে জিজ্ঞেস করলাম, – কেমন আছ?
বলল, ভালোই আছে এখন।
কিছুক্ষণ বিশ্বপতিদা’ আর তাঁর অসুখের ব্যাপারে কথা হল। কী আর বলব। অন্য ব্যক্তিগত ব্যাপারে তো কথা বলা যায় না।
বাবুয়া তারপর হঠাৎ নিজেই বলল, – বিপুলকাকু, জীবনটা কী অদ্ভুত না? আপনাকে একটা জিনিস পড়াব, পড়বেন? আমার বাপির লেখা কটা পাতা। আমি তখন নার্সিং হোমে ভর্তি। বিন্তিকে বিয়ের আগে লিখেছিল।
এনে যেটা পড়তে দিল, সেটা ঠিক ডাইরি না। বিন্তিকে লেখা একটা চিঠি।
বিন্তি মা,
তোকে ছাড়া কাকেই বা জানাই। বাবুয়া তো ভর্তি। সেই যে তুই আমাকে নিয়ে গেলি ডাক্তারের কাছে। ইউএসজি সিটি স্ক্যান। তুই ও তো জানলি পরদিন ডাক্তারের মুখ থেকে, রিপোর্ট দেখাতে গেলাম যখন। বলল, আমার লিভারে ক্যান্সার ধরা পড়েছে। ডাক্তার তোকে আলাদা করে বলেছে খুব খারাপ প্রোগনোসিস আমার অসুখের। দিন আমার গোণা।
বাবুয়ার যা অবস্থা, ও সুস্থ হয়ে নিজে রোজগার করবে ভাবাটা বাতুলতা। অথচ ওর জন্য খরচের বোঝা তো তুই জানিস।
তুই বলেছিস, সে মানসিক ভাবে অসুস্থ জেনেও তুই
বাবুয়ার সঙ্গেই সারা জীবন থাকবি। এটাই নাকি তোর সিদ্ধান্ত।
তোদের খরচ কী ভাবে চলবে মা?
সেদিন তোর সাথে এই সব কথাই বলছিলাম। তুই আঁতকে ওঠার মত একটা প্রস্তাব দিয়েছিলি।
উকিল বন্ধুর কাছে জানতে চেয়েছিলাম, যদি তুই যা বলেছিস সে’রকম কিছু ঘটেও, এই ছেলেমেয়ে দুটোর বিয়ে কি মেয়েটা বিধবা হয়ে যাবার পর আইনত সম্ভব? মানে বিধবাবিবাহ তো হরবখত হচ্ছে আজকাল। সে গম্ভীর ভাবে বলেছিল, বাবার স্ত্রীকে বিয়ে নাকি নিষিদ্ধ সম্পর্কের মধ্যে পরে।
তা ছাড়াও আবার বিয়ে করলে ফ্যামিলি পেনশন বন্ধ হয়ে যাবে। আমিও অফিসে খোঁজ নিয়ে জেনেছি।
আমি জানি সরকারের সঙ্গে প্রতারণা হবে, আর তার চেয়েও বড় প্রতারণা হবে তোর সঙ্গে। সারাটা জীবন পড়ে আছে তোর।
অন্যায় করছি জেনেও পাগলি, তোর সেই একান্ত অসঙ্গত প্রস্তাব, সেদিন যা বলেছিলি, আর আমি হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলাম, মেনে নিচ্ছি। বাবুয়ার মুখ চেয়ে। তোর আদেশে। তুই যা বলেছিস, তাইই হোক তবে।
ইতি,
তোর আর বাবুয়ার বাপি।
বোধহয় মুখে সব কথা বলতে পারেননি লজ্জায়। তাই সে কথা চিঠিতেই লিখেছিলেন বিশ্বপতি।
★
ম্লান হাসল বাবুয়া। জানেন কাকু, শেষ দিন অবধি ও বাপিই ডাকত আমার বাপিকে। আমাকে বাঁচাতে গিয়ে বাপি… আঃ লোকে কত ভুল বুঝল বাপিকে। আর বিন্তিকেও।
ওই কাগুজে বিয়েটার পরও যে শেষদিন অবধি বিন্তি বাপির মেয়েই ছিল। আমি জানি।
অসাধারন।