বাড়িতে ঢুকতেই ছোটোমেয়ে রিম্পা খুব কলরব করে জানালো, — ইসস্, বাবা এট্টু আগে এলে না গো! পোস্টাফিসের থেকে একটা লোক এসেছিলো। কী একটা বেয়ারিং চিঠি না কী যেন এসেছে তোমার নামে। বলল, পয়সা দিয়ে নিতে হবে। তো আমি ক’টাকা লাগবে জিজ্ঞেস করতে বলল অফিসে ফিরে কী সব না কি হিসেব করে জেনে বলতে হবে। ও নাকি জেনে আসেনি। তাই এই চিঠি আজ দেওয়া যাবে না। তোমাকে পোস্টাফিসেই যেতে হবে।
ভুরু কুঁচকালো কমলেশ। রিম্পার কথাবার্তা কেমন যেন অসংস্কৃত হয়ে উঠছে দিনেদিনে। কমলেশরা ছোটোবেলায় পোস্টাফিস থেকে এমন কেউ এলে বলত পিয়নকাকু নইলে পিয়নদাদা।
আহা, সে সব আত্মীয় সম্বোধনে না ডাকুক, পোস্টঅফিসের এক ভদ্রলোক তো বলতে পারে। ভদ্রতা ব্যাপারটাই কেমন যেন উঠে যাচ্ছে সমাজ থেকে।
বহুদিন বাড়িতে কোনও বেয়ারিং চিঠি আসেনি। চিঠি ব্যাপারটাই তো ক্রমশ উধাও হয়ে যাচ্ছে জীবন থেকে।
আজকালকার ছেলেমেয়েরা বেয়ারিং চিঠি পাওয়া দূরের কথা, তার নামই শোনেনি অনেকে। সে তারা অনেক কিছুই শোনেনি। হাল আমলের রিম্পার মত টিন এজাররা অনেকেই তো ডাকপিয়ন, ডাক বাক্স, রানার, চিঠি, খাম বা ইনভেলাপ, পোস্ট কার্ড, অর্ডিনারি চিঠি, বেয়ারিং চিঠি, সার্টিফিকেট অব পোস্টিং, এই সব শব্দের সাথে মোটেই পরিচিত না। রেজিষ্টার্ড চিঠি, রেজিষ্টার্ড উইথ এডি, স্পিড পোস্ট বরং কিছুটা চেনে।
কিন্তু কমলেশের ছেলেবেলায় এই বেয়ারিং চিঠি খুবই পরিচিত একটি বস্তু ছিল।
ব্যাপার আর কিছুই না। খামের গায়ে ঠিকঠাক ডাকমাশুলের টিকিট না লাগানো থাকলে, প্রাপককে ডবল পয়সা দিয়ে সেই চিঠি ছাড়াতে হত। অনেক সময় চিঠি পাওয়া সুনিশ্চিত করতে এই পন্থা নিত কেউ কেউ। তা নইলে সাধারণ ভাবে বেয়ারিং চিঠি আসা তেমন ভালো কিছু ব্যাপার ছিল না। বলতে গেলে এক রকমের অমঙ্গলের দ্যোতক ছিল।
প্রায় কাছাকাছি আর একটি ব্যাপার ছিল পোস্টাফিসের। টেলিগ্রাম।
হয় খুব ভালো কোনও খবর আসত টেলিগ্রামে। নইলে খুব খারাপ কোনও খবর। এই টেলিগ্রাম আবার মিথ্যে খবর দেবারও বাহন ছিল। হোস্টেলে থাকা লক্কা পায়রা শহরে গরিব বাড়ির মেয়ের প্রেমে পড়েছে। ছেলেকে বাড়িতে টেনে এনে যথাবিহিত পণ ইত্যাদির বিনিময়ে বিয়ে দিতে হবে?
মিথ্যে টেলিগ্রাম যেত, ‘মাদার সিরিয়াসলি ইল। কাম শার্প’।
অতি বাধ্য ছেলে বাড়ি ফিরে ফোঁসফোঁস দীর্ঘশ্বাস টানতে টানতে বিয়ের পিঁড়িতে বসত। মাস দুয়েক বাদে শহরে ফিরে খবর পেত অথবা পেত না, গরিব বাড়ির মেয়েটি গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলেছে, নইলে বিষ খেয়েছে।
খবরের কাগজে এককোণে হয় তো ছাপা হত অথবা হত না, “সংবাদে প্রকাশ, ময়নাতদন্তে জানা যায় মৃত্যুকালে এই হতভাগিনী তিন মাসের গর্ভাবস্থায় ছিল।”
টেলিগ্রামে তবু কখনও ভালো খবর থাকত। বেয়ারিং চিঠিতে প্রায় কখনওই কোনও ভালো খবর থাকত না।
বেয়ারিং চিঠির অর্থ প্রায় সব সময়েই ছিল, প্রেরক এতটাই দরিদ্র যে সে যথাযথ পোস্টেজ লাগাতে পারেনি। কাজেই সেই চিঠিতে অব্যর্থ ভাবেই থাকবে অর্থ প্রার্থনা।
আর একরকমের বেয়ারিং চিঠি থাকত বদমায়েশির।
উঠতি বয়সের যুবতী মেয়ের বাবাকে বেয়ারিং চিঠিতে জানানো হত, “আপনার কন্যা অমুকের সঙ্গে লটরপটর করে পেট বাধিয়েছে।”
আবার অন্য ধরণের কোনও বেয়ারিং চিঠিতে থাকত ভিন্নতর মজার জিনিস। “এই মন্দিরে সেই দেবতার গলা পেঁচিয়ে রয়েছে পাঁচ ফণাওয়ালা সাপ। সেই সাপের কিম্বা দেবতারই দয়ায় এ এত সে তত সৌভাগ্যের মুখোমুখি হয়েছে। এই পত্রকে অগ্রাহ্য করেছিল অমুক চন্দ্র তমুক। সর্প দেবতার ক্রোধে তার বড় পুত্রটি একসপ্তাহের মধ্যে মারা গেছে। আর যে এই পত্রকে সমাদর করে দশ কিম্বা একশকপি ছাপিয়ে বিভিন্নজনকে বিলি করেছে হাতে হাতে বা চিঠিতে, তার মহা মহা সিদ্ধিলাভ ঘটেছে।”
নিজেরাই কায়ক্লেশে দিন চালাতেন মধ্যবিত্ত ভদ্রজনেরা। এইসমস্ত নানান অর্থহীন ঝামেলার কারণেই তাঁরা অনেক সময় বেয়ারিং চিঠি ছাড়াতেন না।
বেয়ারিং চিঠির কথায় কমলেশের চিনিকাকুর কথা মনে পড়ে গেল। ভাগ্য বিড়ম্বিত সবচে ছোটো এই কাকা, জীবনে চূড়ান্ত অসফল ছিল। সেই অর্থে স্বাভাবিক আচরণ ছিল না তার।
তখনও কমলেশদের পরিবার একান্নবর্তী ছিল। চিনিকাকু বাবাদের সবচেয়ে ছোটো ভাই। তখনও খুব আদরের।
চিনিকাকু বেশি কথা বলত। প্রায়শই বোকা বোকা কথা। এমনিতে নেশাটেশা ছিল না। তবে এলাচদানা আর মৌড়ি রাখত একটা ডিবেতে। মাঝেমাঝে কচরমচর চিবোত, আর বলত,
— আমাগো হইল জমিদার বংশ। এই কারণেই এলাচমৌড়ি মুহে রাহি।
তখনও চিনিকাকু বাড়িতে ছিল।
সেই একদা একান্নবর্তী উদ্বাস্তু পরিবার যখন ভাঙনের মুখোমুখি হল, তখন কিন্তু কমলেশের মা, জ্যেঠিমা কাকিমারা কেউই এই অকর্মা বোঝাটিকে বইতে চাইল না। আর তাকে বইবার ব্যাপারে বাড়ির পুরুষদের বক্তব্য নারীদের থেকে আলাদা কিছু ছিল না।
সেই সময়ে এক দুয়ার থেকে তাড়া খেয়ে অন্য দুয়ারে যেত চিনিকাকু। কখনও কানপুরে, কখনও মধ্যপ্রদেশে, কখনও কলকাতায় তার পূর্বজদের কাছে আশ্রয় চেয়ে ব্যর্থ এই মানুষের বেয়ারিং চিঠি আসত কমলেশের বাবার কাছে। — সোনাদা, অবিলম্বে আমাকে টেলিগ্রাম মানিঅর্ডারে টাকা পাঠাও!
সোনাদা মানে কমলেশের কেরানি বাবা তখন মুর্শিদাবাদের এক গণ্ডগ্রামে জীবনধারণের লড়াই করছেন। কমলেশ ইস্কুলে হেডমাস্টার আর অফিসঘরে ঘোরাঘুরি করছে মাইনে পুরো ফ্রি না হলেও হাফ ফ্রি যদি করানো যায়।
চিনিকাকুর পাঠানো বেয়ারিং চিঠি এলে অসহায় অপ্রতিভ বাবা, মাকে তা দেখাতে সাহস পেত না। কমলেশ তদ্দিনে বড় হয়েছে। চিনিকাকুর কাছ থেকে আসা সেই বেয়ারিং চিঠিতে, কমলেশের মনে হত যেন একটা ভিখিরি ভিখিরি গন্ধ তো লেগে আছেই আর তার সঙ্গে সেই এলাচ মৌড়ির হালকা সুবাস লেগে থাকত, যে মিষ্টি গন্ধটা চিনিকাকুর কাছাকাছি গেলেই ছোটবেলায় পেত।
টাকা পাঠানোর ক্ষমতা বা ইচ্ছা কোনটাই হতভাগ্য সহোদরদের ছিল না। ফলতঃ বিতাড়িত আশ্রয়হীন চিনিকাকু শেষে রাস্তার ভিখিরি হয়ে যায়। তাকে কমলেশ শেষ দেখেছিল শেয়ালদা সাউথ স্টেশনে। বাবা আর কমলেশ সোনারপুর যাচ্ছিল। চিনিকাকু ওদের কাছ থেকে ভিক্ষে চাইল। বাবা দিলও দুটাকা। মুখ ফিরিয়ে চোখ মুছল অসহায় দুজন সহোদরই। চিনিকাকুর কোমরে গুঁজে রাখা এলাচমৌড়ির ডিবে গড়িয়ে পড়ল মাটিতে।
সেই শেষ দেখা তার সঙ্গে। পারিবারিক এই কলঙ্কিত ব্যর্থতা আর ক্ষতর কথা ভাবলে কমলেশের কেমন যেন উদভ্রান্ত লাগে নিজেকে। এখনও।
পরে পাশটাশ করে কমলেশ কলকাতা শহরে পড়তে এল। সেখানে হোস্টেলে ডাকপিয়ন চিঠি দিয়ে যেত গেটে বসা গোবিন্দের কাছে।
বেয়ারিং চিঠি আসত রুমমেট সুদিনের। ডাকপিয়ন যখন আসত তখন তো পড়ুয়া ছেলেরা কলেজ গেছে। পাছে বেয়ারিং চিঠি রিসিভড না হয়ে ফিরে যায় তার জন্য উৎকণ্ঠিত সুদিন হোস্টেলের গেটম্যান গোবিন্দকে দশটাকা অ্যাডভান্স দিয়ে রাখত।
দশটাকা, সেই আশির দশকে কিন্তু অনেকখানি। তখন মাঝারি সাইজের রসগোল্লা মাত্র পঞ্চাশ পয়সা।
সুদিনকে বেয়ারিং চিঠি পাঠাতো সুদূর গ্রাম থেকে তার প্রেমিকা। প্রেমিকাটি যে খুব গরিব বাড়ির মেয়ে, পয়সার অভাবে বেয়ারিং, তা কিন্তু নয়। বস্তুত সে জোতদার কন্যা। সন্দেহের যথেষ্ট কারণ রয়েছে, সুদিনকে শহরে রেখে পড়াশুনো করানোর স্পনসর সেই মেয়ের বাবা। বহু রকম আমিষগন্ধী প্রেমসম্ভাষণ পূর্ণ সেই পত্রাবলী যাতে অন্য কারুর হস্তগত বা মিসিং না হয়, সে জন্যেই এই বেয়ারিংএর ছলচাতুরি।
তারপরে তো কলেজে পাশটাশ, চাকরি, বিয়ে। জীবন বয়ে গেছে নিজের খাতে। কমলেশ যেটুকু পারে নিজের চেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
সে নিজে উদ্যোগী হয়ে কাউকে তেমন চিঠিটিঠি লিখত না। ওকেও লিখত না কেউ। শেষের দিকে তো চিঠি বলতে বোঝাতো নববর্ষ আর বিজয়া দশমীতে রুটিন মাফিক একটা পোস্ট কার্ডে গুষ্ঠিশুদ্ধ লোকের খবর নেওয়া। দূরে দূরে থাকা আত্মীয়রা কে কেমন আছে, সবাই বেঁচেবর্তে আছে তো?
তাও কতদিন হয়ে গেল। এখন কুশল-জিজ্ঞাসা মানে মোবাইলে পনেরো সেকেন্ড, না পেলে হোয়াটস্অ্যাপে একলাইন! চিঠিই আসে না কোনও তাই বেয়ারিং চিঠি আসার প্রশ্নই নেই।
যাই হোক, এই বেয়ারিং চিঠিটা উদ্ধারের ব্যবস্থা করতে হয়। পরের দিন রবিবার। সোমবার কীসের একটা ছুটি। চিঠি পেতে পেতে সেই মঙ্গলবার। কত রকমের চিন্তা আসে মনে।
কোনও ভাবে কি ব্যাঙ্কের এটিএম কার্ডটা এল বেয়ারিং পোস্টে? অ্যাপ্লাই করেছে চারমাস আগে। আজ করোনা, কাল অমুক, পরশু তমুক লেগেই আছে ওদের। কার্ড আসেনি।
ব্যাঙ্কের বন্ধু অনুপকে ফোন করে ধরল, — হ্যাঁরে, কোনও ভাবে কি এমন হতে পারে যে ব্যাঙ্ক থেকে এটিএম কার্ডটা পাঠাল কিন্তু খামের গায়ে স্ট্যাম্প লাগাতে ভুলে গেল ডেসপ্যাচের লোকেরা?
— আরে বোকা, ওসব কার্ড স্পিড পোস্ট ছাড়া পাঠায় না। এ কি তোর ছেলে বেলার পোস্টাফিস পেলি, যে যা হোক কিছু ঠিকানা লিখে লালবাক্সে ফেললেই চিঠি চলে যাবে?
রিম্পা আজকে বাড়িতে এই বেয়ারিং চিঠি আসার ব্যাপারটায় খুবই উত্তেজিত। কমলেশের বেশি বয়সের আদুরে মেয়ে রিম্পা।
অদ্রীশ বর্ধনের একটা বই আছে, আমার মা সব জানে। রিম্পা মনে করে আমার বাবা সব জানে।
কাজেই সে তার সবজান্তা বাবাকে জিজ্ঞেস করল, — চিঠিটাকে কেন বেয়ারিং বলল, হ্যাঁ বাবা?
যেটুকু জানে বুঝিয়ে বলতে হল ওকে, — চিঠিতে ডাকটিকিট লাগাতে হয় জানিস তো? কেন লাগাতে হয় জানিস?
ডাকঘরের চিঠি তেমন বেশি দেখেনি রিম্পা। হ্যাঁ, ডাক টিকিট লাগানো থাকে তাতে। রিম্পা কিন্তু অন্যরকমও দেখেছে। বাবাকে সেটাই বলল, — মোটেই সব চিঠিতে স্ট্যাম্প লাগাতে হয় না। এই তো কুরিয়ারে দাদার চিঠি আসত, কই কোনও স্ট্যাম্প তো লাগানো থাকত না তাতে।
— আরে, এই কুরিয়ার ব্যাপারটাতো মাত্র এই সেদিনের। তারও অনেক আগে থেকে এই চিঠি দেওয়া নেওয়া শুরু হয়েছে তো। কুরিয়ারই বল আর পোস্টাফিসই বল, চিঠি পৌছনোর সেই কাজটা যারা করবে, তাদের খরচা দিতে হবে না? সেই খরচ তোলার জন্যই এই ডাকটিকিট। ওজন বুঝে খামের গায়ে ডাকটিকিট লাগাবি, পোস্টাফিস তোর সেই চিঠি পৌছে দেবে যে ঠিকানা লিখেছিস, সেখানে। এখন ধর ডাকবাক্সে চিঠি ফেলার আগে যত দামের টিকিট দরকার, লাগালি না, কিম্বা মোটেই লাগালি না, কী হবে তখন?
— তাই তো, কী হবে তখন?
চিন্তিত রিম্পাকে নিশ্চিন্ত করে কমলেশ। -তখন যত পয়সার ডাকটিকিট লাগানোর কথা তার ডবল পয়সা পিয়নকে দিয়ে যার চিঠি সে উদ্ধার করবে। এই হল নিয়ম। বুঝেছিস পেঁচি?
আদরের মেয়ের নাকের ডগাটা নেড়ে দেয় কমলেশ।
পেঁচিটি মানে রিম্পা কিছুটা বুঝল বটে, কিন্তু উত্তেজনাটা গেল না।
প্রথমে ফোন করল, দাদাকে। সাগ্নিক… রিম্পার চেয়ে পনেরো বছরের বড়। আইটি কোম্পানিতে কাজ করে। এখন হায়দরাবাদে। রিম্পাকে এই লকডাউনের অনলাইন ক্লাস সামলাতে ফোন কিনে দেওয়া হয়েছে। দাদাকে ফোনে ফিসফিস করে বলল, — অ্যাই দাদা, জানিস তো আজ বাড়িতে একটা হেব্বি জিনিস আসতে আসতে আসেনি।
সাগ্নিক এই বোনটাকে ভালোবাসে খুবই। কিন্তু এখন সে একটা কনফারেন্স কলে আছে। এখন কিছুতেই বেয়ারিং চিঠির রহস্যে সে জড়াতে পারবে না। বোনকে খুব বিনীত ভাবে সেই কথা জানাল সে।
বোন রেগেমেগে — দাঁড়া, তুইও যখন তোর বসের কাছ থেকে বেয়ারিং চিঠি পাবি… মজা বুঝবি!
বলে ফোন কাটল।
সাগ্নিক বলার সুযোগই পেল না, সে বসের কাছ থেকে চিঠি অলরেডি পেয়েছে। সেই চিঠি বেয়ারিং না। বসের যে কোনও চিঠিই আসে ইমেইলে।
বাবাকে অ্যাসেসমেন্টের সেই তেতো চিঠির কথা জানানো যাবে না। বাবা এমনিতেই সংসার চালাতে জেরবার। সাগ্নিক জানে। তাই রিম্পাকেও সে চিঠির কথা বলবে না সে।
রিম্পার মনে হল আরও কাউকে জানানো দরকার এই বিরাট খবরটা।
কাকে? রূপমকে। নাঃ, ফোনে পাওয়া গেল না । আসলেই তো রূপম বলে কেউ নেই। তাই ওকে ফোনে পাওয়া যায় নাা।
পাওয়া না গেলেও ক্ষতি নেই। এই রূপমের সঙ্গে ও মনে মনে কথা বলে। এই মনে মনে কথা বলাতেই বরং মজা বেশি। নইলে হয়তো আসল রূপম বলে সত্যি কেউ থাকলে হয়তো প্রচুর বাজে বকত। তখন বকুনি দিয়ে থামাতে হত ‘অ্যাই বেশি ভাট বকিস না’ বলে।
কথাবার্তা হল মোটামুটি এই রকমের…— জানিস তো, আমাদের বাড়িতে একটা বেয়ারিং চিঠি এসেছিল আজ।
— ওই জিনিস আমাদের বাড়িতে রোজ আসে। রূপম বলল।
— ভ্যাট, বললেই হল? ওই চিঠি আসে হাতে গোণা কিছু লোকের বাড়িতে। রাজার লোক নিয়ে আসে সেই সব চিঠি। নগদ পয়সা দিয়ে ছাড়াতে হয়। সেই চিঠিতে লেখা থাকে বাবাকে কী করতে হবে না হবে।
— এ মা, তোর বাবা কি বাচ্চা ছেলে নাকি? কী করবে না করবে বলে দিতে হবে কেন?
— আসলে দাদা তো এখানে নেই, আর আমিও খুব ছোটো, মানে তত বড় তো হইনি এখনও! কে আর বাবাকে বুদ্ধি দেবে বল?
— ঠিকাছে ঠিকাছে, কাকুকে বলিস এবারের চিঠিটা যেন আমাকে দেখায়। আমি বলে দেব কী করতে হবে।
— অ্যাই রূপম, শোন, তুই আমাকে একটা বেয়ারিং চিঠি দিবি রে? তোর মত মিথ্যেমিথ্যি হবে না সেই চিঠিটা। সত্যিকারের বেয়ারিং চিঠি। যেটা আমাকে খুঁজে খুঁজে ঠিক আমার কাছে চলে আসবে!
বাড়ির আর এক জনও এই বেয়ারিং চিঠির ব্যাপারে খুব চিন্তিত। কমলেশের বউ মল্লিকা।
যখন ডাকপিয়ন এসেছিল, মল্লিকা তখন রান্নাঘরে। সে হাজির হবার আগেই পিয়নকে মেয়ে যা বলার বলে দিয়েছে।
আসলে যে চিঠি আসার কথা না সেই রকম চিঠির ব্যাপার শুনলে মল্লিকার ভয় করে।
ছেলেবেলায় জামশেদপুরে কোয়ার্টারে থাকত। পাশের কোয়ার্টার মানে পরিতোষ কাকুদের বাড়িতে বেনামি চিঠি আসত। ওপরে ব্লক লেটারে গোটা গোটা অক্ষরে কাকুর নাম লেখা, জোসেফ পরিতোষ বিশ্বাস।
সেই চিঠি ডাকে আসত না। ওদের কোয়ার্টারে চিঠির বাক্সে কেউ ফেলে যেত। ওই সব চিঠিতে নাকি পরিতোষ-কাকিমাকে জড়িয়ে নানা রকম কথা থাকত। রেবেকা না কী যেন নাম ছিল কাকিমার । মেমসাহেব মেমসাহেব নাম। আসলে তো খ্রিশ্চান ছিল ওরা। মানভূমে কোথায় যেন বাড়ি।
সেই বেনামি চিঠি মহাচিন্তিত পরিতোষ কাকু মল্লিকার বাবাকে দেখাতে এসেছিল। — দেখুন তো রঞ্জিত দা’। কী নোংরা নোংরা কথা লেখা আমার বউকে নিয়ে। আবার ওসব চিঠিতে লেখা কিছু কিছু কথা ফলেও যাচ্ছে।
— ফলে যাচ্ছে? সে আবার কী কথা?
— হ্যাঁ দাদা, তিনমাস আগে বাচ্চাদের নিয়ে সেদিন সকালেই গেছে বাপের বাড়ি গেছে বউ। ডিউটি সেরে ফিরবার পরে খেয়েদেয়ে শুলাম। বিছানায় ফস করে আগুন ধরে গেল। ভাগ্যি ভালো তাই বেঁচে গিইচি। সেদিনই ডাকবাক্সে চিঠি পেলাম। সেই চিঠিতে লেখা ছিল আমার বউয়ের পাপে ঘরে আগুন লাগবে।
— না হে, তুমি হয়তো নেশার ঘোরে নিজেই কিছু করে ফেলেছ। তাই আগুন লেগেছে। বাবা পরিতোষ কাকাকে বুঝিয়েছিল।
তখন দুটি ছেলেমেয়ে ওদের। ছোটো মেয়ে হেলেন মল্লিকার চেয়ে কিছু বড়। এই বয়সে ছোটো মল্লিকাই তার বন্ধু।
একদিন সেই হেলেন চুপিচুপি বলল, — মিলু, জানিস তো, কে আমাদের চিঠির বাক্সে চিঠি ফেলে ধরতে পেরিচি।
— কে দেয় রে চিঠি?
— কে আবার, আমার মা নিজেই। নোংরা নোংরা কথা লেখা চিঠি লেকে নিজের নামে। বাম হাত দিয়ে… জানিস তো? আমি দেখলম, মা নিজে লেটারবক্সে চিঠিটা রাকল।
— ধ্যাৎ, নিজের নামে ওইসব লিখবে কেন? কী লাভ?
— আসলে বাবাটা তো আমাদের আর মায়ের মোটে যত্ন নেয় না। মদ খায়। নদী ধারের ঝুপড়িতে যায়। তাই মা লেকে বোধ হয়। যদি বাবা ওইসব চিঠি দেখে হিমসের চোটে শুদরোয়।
বাচ্চা মল্লিকা বোকার মত বলেছিল, — কেন রে হেলেনদিদি, ঝুপড়িতে গেলে কী হয়। হিংসে কীসের?
এঁচোড়ে পাকা হেলেন চোখ নাচিয়ে বলেছিল, — বড় হ। বুঝবি ক্যানে।
— কিন্তু তোরা যেদিন মামাবাড়ি গেলি আগুন ধরে গেল পরিতোষ কাকার খাটে, সেটা কেমন করে হল? ওই চিঠিতেই নাকি লেখা ছিল!
রহস্যময়ী হেলেন হাসল, — সেটাও আমি দেখিচি, বুঝলি রে বোকা। মা বেরোনোর সময় ইট্টুস একটা মোমবাতি ধরিয়ে মাটিতে লুটানো বিছানার চাদরের ওপর রেখে গেছিল। আমি খুব জানি কী করে বিছানায় এক ডের ঘণ্টা বাদে আগুনটো লাইগলো।
নিজের মাকে বলতে, মা এসব কথা কাউকে বলতে নিষেধ করেছিল। বলেছিল, — মিলু, তুই ওই হেলেনের সঙ্গে মোটে মিশবি না।
না, মল্লিকা হেলেনের সঙ্গে আর বেশিদিন মেশার সুযোগ পায়নি। আসলে এই সব কথার মাস দুয়েক পরেই হেলেন আর তার ছোটো ভাই মামার বাড়ি চলে গেল। যেতে হল বাধ্য হয়ে।
শেষ একটা বেনামি চিঠিতে লেখা ছিল কার সাথে নাকি পালিয়ে যাবার প্ল্যান করেছে কাকিমা। চিঠির শেষে লেখা ছিল এমন বউকে যে শাসন করতে পারে না তার বিষ খেয়ে মরা উচিত।
জোসেফ পরিতোষ বিশ্বাসকে একদিন অজ্ঞান অবস্থায় পাওয়া গেল ঝুপড়ি পেরিয়ে যে রাস্তাটা খড়কাই নদীর দিকে গেছে তার ধারে। বাবা সমেত কলোনির লোকেরা খবর পেয়ে হাসপাতালে নিয়ে গেল। ওরা বলল মরে গেছে। পুলিশ এসে ধরে নিয়ে গেল পরিতোষ কাকিমাকে।
বাবা মাকে বলছিল ,পুলিশের সন্দেহ ওই কাকিমাই নাকি বিষ দিয়ে…
এই বেয়ারিং না কী, সেও তো ওই বেনামি চিঠি গোছেরই একটা কিছু হবে। সেই ছেলেবেলার চিঠি রহস্য মনে পড়ে যেতে, কী থেকে কী হয় ভেবে শিউরে উঠল সরল মেয়ে মল্লিকা।
আজ বুধবার। সেই বেয়ারিং চিঠি উদ্ধারের দিন। মঙ্গলবারই যেতে পারলে ভালো হত। কিন্তু অফিসে যেতেই হল কমলেশকে। সরকারি অফিস যদিও, বড় স্যার না বলে অ্যাবসেন্ট করা পছন্দ করেন না। ছুটি নেওয়াই পছন্দ নয় তাঁর। এই যে কথায় কথায় আজকাল ছুটির ব্যবস্থা হয়েছে,এই কারণে ক্রোধের সীমা নেই তাঁর। তবু তাঁকেই গিয়ে বলতে হল ছুটির কথাটা।
ছুটি চাই বলতেই তিনি মনে করিয়ে দিলেন আপ্তবাক্যটি, লিভ ইজ নট এ রাইট। তার পর ছুটি নেবার কারণটা শুনলেন। বেয়ারিং চিঠি উদ্ধার শুনে কিছু না হোক মিনিট খানেক হাসলেন খুব। সদা গম্ভীর স্যারের হাসি নাকি বিপদের কারণ। বছর কয়েক আগে এই রকম হেসেছিলেন তিনি ক্যাশবুক সই করতে গিয়ে। তার পরের দিনই সাসপেন্ড হয়ে গেছিল ক্যাশিয়ার বাবু, হিসেবে এতই নাকি গণ্ডগোল ছিল।
স্যার বললেন— অ্যাপ্লিকেশন জমা দিন। কারণটা মেনশন করে দেবেন ঠিক করে।
অ্যাপ্লিকেশন জমা দিয়ে আসার পর পাশের টেবিলের ইউনিয়নবাজ বিপ্লব সব শুনে বলল,
– এঃ হে, কমলেশদা, ব্যাটা বলল আর আপনি সত্যি কথাটা লিখে অ্যাপ্লাই করে দিয়ে এলেন? অন্য যা কিছু লিখতে পারতেন তো। মেয়ের ইশকুলে ডেকেছে কী বউদিকে ডাক্তার দেখানো। এই সব কিছু না লিখে লিখলেন বেয়ারিং চিঠি? এই চিঠি দেখিয়ে ও প্রমাণ করবে আমরা কত অকিঞ্চিৎকর ফালতু কারণে ছুটি নিই। আপনার এই কাজটা চূড়ান্ত ইউনিয়ন বিরোধী হল তা জানেন?
নাঃ, কমলেশ এত ঘোর প্যাঁচ সত্যিই বোঝে না।
পোস্টাফিসে গিয়ে খোঁজ নেওয়া বড় সহজ কাজ না। বহুদিন বাদে গিয়ে বুঝল ডাকঘর ব্যাপারটাই পালটে গেছে। নানান কাউন্টারে নানান রকম কাজ হচ্ছে বটে, কিন্তু তার পুরোটাই ব্যাঙ্কিংএর কাজ। এখন চিঠি পাঠানো বলতে শুধু রেজিস্ট্রি আর স্পিড পোস্ট।
একটা কাউন্টারে ভারি দয়াবতী চেহারার এক মেয়ে বসেছে। তার কাছে গিয়ে খোঁজ নেওয়া যাক, ভাবল নার্ভাস কমলেশ।
হায়, এই সংসারে দয়া কোথাও সাজানো নেই।
কাউন্টারের সামনে লাইন বেঁধে দাঁড়ানো ঘনবদ্ধ ভিড়, কলরব করে উঠল — লাইন দিন… লাইন দিন… কমলেশের দয়াবতী কমপিউটার স্ক্রিন থেকে মুখটিও তুলল না।
কিন্তু আছে। দয়া আছে…
ওই লাইনেই দাঁড়িয়ে থাকা এক মেয়ে, ওকে ডেকে কী ব্যাপার জানতে চাইল, — কী জানেন…পোস্টাফিসে রিসেপশন কাউন্টার বলে কিছু নেই তো। তার মুখটা এমন কাঁচুমাচু যেন সেটা না থাকার দায়টা তারই।
সব শুনে বলল, – দাদা, এইসব কাউন্টারে লাইন দিয়ে আপনার হিল্লে হবে না। আপনি এই বাড়িটার পেছনে চলে যান। সেখানে বিটের পিয়ন দাদারা থাকেন। শিগগিরি যান। নইলে তারা বিটে বেরিয়ে গেলে ফিরতে ফিরতে বিকেল।
এবারের কাজ তার কথা মত পেছন দিকে গিয়ে সেই লোককে খুঁজে বার করা। সেখানে নিজের বাড়ির লোকেশন বলে জানা গেল সেই তার নাম রঘুবীর।
চশমা চোখে বয়স্ক মতন একজন গলা উঁচু করে হাঁকল — অ্যাই, আমাদের দক্ষিণ পাড়া বিটের রঘু কোথায় রে?
তিন চারজন একসাথে জবাব দিল, — তার আজকে আসতে দেরি হবে, বিশ্বনাথদা’। কাল বলে গেল না, ভায়রাভাই এখন তখন। হাসপাতালে।
বিশ্বনাথ চোখের চশমাটা বাঁ হাতের তর্জনি দিয়ে নাকের ডগায় সেট করে বললেন, — ওই শুনলেন তো। হয়ে গেল। কতক্ষণ লাগবে কোনও ঠিক নেই। আর যদি আদৌ না আসে তো হয়েই গেল। ওর আর কী। সিএল নিয়ে নেবে একটা।
আঁতকে ওঠা কমলেশকে ফের জিজ্ঞেস করলেন তিনি, — আপনার সমস্যাটা কী, শুনি?
সমস্যা বলা গেল। শুনে তো তিনি অবাক। — আসল চিঠিই ঠিকঠাক দেওয়ায় ফাঁকি পড়ে যায়। তার আবার বেয়ারিং! বেয়ারিং চিঠির মানে বোঝেন? কোন না তেরো খানা জায়গায় লিখতে হবে কী তার বেত্তান্ত। তারপরে সেই আদায়ের পাইপয়সার হিসেব। সেই চিঠি দিতে গেছে? রঘুটা এত গাধা জানতাম না তো!
রঘুবীরের অপেক্ষায় পোস্টাফিসের পেছনের এক চিলতে জায়গায় অগত্যা পায়চারি। কপাল ভালো, মিনিট পনেরো পরেই সাইকেল থেকে একজন এসে নামতেই বিশ্বনাথনাবু তাকে বললেন, — অ্যাই যে রঘু, তোর বিটের এই ইনি অনেক সময় তোর জন্যে অপেক্ষা করছেন।
রঘু ছেলেটা ভালো। কমলেশ তার আসার কারণ বলতেই বলল, — সে তো প্রায় কুড়ি তিরিশ বছর আগের চিঠি স্যার। খামটা হলদেটে হয়ে গেছে। কোথায় কোন পোস্টাফিসের কোণায়কানায় আটকে ছিল। ঘর পরিষ্কার করতে গিয়ে পেয়েছে হয়তো। খেয়ে দেয়ে কাজ নেই। স্ট্যাম্প নেই, ফালতু জিনিস… ফেলে দিবি। তা না উদ্যোগ আয়োজন করে পাঠিয়েছে।
বিশ্বনাথ বাবু কান খাড়া করে শুনছিলেন। মন্তব্য করলেন, — এরম খবর তো কাগজে বেরোয়। দ্যাখো গে, পেপারে নাম তোলার মতলব হয় তো! তা হ্যাঁ মশাই, তিরিশ বছর আগের চিঠি বলছে। এই একই ঠিকানায় আছেন, এত বছর?
না, কমলেশ এত বছর ধরে একই ঠিকানায় নেই। ট্রান্সফারের চাকরি। অনেক জেলা ঘুরে এখন রিটায়ারমেন্টের দোরগোড়ায় পৌঁছে নিজের পৈত্রিক বাড়ির কাছে পোস্টিং পেয়েছে সে। পৈত্রিক বাড়িতে থাকে এখন।
সে যাই হোক আমতা আমতা করে শ্রীমান রঘুকে কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল কমলেশ, — ভাইটি, আমার চিঠিটা কি পাওয়া যাবে এখন? কত দিতে হবে?
ভাইটি মানে রঘু বলল, — আরে স্যার, কালকে এলেও হত। সে চিঠি তো গতকালই ব্যাক করে দেওয়া হয়েছে। আসলে মাস্টারমশাইকে জিজ্ঞেস করতে বললেন উনি নিজেও জানেন না সেকালের সেই চিঠি বেয়ারিং হয়ে গেলে কত চার্জ নিতে হবে। সেই পুরোনো কালের হিসেবে না নতুন শিডিউলে। নেট ঘেঁটে ম্যানুয়ালেও কিছু পাওয়া গেল না। অগত্যা উনিই বললেন ঝামেলা জিইয়ে না রেখে, অ্যাড্রেস নট ফাউন্ড বলে ফেরত পাঠিয়ে দিতে।
রঘুবীর ইতিমধ্যেই বুঝে গেছে, এই গোবেচারা লোকটাকে আর স্যার বলার দরকার নেই। — সে চিঠি আর পাওয়া যাবে না দাদা।
ব্যর্থ মনোরথ কমলেশ ফিরে চলে যাচ্ছে। কী আর করা। ফেরত চলে গেছে, সেই এসেও না আসা চিঠি।
বেরিয়ে প্রায় গলির মুখে, হঠাৎ শোনে পেছন থেকে দাদা দাদা বলে ডাক। মুখ ফেরাতে দেখে সেই রঘু পিছু ডাকছে। কাছে যেতে বলল, — একটা কথা বলতে ভুলেছি। আজব ব্যাপার। সেই বেয়ারিং চিঠিটায় আশ্চর্য একরকমের গন্ধ পেয়েছিলাম, বুঝলেন দাদা। খুব হাল্কা গন্ধ যদিও। কেমন যেন…। এলাচ আর মৌড়ির গন্ধ একসাথে মেশালে যেমন হয়… সেই রকম।
বেশ ভালো লাগলো গল্পটা।🙏