বড়দের স্ট্রোক হয় শুনেছি। আমাদের পাড়ায় তো ১৫ বছরের মেয়েটারও স্ট্রোক হয়েছে। কি দিনকাল পড়লো বলুন দেখি।
চেম্বারের বাইরে জমে থাকা ভিড়ের মধ্যে কেউ একজন বললেন অপর কোনো এক অপেক্ষমান রুগীর উদ্দেশ্যে।
চেম্বারের ভেতরে বিভিন্ন রোগের বিবিধ বর্ণনা শোনার মাঝেই কথাগুলো কানে এসেছিলো। সহকারীকে ডেকে ভদ্রলোককে ভেতরে ডেকে পাঠালাম।
আমার কথার উত্তরে ভদ্রলোক বর্ণনা দিলেন, গত পরশু থেকে পাশের বাড়ির মেয়েটার স্ট্রোক হয়েছে। মুখ একদিকে বেঁকে গেছে। ক্রমাগত লালা ঝরছে মুখ থেকে। একটা চোখ তো নষ্টই হয়ে গেছে বোধহয়। কিছুতেই ঐ চোখ বন্ধ করতে পারছে না।
উনার বর্ননা শুনে ঈষৎ চিন্তিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, শরীরের বাকি অংশে কিছু হয়নি?
-না, আমাদের গ্রামীণ চিকিৎসক বললেন, ফেস স্ট্রোক হয়েছে, কলকাতা যেতে হবে। সিটি স্ক্যান করতে হবে। গরীব পরিবার। ওদের তো মাথায় হাত!
উনার কথা শুনে বললাম, একবার আমার চেম্বারে আনতে বলতে পারেন। বিনা পারিশ্রমিকে একবার দেখে নিতাম না হয়।
আমার কথা শুনে ভদ্রলোক তৎক্ষণাৎ ফোন ঘুরিয়ে ডাকলেন মেয়েটিকে।
সকালের চেম্বারের নির্ধারিত সময়ের মধ্যে মেয়েটি এলো না।
এলো পরের দিন বিকেলে। বামদিকের চোখ সত্যিই বন্ধ করতে পারছে না সে। পলক পড়ছে শুধুই ডান চোখে। বাম দিকের চোখের কালো মণিটা পলক পড়ার সময় উপর পল্লবের অবয়বে আড়াল হয়ে যাচ্ছে মুহূর্তে। ঠোঁট দুটো ডান দিকে হেলেছে বেশ দৃষ্টিকটুভাবেই। কপালের ভাঁজ বাম দিকে স্পষ্টতই প্রায় নেই বললেই চলে। সে তুলনায় ডান দিকের কপালের ভাঁজ বেশ স্পষ্ট। গাল ফুলিয়ে মুখের ভেতর হাওয়া ধরে রাখতে বলায় মুখ ফোলাতেই পারলো না সে। হাওয়া বেরিয়েই গেল বাম গাল বেয়ে। তাতে খানিক লজ্জা পেয়ে মুখ ঢাকার চেষ্টা করলো একখান কাপড়ের খন্ড দিয়ে।
-খাবার খেতে গেলেই মুখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে, স্যার। জল খেতে গেলেও একই অবস্থা। পাড়ার ডাক্তার বললেন মুখে স্ট্রোক হয়ে গেছে। এত কম বয়সে স্ট্রোক হয়ে গেলো? গরীব মানুষ আমরা। কি করে কি করবো স্যার? পাশ থেকে বললেন মেয়েটির বাবা। মলিন পোশাকে মলিনতর হলো মুখ।
নিরীক্ষণ বিছানায় মেয়েটিকে শুতে বলে পায়ের পাতায় প্লান্টার প্রতিবর্ত ক্রিয়া দেখলাম। স্বাভাবিক। মুখমণ্ডলের বাম দিকের মাংসপেশিগুলো অস্বাভাবিক ভাবে দুর্বল। চিকিৎসা পরিভাষায় “পলসি”। কপাল ভাঁজ করার সময় বাম দিকের কপালে ভাঁজের রেখা তৈরিই হচ্ছে না প্রায়। অর্থাৎ কিনা সপ্তম ক্রেনিয়াল নার্ভের লোয়ার মোটর নিউরোন পলসি। সহজবোধ্য ভাবে, মুখমন্ডলের পেশিকে সরবরাহ করার নার্ভের নিষ্ক্রিয়তার দরুন প্যারালিসিস। এই নার্ভের নাম “ফেসিয়াল নার্ভ”। এর দুটি নিউক্লিয়াসের নিচের অংশ আক্রান্ত হওয়ার ফলে একদিকের কপাল প্রায় ভাঁজহীন। এ ধরনের প্যারালিসিসকে চিকিৎসা পরিভাষায় “বেল’স পলসি” বলে। আপাত ভয়ংকর এ রোগের চিকিৎসা মোটেও জটিল নয়। সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়া যায়। সর্বোপরি স্ট্রোক বলতে যে ভয়ংকর রোগের কথা আমরা জানি, তার তুলনায় নিতান্তই নিরীহ এ রোগ।
মেয়েটিকে আশ্বস্ত করে বললাম, ভয়ের কিচ্ছু নেই। একদম ঠিক হয়ে যাবে। সিটি স্ক্যান করার প্রয়োজনীয়তা নেই। দূর শহরে যেতে হবে বলেও মনে হয় না।
কয়েকটি ওষুধ লিখে দিচ্ছি। সেগুলো খাওয়ার সাথে সাথে মুখমন্ডলের ব্যায়াম দেখিয়ে দিচ্ছি। এগুলো করতে হবে। চোখে আপাতত রোদ চশমা পরে থাকতে হবে। ঘুমানোর সময় বাম চোখ খোলা থেকে যাতে শুষ্কতাজনিত জটিলতা না হয় সে জন্য গজকাপড়ের আইপ্যাক দিয়ে চোখ ঢেকে ঘুমাতে হবে।
এই বলে চিকিৎসাপদ্ধতি অনুযায়ী মূলত: স্টেরয়েড গ্রুপের ওষুধ ধাপে ধাপে ডোজ কমিয়ে খেতে বলে ব্যায়ামগুলো দেখাতেই মেয়েটি খানিক খোঁনা গলায় বলে উঠলো- এতগুলো ব্যায়াম কি করে মনে রাখবো ডাক্তারবাবু?
ওর কথায় আশ্বস্ত করে বললাম, আচ্ছা বেলুন ফোলাতে পারবি? বা শাঁখ বাজাতে ?
মেয়েটি হাসলো। এই অবস্থায় কি করে করবো ডাক্তারবাবু?
আমি বললাম- এগুলো করার চেষ্টাটাই আসলে ওই ব্যায়ামগুলো। এগুলো যেদিন নির্দ্বিধায় করতে পারবি, সেদিন সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যাবি তুই। আজ থেকেই শুরু করে দে। সাত দশ দিনে প্রায় সেরে উঠবি তুই।
আমার কথায় আশ্বস্ত হয়ে মুখে হাসি ফুটলো মেয়েটির। বাঁকা গালে হাসি গড়িয়ে এলো মুখের ডান কোণ ঘেঁষে।
আমার সহকারী এতক্ষণ হাঁ করে গোগ্রাসে গিলছিলো সমস্ত ঘটনাটি।ওরা বেরিয়ে যেতেই চেপে ধরলো আমায়- কেন হয় স্যার এই রোগ?
-কিছু ক্ষেত্রে হারপিস গ্রুপের ভাইরাস দায়ী হলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কারণ খুঁজে পাওয়া মুস্কিল। চিকিৎসা পরিভাষায় এই সব কারণ না খুঁজে পাওয়া কারণগুলোর অদ্ভুতুড়ে নাম দিয়েছি আমরা। “ইডিওপ্যাথিক”।
সপ্তাহ দুয়েক পরে ফিরে এসেছিলো মেয়েটি। সত্যি বলতে কি, সেদিনের বিকৃত মুখ সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠায়, পরের দর্শনে ওকে চিনতেই পারিনি। আমার অপ্রস্তুত ভ্যাবাচেকা মুখের দিকে তাকিয়ে ও যে সরল হাসিটা হেসেছিলো, তাতে আগের বাঁকা ভাব আর ছিলো না।