(চিত্তপ্রসাদের আঁকা দুর্ভিক্ষের চিত্র – উইকিপিডিয়া)
Famine Inquiry Commission: Report on Bengal ১৯৪৫ সালে এদের রিপোর্ট প্রকাশ করে। সে রিপোর্টে জানানো হয় – ১৯৪১ সালে আমন ধান চাষের জমির পরিমাণ ছিল প্রায় ১ কোটি ৭০ লক্ষ একর, উৎপাদনের পরিমাণ ৭০ লক্ষ ৪০ হাজার টন; ১৯৪৩ সালে চাষের জমির পরিমাণ বেড়ে হয়েছিল ১ কোটি ৮০ লক্ষ একরের বেশি জমিতে এবং উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৮০ লক্ষ ৫৩ হাজার টন।[1]
এরপরেও দুর্ভিক্ষ হয়েছিল। মৃত মানুষের সংখ্যা বিভিন্ন গবেষকের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী কম করে ২০ লক্ষ থেকে ৪০ লক্ষ। অমর্ত্য সেন তাঁর সুবিখ্যাত পুস্তক পভার্টি অ্যান্ড ফ্যামিন-এ লিখছেন – “Since the famine hit Bengal in 1943, it is quite natural, in view of the cyclone, flooding, fungus diseases, the disruption of the war, and the loss of Burma rice, that its primary cause should be seen in ‘the serious shortage in the total supply of rice available for consumption in Bengal as compared with the total supply normally available’ (Famine Inquiry Commission, India, 1945a, p. 77). This thesis will be examined presently.”[2] ফ্যামিন কমিশন-এর ব্যাখায় যে বিকৃত ও ভুল তথ্য দেওয়া হয়েছে সেন তাঁর পুস্তকে অত্যন্ত বিশ্বাসযোগ্যভাবে বিশ্লেষণ করেছেন। জানাচ্ছেন – “The economic experience of Bengal leading to and during the famine can be split into three phases: Phase 1: from the beginning of 1942 to March 1943; Phase II: from March 1943 to November 1943; Phase III: From November 1943 through most of 1944.”[3]
অমর্ত্য সেনের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, কলকাতা দুর্ভিক্ষকে দেখেছিল প্রধানত গ্রাম এবং জেলা থেকে ছিন্নমূল হয়ে আসা সর্বস্বান্ত মানুষের সারি হিসেবে যারা রাজপথ ছেয়ে ফেলেছে আর লঙ্গরখানায় এক বাটি লপ্সির জন্য লাইন দিচ্ছে।[4] সহজ কথায় বললে, বাংলার এই ভয়ংকরতম ‘হিউম্যান ট্র্যাজেডি’ যে কলকাতার আমজনতার মনে খুব ছাপ ফেলেছিল এমনটা নয় – বিভিন্ন ঐতিহাসিক দলিল যেরকম সাক্ষ্য আমাদের কাছে তুলে ধরে।
বিপরীত চিত্র দেখা গেছে শিল্পী-সাহিত্যিক-চিত্রকর-ভাস্করদের ক্ষেত্রে যারা মূলত বামপন্থী আদর্শে গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন। সুভাষ মুখোপাধ্যায় লিখছেন (‘স্বাগত’) –
গ্রাম উঠে গিয়েছে শহরে –
শূন্য ঘর, শূন্য গোলা, ধান-বোনা জমি আছে পড়ে।
শুকানো তুলসীর মঞ্চে
নিষ্প্রদীপ অন্ধকার নামে, আগাছায় ভরেছে উঠোন।
সূর্য পাটে বসেছে কখন।
রাখালের দেখা নেই –
……
ডাক ওঠে শহরে শহরে।
রাস্তার শ্মশানে থেকে মৃতপ্রায় জনস্রোত শোনে;
মাঠের ফসল দিন গোনে।
…..
মাঠের সম্রাট দেখে মুগ্ধ নেত্রে
ধান আর ধান।।
রামকিঙ্কর অবিস্মরণীয় স্কেচ তৈরি করছেন এই দুর্ভিক্ষের প্রেক্ষিতে।[5]
তৈরি হচ্ছে জয়নুল আবেদিনের স্কেচ।[6]
নিউ ইয়র্ক টাইমস-এ দুর্ভিক্ষ নিয়ে সংক্ষিপ্ত রিপোর্ট বেরিয়েছিল “বেঙ্গল ফ্যামিন রিপোর্টেড ওভার” শিরোনামে।[7] এর কয়েকদিন আগে এই সংবাদপত্রেই প্রকাশিত হয়েছিল “RELIEF CONTINUES IN BENGAL FAMINE”।[8] রিপোর্টে জানানো হয়েছিল – “Last week’s developments show that official and private relief measures continue to make headway in alleviating the famine distress in Bengal”।[9]
দুর্ভিক্ষকালে মেডিক্যাল রিলিফ, চিকিৎসা ও জনস্বাস্থ্য
এ সংক্রান্ত সরকারি রিপোর্ট নিয়ে কথা বলার আগে একজন গান্ধীবাদী নিরলস সাংবাদিক টি জি নারায়ণ-এর দেওয়া, দুর্ভিক্ষ-বিধ্বস্ত অঞ্চল সরেজমিনে দেখে সে পরিস্থিতির প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ আমি দেখতে চাইবো। তিনি সুদূর (তৎকালীন) মাদ্রাজ থেকে বাংলায় এসেছিলেন। তাঁর ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল হিন্দু এবং ম্যাঞ্চেস্টার গার্ডিয়ান-এর মতো সংবাদপত্রে। তাকে বলা হয়েছে – “an eminent representative of socially responsible journalism before independence”। এছাড়াও ফরওয়ার্ড এবং অমৃত বাজার পত্রিকা-য় তিনি নিয়মিত লিখতেন বিভিন্ন বিষয়ে, বাংলার দুর্ভিক্ষ নিয়ে তো বটেই।[10]
দুর্ভিক্ষের সময়কালে মেদিনীপুরে এবং বাংলার উপকূলবর্তী অঞ্চলে জোরালো সাইক্লোন হয়েছিল। এর ফলে নোনা জল ঢুকে চাষের জমিকে নষ্ট করে দেয়। এরকম এক সময়ে ১৯৪৩ সালের নভেম্বর মাসে নারায়ণ কাঁথিতে যান। সেখানে পাঁচ দিন ছিলেন। সব মিলিয়ে ২০০ মাইল পথ তিনি পায়ে হেঁটে, নৌকোয় বা লরিতে চড়ে অতিক্রম করেন। তাঁর যাত্রাপথে তিনি দেখেন ফসল ভরা মাঠের মাঝে মানুষের হাঁ-মুখ খুলি (grinning skulls) এবং তার পাশে পড়ে থাকা মৃত মানুষের লাশ।[11] ওখানে গ্রামের ভেতরে আরও অগ্রসর হয়ে তিনি একটি গ্রাম দেখেন যেখানে মানুষের পানীয় জল, খাবার বা ওষুধ কিছুই নেই। দুর্ভিক্ষে ধুঁকে মৃতপ্রায় এবং শিশুরা রয়েছে। কিন্তু ফসল ভরা মাঠের মধ্য দিয়ে হেঁটে গিয়ে ত্রাণকেন্দ্রে পৌঁছুনোর জীবনীশক্তি অবশিষ্ট নেই।[12] ব্যক্তিগত কিংবা বিভিন্ন নিবেদিত সংগঠনের উদ্যোগে (যার মধ্যে রামকৃষ্ণ মিশনও ছিল) বাচ্চাদের জন্য দুধ বা মিল্ক পাউডার এবং খিচুড়ি বিতরণের লক্ষ্যে ত্রাণকেন্দ্র খোলা হয়েছিল। কিন্তু উপনিবেশিক রাষ্ট্র কিংবা প্রশাসনের কোন ভূমিকা এখানে ছিলনা – অন্তত সে সময় অবধি।
রোগ ছড়ানোর জন্য এরকম এক ঊর্বর পরিস্থিতিতে কলেরা, আমাশা এবং ম্যালেরিয়ার মহামারি শুরু হয়। সমুদ্র তীরবর্তী একটি গ্রামে তিনি দেখেন ১৩০ জন ম্যালেরিয়া এবং আমাশায় মারা গিয়েছে। আরও বেশ কয়েকজন মৃত্যুর প্রহর গুণছে।[13] তাঁর বর্ণনায় – “কন্টাইয়ে (কাঁথি) এমনকি নভেম্বর মাসেও মেডিক্যাল রিলিফ ছন্নছাড়া অবস্থায় ছিল (was in a mess)। ত্রাণের জন্য যে সব সংগঠন এসেছিল তারা বারংবার সোচ্চারে দাবী করছিল (crying hoarse) ইমার্জেন্সি হাসপাতাল খুলে সংক্রামিতদের আলাদা করে চিকিৎসা করা হোক। মেডিসিন ছাড়া খাবার দেওয়া নিতান্ত অর্থহীন। তারা দাবী করছিল হাসপাতাল, ডাক্তার এবং নার্সদের ব্যবস্থা করা হোক। টিউবওয়েল এবং ম্যালেরিয়া প্রতিরোধী ব্যবস্থা নেওয়া হোক। তাদের যা চাহিদা ছিল তার তুলনায় নিতান্ত সামান্য কিছু পেয়েছিল, কারণ হাসপাতালগুলো বাংলার সরকারের সার্জন জেনারেলের নিয়ন্ত্রণে ছিল। কুইনিন, সিরাম এবং প্রতিষেধক ওষুধ নিয়ন্ত্রণ করত ডিরেক্টর অফ পাবলিক হেলথ এবং টিউবওয়েলের জন্য রাইটার্স বিল্ডিংযের অন্য কোন দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি। এদের মধ্যে কোনরকম সমন্বয় ছিলনা।”[14] সাইক্লোনের এক বছরের মধ্যে মেদিনীপুরের সিভিল সার্জন কাঁথিতে কোন পরিদর্শনে আসেননি।
পিছাবনিতে একটি সরকারি হাসপাতাল গড়ে ওঠার মুখে ছিল। পিছাবনি নামটির একটি ঐতিহাসিক তাৎপর্য আছে। ১৯৩০ সালে লবণ সত্যাগ্রহের সময় পুলিশের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এ অঞ্চলের দৃঢ় প্রতিজ্ঞ মানুষেরা বলেছিলেন “পিছাব নি” অর্থাৎ পিছনে হটবো না। “পিছাব নি” শ্লোগান থেকে এ এলাকার নাম পিছাবনি হয়েছে।
যাহোক, নারায়ণ এক মজার বর্ণনা দিয়েছেন। পিছাবনিতে হিন্দু মহাসভার তৈরি একটি ছোট হাসপাতাল দেখেছিলেন। এ হাসপাতালের ৩০টি বেডের মধ্যে ১৫টি বেডই খালি ছিল। তিনি জানাচ্ছেন, এ থেকে এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছুনো যাবেনা যে ওখানে সবাই সুস্থ ছিল। তিনি শুনেছিলেন যে বেড খালি রাখার পেছনের কারণ ছিল, হাসপাতালটি দেখাতে চেয়েছিল ওখানে মৃত্যুহার ভারী কম এবং যেসব রোগীর বাঁচার আশা কম তাদেরকে পত্রপাঠ বিদেয় করা হত। হাসপাতালের প্রতিটি ঘরে ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির একটি ছবি টাঙ্গানো থাকতো। নারায়ণের সকৌতুক মন্তব্য – “I do not know what therapeutic effect had on the patients. The physician-in-charge couldn’t enlighten me on this point. I was certain Dr. Mookerjee was not aware of these experiments on pictorial therapy.”[15]
আমরা কি বর্তমান ভারতের ছবি পুজো, বীর-গাথা রচনা এবং নানা পরিসংখ্যান কিভাবে manipulate করা হয় তার সাথে ৮০ বছর আগেকার এ ঘটনার কোন সাদৃশ্য দেখতে পাচ্ছি?
এরপরে নারায়ণ ভোগা নামে এক জায়গার কথা বলছেন। সেখানে তিনি মাটির দেওয়াল এবং খড়ের ছাউনি দেওয়া এক হাসপাতাল দেখেছিলেন। সে ‘হাসপাতাল’-এর উঠোনে আড়াই জন রোগীকে অবিন্যস্ত অবস্থায় ছিল। দুই বুড়ো-বুড়ি এবং একজন শিশু, এই হিসেবে আড়াই জন। একজন বুড়ো সাব-অ্যাসিস্ট্যান্ট সার্জন হাসপাতালের দায়িত্বে ছিলেন। তিনি অবসর নেবার পরে আবার সরকার তাকে ডেকে এনেছে। এ হাসপাতালে অনেক ওষুধ ছিল, সিরিঞ্জ ছিল, কিন্তু সুচ ছিলনা। ছিলনা স্টেরিলাইজেশনের কোন ব্যবস্থা, এমনকি প্রয়োজনীয় অ্যাবসোলিউট অ্যালকোহলও ছিলনা। সে এলাকার ২ মাইলের মধ্যে এক ফোঁটা জলের কোন ব্যবস্থা চোখে পড়েনি নারায়ণের।[16]
কন্টাই বা কাঁথির ইমার্জেন্সি হাসপাতালে দিল্লি থেকে স্বেচ্ছায় কাজ করতে আসা অসরকারি মহিলা ডাক্তার শান্তি সোনি অসামান্য নিরলস কাজ করে যাচ্ছিলেন। তাঁর প্রাণশক্তি অন্যদের মধ্যেও সঞ্চারিত হয়েছিল। কিন্তু শান্তি সোনির মতো কুশলী স্বেচ্ছাসেবক ডাক্তারেরা সরকারি ব্যবস্থার অস্বস্তির কারণ হয়ে উঠেছিলেন – সরাকারি মেডিক্যাল রিলিফের বড়সড় ফাঁক প্রকট হয়ে উঠছিল।[17] এখনও কি এ কথাগুলো সত্যি নয়?
নারায়ণ ‘cloth faime’ বলে একটি শব্দ চমৎকারভাবে ব্যবহার করেছেন। নভেম্বরের ঠাণ্ডায় রাস্তার ওপরে তিনি এক খণ্ড সুতোহীন, সম্পূর্ণ উলঙ্গ মানুষের সারি দেখেছেন। তাঁর অভিমত অনুযায়ী, ‘cloth famine’ সামলানো না গেলে ‘food famine’-এর মতোই ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে।[18]
নারায়ণ যেমন গ্রামীণ হাসপাতালে চিকিৎসার সরঞ্জামের প্রকট ঘাটতির কথা উল্লেখ করেছেন, সেরকম ঘাটতির কথা ১৯৪৪ সালে খোদ কলকাতা শহরের নামী হাসপাতালেও দেখা গিয়েছে। ১০ জুলাই, ১৯৪৪-এ নিতাই বলে একটি ‘হিন্দু ছেলে’কে কলকাতার রাস্তা থেকে উদ্ধার করা হয়। ছেলেটি দুর্বল এবং একেবারে শুকিয়ে যাওয়া অবস্থায় ছিল। মাসদুয়েক ধরে মাঝেমাঝেই ওর জ্বর আসছিল। কালা-জ্বর হবার সম্ভাবনা প্রবল ছিল। ওর বাঁদিকের বুকে সংক্রমণের লক্ষণ ছিল, বিভিন্ন ‘organ failure’-এর লক্ষণও ছিল। গোটা শীতকাল জুড়ে ওর গায়ে কোন বস্ত্র ছিলনা, থাকার জায়গা ছিলনা। নারায়ণ বর্ণিত ‘cloth faime’-এর কথা মনে পড়বে আমাদের। ওকে যখন ক্যাম্পবেল মেডিক্যাল স্কুলে (এনআরএস হাসপাতাল) নিয়ে যাওয়া হল তখন টিবি আছে কিনা ডায়াগনোসিস করার মতো কোন রিএজেন্ট হাসপাতালে ছিলনা। প্রস্রাবে প্রচুর পরিমাণ ফসফেট প্রমাণ করেছিল কিডনির গণ্ডগোল শুরু হয়েছে। রোগীর হাত-পা বিপুলভাবে ফুলে গিয়েছিল। ব্লাড শুগার স্বাভাবিকের অনেক নীচে ছিল। অপুষ্টি জনিত ‘ফ্যামিন ডায়ারিয়া’-য় ভুগছিল রোগীটি। ১০ জুলাই, ১৯৪৪-এ হাসপাতালে ভর্তি হবার পরে ২০ জুলাই, ১৯৪৪-এ ও মারা যায়।[19]
সমগ্র ঘটনাটি চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, সে সময়ের সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থা এমনকি প্রায় ২ বছর ধরে মন্বন্তর চলার পরেও কতটা অপ্রস্তুত এবং গোলমেলে অবস্থায় ছিল। একে তো চিকিৎসার বেহাল দশা, অন্যদিকে মানুষের জীবন নিয়ে উপনিবেশিক শাসকদের বিন্দুমাত্র চিন্তা ছিলনা। অথচ উপনিবেশিক যুদ্ধ, মিলিটারির জন্য খাদ্য সঞ্চয় করে রাখা, মুনাফা, রাজনীতি, অর্থনীতির যুগপৎ ক্রিয়ায় জন্ম নিয়েছিল ১৯৪৩-এর মন্বন্তর। কম করে ৩০ লক্ষ মানুষ স্রেফ না খেয়ে, আশ্রয় না পেয়ে, চিকিৎসার অভাবে পোকামাকড়ের মতো মরে গেল।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্বের শিক্ষক তারকচন্দ্র দাস মন্বন্তর নিয়ে তাঁর ক্ষেত্রসমীক্ষা করা গুরুত্বপূর্ণ পুস্তকে প্রশ্ন করেছিলেন – কেন নিঃস্ব ও সর্বস্বান্তরা তাদের ঘরবাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল? কি কারণেই বা তাদের পৈত্রিক ভিটে, যা তারা কোনওসময়েই ছাড়তে চায়না, হারাতে হল? তাঁর সম্ভাব্য উত্তর – (১) খাদ্য এবং কাজের অভাব, (২) বন্যা এবং সাইক্লোন, (৩) ফসল উৎপাদন কমে যাওয়া, (৪) খাদ্য এবং কাজ ছাড়াও পারিবারিক কলহ, এবং (৫) সামরিক দখল।[20] মন্বন্তরের ফলে আরেকটি সামাজিক পরিবর্তন (অস্থায়ী হলেও) ঘটেছিল। হিন্দু বর্ণবিভাগ অনুযায়ী, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে, উচ্চবর্ণের মানুষ নীচু বর্ণের কাছ থেকে খাবার বা জল গ্রহণ করতো না। মন্বন্তর এই সামাজিক বিভাজনকে মুছে সবাইকে এক ভূমিতে এনে দাঁড় করায়। তাঁর বিশ্লেষণ অনুযায়ী, দুর্ভিক্ষে মৃত প্রতি ১০০০ মানুষের মধ্যে ৬৫১ জন ছিল পুরুষ এবং ৩৪৯ জন নারী।[21] দুর্ভিক্ষের অনাহার এবং অপুষ্টি হতভাগ্য মানুষদের এতটাই শীর্ণ করে তুলেছিল যে বাইরে থেকে দেখে এদের বয়স অধিকাংশ সময়েই বোঝা যেতনা।
দুর্ভিক্ষের গভীর প্রভাব পড়েছিল স্বাস্থ্যের ওপরে। জন্মহার কমে গিয়েছিল প্রধানত “abortion, miscarriage, and still-birth resulting malnutrition and disease”-এর কারণে।[22] শুধু তাই নয় – “The mortality figures show that almost the whole of Bengal, in greater or lesser degree, was affected by the famine and the outbreaks of epidemic diseases associated with it.”[23] জুলাই, ১৯৪৩-এ ম্যালেরিয়া এবং কলেরার জন্য অত্যধিকহারে মৃত্যু হয়েছিল। যেসব সর্বস্বান্ত মানুষ কলকাতায় এসে ভিড় করেছিল, তাদের ৪০%-এর রক্তে ম্যালেরিয়ার প্যারাসাইট পাওয়া গিয়েছিল। আগস্ট থেকে নভেম্বর (১৯৪৩) মাস পর্যন্ত কলকাতার হাসপাতালে ভর্তি অধিকাংশের মৃত্যুর কারণ ছিল ভয়ংকর অনাহার এবং তার শারীরিক প্রভাব।[24]
মারাত্মক রকম অনাহারের ফলে মানসিকভাবে ভারসাম্যহীনতা সাময়িকভাবে তৈরি হত – “Actually, the clouding of the mind induced by starvation cleared in a few days, if the patient could be rallied by suitable dietary and medical treatment.”[25] “ফ্যামিন ডায়ারিয়া”-র সঠিক কারণ হিসেবে ফ্যামিন ইনক্যুয়ারি কমিশন ৩টি বিষয়কে চিহ্নিত করেছিল – (১) অনুপযুক্ত (unsuitable) খাবার, (২) অন্ত্রের খাবার হজম করার ক্ষমতা নষ্ট হওয়া – “actual anatomical changes in the intestinal wall, due to the consumption of a diet grossly inadequate in quantity and defective in quality.” এবং (৩) আমাশয়ের সংক্রমণ।[26] বহুল সংখ্যক রোগীর মধ্যে দুর্ভিক্ষজনিত কারণে শরীর বিপুল পরিমাণে ফুলে যাওয়া দেখা গিয়েছিল। কমিশনের রিপোর্ট জানাচ্ছে, এরকমভাবে শরীর ফুলে যাওয়া প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে মধ্য ইউরোপের অভুক্ত মানুষের মাঝে দেখা গিয়েছিল। বাংলায় আক্রান্তদের বেশিরভাগ অংশের মাঝে রক্তাল্পতাও ছিল। “An interesting observation was that malaria not infrequently developed in patients who had rallied after a few days’ stay at hospital.” অর্থাৎ হাসপাতালে থাকার কয়েকদিন পরে ম্যালেরিয়ার লক্ষণ ফুটে ওঠে। এর সম্ভাব্য কারণ হল দীর্ঘ সময়ের তীব্র অনাহারের ফলে শরীরের ইমিউনিটি ঠিকমতো কাজ করেনি, ম্যালেরিয়ার লক্ষণ চাপা পড়ে ছিল। ম্যালেরিয়া এবং অপুষ্টির যুগপৎ আক্রমণে রক্তাল্পতা তৈরি হত।[27]
হাসপাতালে ভর্তি থাকা অভুক্তদের চিকিৎসার জন্য All-India Institute of Hygiene and Public, Health, Calcutta একটি গাইডলাইন তৈরি করে – “TREATMENT AND MANAGEMENT OF STARVING SICK DESTITUTES (Prepared by The Committee of Enquiry into Effects of Starvation, Indian Research Fund Association)”। তৎকালীন বিখ্যাত ভারতীয় মেডিক্যাল জার্নাল ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল গেজেট-এ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৪-এর সংখ্যায় এই গাইডলাইন প্রকাশিত হয় (প্রথম প্রকাশ হয়েছিল বিস্তৃতাকারে ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নাল-এর ২৮ আগস্ট, ১৯৪৩ সংখ্যায়)।[28] এ গাইডলাইনে অনাহারে আক্রান্ত রোগীদের ৪ ভাগে ভাগ করা হয় – (১) গ্রুপ ১ – যারা শারীরিকভাবে নিঃশেষিত (collapsed cases) যাদের কে রক্তনালী দিয়ে বিকল্প খাদ্যের বা চিকিৎসার ব্যবস্থা করা যাবেনা, এমনকি তরল খাবারও নিতে পারেনা অর্ধ-কোমায় থাকার দরুন, তারা সচরাচর মারা যায়। (২) গ্রুপ ২ – তুলনায় কম নিঃশেষিত, যারা “capable of recovery ordinarily by oral feeding”। (৩) গ্রুপ ৩ – যারা সাধারণ ডায়েট হিসেবে দুধ খাবার মতো অবস্থায় আছে, এবং (৪) গ্রুপ ৪ – যারা কয়েকদিন হাসপাতালে কাটানোর পরে তরল খিচুড়ি খেতে পারছে এবং নিজেদের খেয়াল রাখতে সক্ষম হচ্ছে।[29]
যাদের শরীরে তরল খাদ্য রক্তনালী দিয়ে যাবে তাদের ক্ষেত্রে এই বিশেষজ্ঞদের মেডিক্যাল সুপারিশ ছিল –
Milk (skimmed or ghol), 4 pints 800 (calorie) 80 (gm protein)
Glucose, 4 oz. .. .. 450 (calorie)
Salt, i oz.
Eggs, 2 .. .. + 120 (calorie) 10 (gm protein)
Shark liver oil, i oz. .. 50
Compound vitamin tablet, 1
(১ আউন্স = ২৮.৩ গ্রাম বা ২৯.৫ মিলি)
এতে মোট 1,420 ক্যালরি এবং 90 গ্রাম প্রোটিন পাওয়া যাবে। দিনে ৪ পাঁইট (১ পাঁইট = ৪৭৩.১ মিলি) অব্দি তরল দেওয়া যেতে পারে। হাসপাতাল ডায়েটের ব্যাপারে বরাদ্দ হয়েছিল – তরল খাদ্য হলে ৮০০ ক্যালরি, দুধ হলে ১২০০ ক্যালরি এবং তরল কিচুড়ি হলে ১৯০০ ক্যালরি।[30] কিভাবে তরল খাদ্য দেওয়া হবে এ নিয়ে সেসময়ে ব্যবহৃত একটি ইন্ট্রাভেনাস অ্যপারেটাসের চিত্রও দিয়েছিল কমিটি।
উপরোক্ত কমিটি-চিহ্নিত প্রধান রোগগুলো ছিল – (১) ম্যালেরিয়া, (২) নিউমোনিয়া, (৩) Intestinal disorders, যার মধ্যে জীবাণু এবং অ্যামিবা ঘটিত দু’রকমের আমশা ছিল, ছিল মারণান্তক কলেরা, (৪) “ফুলে যাওয়া”, (৫) অ্যানিমিয়া, (৬) বিভিন্ন ধরণের ত্বকের রোগ – “Phagedenic ulcers”, স্কেবিস বা খুজলি এবং অন্যান্য রোগ।[31] কমিটির পর্যবেক্ষণ ছিল – “The cases admitted to hospital from the ‘sick destitutes’ found on the streets of Calcutta could be divided roughly into three groups : (a) those suffering from inanition due to starvation only, (b) those suffering from inanition due to a combination of starvation and disease, and (c) those showing relatively little inanition but suffering from acute disease.”[32] যে সমস্ত রোগীকে হাসপাতালে “ইন এ স্টেট অফ কোলাপ্স” আনা হয়েছে তাদের “ইন্ট্রাভেনাস পেপটোন গ্লুকোজ” দেবার সুপারিশ ছিল – দিনে সর্বোচ্চ ৪০০ মিলি পর্যন্ত দেওয়া যেত। এতে ৩ দিনের মধ্যে ধীরে ধীরে অবস্থার উন্নতি হত। শরীর ফুলে যাওয়া কমে যেত বা সেরে যেত। এমন কথাও বলা হয়েছিল – “It is evident that a somewhat crude and incomplete programme of hospital treatment will be necessary, if the small number of beds available is to be used to best advantage.”[33] হাসপাতালে স্বল্পসংখ্যক বেডকে কাজে লাগানোর জন্য মেডিসিনের কিছু ছাঁটকাটও করতে হয়েছে। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে অনাহার-ক্লিষ্ট রোগীদের ক্ষেত্রে ভিটামিনের অভাব সেভাবে দেখা যায়নি।
ফ্যামিন কমিশনের রিপোর্ট অনুযায়ী, ১৯৪৩-এর জুলাই থেকে ডিসেম্বর মাসের মধ্যে ৪৭০,০৮৯ জন মানুষ ম্যালেরিয়ায় মারা গিয়েছিল। এ সংখ্যা আগের ৫ বছরের চেয়ে ২৬৬,২০৮টি (১২৫.১%) বেশি ছিল। ১৯৪৩-এর প্রথম ৬ মাসে কলেরার কারণে মৃত্যুর সংখ্যা অস্বাভাবিক রকমের বেশি ছিল।[34] কমিশনের পর্যবেক্ষণ – “A famine-stricken population is a sick population. Famine means not only lack of food in the quantitative sense but also lack of essential food constituents which are needed for bodily health.”[35]
১৯৪৪-এর জানুয়ারিতে মোটের ওপরে ১৩,০০০ হাসপাতাল বেড লভ্য ছিল। জুলাইতে সে সংখ্যা বেড়ে ১৮,২৫০ হয়। এ সংখ্যার বেশিরভাগটাই এসেছিল ‘রিলিফ ইমার্জেন্সি হাসপাতাল’-এর বেড থেকে। এ পরিপ্রেক্ষিতে সরকার চিন্তাভাবনা করে যে স্থানীয় অথরিটিদের হাত থেকে জেলা এবং সাবডিভিশনের হাসপাতালগুলোর দায়িত্ব দেওয়া হবে প্রাদেশিক সরকারের হাতে। জুন, ১৯৪৪-এ এরকম ৪১টি হাসপাতাল প্রাদেশিক সরকার অধিগ্রহণ করে এবং আরও ৪৪টি অধিগ্রহণের পথে ছিল। নভেম্বর, ১৯৪৩-এ আইএমএস (ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল সার্ভিস)-এর নতুন ডিরেক্টর জেনারেল বাংলায় আসেন মেডিক্যাল রিলিফ এবং জনস্বাস্থ্যের বিভিন্ন কর্মসূচির ক্ষেত্রে সহযোগিতা ও উপদেশ দেবার জন্য।[36] সেসময়ে দেখা গেছে ডাক্তারেরা “reluctant to serve in rural areas under the conditions produced by the famine, and moreover the pay offered was not attractive enough.”[37] ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৪-এ, প্রয়োজনের তুলনায় ন্তান্ত কম, ১৬০ জন ডাক্তারকে নিয়োগ করা হয়। জুন মাসের শেষ নাগাদ দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতিতে কাজ করার জন্য ৩২৮ জন ডাক্তারকে সংগ্রহ করা হয়। বাংলার সরকার জানায়, এ সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় অর্ধেক। স্বাভাবিক সময়েও ভারতে তখন নার্সদের বিপুল ঘাটতি ছিল। মাত্র ৭,০০ প্রশিক্ষিত নার্স ছিল গোটা ভারতের জন্য – ৫৬,০০০ জনসংখ্যার জন্য ১ জন মাত্র নার্স। দুর্ভিক্ষের সময় নার্সদের ঘাটতি মেটানো একটি অসাধ্য কাজ ছিল।[38] বর্তমান ভারতের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে।
আরেকটি বড়ো সমস্যা ছিল কুইনিন তৈরি এবং সরবরাহ করা। শান্তির সময়ে ভারতে ২০০,০০০ পাউন্ড (৯০৭১৮.৫ কেজি) কুইনিনের চাহিদা ছিল। দুর্ভিক্ষের সময়ে এর চাহিদা বহুগুণ বেড়ে যায়। এ চাহিদা উপযুক্তভাবে সামাল দেওয়া যায়নি। ইংল্যান্ড থেকে ১,০০০,০০০ সালফাগুয়ানাইড (অ্যান্টিবায়োটিক) পাঠানো হয় ব্যাক্টেরিয়া জনিত আমাশার চিকিৎসার জন্য। কলেরার ক্ষেত্রেও চেষ্টা করা হয়েছিল, ফলাফল শূন্য। এছাড়াও সামরিক বাহিনী এবং অসামরিক ক্ষেত্র থেকে ১০ লক্ষের বেশি ভিটামিন ট্যাবলেট সরবরাহ করা হয়েছিল। কমিশনের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, বাংলায় বিদ্যমান হাসপাতালগুলো খুব খারাপভাবে রয়েছে (poorly equipped) রয়েছে এবং প্রায় সব হাসপাতালে মেডিক্যাল সাপ্লাইয়ের অবস্থা সঙ্গিন।[39]
এখানে আমাদের ভাবতে হবে, উপনিবেশিক ভারতে বেজায় ঢাকঢোল পিটিয়ে ১৮৩৫ সালে এশিয়ার প্রথম মেডিক্যাল কলেজের প্রতিষ্ঠা হলেও সামগ্রিকভাবে চিকিৎসা এবং জনস্বাস্থ্যের অবস্থা করুণ ছিল – না ছিল উপযুক্ত হাসপাতাল এবং পরিকাঠামো, না ছিল যথেষ্ট সংখ্যক ডাক্তার, নার্সদের সংখ্যা ছিল ভয়াবহরকমের কম। উপনিবেশিক কর্তাদের তর্জনীতে ভয় পাইয়ে স্বাভাবিক এরকম বহুছিদ্র স্বাস্থ্যের কাঠামো দিয়েই কাজ চলে যাচ্ছিল। কিন্তু মন্বন্তরের সময় এই ফাঁকগুলো এমনভাবে গহ্বর হয়ে ওঠে যে আর ঢেকেচেপে রাখা যায়নি। হিউ টিংকার তাঁর দ্য ফাউন্ডেশনস অফ লোক্যাল সেলফ গভর্নমেন্ট ইন ইন্ডিয়া, পাকিস্তান অ্যান্ড বার্মা গ্রন্থে (১৯৬৭) দেখিয়েছেন যে ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের হাতে অতি সীমিত ক্ষমতা ছিল – ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের সরকারি নীতির ফলে। অথচ তাদেরকে বলা হয়েছিল রাস্তা, হাসপাতাল, টিউবওয়েল বসানো ইত্যাদি কাজগুলো নিজেদেরকেই অর্থসংস্থান করতে হবে। বাস্তবে এটা সম্ভব ছিলনা। দুর্ভিক্ষের সময় এ তামাশা প্রকট হয়ে ওঠে।
ফ্যামিন কমিশন এদের রিপোর্টে প্রকারান্তরে এ কথা স্বীকার করে নেয় – “The severe cholera epidemic made the repair of tube wells a matter urgent public health importance … In November 1943 the Government drew the attention of all District Boards to the vital need of ensuring uncontaminated water supplies … The practical results of this step were negligible.”[40] কমিশনের রিপোর্টে “Previous Defects in the Public health Organization” অংশে বলা হয় – “The Department of public Health and Local Self-Government (Medical) under the charge of a Minister, is responsible for public health.”[41] যে প্রশ্নটি এড়িয়ে যাওয়া হল – এর অর্থ জোগাবে কে? উপনিবেশিক সরকার যুদ্ধ, territorial expansion এবং সামরিক প্রয়োজনে অর্থের সিংহভাগ ব্যয় করেছে। সেখানে জনতার স্বাস্থ্য বা জনস্বাস্থ্যের প্রসঙ্গ আদৌ বিবেচ্যই ছিলনা কেবলমাত্র মহামারির সময় ছাড়া। এরও কারণ ছিল, মহামারি সাদা-কালো, উপনিবেশিক-উপনিবেশিত মানেনা। ফলে মহামারি সামরিক বাহিনী ও সাদা শাসকদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়েছিল। একে রোখার জন্য নামমাত্র জনস্বাস্থ্যের ব্যবস্থা নেওয়া হয়ে এসেছিল।
কমিশনের রিপোর্ট জানাতে বাধ্য হচ্ছে – “Representatives of the District Boards who appeared before the Commission ascribed the inefficiency of the rural health and medical services to financial stringency … It is scarcely surprising that they failed to rise to the occasion.”[42] কমিশনের রিপোর্ট থেকে স্পষ্টভাবে জানা যায়, কলেরা এবং স্মল পক্সের মতো মহামারি মোকাবিলার ক্ষেত্রে হাসপাতালগুলো সম্পূর্ণত অনুপযুক্ত ছিল। শুধুমাত্র হাতে গোণা কয়েকটি বড়ো শহরে ঠিকভাবে হাসপাতাল কাজ করছিল। ফলে, ফ্যামিন ডায়ারিয়ায় যেসব রোগীরা আক্রান্ত হয়েছিল তাদের চিকিৎসা করার কোন ব্যবস্থাই সাধারণ হাসপাতালগুলোর ছিলনা।[43]
কমিশনের রিপোর্ট থেকে এটাও জানা যাচ্ছে, যে সমস্ত ডাক্তারদের দুর্ভিক্ষের কাজে নিয়োগ করা হয়েছিল তারা “in general of poor calibre.” যদিও এসব ডাক্তারদের বিস্তৃত বিবরণ পাওয়া যায়না এ রিপোর্ট থেকে তবে অনুমান করা যায় এরা সরকারি মেডিক্যাল কলেজ থেকেই পাশ করেছে (সে সময় বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজের অস্তিত্ব ছিল এরকম কোন নথি আমার গোচরে নেই)। তাহলে মেডিক্যাল কলেজগুলোর শিক্ষার মান সে সময় কি আশাপ্রদ নয়, যে কারণে কম যোগ্যতা সম্পন্ন ডাক্তারদের নিয়োগ করতে হচ্ছে? এর উত্তরও কমিশনের রিপোর্টেই রয়েছে – “The poor standard of the civilian doctors must be ascribed largely to defects in their medical education.” নভেম্বর, ১৯৪৪ অব্দি ২৫,৫৫১ জন ফ্যামিন হাসপাতালগুলোতে এবং ২০৩,৭০২ জন রোগী জেলার হাসপাতালগুলোতে ভর্তি হয়েছিল। কলকাতায় ৮,৯১২ জন (৩৪.৮%) এবং জেলায় ২২,৯৯২ জন (১১,৩%) মারা গিয়েছিল।[44] রিপোর্টে এটাও স্বীকার করে নেওয়া হয়েছিল যে দুর্ভিক্ষের এই ইমার্জেন্সি অবস্থা “revealed the serious defects of the public health organization in the districts.”[45]
রিপোর্টের সিদ্ধান্ত ছিল – “বাংলায় সামগ্রিকভাবে আরও অনেক হাসপাতালের প্রয়োজন এবং সমস্ত রকমের চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে যাতে সাময়িকভাবে দুর্ভিক্ষ ও রিলিফের জন্য তৈরি সংগঠনগুলোকে প্রদেশগুলোতে চিরস্থায়ী চেহারা দেওয়া যায়।”[46]
কোভিডের সময়কালে আমরা দেখেছি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোর প্রায় অনুপস্থিতি এবং ভঙ্গুর প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার জন্য মানুষের আর্ত অবস্থার মোকাবিলা ভালোভাবে করতে পারিনি। এরকম এক প্রেক্ষিতে ফ্যামিন কমিশনের রিপোর্ট এখনও কিছু প্রাসঙ্গিকতা বহন করে। আরেকটি বিষয় হল, বাংলার পঞ্চাশের মন্বনত্র নিয়ে বিস্তর লেখালেখি হয়েছে – অমর্ত্য সেন, তারকচন্দ্র দাস, পি সি মহলানবিশ থেকে হালের জনম মুখার্জি এবং অন্যান্যদের অতি মূল্যবান গবেষণার ফসল। কিন্তু মন্বন্তরের সময়কার চিকিৎসা, অসুখ, স্বাস্থ্যব্যবস্থা এবং জনস্বাস্থ্যের হাল নিয়ে উল্লেখযোগ্য গবেষণা প্রায় নেই বললেই চলে। সে ফাঁক ভরাট করার লক্ষ্যে এ প্রবন্ধ একেবারেই প্রাথমিক একটি পদক্ষেপ।
_________________
[1] Famine Inquiry Commission: Report on Bengal (1945), ১৪৭।
[2] Amartya Sen, Poverty and Famines- An Essay on Entitlement and Deprivation (USA: Oxford University Press, 1983), ৫৩.
[3] Ibid, ৫৫.
[4] তদেব, ৫৭।
[5] Nikhil Srakar, tr. Satyabrata Datta, A Matter of Conscience: Artists Bear Witness to the Great Bengal Famine of 1943 (কলকাতাঃ পুনশ্চ, ১৯৯৮), ২৫.
[6] তদেব, ৫২.
[7] নিউ ইয়র্ক টাইমস, ডিসেম্বর ১৯, ১৯৪৩, পৃঃ ৩৩।
[8] নিউ ইয়র্ক টাইমস, নভেম্বর ২২, ১৯৪৩, পৃঃ ৪।
[9] তদেব।
[10] Subin Pal and David Dowling, “Gandhi’s Newspaperman: T. G. Narayanan and the quest for an independent India, 1938-46”, Modern Asian Studies, 2019, 54 (2): 1-31.
[11] T. G. Narayan, Famine Over Bengal (Calcutta: The Book Company Ltd., 1944), 157.
[12] তদেব, ১৬১।
[13] তদেব, ১৭০।
[14] তদেব, ১৭১।
[15] তদেব, ১৭২।
[16] তদেব, ১৭৩।
[17] তদেব, ১৭৪।
[18] তদেব, ১৭৪-১৭৫।
[19] Janam Mukherjee, Hungry Bengal: War, Famine, Riots and the End of Empire (India: Harper Collins, 2015), 188-189.
[20] T. C. Das, Bengal Famine (1943), as Revealed in a Survey of the Destitutes in Calcutta (Calcutta: University of Calcutta, 1949), ৬৫।
[21] তদেব, ৯৩।
[22] Famine Inquiry Commission: Report on Bengal (1945), ১১২।
[23] তদেব, ১১৫।
[24] তদেব, ১১৬।
[25] তদেব, ১১৭।
[26] তদেব, ১১৭।
[27] তদেব। ১১৭।
[28] “Treatment and Management of Starving Sick Destitutes (Prepared by The Committee of Enquiry into Effects of Starvation, Indian Research Fund Association)”, Indian Medical Gazette (February, 1944): 74-81.
[29] তদেব, ৭৪-৭৫।
[30] তদেব, ৭৭-৭৮।
[31] তদেব, ৭৯-৮০।
[32] তদেব, ৭৫।
[33] তদেব, ৭৭।
[34] Famine Inquiry Commission: Report on Bengal (1945), ১১৯।
[35] তদেব, ১২০।
[36] তদেব, ১২৪।
[37] তদেব, ১২৫।
[38] তদেব, ১২৫।
[39] তদেব, ১২৬।
[40] তদেব, ১২৮।
[41] তদেব, ১৩২।
[42] তদেব, ১৩৬।
[43] তদেব, ১৩৮।
[44] তদেব, ১৩৯।
[45] তদেব, ১৪০।
[46] তদেব, ১৪১-১৪২।
So basically we haven’t learned anything! Even before infamous t Bengal famine, Gandhi has written in his book how Indians used to live in ghetto in South Africa and their callous attitude towards cleanliness and hygiene. Sometimes I really feel if the whole blame should be put on government and common people also were also responsible for what happened to them.
even today Bengalis have the same attitude. Few months back I was in Bolpur for few weeks. Mosquito is a major issue here. In the middle of the twin there is pond – it’s so dirty that looking at I was about to throw up. Locals cleans their clothes, utensils in that dirty water nonchalantly but can’t get together to clean up the place. with such attitude No government can help! And all these studies seem so futile!
Thanks,
Kamal Taparia
আরো একটি মূল্যবান প্রবন্ধ!
বিংশ শতাব্দীতে পৃথিবীর তিনটি দেশে/প্রদেশে (ইউক্রেন (১৯৩২-১৯৩৩, বাংলা (১৯৪৩-১৯৪৪, এবং চীন (১৯৬১-১৯৬২) ভয়ংকর খাদ্যাভাব, দুর্ভিক্ষ, এবং মহামারীতে প্রায় চার কোটি মানুষের মৃত্যু হয়, এবং পরবর্তী সময়ে দুর্ভিক্ষের পরেও যারা বেঁচে গেছেন, তাঁদের উত্তরসূরীদের নানারকম স্বাস্থ্যসংক্রান্ত সমস্যা দেখা দেয় | এর মধ্যে যেটি বিশেষ করে তাৎপর্যপূর্ণ, প্রতিটি ক্ষেত্রেই দুর্ভিক্ষ মানুষের বিশেষ করে শাসকের অব্যবস্থার কারণে উদ্ভুত, এবং তার খেসারত দিতে হয়েছে সাধারণ মানুষকে তাদের প্রাণ দিয়ে।
এদের মধ্যে বাংলা এবং ইউক্রেনের মন্বন্তর অনেকটা মিল রয়েছে উভয় দেশেই শাসকদের উদাসীনতায় অল্পবিস্তর ২০-৪০ লক্ষ মানুষের প্রাণহানি হয়। বাংলার ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে যে অন্তত ফসল ফলে নি তা নয়, তবে প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং শাসকের চূড়ান্ত ইচ্ছাকৃত অব্যবস্থার কারণে মানুষ অসহায়ভাবে মারা গেছেন।
মনে হয় আজকের দিনে হয়ত সেযুগের মতন ভয়ংকর দুর্ভিক্ষের সম্ভাবনা আর নেই, তবে পর্যাবরণের পরিবর্তনের কারণে যে ভয়ংকর দিন আসছে না, তা বলা যাবে না, এখনো বহু মানুষ বিভিন্ন দেশে অপুষ্টিজনিত কারণে প্রায় দুর্ভিক্ষের মতন অবস্থায় প্রাণ হারাচ্ছেন। যে কারণে এই ধরণের লেখা এবং বিস্তারিত বিশ্লেষণের বিশেষ প্রয়োজন রয়েছে।
সুলিখিত প্রবন্ধ।তবে ঈস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অসীম লাভের জন্য খাদ্যশস্য মজুদ করে রাখা(ইয়াং হাসবেন্ড লিখিত) বা বাংলার এক তৃতীয়াংশ মানুষের অনাহারে মৃত্যুর পরেও কোম্পানির মুনাফাবৃদ্ধির (ওয়ারেন্ট হান্টার) উল্লেখ থাকলে হয়তো বাস্তব পরিস্ফুট হতো।
সরকার স্বাস্থ্যখাতে কবেই বা যথোপযুক্ত যত্নবান হলো? এ পরিবর্তনে অপরিবর্তনীয়।
দীপঙ্কর
Undoubtedly another well researched paper .Jayanto shoud be congratulated for opening up — a new window on the state of poor health cosiousnes — on the part of ruling dispenssions of that tragic days of 1943 — which is painfully etched in my mind ( I was 8yrs. school going child in colonial Calcutta at that time). I am surprised and dismayed to see Kamal Taparia’s — rather disjointed comment on Jayanta’s seminal acdemic write up. His comment reflects his lack of real academic comprhension of this dreadfull event which rocked the international minds of the time and still moves any seriosly compassionate soul. He braught up in an ugly manner of Bengali peoples — way of life style — a description fits even more dearly in various corners of the country — including Gujarat and Rajasthan — which I personally experienced due to my peripatetic service life over large swath of my country. His comments smack of early biased statement against Bengali people.
খুবই বেদনাদায়ক চিত্র, বরাবরের মত তথ্যসমৃদ্ধ , অনবদ্য লেখনী।
In my view, the cause of Bengal famine of 1943 could be attributed to general speculation, war profiteering, abysmal policy/ lacklustre attitude and antipathy of the govt towards native Indians,and exhaustive use of Indian resources as war effort across the globe by the British empire, apart from natural causes, viz drought, cyclone, flooding and diseases that followed suit because of unhygienic living conditions at that time. The starvation led to Inanition, which affected the immunity to fight the diseases. Lack of medical facilities those days made the situation worse.
অনেক তথ্য সংগ্রহ করে আপনি মন্বন্তরের যে হতাশাজনক চিত্র উদ্ধার করেছেন তাকে আমাদের শিক্ষা হিসাবে গ্রহণ করে জনস্বাস্থ্যের ওপর ক্রমবর্দ্ধমান প্রগতির দিকে ব্রিটিশ সরকার নজর দেন নি। স্বাধীনতার পরে বিক্ষিপ্তভাবে কাজ হয়েছে, কিন্তু ধারাবাহিকতা থাকে নি। এখন তো স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ক্রমশঃ বেসরকারী হাতে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। শুনেছিলাম এক বয়স্ক LMF ডাক্তারের মুখে TABC injection নেওয়ার সময়, রোগের চিকিৎসার দিকে নয়, আগে রোগ না হওয়ার ব্যবস্থা নিতে হবে। সেই দর্শন সরকারের নীতিতে এখনও দেখি না।
চমৎকার লেখা। অভিনন্দন, ডঃ জয়ন্ত ভট্টাচার্য।