আজ বাঙালি মা আর রবীন্দ্রনাথ, দুজনকে একসঙ্গে উদযাপনের সুযোগ পেয়েছে। এ কম বড় কথা নয়। আসলে রবীন্দ্রনাথ মনে হয় ভুল করে বাঙালি। কারণ, রবীন্দ্রনাথ যা ভাবতে পেরেছিলেন, এত বছরেও বাঙালি জাতি তার ধারেকাছে যেতে পারেনি। অদূর ভবিষ্যতে পারবে বলেও মনে হয় না।
সেই কবে তিনি লিখেছিলেন, মা খোকাকে বলছেন, “ইচ্ছে হয়ে ছিলি মনের মাঝারে”। কিন্তু আজও আমরা মানতে শিখলাম না, মা হতে চাওয়ার ইচ্ছেটা জরুরি। এ দেশে মা হব কিনা, এ নিয়ে প্রশ্ন তোলাটা আজও অপরাধ। আসলে motherhood should be a choice এটা শুধু বইয়ের পাতাতেই আটকে থাকলো।
ফেসবুক স্ক্রোল করলেই মায়ের সঙ্গে ছবি! আবার অনেকেই বলেছেন, মায়ের জন্য বছরভর বরাদ্দ, একটা দিনে আটকে কেন থাকবো! কিন্তু, মাতৃত্বের এই উদযাপনে একটা প্রশ্ন যেন, আমরা আড়ালে রাখতেই ভালোবাসি! মা সন্তানকে স্নেহ করেন, আবার সন্তানের নিশ্চিন্ত নিরাপদ আশ্রয়স্থল মা, এ তো চিরন্তন সত্য। কিন্তু এই সবের পরেও আমাদের কাছে একটা ধারণা যেন অস্পৃশ্য হয়ে আছে, আর সেটা হলো ইচ্ছুক মাতৃত্ব বা উইলিং মাদারহুড!
আমাদের কাছে পেরেন্টহুড বিষয়টাই একটা শহুরে বিলাসিতার মতো ধারণা। কারণ, যে রাজ্যে ৪২ শতাংশ নাবালিকার বিয়ে হয় ও নাবালিকা মায়ের হিসাবে যে রাজ্য প্রথম সারিতে আছে (সাম্প্রতিক ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে রিপোর্ট সে কথাই জানিয়েছে), সেখানে মাতৃত্ব বিষয়টি এখনো বাধ্যতামূলক হয়েই রয়েছে ।
আমি একজন ইচ্ছুক মা। কিন্তু প্রতিদিন মায়ের ভূমিকায় উপলব্ধি করছি, এই পথ চলা শুধু সুন্দর নয়। অনেক বড় দায়িত্ব। এই দায়িত্বে ভুল হলে অনেক বড় মাশুল গুনতে হবে। আর সেই ক্ষতি শুধু হয়তো ব্যক্তিগত স্তরে আটকে থাকবে না। কারণ, একটি শিশু ভালো মনের মানুষ না হলে তা সমাজের পক্ষেও ক্ষতিকারক। তাই যাঁরা মাতৃত্বের যাত্রাপথকে শুধুই সুন্দর বলেন, আসলে কিন্তু তা অর্ধসত্য। মাতৃত্বের সবটুকু সোনার খামে মোড়া হয় না।
সকলের জীবনবোধ এক নয়। জীবন যাপনের ইচ্ছেও এক নয়। বাচ্চা ‘হওয়ার’ জন্য সবাই বিয়েও করে না। একথা আমরা বুঝি না। বুঝতে চাই না। কারণ, এ দেশে মা হবো না, এ কথা বলাটা অন্যায়। তার মতো খারাপ মেয়ে আর একখানাও হয় না। কারণ, আজও আমরা মনে করি মাতৃত্বেই নারীর স্বার্থকতা। আর কেরিয়ার কিংবা অন্য জিনিস নিয়ে যে মেয়ে ভাবে, সে কেন বিয়ে করবে, এ প্রশ্নের উত্তর আজও আমাদের গবেট মস্তিষ্ক পায় না। তাই বৌভাতের পরের দিন থেকে চোখ টেপাটিপি করে নতুন বৌয়ের কানের কাছে বাচ্চা নিয়ে ফিসফিস করা থেকে নিজেদের আটকাতে পারি না।
আজকে আমরা যাঁরা, নাচ-গান-কবিতায় রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করছি, তাঁরাই কাল থেকে পাড়ার কোন বৌয়ের বাচ্চা বিয়ের কতদিন পরে হলো না, সে হিসেব করতে খাতা-কলম নিয়ে বসে পড়বো। আসলে, রবীন্দ্রনাথ তো আমাদের মননে কোনও দিন ছিলেন না। তাঁকে বোঝার মতো বোধশক্তি আমাদের নেই। তাই রবীন্দ্রনাথের উদযাপন করি না। শুধু নাচ-গান করে আমোদ করি।
আর মাতৃত্ব! সে তো এ দেশে কোনও কালেই উদযাপন হয়নি। কারণ, মা হওয়া এ দেশে আবশ্যিক। আর যার মধ্যে বাধ্যবাধকতা থাকে, তাতে উদযাপন হয় না। এ দেশের মায়েরা ‘নিরূপা রায়’ কিংবা ‘সন্ধ্যা রায়ে’র বাইরে কিছু হলেই ভ্রু কুঁচকে যায়। কারণ, মা তো সব পারে, এই কথাটা বলে আমরা মায়েদের উপরে অনেক অন্যায় সহজই করে ফেলতে পারি।
তবে, এই বস্তাপচা ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে সময় এসেছে কিছু বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তোলার। কারণ, এতো চলছে, এ কখনো বদলানো যাবে না, এই মানসিকতাই আমাদের সীমা অতিক্রম করতে দেয় না। বরং প্রতি দিন প্রশ্ন তুললে একদিন হয়তো ছবিটা বদলে যাবে! কেউ কেন মা হবে, এই প্রশ্ন যেমন জরুরি, তেমনি কীভাবে সে সন্তানের জন্ম দেবে, সে নিয়েও তাদের জানা দরকার।
এ দেশে অধিকাংশ ক্ষেত্রে মেয়েরা মা হয়, কারণ, বাচ্চা না থাকলে বর সঙ্গে থাকবে না, একা একা সারা জীবন কাটাবে কী করে, এই সব আজগুবি কারণের জন্য। সচেতনভাবে মা হওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ খুব কম মেয়েই পান। তাই মাতৃত্বের অধ্যায়ের প্রথম পর্ব থেকেই মেয়েদের চয়েসের অধিকার তেমন পাত্তা পায় না। তারপরের প্রশ্ন, একটি মেয়ে কীভাবে তার সন্তানের জন্ম দেবে। সিজার নাকি স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায়। দিন কয়েক আগেই রে রে আওয়াজ উঠেছিল, সিজার অডিট নিয়ে। রাষ্ট্র বা সমাজ কেউ বলে দিতে পারে কি মা কীভাবে সন্তানের জন্ম দেবেন? এটা একান্ত মা ও তার চিকিৎসকের সিদ্ধান্ত হওয়া উচিত। অর্থাৎ, মাতৃত্বের প্রত্যেক ধাপেই এই চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতা। আর এর প্রতিফলন আমরা দেখি সন্তানকে বড় করে তোলার পর্বে। যে মায়ের চয়েসের অধিকার নেই, অধিকাংশ ক্ষেত্রে সে সন্তানের ক্ষেত্রে ও চাপিয়ে দেওয়ার রাস্তাতেই হাঁটেন। কারণ, বাকি পথগুলো তো তার অজানা।
তাই মাকে নিয়ে ভাবার সময়, আরও একধাপ মাতৃত্বকে নিয়ে আমরা ভাবতে শিখলে পরবর্তী প্রজন্ম হয়তো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে শুধু মুখস্থ নয়, আত্মস্থ করতেও শিখবে।