আজ সন্ধ্যের খবরে দেখাল, শিলিগুড়ি থেকে নাকি কাঞ্চনজঙ্ঘার দেখা পাওয়া যাচ্ছে। ভাগ্য ভালো থাকলে, আবহাওয়া ভালো থাকলে, শিলিগুড়ি তথা উত্তর বাংলার নানা জায়গা থেকেই এ’রকম মাঝে মধ্যে দেখা যায়। সেই তুষারমৌলিকে, আমি তো শিলিগুড়িতে বছরের সারা সময় থাকিনি কখনও, তাই দেখিনি।
কিন্তু কেউই কি জানে, শিলিগুড়ি ‘থেকে’ নয়, খোদ শিলিগুড়িতেই কাঞ্চনজঙ্ঘার দেখা পেয়েছিলাম আমি? ওই রকমের বিরাট। ওই রকমের অপ্রত্যাশিত। ওই রকমের অভাবনীয়।
গল্পটা শোনাই তোমাদের।
২০২০ সালে আমাকে কালিম্পং যেতে হয়েছিল। না, সেই স্বর্গের বিবরণ বহুবার এই ফেসবুকে শুনিয়েছি। নতুন করে আর বলব না। কিন্তু সেই স্বর্গে প্রথমবার যাবার সময়ের এই ভূমিকাটি শোনাব, অনেকদিনই ভেবেছি। কিন্তু শোনানো হয়নি।
বলা হয়নি, সে আমার ভুবনবিদিত বহুনিন্দিত আলস্যের জন্য। নাকি এমনও হতে পারে, ‘এ’ স্বাদের ভাগ হবে না’ এই ভেবে তাকে ‘হিয়ার মাঝে’ লুকিয়ে রেখেছিলাম।
তা’ সে রেখেছিলাম বেশ করেছিলাম। আজ কেন ঝাঁপি খুলে, ‘মেরা মন ডোলে রে’?
সে’ও আরেক গল্প। আজকেই কথায় কথায় আমার কন্যা মনে করাল।
সেই অনেকের-মধ্যে-এক আমার অনন্যা মেয়ে যখন হুকুম করল, – বলো বলো, আমার অন কথা সবাইকে বলো, ঝরঝর করে ঝরে পড়ল আমার সেই ঝোড়ো সময়ের স্মৃতিমালা।
কেন, কী কারণে কালিম্পং যেতে হল সে তোমরা জানো। পাহাড়কে স্বাস্থ্য ভবনের কর্তারা ভাবে, বাংলার সাইবেরিয়া। আর আমি ছিলাম সাইবেরিয়া যাত্রী এক আইভ্যান।
বাড়িতে তখন আমার বাবা মৃত্যুশয্যায়। থাক, সে কথাও থাক। আমার কাছে কাঞ্চনজঙ্ঘা নিজেই যে এসেছিল সেই কাহিনি বলি।
আমি বিদেশ তো দূর কথা নিজের দেশ ঘোরা মানুষও আদৌ নই। কী করে ট্রেনে অনলাইন বুকিং করে, সেই প্রকরণ আমার অনায়ত্ত। কুছ পরোয়া নেই। আমার বড়ছেলে, ওই কী বলে তৎকাল, সে আবার যে সে তৎকাল নয়, তিন গুণ মূল্যের প্রিমিয়াম তৎকাল বুক করে দিল দার্জিলিং মেলে।
যদিও আমি নিজেকে বাইশ বছর বয়সী শিং ভাঙা বাছুর ভাবি নিজেকে, মেঘে মেঘে বেলা তো পঁয়ষট্টি! রাস্তা না চেনা আমার সঙ্গে অথচ এই যাত্রায় বাড়ির কেউ নেই।
কী করে থাকবে বলো? আমার বাবার যে তখন, এখন তখন অবস্থা! বাড়ির অন্যরা ব্যস্ত ওঁকে নিয়ে, নার্সিং হোমে। উনি চলে যাবেন আর দিন পঁচিশেকের মাথায়।
আমার ট্রেন ছাড়ল শেয়ালদা’ থেকে রাত্তিরে। পরদিন ভোর বেলায় এক চেনা নম্বর থেকে ফোন এল, – স্যার, আপনি এখন কোথায়?
বয়স হবার এই এক বিপদ। নাইটহুড না পেয়েও, শিক্ষক বা চাকরির বস্ না হয়েও, স্রেফ বয়েসগুণেই ‘স্যার’ হওয়া যায়। সত্যি বলতে কী, আমার অনেকের-মধ্যে-এক এই কন্যাটিও ওই ‘স্যার’ই বলত আমাকে প্রথমে। অবশ্য ভুল নামে ডাক যে আমাকেই একা শুনতে হয় তা’ নয়। সংসারে অনেককেই এই রকম ভুলভাল ডাক শুনতে বাধ্য করা হয়।
উদাহরণ? কোন মহিলার পাণিগ্রহণ না করেও সন্ন্যসীরা ‘স্বামিজী’, কোনও ঐহিক জমিজমার মালিক না হয়েও তাঁরা ‘মহারাজ’। তেমনি হাসপাতালে, একজন ছাত্রকে না পড়ালেও, ওয়ার্ড-মাস্টারকে মাস্টার-মশাই বলে ডাকে আপামর সহকর্মী আর ডায়েট কন্ট্রাক্টররা।
এই দেখুন, কী কথার থেকে কী কথায় চলে এলাম।
আমার মা ছেলেবেলায় বলত, – এই বেশি কথাই তোর কাল।
তো বড় হয়ে দেখলাম, খালি কাল নয়, কথাই আমার আজ কাল আর পরশু। বেশি কথার শতেক দোষ। পারম্পর্য থাকে না।
হ্যাঁ, যা বলছিলাম। ফোন।
ঠিক কথা, শিলিগুড়িতে থাকা এক ছেলেকে আমি ফোন করেছিলাম, পথের হদিশ নিতে। তাই বলে সে যে নিজেই ঘড়িতে অ্যালার্ম দিয়ে কাক-ভোরে ঘুম থেকে উঠে আমার তালাশ করবে, কে ভেবেছিল?
তা ভালো, খোঁজ নিচ্ছে নিক। পেছন দিকে ছুটে যাওয়া চলন্ত স্টেশনের নাম পরম আলস্যে পড়ে তাকে জানালাম। জানিয়ে ফের ঝিমোচ্ছি। এ’দিকে ট্রেন নিউ জলপাইগুড়িতে আউটার সিগন্যালে পৌঁছে গেছে। এমন সময় আবার ফোন, – স্যার আমি দাঁড়িয়ে আছি। ওভার ব্রিজের ওপরে।
আমি যাকে বলে, চমকে চ হয়ে গেছি। কী কাণ্ড! শুধু সেই কবে ফোনে জিজ্ঞেস করেছি বলে সেই ছেলে স্টেশনে এসে দাঁড়িয়ে আছে! যে আমার মুখটাও চেনে না!
ও যদি আমার নিজের ছেলে হত, এর বেশি কী করত?
জিজ্ঞেস করলাম, – কেন এত কষ্ট করলে শুধু শুধু?
ফোনেই হাসল ছেলে।
-বাঃ রে, আপনাকে বাসে চাপিয়ে দেব তো? আপনি তো যা বুঝেছি কিচ্ছুটি চেনেন না এ’দিকের।
ইতিমধ্যে ট্রেন ঢুকে পড়েছে স্টেশনে। হাঁচোড়পাঁচোড় করে নেমেছি। বিভ্রান্ত আমাকে খুঁজে বার করেছে সেই। ব্রেকফাস্ট ইত্যাদি করিয়ে নিজের গাড়ি করে বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে দিয়েছে।
না, তারপরেও ছাড়েনি। মানে ছাড়বার সুযোগ দিইনি, চির বেভুল আমি। বাসে উঠেছি। ওঠার সময় যথারীতি কালিম্পং না বলে কার্শিয়াং বলে, ভুল একটা বাসে উঠেছি। গুছিয়ে বসেছি। দুয়েক কিলোমিটার যাবার পর সহযাত্রীদের সঙ্গে কথায় ভুল বাসের ব্যাপারটি ধরা পড়েছে। সেই ছেলেকে ফোনে জানাতেই সে তৎক্ষনাৎ নেমে পড়ার নির্দেশ দিয়েছে। গাড়ি করে ফের অকুস্থলে পৌঁছেছে। কালিম্পং-যাত্রী এই ধেড়ে খোকাকে উদ্ধার করে সঠিক যানে উঠিয়ে দিয়েছে পানিট্যাঙ্কি থেকে।
এই ছেলে, যার মুখ অবধি চিনতাম না, শুধু গলাটা চিনতাম, সে কোন দয়ায় এই অভাগাকে উদ্ধার করেছিল, সে’ই জানে। অথবা জানে না। কাঞ্চনজঙ্ঘা কি জানে, সে কত বিরাট আর মহামহিম?
তার সঙ্গে পরে আলাপ বেড়েছে। ছেলে মেডিকেল কলেজে অ্যানাটমির টিচার। আবার শিলিগুড়ি কাঁপানো বিরাট রেডিওলজিস্টও বটে।
আরও পরে ভার্চুয়ালে আলাপ ঘন হয়েছে। খুব ভালো বাংলা গদ্য-পদ্য-প্রবন্ধের হাত তার। বঙ্কুবাবুর বন্ধুরা বলে এক গ্রুপ আছে। সেখানে লিখে কাঁপায়!
আমার ব্যক্তিগত অসুখে আর মানসিক বিপর্যয়ের ক্ষণে, সময় নেই অসময় নেই, কত পরামর্শ দিয়েছে।
যখন কোভিড হল আমাদের পরিবারের সবাইয়ের প্রতিদিন খোঁজ নিয়েছে শুধু না, পরামর্শও দিয়েছে। অনির্বাণ, মতিউরদা, ঐন্দ্রিল, আরও কতজনের সাহায্য না পেলে উদ্ধার পাওয়া সত্যিই মুশকিল হত।
কিন্তু এতক্ষণ যার কথা বলেছি, সেই ছেলে, সে নিজেও জানে না যে আমার কাছে সে আসলেই কাঞ্চনজঙ্ঘা। আমি কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখেছিলাম। শিলিগুড়ি থেকে নয়, শিলিগুড়িতেই।
শুধোতে ইচ্ছে করে, কেন? কেন?
আলাপ হয়নি আজও, এই মুখ আদৌ চেনোনা,
ভিখিরিকে না চিনেই, ভিক্ষাপাত্রে ঢেলে দিলে সোনা!
সে শুধু ভিখিরি নয়, ভালোবাসা পেলে… ক্রীতদাসও!
শুধু বলো, কেন ভালোবাসো…
★
খুব ভালো থাকিস, স্মরণ।