আমার মা শ্রীমতী আরতি ভট্টাচার্য আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে একটা স্কুল শুরু করেছিলেন। তখন তিনি ত্রিশ-এর গন্ডি পেরোননি। সদ্য এম এ পাশ করে রিসার্চ করছেন, হাতে সরকারি কলেজের নিয়োগপত্র। কিন্তু মেয়েদের স্কুল তৈরি করার জেদ তখন পেয়ে বসেছে তাঁকে। সঙ্গী আরো ক’জন তরুণী–মনিকা মাসি, গৌরী মাসি ও আরো ক’জন। মাইনে পত্তর পাবার আশা নেই, বাড়ি থেকে চেয়ার টেবিল, মাদুর, পাটি নিয়ে শুরু হয় স্কুল। বাড়ি বাড়ি ঘুরে সংগ্রহ করা হয় ছাত্রী, তারা বেশির ভাগ সমাজের পিছিয়ে পরা বাড়ির মেয়ে, যাদের পড়াশোনার কথা কেউ কখনো ভাবেনি, কারণ তারা যে আর্থসামাজিক শ্রেণীর সেখানে মেয়েদের পড়াশোনার কথা ভাবা ছিল অসম্ভব।
এই ছাত্রী সংগ্রহ আমার মাকে অনেকদিন করতে হয়েছে। ছেলেবেলায় ভোর থাকতে উঠে আমি আর বাবা, মায়ের সংগে এই অভিযানে বেরোতাম। বাড়ি বাড়ি গিয়ে মা বোঝাতেন। সে মেয়ে তখন নেহাৎই শিশু হলেও হয়তো উপার্জন করে, সে যুগে শিশুশ্রম নিষিদ্ধ হয়নি, সে শিশুর উপার্জন সংসার চালানোর জন্য অত্যন্ত জরুরি। এই অবস্থায় সে বাড়ির মানুষদের রাজি করানো বড় সোজা কাজ ছিল না। প্রথমে ভাড়া বাড়ি তারপর স্থানাভাবে স্কুল উঠে যাবার উপক্রম। আবার মায়ের সঙ্গে আমি (তিন চার বছর বয়স আমার তখন) আর বাবা দরবার করতে চলেছি ডি এম, এস ডিও, পঞ্চায়েত-এর অফিসে। পাড়ায় পাড়ায়, গ্রামে গ্রামে গিয়ে মানুষকে বোঝানো মেয়েদের স্কুল কত জরুরি। এই করে একদিন স্কুলের বাড়ি হল, সরকারি স্বীকৃতি হল। সে টিনের বাড়ি, মুলিবাঁশের দেওয়াল, নীচে বালি। গ্রীষ্মে প্রচন্ড গরমে মা প্রায় দিন মাইগ্রেনের ব্যাথা নিয়ে ফেরেন কিন্তু যতদিন ছাত্রীদের ঘরে ফ্যান লাগেনি টিচার্স রুমেও ফ্যান লাগান নি।
স্কুলটা ছিল আমাদের পরিবারের বর্ধিত অংশ। স্কুলের দিদিমণিরা আমার মায়ের বোন আর আমার সব মাসি (নিজের মাসি না থাকার অভাব তাঁরা কোনদিন বুঝতে দেননি) আর ছাত্রীরা আমার দিদি। একদম ছোট বেলায় সেই দিদিরা বিকেলে এসে আমাকে কোলে করে বেড়াতে নিয়ে যেত। মার অসুখ করলে সবাই দেখতে আসত। তারা নিজেরাই বিস্কিটের কৌটো খুলে বিস্কুট খেত, কুঁজো থেকে জল গড়িয়ে নিত। বহুদিন গিয়েছে মা বউ মাসি (মেট্রন)-কে দিয়ে চিঁড়ে মুড়ি বাতাসা আনিয়েছে স্কুলে সেই দিদিদের জন্য, তারা অনেকেই খেয়ে আসত না স্কুলে।
সেই স্কুল ধীরে ধীরে বড় হল। পাকা বিল্ডিং হল। ঘরে ঘরে ফ্যান আলো হলো। শয়ে শয়ে ছাত্রীরা পড়াশুনো করে, পাশ করে কলেজে গেল। মা সময় মেনে প্রধান শিক্ষিকার পদ থেকে অবসর নিলেন। কোন রাজনৈতিক দলের তাঁবেদারি করেননি। সে সময়ের শাসক দলের দোর্দণ্ডপ্রতাপশালী নেতা নিজের অযোগ্য সন্তানকে অনৈতিক ভাবে শিক্ষিকা পদে ঢোকাতে প্রাণপণ চেষ্টা করলে মা রুখে দাঁডিয়েছেন। যোগ্য প্রার্থীর চাকরি পাওয়া সে নেতা গোষ্ঠী আটকাতে পারেনি। মা প্রাণনাশের হুমকির সামনেও অবিচল থেকেছেন। জীবনে আপোষ করেননি কোনদিন। তাই সরকারি বা বেসরকারি স্বীকৃতি হয়তো পাননি। কিন্তু যা পাওয়ার জন্য সারাজীবন কাজ করেছেন তা দুহাত ভরে পেয়েছেন।
এই পঞ্চাশ বছরে শয়ে শয়ে মেয়েরা পড়াশোনা শিখেছে, তারা বেশির ভাগ প্রথম প্রজন্ম যারা স্কুলে গিয়েছে। হয়তো হাজার প্রতিকূলতার সাথে যুদ্ধ করে তারা বিরাট বড় সাফল্য পায়নি, কিন্তু যে জ্ঞানের প্রদীপ এই স্কুল তাদের মধ্যে জ্বালিয়ে দিয়েছে তা নিশ্চয়ই পরবর্তী প্রজন্মকে সাফল্যের শিখর ছুঁতে সাহায্য করেছে।
আমার মায়ের এবং তাঁর কমরেড বাকি দিদিমণিদের এই পরিশ্রম এই ত্যাগ আজ হাজার হাজার ঘরে জ্ঞানের আলো, শিক্ষার আলো হয়ে জ্বলছে। আর একজন মানুষ যিনি সারাজীবন শুধু পাশে থেকে নয় সক্রিয় ভাবে নিরলস কাজ করে এই স্কুলের সংগে৷ থেকেছেন তিনি আমার বাবা। এই স্কুল আজ পঞ্চাশ বছর পূর্তি উৎসব করছে। “ভবেশ চন্দ্র বালিকা বিদ্যালয়” কতিপয় শিক্ষিকার পরিশ্রমের ফসল, গর্বের সঙ্গে বলতে পারি আমার মা সেই শিক্ষিকাদের এবং শত শত ছাত্রীদের “বড়দি”।