চকগুড়দহ গ্রামের বিপিন তালুকদারের ছোট মেয়ের আজ বিয়ে। বড়টার বিয়ে হয়ে গেছে বছর পাঁচেক আগে। এরা দুই বোন। মানে বিপিনের দুইটিই সন্তান। প্রথম মেয়ের বিয়েতে বিশেষ ভুগতে হয়নি বিপিনকে। সে একটু ফর্সা এবং লেখা পড়াতে মাঝারি ধরনের হওয়াতে কামদেবপুরের হারাধন সরকারের ছেলের সাথে অল্প আয়েশে বিয়েটা হয়ে যায়। তারা সম্পন্ন চাষি। বিশ বিঘে জমির মালিক। বেশ ধান পাট সব্জি চাষ হয় সেখানে ।
সে তুলনায় ছোট মেয়ে কিঙ্করী নিতান্তই এলে বেলে। কালো রোগা আর তার মাথার এক ঢাল চুলে কখনও অযত্নে জট পড়ে যায়। সে বড় ভক্তিমতী। বিপিন তার ভিটে বাড়ির লাগোয়া একফালি জমিতে একটা কালি মন্দির তৈরি করেছে। এ জমি বিপিনের নয় তবুও একখানা চালা তুলে বিপিন সেটাকে মন্দিরের রূপ দিয়েছে। কিঙ্করী সেখানে প্রতিমাকে মালা পরায় পুজো করে আর সাধনা করে । বিয়ের কথা বললে ঘাড় বেঁকিয়ে থাকে। জানা শোনার মধ্যে দু’চারজন কনে দেখে গেছে। তবে সুসংবাদ কেউ দেয়নি। বিপিন বড় চিন্তাতেই আছে।
সে যে কি সাধনা করে, সে নিজেও জানে না। তবে আশ পাশের লোকজন তাকে একটু ভয়ভীতির চোখে দেখে। আবার অনেকে বলে সে তন্ত্র সাধনা করে। ডাকিনী তন্ত্র। দেবু মাষ্টার নাকি দেখেছে সে পাঁঠা বলির পাঁচ কেজি ওজনের খড়্গটাকে ঝামা দিয়ে ঘসে চকচকে করে। আর তেল সিঁদুরের টিপ পরিয়ে মন্ত্রপূত করে রাখে।
এ অস্ত্রখানা ছিল আদতে কালু সর্দারের ব্রহ্মাস্ত্র। কুশডাঙার কালু সর্দার তল্লাটের ত্রাস। একবার গ্রামে নামলে বাড়ির পর বাড়ি উজাড় করে ডাকাতি করে। লুঠ তরাজ করে ভাঙচুর করে মারামারি কাটাকাটি করে। সেই কালু একবার বড় ফেঁসে গেল এক বাড়ি ডাকাতি করতে গিয়ে ।
বামুনের চরে কৃষ্ণপ্রসাদ দত্ত বাবুর বাড়িতে তাঁর মেয়ের-ঘরের নাতির অন্নপ্রাশনের রাতে চড়াও হয় কালু । তারা বড়লোক। আত্মীয়স্বজনও সব ধনী লোক। কাঁড়ি কাঁড়ি সোনা রূপোর গয়না তাদের গায়ে।
মাঝরাতে সবাই যখন আয়েশ করে ঘুমোচ্ছে সে সময় মগ ডাকাতের মতো দল নিয়ে কালু সর্দার গিয়ে হামলা করলো সেই যজ্ঞি বাড়িতে । কিন্তু উজবুক কালু একটা মস্ত বড় ভুল করে বসল। দত্তবাবুর নাতজামাই সে রাতে কয়েকজন ইয়ার বন্ধু নিয়ে তার দাদাশ্বশুরের বাড়িতে ভরপেট খেয়ে তাস পিটছিল। তারা সবাই পুলিশের লোক। আর নাতজামাই তো নিজে দাপুটে দারোগা।
পিস্তল হাতে নাতজামাই দুটো ডাকাতের ঠ্যাং ফুটো করে দিয়ে কালুর রাম-দা’র ওপর তাক করে গুলি চালায়। অব্যর্থ নিশানায় ছিটকে পড়ে কালুর হাতের ‘চোখ খোদাই করা’ রামদা। তবে কালু তো আর যে সে ডাকাত নয়। সে রঘু ডাকাতের ভাবশিষ্য । কোনক্রমে রামদা নিয়ে চম্পট দেয়। যারা অক্ষত ছিল তারা রণপা চড়ে আবার বর্ত্তির বিল পেরিয়ে তাদের কুশডাঙার গোপন ডেরায় পালিয়ে যায়।
সে ঘটনার কয়েকদিন পরে নাকি এই রামদা কালি মন্দিরের প্রতিমার পায়ের কাছে পড়ে থাকতে দেখা যায়। হয়তো রটনা।
সেই ডাকাতির ঘটনায় হুজ্জুতি কম হয়নি। তবুও সে যাত্রা কালু বেঁচে যায়। কেস কাবারিও কোর্টে ওঠে নি। দারোগা নাতজামাইয়ের দাদাশ্বশুরের বাড়িতে ডাকাতি অথচ কালুর সাতখুন মাফ? পুলিশে ছুঁলে আঠারো ঘা। তবে কি মিথ্যে কথা!
একথাও ঠিক সেই থেকে কালু ভিজে বেড়ালটি হয়ে গেছে। তাকে অনেকে গো-হাটায় দেখেছে গরু ছাগল কেনা বেচার দালালি করতে।
দেবু মাষ্টার সব খবর যে ঠিক দেয় তেমন নয়। তার এ খবরটা যেমন অনেকে বিশ্বাস করছে না । এই কিঙ্করী ভৈরবীর কল্যাণে নাকি কালুর টিকি-টি ছুঁতে পারেনি পুলিশ।
আজ বিয়ের তারিখ। একটা রঙীন সামিয়ানা টাঙান হয়েছে উঠোন ছেয়ে। আর মাটির উঠোনটি গোবরমাটি দিয়ে নিকোন হয়েছে। বড় মেয়ে সকালে জামাই সমেত হাজির। সে জামাই খুব চালাক চতুর । একশ জন লোকের খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। সে দোকানঘাট করতে গেছে। একটা মাইকের ব্যবস্থাও সে করেছে। বিয়ের গান বাজছে প্যান প্যান করে।
তাদের ছোট বাচ্চাটিকে কোলে নিয়ে কিঙ্করী একবার বাড়ি আর মন্দির করে বেড়াচ্ছে। চেয়ার টেবিল ভাড়া করা হয়েছে। কিঙ্করী চুলে শ্যাম্পু করে একটা ছাপা শাড়ি পরে খোলাচুলে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তার দু হাতে দু’গাছা সোনার চুড়ি। তার দিদি দিয়েছে।
রাত গভীরে লগ্ন। তা’বলে নিমন্ত্রিতরা তো আর না খেয়ে বসে থাকতে পারে না। তারা সব খাওয়ার জায়গায় বসে পড়েছে । সে সময়েই বরযাত্রী এসে হাজির। পুরোহিত মশাই ঝিমোচ্ছিলেন। সজাগ হয়ে এবার আসর সাজিয়ে বসলেন। বর এসেছে পাল্কি চড়ে। আর দুটো ম্যাটাডোর ভর্তি করে জনা তিরিশ লোকজন।
বড় মেয়ে তার মা আরো সবাই মিলে পাত্রকে বরণ করে নিয়ে এল।
পাত্রটির বয়স কম। তবে বেশ লম্বা চওড়া। রঙ ময়লায় দিকে। চোখ দুটো বেশ বড় বড়। একটু যেন শীতল ও কঠিন চোখ।
বড় জামাই তার বৌকে এক ফাঁকে ইয়ার্কি মেরে বলল, – কি গো এ দেখি ডাকাতের চোখ।
– চুপ, কি যে বলনা। ছুটকি তো নিজেই পছন্দ করেছে।
– বাপরে বাপ। বলিহারি ভৈরবীর চয়েস!
বড় জামাইয়ের কাছে আরো আশ্চর্যের মনে হল। বরের বাবা একটা সাদা চাদর গায়ে খুবই চুপচাপ। এখনও তো তেমন শীত পড়েনি । মুখটাও ঢাকা দিচ্ছে কখনও। তার সঙ্গের গুরুজনরাই উৎরে দিল বিয়ের সব শুভ কাজ।
বেশ মিটে গেল বিয়ের পর্ব। সাত পাক হলো। মালাবদল হলো। যা যা রীতিকর্ম সব হল। মায় ঘোলা জলে কড়ি খেলা হল। অনেকটা রাত হয়েছে। বরযাত্রী সব উসখুস করছে। তারা ফিরে যাবে।
বিপিন তালুকদারের ছোটমেয়েকে আজ সুন্দর লাগছে। শোলার মুকুটে তাকে রাজরানীর মত লাগছে। গায়ে অল্প স্বল্প গয়নাগাঁটি। তবুও নব বধূকে মনে হচ্ছে যেন কাঠামোর ওপরে বসান প্রতিমা। মেয়ে -জামাই এবার খেতে বসবে। বেয়াই মশাইকে হাত ধরে বিপিন বলল, – মেয়েকে দিলাম। দেখবেন। ও একটু অন্যরকম। আশীর্বাদ করুন।
খুব গম্ভীর গলায় বেয়াই মশাই বলল, – কিঙ্করী আপনার মেয়ে। আর ও আমার মা, বৌমা নয়। ভৈরবী মা।
আশীর্বাদ করে আবার চাদরে মুখ মুড়ে ম্যাটাডোরে গিয়ে ড্রাইভারের পাশে বসল। এবার ফেরার পালা। সৌজন্য বশতঃ বড় জামাই তার মোটর বাইকটা নিয়ে একটু এগিয়ে বড় রাস্তা অবধি দিতে গেল। বাঁকের মুখ ঘুরলেই বড় রাস্তা। একটু খাঁড়াই মুখ। দুটো সাদা রঙের জিপ গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে রাস্তা আটকে। বাইকের হর্ণ দিল বড় জামাই তারা সরল না । ম্যাটাডোরের ড্রাইভার জোর হর্ণ বাজাল। বিরক্ত হল। কোন কাজ হল না।
বেয়াই মশাই ধৈর্য রাখতে পারল না। গায়ের চাদর ফেলে বাঘের মত হুঙ্কার দিয়ে এক লাফে ম্যাটাডোর থেকে নেমে। রাস্তায় চলে গেল। আর তখনি আশপাশ থেকে দুটো ষন্ডা মার্কা লোক বেয়াইয়ের হাত দুটো চেপে ধরল। সামনের গাড়ি থেকে এক লাফে হাতে খোলা পিস্তল নিয়ে এক তরুণ বেয়াইয়ের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। আগ্নেয়াস্ত্রের নলটা বেয়াইমশাইয়ের গলায় ধরে বলল, – কি হে কালি প্রসাদ সরদার, তুই কি ভেবেছিস আমি কিছু খোঁজ খবর রাখি নে। নোনাপুকুর থানার ছোট দারোগা নিলয় কুন্ডুকে এত নিষ্কর্মা ভাবিস?
ম্যাটাডোর থেকে আরো দু’চার জন কালোকোলো লোক নেমে কালুর কাছাকাছি যেতে ছোট দারোগা হেঁকে বললে, – তোর লোকজনকে বারন কর। না হলে তোর গলা ফুঁড়ে দেব।
ওদেরকে ঈশারায় পিছিয়ে যেতে বলল কালু ওরফে কালিপ্রসাদ। তারপর হাতজোড় করে বলল, – যা করার করুন ছোট বাবু। শুধু কুটুম মানুষের সামনে বেইজ্জতি করবেন না।
বড় জামাই দাঁড়িয়ে সব দেখছিল, সে একথায় লজ্জা পেল।
– এক শর্তে ছেড়ে দেব। বল বাকি জীবন সৎ পথে থাকবি। তোর বৌমার কাছে অস্ত্র খানা লুকিয়ে রেখে গিয়েছিলি, না?
– আমি সব শর্তে রাজি ছোটবাবু। শঙ্করী আমার বৌমা নয়। মা, সাক্ষাৎ ভৈরবী মা।
– বেশ তবে সে কথাই রইল।
মিটমাট হলো। নাতজামাই নিলয় কুন্ডু তার জিপে উঠতে যাচ্ছে।
– একখানা কথা বাবু?
– বল? তোর কি বলার আছে?
– কাল বাদে পরশু এই গরীবের ঘরে একটু পায়ের ধূলো দেবেন। ভৈরবী মায়ের হাতের ঘি ভাত একটু ছুঁয়ে যাবেন। আশীর্বাদ করবেন।
– বেশ। তবে যেন প্রতিশোধ নেয়ার চেষ্টা করিস না।
জিব কেটে দুকানে হাত দিয়ে কালু বলল, – কি যে বলেন, স্যার। কালু সর্দারের এক কথা।
(শেষ)











