গল্পটা এক বাঙালি অন্ত্রেপ্রেনিওরের। রানাঘাটের রেল বাজারের এক ভাতের হোটেলের রসুয়ে বামুন কর্মচারী থেকে ভারত জোড়া কেটারিং কোম্পানি গুজরাটি ধুরন্ধর খাড্ড-এর কনসালটেনটের পদে উন্নতির এক এপিক জার্নির গল্প। কর্মচারী থেকে তদ্দিনে সেই বাঙালি নিজেই দু দুটি হোটেলের মালিক। কিন্তু আরো কাজ শেখার তাগিদে ব্যবসার খুঁটিনাটি শেখার তাগিদে স্ত্রী কন্যা জামাইকে ছেড়ে পাড়ি দিলেন বোম্বে।
এই উপন্যাসের নায়ক প্রায় নিরক্ষর প্রৌঢ় হাজারি ঠাকুরের পাশে রাখুন রূপবান, বিদ্বান, রোমান্টিক অপুকে অথবা সাহসী সুঠাম এডভেঞ্চার প্রিয় শংকরকে। হাজারি কোনো মতেই অথর ব্যাকড চরিত্র নয়। মানুষটা কেবলমাত্র সৎ, আন্তরিক আর দারুন রাঁধতে পারেন। তাকে নিয়ে সাহস করে উপন্যাস লিখছেন একজন বাঙালি লেখক। উপন্যাসে নায়িকা নেই। প্রধান নারী চরিত্র সেই ভাতের হোটেলের কলহপ্রিয় জাঁদরেল পদ্ম ঝি। এ নিয়ে ভরসা করে এক বাঙালি লিখছেন আর অন্য বাঙালিরা পড়ছেন। শেষ পাতায়, লেখকের ভাষায় হাজারি ঠাকুরের বোম্বে যাত্রার শুরু-
“শেষ রাত্রে দুখান গাড়ি করিয়া সকলে আবার রানাঘাট আসিল। দুপুরের পর হাজারি আবার একটু ঘুমাইয়া লইল। ট্রেন নাকি সারারাত চলিবে, কখনো সে অত দূরে যায় নাই, এতক্ষন গাড়িতেও থাকে নাই। ঘুম হইবে না কখনোই। যাইবার সময় টেপি ও টেপির মা কাঁদিতে লাগিল। কুসুমও ইহাদের সাথে যোগ দিল। অতসী সকলকে বুঝাইতে লাগিল – ছিঃ কাঁদে না, ও কি কাকীমা, বিদেশে যাচ্ছেন। একটা মঙ্গলের কাজ। ছিঃ টেপি, অমন চোখের জল ফেলো না ভাই।”
রানাঘাটের সেই আদর্শ হিন্দু হোটেলের রান্নাঘরের ধোঁয়ার মধ্যে আগুনের তাপে ঘেমে নেয়ে একাকার হাজারির হাতে বুনিপ শিকারের রাইফেল নেই, আছে হাতা-খুন্তি। পড়ন্ত বিকেলের ভুত গত খাটুনি শেষে শুকনো কড়কড়ে ভাত তেঁতুল দিয়ে মেখে খেতে বসার সময় কোনো অপর্ণা পাখার বাতাস দেয় নি একটুকু। তবুও হাজারি তার মতো করে লড়াই চালিয়ে গেছে। চালিয়ে গেছে খাঁটি বাঙালি কায়দায়। হাজারিকেও উন্নতির আশায় পোড়া বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যেতে হয়। লেখকের ভাষায়
“… টেপি চোখ মুছিতে মুছিতে বলিল – খাবারের পুঁটুলিটা ওপরের তাক থেকে নামিয়ে কাছে রাখো বাবা, নামাতে ভুলে যাবে তোমার তো হুঁশ থাকে না কিছু।
…. অতসী পায়ের ধুলা লইয়া বলিল – আসবেন কিন্তু পুজোর সময় কাকাবাবু মেয়ের বাড়িতে নেমন্তন্ন রইল, ঠিক আসবেন।”
পথের পাঁচালী, আরণ্যক, ইছামতি, চাঁদের পাহাড়ের পাশাপাশি ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’।।এই বিশাল ব্যাপ্তি যার লেখায় সেই মানুষটা কোনোদিন নোবেল প্রাইজ পেলেন না স্রেফ আ মরি বাংলা ভাষায় লিখতেন বলে। নেহাৎ আটপৌরে, গৃহস্থ মানুষটি কিছু পয়সা সাশ্রয় এর জন্য কলকাতা থেকে গুড় কিনে উঠতেন বনগাঁ লোকালে। হেমিংওয়ের মতো স্পেনের পাহাড়ে জীবনকে লাথি মেরে ছুঁড়ে ফেলে দেখান নি। লবটুলিয়ার তীব্র কটু গন্ধে ভরা জঙ্গলে জীবনকে দু হাতে আঁকড়ে ধরেছেন বারেবারে।
স্রেফ এই মানুষটির লেখা পড়ার জন্যই পরের জন্ম বলে কিছু থাকলে আবার বাঙালি হয়েই জন্মাতে চাই। জন্মদিনে ভালো থাকবেন অপরাজিত বিভূতিভূষণ। আপনার লেখা আমাদের শিখিয়ে যায় সেই মন্ত্র -ডাউন বাট নট ডিফিটেড।
সামনে পুজো। হাওড়া স্টেশনের বড় ঘড়িটার তলায় দাঁড়িয়ে থাকলে হয়তো শুনতে পাওয়া যাবে সেই গমগমে ঘোষণা – গীতাঞ্জলি এক্সপ্রেস .. নং প্ল্যাটফর্মে ঢুকছে। ট্রেন এসে থামবে।
খিদের জ্বালায় পোড়া বাংলাদেশ ছেড়ে ঘরছাড়া যাঁরা পুজোর সময় ঘরে ফিরে আসছেন তাঁদের সেই ভিড়ের মধ্যে ওই তো দেখতে পাচ্ছি হাজারি ঠাকুরকে। কি বললেন, চিনবো কেমন করে ? আরে ওই মানুষটাকে কি চিনতে ভুল হয় ভাই? হাজারি ঠাকুর তো একটাই। আমার আইডল বাঙালি। ডাউন বাট নট ডিফিটেড।