সংবৎসরব্যতীতে তু পুনরাগমনায় চ।
ফিরে আসার জন্যই চলে যাওয়া। এ যেন বুকে আশার প্রদীপ জ্বালিয়ে দিয়ে বিচ্ছেদ। এ যাওয়া ‘যাওয়া তো নয় যাওয়া’। বিসর্জনে তাই সিঁদুর খেলা, কোলাকুলি আর মিষ্টিমুখ করে বিদায়কে আবাহনে বাঁধা হয়। টুটবে আগল বারে বারে তোমার দ্বারে, লাগবে আমায় ফিরে ফিরে, ফিরে-আসার হাওয়া।
‘ফুরায় যা, তা ফুরায় শুধু চোখে।’ একদম ছোটবেলাটার বিসর্জন হয়েছিল বোধহয় প্রাইমারি স্কুল ছাড়ার পরপরই। গুটলি বয়সে পড়তাম বালিকা বিদ্যালয়ে। ক্লাসে অবশ্য বালকদের সংখ্যাই বেশি ছিল। কিন্তু স্কুলের খেলাগুলো ছিল বালিকা ঘেঁষা। কুমির ডাঙা, রুমাল চোর- ইত্যাদি ইত্যাদি। সোমালি, ঋত্বিকরা আমাকে কুমির ডাঙার একগলা জলে দাঁড় করিয়ে রেখে কোথায় যেন হারিয়ে গেল একদিন। সেই ক্ষণস্থায়ী বিচ্ছেদবেদনা কাটিয়ে ঢুকলাম শ্রীরামকৃষ্ণ আশ্রম, মাহেশে। যেন এক বৃন্ত থেকে অন্য বৃন্তে ফুটে ওঠা- পুনরাগমনায় চ।
অমিত, অভিজিৎ, গোপেশ্বর, মৈনাকদের নিয়ে জমাটি স্কুল জীবন। সিনিয়র বেসিক আর পাঠশালার মাঝখানে ছিল জটায়ুর টাকের মতো ফুটবল মাঠ। একদম একপাশে অল্প কিছু ঘাস। বাকিটা ফটফটে সাদা। সেখানে সিনিয়র বেসিক স্কুলের চারটি ক্লাসের খান আশি ছেলে চারটে ভিন্ন রঙের টেনিস বল নিয়ে টিফিনের আধঘন্টা ফুটবল খেলতো। ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান, রিয়াল মাদ্রিদ-বার্সেলোনা, এসি মিলান-জুভেন্টাস বা ম্যাঞ্চেস্টার-চেলসির থেকে কম উত্তেজনাপূর্ণ ছিল না খেলাগুলো। আর আশিটা ছেলেদের নিজের গ্রুপের বল চিনতে অসুবিধেও হতো না কখনো। এই দোর্দণ্ড ফুটবল খেলোয়াড়রাই আবার বড়ো মহারাজের ‘মনের ব্যায়াম’ ক্লাসে পঁয়তাল্লিশ মিনিট ধ্যানস্থ হতে পারতো। কৈশোর কতকিছু পারিয়ে নেয়। সেই স্কুলবেলাও একদিন শেষ হলো। হঠাৎ অমিতের সঙ্গে দেখা কয়েকদিন আগে। ছোটবেলাটা এক ঝটকায় যেন সামনে চলে আসে। সেই ফুটবল মাঠ, ক্লাসরুম, পেছনের বাগান, লাইব্রেরি। মনে হয় ওর কাঁধে হাত রেখে অনুপমের গানটা গাই-
বন্ধু চল.. রোদ্দুরে
মন কেমন.. মাঠজুড়ে
খেলবো আজ ওই ঘাসে
তোর টিমে, তোর পাশে।
অমিতরা ‘আমরা পঁচাশি’ নাম দিয়ে একটা হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ তৈরি করেছে। আমরা পঁচাশি সালে মাধ্যমিক দিয়েছিলাম। মেসেজগুলো পড়ি। ওদের ছবিগুলো এড়িয়ে যাই। ওদের সবার ছবি আমার কাছে আছে। মনের গভীরে রেখে দেওয়া। সব্বাই ক্লাস টেনের ছাত্র। ওরা সারাজীবন ক্লাস টেনে পড়ে যাবে।
আরজিকর মেডিক্যাল কলেজ আমাকে নদী থেকে সাগরে এনে ফেলে। হোস্টেল, বাবা-মাকে ছেড়ে থাকা, পড়াশোনার চাপ, ছাত্র রাজনীতির অআকখ শেখা এক ধাক্কায় অনেকটা পূর্ণবয়স্ক মানুষ করে দেয় আমাকে। কৌশিক, প্রবাল, জয়ন্ত, নির্মাল্য, ইন্দ্র নতুন বন্ধু হয়। হঠাৎ করে বড়ো হয়ে যাই আমি। তারপর থেকে বড়ো হতেই থাকি। বড়ো হতেই থাকি। বিসর্জনে যায় কলেজবেলাও। সারা পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে যায় কৌশিক, অমৃতা, সন্দীপ, শ্রাবণীরা। আমি এক অস্থির বিন্দু তার ব্রাউনিয়ান মোশান নিয়ে পশ্চিমবাংলার বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে বেড়াই। কানে শুধু বিসর্জনের বাজনা শুনি।
মায়ের ডায়াবেটিস ধরা পড়ে আমি ডাক্তারি পড়তে ঢোকার পরপরই। মায়ের মধ্যে বেশ একটু ছেলেমানুষি ছিল। বিজয়া দশমীর দিন মা বিভিন্ন ধরনের মিষ্টি আনাতো বাবাকে দিয়ে। বাবা মায়ের ক্ষেত্রে আপত্তিকর ভাবে স্নেহশীল ছিল। যে-ই মাকে বিজয়া জানাতে আসতো তাকেই মা মিষ্টি খাওয়াতো। তাদের সঙ্গে অবধারিতভাবে নিজেও মিষ্টি খেতো। মায়ের যুক্তি ছিল মানুষটি একলা খেলে তার খারাপ লাগতে পারে। বাবা মুচকি হেসে চুপ করে থাকতো। মাকে ডায়াবেটিসের কম্পলিকেশনগুলো বুঝিয়ে বললেও ভবি ভোলবার নয়। তারপরের তিরিশ বছর মায়ের সঙ্গে ডায়াবেটিসের মোটামুটি শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ছিল।
মায়ের মৃত্যু এক শীতের সকালে। বাবার মৃত্যু তার কয়েক মাসের মধ্যে। বাবা বিশ্বাস করতো ‘বাসাংসি জীর্ণানি যথা বিহায় নবানি গৃহ্ণাতি নরোহপরাণি । তথা শরীরাণি বিহায় জীর্ণান্য- ন্যানি সংযাতি নবানি দেহী।’
বিসর্জন আর গীতা কোথাও গিয়ে মিলে যায়। কোনোকিছুই হারিয়েছে? কোনোকিছুরই কি সম্পূর্ণ বিসর্জন হয়েছে? না বোধহয়।
তোমায় নতুন করেই পাব বলে হারাই ক্ষণে ক্ষণ।
বিজয়ার শুভেচ্ছা। সবাই ভালো থাকবেন।
Mugdha hoye gelama asadharon lekha dear sir ❤️I really appreciate
শুভ বিজয়ার অনেক অনেক শুভেচ্ছা নেবেন ডাক্তার সাহেব। ভালো থাকবেন সবাই।