৯ জুন দিনটা কার নামের সাথে জড়িত শহীদ দিবস সেটা জানা থাকলে এই লেখাটা আপনার পড়ার দরকার নেই। না জানা থাকলে বা ভুলে গিয়ে থাকলে চলুন ঘুরে আসি সাঁওতাল পরগনা।
জায়গাটা কিন্তু বাঙালির কাছে অপরিচিত নয়। বহুকাল ধরে বাঙালি বাবুবিবিদের বেড়াবার জায়গা ওটা। পছন্দ হয়ে গেলে সেখানে জমি জায়গা কিনে বাড়ি বানিয়ে ফেলার উদাহরণও সেই বিদ্যাসাগরের সময় থেকেই অনেক আছে। সকাল সন্ধ্যা সেই পরগনার রাস্তা ঘাটে বেড়াতে বেরোনো বাঙালি বাবুর চোখ কেবল খুঁজে বেরিয়েছে সস্তায় কি কি বাজার হাট করা যায়। তাঁরা কিনবেন, আর বেচনেওয়ালার দল, কপালের ঘাম মুছে, “বাবু বড় ক্ষেতি হয়ে গেল” বলে সেই পণ্য তুলে দেবে বাড়ানো হাতে এটাই দস্তুর।
এই ড্যাঞ্চি বাবুর দল কিন্তু কোনোদিন জানতে চায় নি যে ভাঙ্গা পথের রাঙা ধুলোর কতটা ল্যাটেরাইট পাথরের গুনে লাল আর কতটা বিদ্রোহের নায়কদের রক্তে। ওখানকার কালো কুলো তথাকথিত অশিক্ষিত অর্ধশিক্ষিত আদিম অধিবাসী মানুষজনগুলোকে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালি কোনো ধর্তব্যের মধ্যেই আনেনি, নির্দ্বিধায় তুই তোকারি করে গেছে। নবজাগরণ নিয়ে বড় বড় কথা বলা বাঙালি বড়জোর তাদের বিনে পয়সায় ভুট্টা খাইয়েছে, হোমিওপ্যাথির গুলি খাইয়েছে কিন্তু নিজেদের সামাজিক রাজনৈতিক ডিসকোর্সে স্থান দেয় নি।
নবজাগরণের নায়করা ইংরেজি শিখেছে কষে, সঙ্গে হিব্রু ল্যাটিন বাদ যায় নি, কিন্ত পলিম্যথ নায়কের দল কোনো দিন খুঁজে দেখেনি জানতে চায় নি “উলগুলান” শব্দটার মানেটা কি, একরাতে হিব্রু শেখা রামমোহন কোনোদিন তাগিদ পান নি মুন্দারি শেখার। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে। ওইসব মিল বেন্থাম লক রুশো ভলতেয়ার পড়া নায়কদের পাত্তা না দিয়েই ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে “আনপড় গাওয়ার অশিক্ষিত” কালো কালো মানুষগুলো। বিবেকানন্দ যখন ক্যালিফোর্নিয়াতে বিদেশি ভক্তদের শেখাচ্ছেন কৃষ্ণ চরিত্রের মাহাত্ম্য, তখন কৃষ্ণের মতই কালো, কৃষ্ণের মতই সাহসী, কৃষ্ণের মতই সিংহ হৃদয় এক সাঁওতাল যুবক পচে মরছে ইংরেজের জেলখানায়, বিবেকানন্দের ভাষণে যার উল্লেখ নেই, থাকার কথাও নয়। কারণ সেই যুবক তো চুরি ডাকাতি করে জেলে যান নি, গেছেন বিদ্রোহ করে, তাঁর কথা বললে ইংরেজ প্রভুদের রাগ হতে পারে। সেই ১৯০০ সালে আজকের দিনেই যাঁর শেষ নিশ্বাস ত্যাগ হবে। যাঁর বিদ্রোহের ঠেলায় ইংরেজ বাধ্য হয়েছিল পাস করতে ছোটনাগপুর টেনেন্সি এক্ট, ১৯০৮ সালে যাতে ট্রাইবালদের জমি জায়গা হুশ করে কিনে নিতে না পারে নন-ট্রাইবলরা।
নবজাগরণের সোনার ফসল ঘরে তোলা মধ্যবিত্ত শিক্ষিত বাঙালিকে রাস্তার মোড়ে হঠাৎ দাঁড় করিয়ে যদি জিজ্ঞেস করেন আজ কার মৃত্যুদিন, ৯০ শতাংশ উত্তর দিতে পারবে না। ফর্সা বউ খোঁজা বাঙালি ওই কালো মানুষগুলোর সাথে কোনোদিন একাত্ম বোধ করেনি আজ হঠাৎ করে করবে এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই। একপিস মূর্তি বানিয়েই খালাস। রোদ্দুর রায়ের মানবাধিকার লঙ্ঘন হলে বাঙালি রাস্তায় নামতে রাজি কিন্তু আদিবাসীদের জল জঙ্গল জমি কেড়ে নেয়ার জাতীয় ছকের বিরুদ্ধে রাস্তায় নামতে গেলে তাদের পায়ে ব্যাথা করে। ওই মূর্তির গলায় মালা দিয়েই কাজ সেরে ফেলে। তোমার নাম আমার নাম ভিয়েতনাম বলে রাজপথ কাঁপানো বাঙালির কাছে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামের আইকনদের মধ্যে বিরসা মুন্ডার নাম আর কই। বাঙালির ব্রিগেডে ঝান্সির রানীর নাম থাকবে, বিরসা মুন্ডার নাম থাকবে না। কালো ছিল যে লোকটা। আমরা বাঙালিই থেকে গেলাম। বড়জোর সামনের শীতে নেক্সট ট্রিপ সাঁওতাল পরগনা, OYO তে বুকিং পাওয়া যাবে বলে রাখলাম, এখনো বড়ই সস্তার জায়গা, ড্যাম চিপ (আগ্রহী পাঠক পরিমল ভট্টাচার্য এর দ্যাঞ্চিনামা পড়ে দেখতে পারেন)।
ও হ্যাঁ আরেকটা কথা, আগে এসব ছিল না, এখন কিন্তু ট্র্যাভেল প্যাকেজে ট্রাইবাল ড্যান্স মাস্ট। তাই একবার গেলে পরে হাত ধরাধরি করে নাচতে ভুলবেন না। আগন্তুক সিনেমার মমতাশঙ্করের মতো শাড়িটা ভালো করে জড়িয়ে নেবার সাথে একটিবার খালি দেখে নেবেন যে ওই কালো হাতগুলো সাদা দস্তানায় মোড়া আছে কি না। বলা যায় না কখন কি ইনফেকশন হয়ে যেতে পারে!