আজ বুদ্ধ পূর্ণিমা। গৌতম বুদ্ধর জন্মদিন।
আমার চোখে, এই পৃথিবীর বুকে হেঁটে যাওয়া মহোত্তম মানুষটি তিনিই। পৃথিবীর উপাদান যেহেতু কিছুই লুপ্ত হয় না – পরিবর্তিত বা অপরিবর্তিত রূপে রয়েই যায় – সেহেতু, সেই ধূলা-মৃত্তিকা, যার উপর দিয়ে হেঁটে গিয়েছিলেন স্বয়ং তথাগত, আমিও হেঁটে গেছি সেই মাটির ‘পরেই। আমার পায়ে লেগে গিয়েছে যে ধূলো, কোনও এক ক্লান্ত বিকেলে তা হয়ত কখনও নিজের পা থেকে ধুয়ে মাটির মধ্যে মিশিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। প্রতিমুহূর্তে যে কোটি কোটি নিউট্রিনো ভেদ করছে আমাকে, তার কয়েকটি পার হয়ে এসেছে তাঁরও শরীর। এইসব ভাবতে থাকলে, বিশ্বাস করুন, শিহরণ জাগে। নিজের অস্তিত্ব ও একান্ত নিজস্ব এই তুচ্ছতাও যেন তুচ্ছ বোধ হয়।
তাঁর বলে যাওয়া চারখানি সত্য চিরন্তন।
১. জগতে দুঃখ রয়েছে। সর্বত্র রয়েছে। সর্বং দুঃখম।
(এই দুঃখ বলতে স্রেফ স্যাডনেস অর্থে দুঃখ নয়, কেননা তথাগত কোনও হতাশার দর্শন শেখাননি। এই দুঃখের অর্থ আরেকটু বিস্তৃত। অর্থ – অনিত্যতা, নিত্য পরিবর্তনশীলতা, সার্বিক ক্ষণস্থায়িত্ব।)
২. দুঃখের কারণ আছে। অর্থাৎ উদয় তথা উৎপত্তি আছে। দুঃখসমুদয়ঃ।
৩. দুঃখের নিরোধ বা নিবৃত্তি সম্ভব। দুঃখনিরোধঃ।
৪. দুঃখনিরোধের উপায় বা পথ (মার্গ) আছে। দুঃখনিরোধগামিনী প্রতিপৎ।
ডাক্তারি, বিশেষত আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান, দাঁড়িয়ে রয়েছে প্রায় কাছাকাছি চারখানা সত্যের উপর। (যদিও এমন করে সেই চার সত্য কেউ লিখে যাননি।)
অসুখ রয়েছে। অসুখের কারণ রয়েছে। অসুখ সারানো সম্ভব। এবং অসুখ সারানোর উপায় রয়েছে।
অসুখ সারানোর উপায়, অর্থাৎ চিকিৎসা, যা কিনা চতুর্থ সত্য – তা অসহায় হয়ে যায় আগের তিন সত্য না মানলে। তাই হিস্ট্রি টেকিং, তাই ইনভেস্টিগেশন্স, তাই এত রিসার্চ ইত্যাদি।
তবে সব সময় কি আর অসুখের চিকিৎসা থাকে!! জরাগ্রস্ত দেহ, ভঙ্গুর স্বাস্থ্য আর ক্লান্ত মন – তিনে যখন মেলে, তখন নতুন অসুস্থতা এলে, এমনকি সে অসুস্থতা সারানোর উপায় থাকলেও…
এই পৃথিবীতে হাতে ধরে হাঁটতে শিখিয়েছিল যে – তারও আগে কোলে করে বহির্জগৎ দেখিয়েছিল যে – তার অনেক পরে শুধু দেখতে পাওয়াটাই যে দেখা নয়, দেখতে শিখিয়েছিল যে – সেই মানুষটা, মানে আমার বাবা, অনেকদিন ধরেই বেশ অসুস্থ। প্রাণশক্তি যেটুকু অবশিষ্ট ছিল, সেটুকু শুষে নিয়েছে দু’বছরের গৃহবন্দিত্ব।
দীর্ঘ অবহেলা ও অযত্নে ভগ্ন স্বাস্থ্য। বিভিন্ন অসুখ-বিসুখ। তার উপর দুদিন আগে ঘরে পড়ে গিয়ে কোমরের হাড় ভাঙল। ফ্র্যাকচার নেক ফিমার। এই স্বাস্থ্য নিয়ে সে আঘাত কতখানি সামলানো সম্ভব, তা আমার জানা নেই। তবু, যেহেতু ‘দুঃখনিরোধগামিনী প্রতিপৎ’, আর এক্ষেত্রে সেটা অপারেশন, তা-ই করা হলো। আজই।
তথাগত শিখিয়েছিলেন, বর্তমান-এ থাকা। অতীত বিগত, ভবিষ্যৎ অনাগত – সুতরাং অজ্ঞেয় – অতএব বর্তমান-ই…
ওটি থেকে বেরোনোর পর বাবার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম। ক্লান্ত চোখ দুটোতে একটু হাসি।
বুদ্ধপূর্ণিমা।
সব্বে সত্তা সুখী হন্তু।
সংস্কৃতে – লোকাঃ সমস্তাঃ সুখিনো ভবন্তু।
জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সকল মনুষ্য তো বটেই, এই প্রার্থনা প্রজাতি-নির্বিশেষে জীবজগতের সবকিছুর জন্য।
আপনিও সুখে ও শান্তিতে থাকুন। ইহজগতের সবার শান্তি ও ভালো থাকার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে আপনার সুখ ও শান্তিতে থাকা, শুধু এইটুকুনি মনে রাখুন।