দেখতে দেখতে বেয়াল্লিশ-এ পা রাখা হয়ে গেল টপটপিয়ে। আর এই মধ্যরাতে… লোভাতুর মন আমার ফেসবুক মেমোরি হাতড়ে হুতড়ে খুঁজে পেল বছর বারো আগের কিছু শুভেচ্ছা বার্তা। অর্কুট পেরিয়ে জুকেরবার্গের জগতে যখন সদ্য ঝুঁকছে দুনিয়া।
ফোনের ক্যামেরা যদিও তখনও ‘ভিজিএ’। মোবাইল মানে যদিও–বোতাম নকিয়া। আর তাইতে, বড় কষ্ট মস্ট করে খুলতে হয় ফেসবুক। বারংবার কাস্টমার কেয়ারে ফোন করে করে তৈয়ার করতে হয় জিপিআরএস সেটিংস। টাকা কেটে নেয় ফোন-কম্পানি পলকে পলকে।
হ্যাঁ, একথা অবশ্যই ঠিক যে তখন আমরা, অর্থাৎ মেডিক্যাল কলেজ পাস আউট ‘দুই হাজারি ব্যাচ’–ছেলেমেয়েরা ভালোবাসার ধ্বজা ওড়তে এতটা অভ্যস্ত ছিলাম না মোটেও। আমরা , সখ্য করতাম সংগোপনে। আমরা আলাপচারিতা জমাতাম নিভৃত আড্ডায়। আমরা, ‘আমরা’ হয়ে উঠতাম কেবল একান্ত কামরাতেই।
কিন্তু সর্বসমক্ষে সোচ্চার নিবেদনের সর্বকালীন একটা মোহ আছে বৈকি।
সেই যে সেই বলেছিল একজন চির অতৃপ্ত প্রেমিক –
কল্পনা করুন না, যেন এখনই প্রাণ খুলে গলা ছেড়ে আপনাকে ডাক দিয়েছি। নামের ডাক বনে বনে ধ্বনিত হলো। আকাশের ওই রঙিন মেঘের কাছ পর্যন্ত পৌঁছলো।
ঠিক সেইরকম। সোচ্চারে বলা। সাক্ষী রেখে বলা। সক্কলকে। সব্বাইকে। সমস্তকে।
এর লোভ বড় সাঙ্ঘাতিক। তো সেই ডাক আমায় ডেকেছিল যারা , বা বলা ভালো যে দুইজন, তাদের কারো সাথেই আর বিন্দুমাত্র যোগাযোগ নেই আমার। এমনকি, বেঁচে আছে না মরে গেছে তাও ইয়া গজব…. জানি না। সোচ্চারে বলা সমস্তটাই তাই হয়ত চিরন্তন নয়। সংগোপনে বলাটাও… কি? নাঃ। না বোধহয়। এ জগতে চিরন্তন, শুধু নিজেরই স্বগত কথোপকথন।
তাই এসব কচকচি বরং থাক। পেরিয়ে এসেছি সেই কমবখত বেহুদা দিনকাল যখন ফি-জন্মদিনে কবিতা লিখতাম ট্যাপটেপিয়ে–-
বুক ফুলিয়ে ফিরছি দ্যাখো, দিচ্ছি আবার শিস।
থোড়াই তোকে কেয়ার করি বয়স ছত্তিরিশ।
এখন বরং লিখতে ইচ্ছে করে
পরিশ্রান্ত ফিরছি দ্যাখো, এবার আব্বুলিশ।
আমার আমি, আমিই আমি । বয়স বেয়াল্লিশ।
তবুও… লিখি না। তবুও লিখিনি। জন্মদিনে, এ বছরেও শুভেচ্ছাবার্তা তো জমা হয়নি আমার মন্দ! তো তাদেরকেও তো কিছু একটা দিতে হয় বৈকি! প্রত্ত্যুত্তরে। আর তাই জন্যই স্বেচ্ছায় সরিয়ে রাখা কলম ধরলাম বারেক। রাতদুপুরে।
তো, হে আমার ভ্রাতা এবং বান্ধবীগণ, নিচের যে ছবিটা দেখছেন, ঐটা আমারই আঁকা। আঁকা, কোভিডেরও বছর দুয়েক আগে। নেট ফেট ঘেঁটে এঁকেছিলাম বহু কষ্ট করে। গত কয়েক মাস হলো এইটাই ন্যাশনাল টিউবারকিউলসিস এলিমিনেশন প্রোগ্রামের পোস্টারে অফিসিয়াল ছবি হিসাবে স্বীকৃত হয়েছে। এবং দিল্লির কর্তাব্যক্তিরা এসে জানিয়ে গেছেন, ” ডক্টরসাব, পুরা ইন্ডিয়া ঘুম লিয়া। লেকিন ইতনা ক্লিয়ার ঔর টু দ্য পয়েন্ট তসবির না মিলা হাম লোগো কো। ”
এটাই।
এই ছবিটা, এবং এই নিয়ে একবগ্গা লড়াইটাই হলাম… আদত আমি।
এ দুনিয়ায় সমস্ত রোগ-বালাই নিয়েই কথা হচ্ছে তাবৎ মাধ্যমে। ক্যানসার থেকে করোনারি থ্রম্বোসিস। ম্যালেরিয়া, পক্স বা ধরা যাক–মায়ের আশিষ। কেবল একলা টিউবারকিউলোসিস-ই ব্রাত্য। অথচ, এ টিবির জীবাণুই শতকরা 30-35 জন ভারতীয়র শরীরে বসত করে আছে ঘাপটি মেরে। আজ হোক বা কাল, আপনি সামান্য দুর্বল হলেই থাবা বসাবে রোগ হিসাবে। হালুম!
মাথায় রাখবেন মিলিয়ন ডেভেলপমেন্ট গোল-এ প্রধানমন্ত্রী স্রেফ এই একটি বিশেষ রোগের জন্যই বাড়তি বরাদ্দ রেখেছেন/ রাখতে বাধ্য হয়েছেন। তদুপরেও , আজও টিবি ব্রাত্য। জনমত আজও ভাবে, টিবি হয় রিকশাওয়ালা আর ভিখারীদের। তদুপরেও টিবি চিকিৎসক হিসাবে এখনো আমাকে দুয়ো শুনতে হয় সহচিকিৎসকদের কাছ থেকে। কেউ কেউ তো এমনও বলেন–ওহ! টিবি হাসপাতাল এখনো আছে! আমি তো জানতাম উঠে গেছে! ( ছিঃ, চিকিৎসক হিসাবে এ বড় লজ্জার। বক্তার)
এবং যদিও… যে বিপুল সংখ্যক রোগীকে পরিষেবা দিয়ে থাকি আমরা প্রতি বছর তার মধ্যে আমলা থেকে ইঞ্জিনিয়ার, কামলা থেকে ওভারশিয়ার … সকলেই পড়েন।
ছবিটা, মাথায় গেঁথে নিন। ছবিটার বক্তব্য সক্কলকে বোঝান। বুঝবে না যদিও কেউ সহজে। তবুও, হার মানবেন না। আজ থেকে বছর বিশেক আগেও পোলিওর টিকা দিতে গেলে গ্রামবাসীরা মারমুখী হয়ে তেড়ে আসতো সদলবলে। সেই তাদের পরবর্তী প্রজন্মই আজ লাইন জমায় পোলিও বুথের বাইরে। কেন? কারণ আমার আপনার মতোই কেউ না কেউ নাগাড়ে লেগে থেকেছে এর প্রয়োজনীয়তা বোঝাতে।
হার নামক তাই কোনো শব্দের স্থান রাখবেন না অভিধানে। হার বলে কিচ্ছুটি হয় না। অনেকটা ওই ‘ সহি হ্যায়’ মিউচুয়াল ফান্ডের মতো। বিনিয়োগ করুন। নাগাড়ে করুন। করতেই থাকুন। শেষমেশ ফল পেয়ে যাবেন একদিন ঠিকই। টিবি মুক্ত হয়ত হয়েই যাবে দুনিয়া।
***
লেখাটা এখানেই শেষ হলে ভালো হতো। বেশ একটা ” আপনার মতো ডাক্তার বড় বিরল ” মার্কা অন্তসারশূন্য মন্তব্য পাওয়ার সম্ভাবনা থাকত বিপুল। থাকত, – আপনার মতো ডাক্তাররা আছেন বলেই “দেশটা এখনো গুজরাট হয়ে যায়নি” মার্কা নচিকেতা ন্যাকামি।
কিন্তু হায়! সেসব প্রলোভন যে পেরিয়ে এসেছি আমি। বললাম না! বয়স বেয়াল্লিশ। কলম তাই এগোনো যাক এখনো আরো খানিকটা। ক্ষরণ করা যাক আমার আরেকটা সত্ত্বার– চন্দ অলফাজ।
আমি না, ইদানিং কেবলই একটা পায়রা গুঁ গুঁ করা দালান খুঁজছি জানেন! যে দালানের একটি কোণায় একালটি দণ্ডায়মান খড়ের প্রতিমার চারিপাশে পড়ে থাকবে গত দুর্গাপুজোর সিঁদূর, শোলাকুচি…শাড়ির ছেঁড়া পাড়। যে দালান, ঠান্ডা হবে খুব। খুব, খু-ব ঠান্ডা। সদ্য চুনকামের নীলচে আভা মাখা শীতলতা শিরাতে শিরাতে। আর সুঘ্রাণ থাকবে গোপন বয়ঃসন্ধির।
মা-কে যাত্রা শুরু করার পূর্বে দেওয়া সন্দেশের গুঁড়ো, যে দালানে হাত বুলালেই পাওয়া যাবে মিহিন। ‘দেবসেনাপতির শব্দজব্দ’- ওয়ালা ছেঁড়া আনন্দমেলার পাতা পড়ে থাকবে কুঁকড়ো মুকড়ো হয়ে। গায়ে তার… গত পুজোর সিঙ্গারা, লবঙ্গলতিকা আর নিষিদ্ধ প্রেমের কলঙ্ক।
সেই দালানে-ই সমস্ত বর্ম, তাবৎ দায়, সমস্ত ধর্মাধর্ম সরিয়ে রেখে এবার দুই দণ্ড বসতে চাই আমি নগ্ন হাঁটু… আর খালি পায়ে। টিউশনি ফেরতা খাতার পাতায় লুকিয়ে রাখা বোকা-বোকা কবিতার হরফে হাত ছোঁয়াতে চাই পরম মমতায়। বড় আর বড্ডো মমতায়। খড়ি ওঠা, ফাটা হাত-পায়ে আরো আরেকবার অনুভব করতে চাই –শিহরণ। দূর থেকে ভেসে আসুক ষড়যন্ত্রের মতো তখনই সোনু নিগমের মিউজিক এলবাম– ‘দিওয়ানা’। আর ঠিক যে মাহেন্দ্রক্ষণে বেজে উঠবে সেই মাইকে অস্ফুট ” দিল সে দিল তক বাত পহুঁছি, মিলতে মিলতে সনম” ঠিক সেই মুহূর্তেই পিয়ালি বলে উঠুক– তুই কিছুতেই বুলেটকে অঙ্ক শেখাবি না বল?
আগমনী বলে যাক, –নৌকা এসেছে। যেতে হবে রে। তোকে কিন্তু ফার্স্ট হতে হবে। হবি তো? পারবি?
আর গহনার নৌকায় চেপে দূর দেশে চলে যাক বিন্নি। পরীর মতো বিন্নি। আমার। বিন্নি।
আশ্চর্য। পরমুহূর্তেই লহমায়, একটা আশ্চর্য মেলা ভেসে উঠবে অচানক ওই পায়রা দালানেই বায়োস্কোপের মতো।
একটা মেলা। একটা নাগরদোলা। সে নাগরদোলায় প্রথম পরশে শিহরিত স্থাণুবৎ দুই বালক বালিকা। বালক, বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে বালিকার কাঁকনের দিকে। ভাবছে– এই স্পর্শে এত শিহরণ কেন? কেন?
এবং নাগরদোলা থামছে না। সবাই নেমে যাচ্ছে একে একে। তবুও ঘুরছে। থামছে না। নাগরদোলা। আর বালক সহসা গেয়ে উঠছে– সোনার হাতে সোনার কাঁকন কে কার অলঙ্কার।
দেখি। এইসব। পায়রা– দালানে। পা ছড়িয়ে। আর তখনই , ঠিক তখনই কে যেন ডাক দিয়ে যায় অলক্ষ্যে– ফিরবি না? পার্থ? ফিরতে হবে যে! বেলা যে হয়ে এলো। এবার ছেড়ে দে। ফিরে আয়। ফের।
আয়। ছেড়ে দে। আয়। আয় না। বাবু…
গল্পটার বাকিটা জানা হয় না আর।
জানতে নেই।
জেনে গেলেই বড় কষ্ট জনাব। বহুৎ তকলিফ। জেনে গেলেই ফুরিয়ে যাবে সব। অকস্মাৎ। আচম্বিত।
( ঋণস্বীকার– বুলেট, আগমনীদের দুর্গাপুজো, বিন্নির খই লাল বাতাসা। স্বপ্নবেলার সেরা তিনটি আখ্যান। আর…)
নিচে লিঙ্কে একটা গান দিলাম। হাঁচি কাশি বাহু রুমালের পাশাপাশি এই আশ্চর্য দিনগুলোও ছড়িয়ে দিতে ভুলবেন না যেন।
ইয়াদ রাখবেন একদিন আপনিও বেঁচেছিলেন। বেঁচে ছিলেন বেশক। বা-খুব।
আজ আর এখনো বাঁচেন যদিও। লেকিন সেই বাঁচা আর এই বেঁচে থাকার মধ্যে তফাৎ খুব সূক্ষ। তফাতটা… আপনি নিজেও জানেন।
তাই, ইয়াদ রাখবেন সেই সব লমহাঁ
যখন,
শিহরণ ছিল আশমানী।
আর ইশক ছিল সিরফ… রুহানি।
আসি?
এবার। কেমন?
(*ছবিতে পোস্টারের ঠিক নিচে একটা সুইচও আছে মলিন।
দুটো মিলেই আমি।)