তিমির তলাপাত্রের সঙ্গে আমার পরিচয় প্রায় সিকি শতাব্দির, সেই যখন প্রথম ডাক্তারি প্র্যাক্টিস শুরু করি। আমার দেড়তলার সেই চেম্বারের নীচে তিমিরদার একটা স্টেশনারি দোকান ছিল।
আসা-যাওয়ার পথে দৃষ্টি ও স্মিত হাস্য বিনিময়, আর ক্কচিত-কদাচিৎ দু-চারটি আবহাওয়া নিয়ে ভাবনাহীন কথার বেশি কোনো দিনই এগোয়নি। তার একটা কারণ যদি আমার বাস বা ট্যাক্সি ধরার তাড়া, অন্য কারণটা হল তিমিরদার আয়তন এবং ওজনগত অসুবিধা।
ঐ স্বল্পপরিসরের সিঁড়ি ভেঙ্গে একশো তেরো কেজির মানুষটির পক্ষে আমার দেড়তলার সেই চেম্বার অবধি আসা খুব কষ্টকর ছিল।
তা একদিন ব্যতিক্রম ঘটল।
রোগীপত্তর শেষ, বেরোনোর তোড়জোড় করছি, এমন সময় হাঁচড়া-পাচড় করে, কোনক্রমে ঐ পনেরোটি সিঁড়ি ভেঙ্গে তিমিরদার আবির্ভাব।
ঈষৎ সংকোচের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত প্রত্যঙ্গটি দেখালেন। দেখলাম ছত্রাকের ভয়ংকর সংক্রমণ। ডায়াবেটিস রোগীদের খুব বেশি হতে দেখা যায়।
-ব্লাড সুগারটা কবে করিয়েছেন?
-ব্লাড সুগার? আমার?
আকাশ থেকে পড়লেন তিমিরদা। বেশ মজাই পেলেন মনে হল।
-কোনও চান্সই নেই। কেন জানেন?
-কেন?
অর্জুন গাছের ছাল। চোখ বুজে, প্রায় ঘনাদার ভঙ্গিতে উচ্চারণ করলেন তিমিরদা।
-কাল আপনাকে এনে দেখাবো। রোজ ঘুম থেকে উঠে খাই। সাথে এক কোয়া রসুন। নো সুগার, নো কোলেস্টেরল।
-বাঃ খুব ভালো। কবে লাস্ট ব্লাড টেস্ট করিয়েছেন?
-আমি? কখনো করাইনি। কারণ আমার ওসব নেই। তিমিরদার ঐ প্রব্লেম আত্মবিশ্বাস আমার প্রায় চিকিৎসাশাস্ত্রের ওপর থেকেই বিশ্বাস সরিয়ে আনছিল।
-তাও করে নিন। একবার করে রাখা ভালো।
-ওকে। বলছেন যখন। তবে কাল আপনাকে অর্জুন গাছের ছাল্টা টেস্ট করাবো। পৃথিবীর সবচেয়ে তেতো বস্তু। ও জিনিস সঙ্গে থাকলে, ডায়াবেটিস নো চান্স।
পরদিন আর ওনাকে কষ্ট দিইনি। চেম্বার শেষে আমিই গিয়েছিলাম ওনার দোকানে। পকেট থেকে বার করে কাগজ আর প্লাস্টিকের মোড়ক খুলে একটি কালচে-খয়েরি জিনিস বার করে, সাবধানে একটু ভেঙ্গে আমাকে খেতে বললেন।
-এর বেশি পারবেন না। অসম্ভব তেতো।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও জিভে ঠেকিয়ে দেখলাম। ঈষৎ তিতকুটে, বিশ্রী বিস্বাদে মুখ ভরে গেল। তাও মুখে সপ্রশংসা হাসি ফুটিয়ে বললাম,- বাঃ, বেশ তেতো তো! আর আপনার ব্লাড রিপোর্ট কোথায়?
-ওটা করা হয়নি, করব।
আরো দিন পনেরো গড়িমসি করে অর্জুন-ভক্ত তিমিরদা রক্ত পরীক্ষা করিয়েছিলেন এবং তারপর তাঁর সেই ভক্তি চটকে যায়।
আজ চব্বিশ বছর পরও দিব্যি মনে আছে, তিমিরদার ফাস্টিং সুফার এসেছিল তিনশো উনচল্লিশ আর পিপি চারশো বাহান্ন।
ভদ্রলোক মারা গিয়েছিলেন এর কয়েক বছর পর। অনিয়ন্ত্রত ব্লাড সুগার থেকে হওয়া কিডনি ফেলিওরে। স্রেফ অপমৃত্যু।
এবার আসি নিমের কথায়। বৈজ্ঞানিক নাম অ্যাজাডিরাচটা ইন্ডিকা। আয়ুর্বেদ মতে এর ওষধি গাছের ডাল, পাতা, রস সবই নাকি কাজে লাগে।
কাজে কতখানি লাগে বলতে পারবো না, কারণ আমি আয়ুর্বেদ শাস্ত্র পড়িনি। যখন মানুষ গুহাবাসী ছিল, তখন এই ধরনের গাছপালাই ছিল মানুষের সম্বল। বিজ্ঞান না হলেও বিশ্বাস সম্মত চিকিৎসার আধার।
কয়েকটি মারাত্মক ভুল ধারণার কথা বলব-
১. ডায়াবেটিস বা বহুমূত্র রোগী রোজ সকালে ১৫-২০ টি নিমপাতা চিবিয়ে খেলে উপকার পাবেন অথবা ৫-৬ চামচ নিমপাতার রস। আসল তথ্য হল রক্তে শর্করা বৃদ্ধি পায়, প্যাংক্রিয়াসের আইলেটস অফ ল্যাঙ্গারহ্যান্স থেকে ইনসুলিনের সঠিক মাত্রার না নিঃসরণের জন্য, অনুপস্থিত রিসেপ্টারগুলির গোলযোগের জন্য, কার্বোহাইড্রেটপূর্ণ খাবার থেকে। মিষ্টি খেলেই যে শর্করা বাড়বে তার কোনও মানে নেই। তাই করলা, নিম, অর্জুন গাছের ছালে ভরসা করলে কোনও দিন ডায়াবেটিস কমবে না। তিমির তলাপাত্রের দশা হবে।
২. নিমপাতা সেদ্ধ করে স্নান করলে খোসপাঁচড়া সেরে যায়—আদৌ নয়, বরং সংক্রমণ বেড়ে যেতে পারে।
৩. নিমের পাতা বেটে মাথায় লাগালে উকুনও সারে না।
৪. নিমের পাতা খেলে বা লাগালে কোনো ফাঙ্গাস বা ব্যাকটেরিয়া মরে না, বরং সঠিক চিকিৎসা বিলম্বিত হয়ে মারাত্মক আকার নিতে পারে।
৫. ত্বকের চুলকানিতেও নিম বা অন্য কোনো ধরনের তেতোর কোনও বিজ্ঞান-প্রমাণিত প্রভাব নেই।
তাই অর্জুন গাছের ছাল, করলা, চিরতার রস বা নিমপাতার ওপর নির্ভর করে তিমির তলাপাত্রের মতো আত্মহত্যার পথে যাবেন না। এটা একুশ শতক। প্রস্তর যুগ নয়। আর ভুল ধারণা ও কুসংস্কার সমার্থক।
চিকিৎসা সম্পর্কিত এই ধরনের মিথ ভাঙাটা খুব জরুরি। প্রতিদিন বিকল্প চিকিৎসার ফেরিওয়ালাদের খপ্পরে পড়ে ধনেপ্রাণে মারা পড়ছে হাজার হাজার মানুষ। এ হচ্ছে এক অর্থে ঠান্ডা মাথায় খুন। আপনারা যে মানুষের এই অবৈজ্ঞানিক ধ্যানধারণা ভাঙার কাজে সচেষ্ট হয়েছেন, এ জন্য আপনাদের সাধুবাদ জানাই।