কিশােরী আমি কত বার অপবিত্র শরীরে আচার ছুঁয়ে দিয়ে ইট পাটকেল পিঠে নিয়েছি তার ইয়ত্তা নেই, বাপ সােহাগী মেয়ে বাবাকে জড়িয়ে শুয়েছিলাম দুপুর বেলায়। সন্ধ্যায় এক জ্যেঠিমার ধমক, লজ্জা লাগে না, অপবিত্র অবস্থায় বাবা কে ছুঁয়ে…”১১ বছরের আমি”-র বাক্যবন্ধে অপবিত্র শব্দটি খায় না মাথায় দেয়, জানা ছিল না। জামায় লেগে থাকা রক্ত দেখে বন্ধুদের নাক সিঁটকানি তােকে খেলতে নেব না, তােকে ছুলে আমাদেরও “শরীর খারাপ” হয়ে যাবে,যা গিয়ে বেঞ্চে বসে থাক।
গুজরাটের স্বামী নারায়ণ ট্রাস্ট পরিচালিত কলেজের হষ্টেলে ৬৮ জন মেয়েকে অন্তর্বাস খুলিয়ে পরীক্ষা করা হয় তারা ঋতুমতী কি না। কারণ ঋতুমতী হলে তাদের সকলের সঙ্গে ডাইনিং-এ বসে খাবার খাওয়ার অনুমতি ছিল না। সংবাদ মাধ্যমে খবর সামনে আসার পর থেকেই হই-হই-রই-রই, ছি- ছি, এখন আবার এমন হয় না কি? কিন্তু আমার প্রশ্ন–এই অন্ধকার কি আমরা নিজেরা চাষ করিনি? যুগ যুগ ধরে আমার আপনার বাড়ির কার্নিসেই এমন অন্ধকারের জন্ম। উপরের ঘটনাগুলাের সঙ্গে কোথাও কি মিলে যাচ্ছে না আমার আপনার আরো অনেকের অভিজ্ঞতা? ‘মাসিক হলে এটাই নিয়ম’– এমন কুসংস্কারগুলাে তাে ‘মানিয়ে নেওয়া’-র নাম নিয়ে আমার বা আপনার বাড়ির জল হাওয়াতেই পুষ্ট হয়েছে, ডাল-পালা মেলেছে এতদিন। তবে, আজ কেন এত খারাপ লাগছে?!
উপরের ঘটনার কিছু দিন পরেই স্বামী নারায়ণ মন্দিরের বাবা কৃষ্ণস্বরূপ দাস জি মহারাজের আরও একটি বােমা, নিয়মিত ঋতুমতী মেয়েদের হাতের রান্না খেলে কুকুর হয়ে জন্মাতে হবে পরের জন্মে। আর যদি জীবনে একবারও ঋতুমতী মেয়ের হাতের রান্না খান , তবে তাে পরের জন্মে বলদ হওয়া নিশ্চিত। কি খুব হাসছেন তাে? এই খবর পড়ে অনেকেই দেখি বলছেন, এমন উচ্চশিক্ষিত মেয়েরা দিনের পর দিন এমন অনায্য প্রথা মেনে নিচ্ছিল কেন? কেন্দ্রীয় মহিলা কমিশনেরও একই প্রশ্ন। কেন আমরা কি এতদিন এসব মেনে নিই নি? এ তাে আমাদের দীর্ঘদিনের ‘মানিয়ে নেওয়ার ফল’। আমরাই তাে আমাদের মেয়েদের এই মেনে নেওয়াকে চ্যালেজ্ঞ জানাতে শেখাই নি।
জন্মের পর থেকেই কি আমাদেরকে শেখানাে হয়নি? মেনে নিতে হয়! সংসারের সুখের জন্য মেনে নিতে হয়!!!! আর সংসারের এমন অন্যায্য অনেক কিছু মানতে গিয়ে আমরা নিজেদের প্রান্তিক করে ফেলেছি। নয়তো আজকে, টেকনোলজির এই চূড়ান্ত উন্নতির সময়ে দাঁড়িয়েও কেন প্রশ্ন ওঠে মেয়েরা সম্মুখ সমরে যাবে কি না? কেন এখনো প্রতিবছর পিরিয়ড শুরু হওয়ার জন্য দেশের ২কোটি ৩০হাজার মেয়েকে স্কুলছুট হতে হয়??? কেন এমন স্বামীজি, এমন অমুক-তমুক বাবারা হাজার হাজার লােকের সামনে দাঁড়িয়ে এই সব অবাস্তব, নারী বিদ্বেষী কথা বলার সাহস পায়। এর জন্য আমরাই দায়ী। দায়ী আমাদের মনে চাষ করা হাজার বছরের কুসংস্কার, আমাদের মনে বাস করা নিয়ম ভাঙার ভয়। যে ভয় আমাদের প্রশ্ন করা থেকে বিরত করে, সেই ভয়ই হস্টেলের রেজিষ্টারে মেয়েদের নিজের হাতে নিজের মাসিকের তারিখ লিখে দিতে বাধ্য করে, বাধ্য করে প্যান্টি খুলে দাঁড়াতে।
প্রথম যখন ঋতু রক্ত দেখি বেশ ভয় পেয়েছিলাম, ওই ঘটনার কিছুদিন আগেই আমার পায়খানার সঙ্গে একটা বড় কৃমি বেরিয়েছিল, রক্ত দেখে ভাবলাম নিশ্চয়ই ওই কৃমি পেটের ভিতর সব কিছু খেয়ে ফেলেছে, তাই এত রক্ত। ভয় পেয়ে মাকে গিয়ে বললাম, মা বুঝল। কিন্তু ঠাম্মাকে ডেকে বলল আপনি ওকে বুঝিয়ে দিন এমন হলে কি কি করতে হবে, আমার ঘেন্না করছে। কিশােরী আমির সেই প্রথম উপলদ্ধি , .‘আমার কোনও বিষয়ে মায়েরও ঘেন্না লাগতে পারে!
অসুস্থ হয়ে জ্বর আসলে মাকে দেখেছি রাতের পর রাত জেগে জল পট্টি দিতে, পায়খানা করে ফেললে পরিষ্কার করতে, বমি পরিষ্কার করতে, পাছু ধুইয়ে দিতে, সেই মায়ের আবার আমাকে ঘেন্না!! আদতে উপলব্ধি, শরীর খারাপ বা মাসিক রজঃস্রাবই ঘেন্নার বিষয়। এটা কাদের হয়? মেয়েদের। রাজনীতিটা বুঝুন।
মাসিক নিয়ে এমন সব ট্যাবুগুলোই প্রজন্মের পর প্রজন্মের হাত ধরে সমাজের মাথায় চড়ে বসে। শরীর খারাপ হওয়ার পর মায়ের প্রথম নিদান, এমন হলে ছেলেদের কাছে আর যেওনা। এবার থেকে এসব হলে ঠাম্মার কাছে জানাতে। কেন? এত দিন তাে আমার মাই আমার আশ্রয় ছিল। বাড়িতে পিরিয়ড নিয়ে কথা বলার পরিস্থিতি ছিল না, আমার পরিচিত অন্য কারােরই ছিল না। শেষ পর্যন্ত ক্লাসরুমের পিছনের বেঞ্চে স্কুলের বদ্ধ পরিবেশে পিরিয়ড রূপকথার মত পাখা মেলত। ‘মাসিকের সময় যাদের পেটে ব্যথা হয়, ভুলেও সেই সময় তাদের গায়ে হাত দিতে নেই, গায়ে হাত দিল অন্যেরও পেটে ব্যথা সহ পিরিয়ড শুরু হবে’, কার কার বাড়ির আমের আচার তাদের অবিমৃষ্যকারিতার জন্য নষ্ট হয়ে গেছে তার খতিয়ান জমা হতো বেঞ্চে। গভীর অন্ধকারে ভুল – অবাস্তব ভাবনার ভূত সদ্য-কিশােরীদের মাথা চিবিয়ে খেত।
কি ভাবছেন? সময় পাল্টে গেছে এখন আর অমন হয় না? সমীক্ষা বলছে এখনও দেশের ৭০শতাংশ মা ঋতুমতী হওয়াকে শরীরবৃত্তীয় কারণ নয়, শরীরের নোংরা বা ঘেন্না হিসেবেই দেখেন । ২০১১-‘১২ সালে ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর মেডিকেল রিসার্চের করা একটি সার্ভেতে উঠে এসেছে, মাত্র ৩৮% ঋতুমতী মেয়েরা তাদের মায়েদের সঙ্গে মাসিকের menstruation# বিষয়ে কথা বলতে পারে। বাকিরা?? তাদের জন্য বরাদ্দ ওই লাস্ট বেঞ্চের সালিশি সভা। কারণ এর বাইরে যারা আছে, সেইসব ছাত্রী আর তাদের মায়েরা জানেই না মেনস্ট্রুয়েশন কি বা কি করে বয়সন্ধির মেয়েকে মেনস্ট্রুয়েশন নিয়ে স্বাস্থ্য সম্মত পাঠ দিতে হয়। শুধু বাড়ির গণ্ডির ভেতরে নয়, দেশের বেশিরভাগ স্কুলে menstrual hygiene নিয়ে কোনো আলোচনাই হয় না। এই অবস্থাটা আরো খারাপ গ্রামীণ ভারতে। কারণ ৬৩% গ্রামীণ স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারা মেনস্ট্রুয়েশন নিয়ে আলোচনা করেন না কারণ তাঁরা জানেনই না বিষয়টিকে কিভাবে ডিল করতে হবে।
আমার ঠাম্মা সে যুগেও নিয়মিত খবরের কাগজ পড়া মহিলা, গল্পের বই পেলে গােগ্রাসে শেষ করত, আমার গল্পের বইয়ের নেশা ঠাম্মার কাছ থেকেই পাওয়া। এ হেন ঠাম্মা মাসের ওই কয় দিন যেন বদলে যেত, শেষে ঠাম্মার ছোঁয়া-ছুঁই নিয়ে কড়াকড়ির চোটে আমি লুকোতে লাগলাম আমার ‘শরীর খারাপ’। বিছানার তলার অপরিষ্কার অন্ধকারে, ধুলাে মাখা বইয়ের স্তুপের তলায় আমার ন্যাকড়ারা লুকোতে থাকল। কারণ ‘শরীর খারাপ’ হয়েছে জানলেই ঠাম্মা আমার খাওয়া থেকে শােয়া, কি ছোঁব আর কি ছোঁব না, এমন অনেক কিছুই নিয়মে বেঁধে ফেলবে। তাই ওই সব কাপড় লুকোতাম যেখানে সেখানে। ঋতুরক্ত যে লুকোনোর জিনিস নয়, তা আমায় বলার মত কেউ ছিল না। কেউ বলেনি এরকম অস্বাস্থ্যকর কাপড় ব্যবহারের জন্য অনেক রকম রোগের সঙ্গে মারাত্মক সার্ভিকাল ক্যান্সারও হতে পারে। এখনো এদেশের প্রতিবছর 60 হাজারেরও বেশি মহিলা সার্ভিকাল ক্যান্সারে মারা যান।
ঋতুরক্ত মাখা কাপড় নিয়ে বিব্রত, সন্ত্রস্ত কিশােরী ধীরে ধীরে ভাবতে শুরু করল ঋতুমতী হওয়া খারাপ কিছু, মায় মেয়ে হওয়াই খারাপ,এসব নোংরা। এই ভাবনায় শেষ অবিশ্বাসটুকু মুছে দিল চারপাশের কিছু আত্মীয় বন্ধুদের অযাচিত মন্তব্য। কেমন করে যেন বড় হয়ে গেলাম।
এরপর স্কুল পেরিয়ে কলেজ, স্যানিটারি প্যডের সঙ্গে পরিচয়, বন্ধুত্ব হতে বেশী সময় লাগেনি। ততদিনে আধুনিক আমি, মাকেও বুঝিয়ে দিয়েছি পিরিয়ডে কাপড় ব্যবহার কেন নিরাপদ নয়। এক দশক পরে শ্বশুরবাড়ি গিয়ে ফের উপলব্ধি করলাম ‘মাসিক ’ মানেই খারাপ কিছু। এক মজার ঘটনা ঘটতে থাকল বারবার। যখনই বাড়িতে কোনও অতিথি আসত তখনই নির্দিষ্ট জায়গা থেকে আমার প্যাডেরা গায়েব হয়ে যেত থাকল। কাজটা কে করছে সেটা বােঝার পর প্রথম প্রথম শুধু কথা বলে তাকে বােঝানাের চেষ্টা করতাম। পিরিয়ড কি? কেন এটা হয় তা বােঝানাের চেষ্টা করলাম। কিন্তু একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি, এরপর এই নিয়ে শুরু হল ঝগড়া। দূরত্ব বাড়ল। এই যে আমি, একবিংশ শতকের আধুনিকা, সচেতন মনের সাবলম্বী মেয়ে, হাজার বার চেষ্টা করেও আমার কাছের মানুষদেরই এই কুসংস্কার থেকে বের করতে পারিনি।
না, আমি পারিনি, সবরীমালা নিয়ে উত্তাল কেরল, ফের মামলা নতুন করে শুরু হয়েছে। মেনস্ট্রুয়াল কাপ না টেম্পুন, পরিবেশ বাঁচাতে প্যাডের বিকল্প কোনটি সেই নিয়ে খবরের কাগজে লেখা আমি পারিনি এই অন্ধকারকে দূর করতে। এই সে দিনও আমার উচ্চশিক্ষিতা জা না-পাক আমির থেকে সযত্নে আচারের বয়েম সরিয়ে নিয়ে গেল। আজও আমার মিডিয়ায় কাজ করা মর্ডান সহকর্মীরাও ‘পিরিয়ডে কোমর ব্যথা হচ্ছে’-র মত কথায় আপত্তি তোলে। এদেশে ঋতুমতী মহিলার সংখ্যা সাড়ে ৩৫কোটি, তার মধ্যে এখনো মাত্র ১২শতাংশ মহিলা পিরিয়ডে প্যাড ব্যবহার করে। এখনো টিভির পর্দায় প্রকাশ্যে খুনোখুনি দেখালেও মেনস্ট্রুয়াল রক্ত কিন্তু নীল ই দেখায়। আসলে এই ভাবেই সেই প্রাচীন সময় থেকে নানান ফন্দি-ফিকিরে ঋতু রক্তকে অশুচি করে রেখেছে সমাজ। ঋতু রক্ত খারাপ এই ধারণাকে সুচারু ভাবে লালন করছে এ সমাজ। এ অন্ধকার দূর করা কোন একক প্রচেষ্টায় সম্ভবও নয়। কারণ সুদীর্ঘ সময় ধরে মেয়েদের অবস্থানকে ছােট করার জন্য এই ধারণাকে গভীরে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে ।
আজ ছাত্রীদের অন্তর্বাস খুলিয়ে পরীক্ষা করার খবরে নড়েচড়ে বসেছে দেশ, সম্প্রতি এক বামপন্থী ছাত্র সংগঠন এই ঘটনাকে ইস্যু করেই “ব্লিড উইদাউট ফিয়ার”bleed without fear# স্লোগান নিয়ে মাঠে নামছেন। তা নামুক, এমন ইস্যু নিয়ে তাে নামাই দরকার। কিন্তু এদের এতদিনের শীত ঘুমের দায় কে নেবে? বাইরের ধর্মগুরুর কথায় আমরা ছি ছি করছি!! আর আমাদের মনের ঘরে যে সব ধর্মগুরুরা আছেন তাঁদের নিদানকে অমান্য করবে? শরীর খারাপ হলে আচারের বয়াম ছুঁয়াে না, ঠাকুর ছুঁয়াে না, পুজোর সামগ্রী ছুঁয়াে না, অন্যকে ছুঁয়াে না, কেন বামপন্থী সংগঠনগুলাে এতদিন এ বিষয়ে চুপ ছিল? কেন স্কুলে স্কুলে গিয়ে ছাত্র-ছাত্রী-অভিভাবক-শিক্ষক-অশিক্ষক কর্মচারীদের সচেতন করা হয়নি? ঘর থেকে অন্ধকারগুলােকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করার সাফাই অভিযানের দায়িত্ব তাে তাদেরই ছিল। অথচ তারাও এসবকে নিছক মেয়েলী বিষয় বলে এড়িয়ে গিয়েছে এতদিন।
এমনিতেই মেয়েলী বিষয় মানেই মামুলি কিছু, মেয়েলী আবেগ তুচ্ছ, তুচ্ছ ভালােবাসা, তাইতাে যুগ যুগ ধরে প্রিয়াকে ফেলে রেখে যুদ্ধে যাওয়া সৈনিকের বীরগাথা রচনা হয়েছে বারবার। সেখানে পিরিয়ড, মেয়েদের দুষিত রক্ত !!!!!! মেয়েদের বদলে যদি এই রক্ত পুরুষের শরীর থেকে বের হত, হয়তো তখন তা হত শৌর্যের-বীরত্বের প্রতীক। সমাজই নিজ দায়িত্বে তা প্রতিষ্ঠা করতে পিছ পা হত না। আমরাও আহ্লাদে ভক্তিতে গদগদ, সেই শােণিতে মাথা ঠেকাতাম। শুনেছি সারদা দেবী নাকি রজস্বলা অবস্থাকে অশুচি বলে মনে করতেন না, এই সময় পুজো থেকে শুরু করে ঘরের সব কাজই তিনি করতেন। কিন্তু আমরা কি পেরেছি সেই মন নিয়ে এগিয়ে যেতে??
এখনো আমাদের স্যানিটারি ন্যাপকিনের ঠাঁই হয় বাথরুমের অন্ধকারে, পিরিয়ডের কথা এড়িয়ে যাই বাবা-ভাই-দাদা বা পুরুষ বন্ধুদের সামনে। দায় টা আসলে আমাদেরই। যতদিন না আমরা স্যানিটারি প্যাডকে সম্মান দিয়ে বাথরুম থেকে বার করে এনে নিজেদের প্রতিদিনের ব্যবহার সামগ্রির মাঝে ঠাঁই দেবো, ততদিন বোধহয় অবস্থাটা বদলানোর নয়। মেয়েরা যতদিন না নিজেদের সম্মান দিতে শিখব, সংসারে সম্মানজনক অবস্থানে নিজেকে রাখব, ততদিন এই অবস্থা পাল্টানোর নয়।