রক্তদান ও রক্তদান শিবিরের উপরে বিমোচনদার অসাধারণ লেখাটা অনেকেই পড়েছেন। আমার লেখাটাও কাইণ্ডলি পড়বেন। লেখাটা একটু বড় হয়ে গেছে। সপ্তাহ অন্তে আমার জন্য একটু সময় নষ্ট করবেন।
আমি প্রথম রক্তদান করি ১৯৮১ সালে। মা’য়ের অপারেশন হবে। ভর্তি হয়েছে বোকা্রো স্টিল সিটি হসপিটালে। মায়ের, আমার আর দাদার গ্রুপ সেম। মায়ের জন্য রক্ত দিতে হবে, ভাবনাটাই হাজার আকাশে উড়িয়ে নিয়ে গেল আমাদের দুই ভাইকে।
সেই থেকে আমি প্রতি বছর নিয়ম করে ব্লাড ডোনেট করি। যেহেতু ডাক্তার, এই কর্তব্য উচিত বলেই মনে করি। অনেককে ধরে নিয়েও যাই। একবার যে ভাবেই হোক, সাহস করিয়ে দিতে পারলে, প্রাথমিক ভীতি কাটিয়ে দিতে পারলে, আর চিন্তা থাকেনা। আমার পরিচিতা অনেক মহিলাও এই সাহস অর্জন করেছে।
এক পরিচিতা ম্যাডামের আবার ইদানিং মন খারাপ। স্বাস্থ্যের কারণে তাকে আর ডোনার হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছেনা বছর তিনেক, সেজন্য। সে এখন বাহান্ন।
প্রাইভেট ব্যাঙ্কগুলোর রেগুলার ডোনার থাকে। তাদের বেশিরভাগ লোকগুলো নিম্ন আর্থসামাজিক শ্রেণি থেকে উঠে আসা, সে কারণে অনেকসময় রক্তের কোয়ালিটি কম্প্রোমাইজড হয়ে যায়। তাই, যদি নিজের লোকের কোন কারণে রক্ত দরকার হয়, তাহলে পরিচিত মানুষদেরই ডোনার হিসেবে নিলে ভালো হয়। অযথা অন্য রোগের সম্ভাবনা এড়ানো যায়।
বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে যারা নেগেটিভ গ্রুপের, তাদের একটা লিস্ট করে রাখলে ভালো হয়। আমার পরিচিত স্থানীয় কয়েকটি ক্লাব এরকম লিস্ট করে রেখেছে। আমার পরিচিত কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা বা কর্মীকেও দেখেছি খুব উৎসাহ ভরে এই সমস্যার মোকাবিলায় বহুবার এগিয়ে এসেছে।
****
এবারে আমি একটা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা লিখবো।
১৯৮৫ সাল। আমি তখন ন্যাশন্যাল মেডিক্যালে MD student. আমার ঐ দাদা ধানবাদ থেকে এল। রেকটাম থেকে প্রবল রক্তপাত হচ্ছে। পাইলস্ হয়েছিল। স্থানীয় এক ডাক্তার Inj Carbolic Acid (Phenol) locally push করেছিলেন সারাবার জন্য। তখন ওটা স্বীকৃত চিকিৎসা ছিল। পাইলসের পাশে পুশ করতে হত। টিস্যু জমাট বেধে রোগটা সেরে যেত। দাদার ক্ষেত্রে কোন কারণে সেটা সফল হয়নি।
দাদাকে আমার পরিচিত এক নার্সিং হোমে ভর্তি করে আমাদের সবার পরিচিত প্রিয় সার্জেন ভবদাকে দেখাই। সেখানে একপ্রস্থ অপারেশন করা হল। একদিনের মধ্যেই আবার এত ব্লিডিং হল যে ভবদা তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত নিলেন, নার্সিং হোমে হবেনা। দাদাকে ন্যাশন্যালে নিয়ে যাওয়া হল। সেখানে সেই যুগে সব গ্যালাক্সি সার্জেনের বসবাস। ডাঃ নব পাল, বিমল মুখার্জি, বিজয় বিশ্বাস, ঊর্মিলা খান্না, কত বড় বড় নাম।
দাদা ভর্তি হল বিজয় বিশ্বাসের আণ্ডারে। ততদিনে চার বোতল রক্ত দেওয়া হয়ে গেছে।
ভর্তির পরদিন এণ্ডোস্কোপি করে দেখা গেল রেকটামের ভেতরে বিশ ইঞ্চি লম্বা খাদ্যনালী কেমিক্যাল বার্ণ হয়ে আছে। ব্লিডিং থামানো প্রায় অসম্ভব।
পরদিন সমস্ত বিখ্যাত সার্জেনরা এক জায়গায় বসলেন, কি করা যায়! আফটার অল, বেলাল, একজন অতিপ্রিয় এমডি ছাত্র, রোগি তার দাদা। ঐ সময়ে কলেজে আমি সবার খুব প্রিয় ছাত্র ছিলাম।
এদিকে প্রতিদিন দাদাকে রক্ত দেওয়া চলছে। দশ বোতল রক্ত ঢুকে গেছে। কোলকাতার প্রায় সবকটা ব্লাড ব্যাঙ্কে আমার হাজিরা দেওয়া হয়ে চলেছে।
দুদিন ধরে বোর্ড বসেও সিদ্ধান্ত দুভাগ। ডাঃ মুখার্জির মতে ঐ affected কুড়ি ইঞ্চি খাদ্যনালী বরাবরের মত এখুনি কেটে ফেলে দিয়ে permanent colostomy করে রোগির জীবন বাঁচানো আশু কর্তব্য। কোলোস্টোমি হল, পেটের এক জায়গায় ফুটো করে খাদ্যনালির নীচের ওপেনিংটা বার করে দেওয়া। সেখানে একটা ব্যাগ ফিট করে রাখতে হয় মল সংগ্রহ করবার জন্য, যেহেতু স্বাভাবিক পায়ুটা আর থাকেনা।
ডাঃ পাল এবং ডাঃ বিশ্বাসের মত হল, ইয়ং ম্যান, ছ’মাস হল বিয়ে হয়েছে, ওর ওরকম ড্রাসটিক সার্জারি করে লাইফটা হেল করতে চাননা, বরং রক্ত আরও দেওয়া চলুক, আরো antiboitic চলুক, নিউট্রিশন মেনটেন হোক। ডাক্তারি পরিভাষায় conservative treatment. বার্ণ ভালো হবে একসময়। হতে বাধ্য।
আসলে হয়েছিল কি, ঐ ফিনল ইনজেকশন শিরার পাশে দেওয়ার পরিবর্তে শিরার মধ্যে দিয়ে ফেলেছিলেন ধানবাদের সার্জন। ফলে সেটা খাদ্যনালির নীচের দিকের প্রায় কুড়ি ইঞ্চি পুড়িয়ে ফেলে।
ডাঃ পাল ব্যক্তিগতভাবে আমাকে নিজের চেম্বারে ডেকে বলেছিলেন, ও মরে যায় যাক, ঐরকম কোলোস্টোমি করেও বেচারা ম্যালনিউট্রিশনে ভুগে একটা বাজে জীবন অল্প কিছুদিন টেনে যাবে। তুই ভরসা রাখ, রক্ত দিতে থাক, টিকিয়ে রাখলে ঐ বার্ণ একদিন সারবেই সারবে। ডাঃ বিশ্বাস, যাঁর আণ্ডারে ভর্তি, তাঁরও একই মত।
সেই মত ট্রীটমেন্ট চলছে। এক সন্ধ্যায়, রক্তের reaction এ দাদার 107 জ্বর এল। থার্মোমিটারে 106ডিগ্রি পর্যন্ত দাগ থাকে। 106 ছাড়িয়ে গেলে রোগি মরেই যায়। জ্বর কিছুতেই কমানো যাচ্ছেনা। দাদা বলেই চলেছে, বেলাল, চেষ্টা ছেড়ে দে, আমি আর বাঁচবো না।
কাঁদতে কাঁদতে ঐ রাতে ওয়ার্ড মাস্টারকে ধরে সার্জারি বিল্ডিং এর পেছন দিকে ডেডবডি রাখার মর্গ খুলিয়ে একটা কফিন বক্স বার করে আনলাম বন্ধুরা মিলে। সেই বক্সের মধ্যে দাদার শরীরটা ঢুকিয়ে বরফ চাপা দিয়ে কিছুক্ষণ রাখার পরে জ্বর কমলো।
আমার দাদা ভালো হয়ে উঠল শেষ পর্যন্ত। টোটাল ছাব্বিশ বোতল রক্ত দেওয়ার পরে! দেড় মাস আমার সকল বন্ধু, সমস্ত ডিপার্টমেন্টের স্যার ও হাসপাতালের স্টাফ, অগণিত ব্লাড ব্যাঙ্ক তৎসহ অনেক জানা অজানা ব্লাড ডোনার, প্রত্যেকেই জান লড়িয়ে দিয়েছিল।
***
এর কয়েক বছর পরে আমার ঐ দাদা যখন তার শালীর বিয়েতে ড্যান্স করে ফূর্তি করছিল, দেখে, আমার দুচোখ তখন ঝাপসা!
***
আজ আবার কান্না পাচ্ছে।
রক্তদান শিবিরে আমি না থাকলে সত্যিকারের পাপ হবে! আপনারাও থাকবেন, অন্য আরেকজনের দাদা, দিদি, ভাই, বোন বা তার প্রিয়জনের জন্য।
বিমোচনদার মত আমার বড়রা থাকবেন উৎসাহ দিতে।
***
(খুঁজে খুঁজে, দাদার দুটো ছবি বার করলাম, এখানে দিলাম। দু বছর আগে তোলা।)