রাস্তা উঁচু হওয়ায় পানিহাটি হাসপাতাল তার ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলেছে। এই ঘোর বর্ষাতেও ‘পানি হাটি’ হচ্ছেনা। বরঞ্চ স্কুটার নিয়ে শুকনো রাস্তা দিয়ে সোজা চলে যাচ্ছি এমারজেন্সির সামনে।
হাসপাতালের রাস্তায় মাছ ধরতে পারছেনা বলে অনেকেরই মন খারাপ। রিক্সাওয়ালাদের মন আরও খারাপ। আগে বর্ষার সিজিনে এই কোমর জলে ঢোবা রাস্তার কল্যাণে তাদের বেশ ভালই আয় হত।
তবে আমার খারাপ লাগছে না। তার প্রধান কারণ পায়ের চুলকানি রোগ থেকে মুক্তি পেয়েছি। মাসের পর মাস জমা জল ভেঙে হাসপাতালে যাওয়ার ফলে গোটা বর্ষাকাল দুই পা চুলকাত। সে যেমন তেমন চুলকানি নয়। সেট্রিজিন, অ্যাভিল, ফেক্সোফেনাডিন সব ফেল মেরে যেত। নীচু হয়ে চুলকাতে চুলকাতে কোমরে ব্যথা হয়ে যেত। এবং সেই ব্যথা এখনও আছে। চুলকাতে গিয়ে জামার পকেট থেকে পড়ে একটি মোবাইল শহীদ হয়েছে।
তবে এটুকু ছাড়া পানিহাটি আছে পানিহাটিতেই। যাইহোক, জলের গল্প অন্য একদিন শোনানো যাবে। আজ ‘সাদা তোয়ালে’র গল্প শোনাব বলে লিখতে বসেছি। সেই গল্পে ফেরত আসি।
ওয়ার্ডে রাউন্ড দিতে ঢুকে আমার প্রথম কাজ বাড়ির লোককে ওয়ার্ড থেকে বের করা। আমাদের ছোটো হাসপাতাল। রোগীরা বেশীরভাগই স্থানীয়। তাদের বাড়ির লোকজন গেটম্যানের দূর্বল আপত্তি শুনতে চায়না। ওয়ার্ডে তাদের অবাধ যাতায়াত।
ওয়ার্ডে ঢুকেই আমি চিৎকার শুরু করি “বাড়ির লোক- বাইরে যান… বাড়ির লোক বাইরে যান…” আমার গলার আওয়াজ শুনেই ওয়ার্ডের সিস্টার এবং আয়ারা আরও কুড়ি-ত্রিশ ডেসিবেল জোড়ে চিৎকার শুরু করেন। দু’চারজন গোঁয়ার ব্যক্তি থাকেন। তাঁরা কিছুতেই বার হতে চাননা।
কিন্তু আমরাও ছাড়ার পাত্র নই। যতক্ষণ না পর্যন্ত সব বাড়ির লোক বাইরে বেরচ্ছে ততোক্ষণ রোগীদেখা শুরু করিনা।
এই বাড়ির লোককে বার করার ব্যপারটা আমি শিখেছিলাম মেডিক্যাল কলেজে দীপাঞ্জন স্যারের কাছ থেকে। মেডিক্যাল কলেজে একিউট মেল ওয়ার্ডে পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ রোগীরা ভর্তি থাকত। মেঝে বারান্দা এমনকি বিছানার তলায় পর্যন্ত রোগী ভর্তি হত। আর রোগীর সংখ্যার দ্বিগুণ থাকত, তাদের বাড়ির লোক। কে যে বাড়ির লোক আর কে রোগী, মাঝে মাঝেই বোঝা অসম্ভব হয়ে উঠত। রোগীর বদলে রোগীর বাড়ির লোক ইঞ্জেকশান পেয়ে গেছে এমন ঘটনাও বিরল নয়।
দীপাঞ্জন স্যার ওয়ার্ডে ঢুকেই প্রথমে বাড়ির লোককে চিৎকার চেঁচামেচি করে বের করতেন। তাঁর একটা বিখ্যাত ডায়লগ ছিল, “এখানে থেকে কি করবি, তারচেয়ে তোরা বাড়ি গিয়ে একটু পড়াশুনো কর। একটু শিক্ষিত হ।”
আবার অন্যদিকে চলে যাচ্ছি। এবার সরাসরি গল্পে ফেরত আসি। গতকাল রাউন্ড দিচ্ছি মেয়েদের এক নম্বর ওয়ার্ডে। ওয়ার্ডে বেশ ভিড়। দুটি করে বেডে তিনজন করে রোগী আছে। বেশ কিছু রোগীকে ছুটি না দিলে এরপর নতুন রোগীকে জায়গা দেওয়া যাবে না।
গোটা তিনেক মেয়ে ঘুমের ট্যাবলেট, একজন ডেটল, আর দুজন ইঁদুর মারা বিষ খেয়ে ভরতি হয়েছে। সকলেই দিব্যি সুস্থ আছে। এদের শপথ বাক্য পাঠ করিয়ে ছেড়ে দেওয়া হোল। বিষ খাওয়া রোগীদের ভগবানের নামে শপথ করে (মুসলমান হলে আল্লার নামে) বলতে হবে জীবনে আর ওসব খাবে না। তবেই ছুটি হবে।
তবে আজকাল ভগবান টগবান কেউ মানে না। তাই দুদিন বাদেই একই লোক আবার কেরোসিন তেল খেয়ে ভর্তি হয়।
দ্রুত রোগী দেখছি। আরও দুটো ডাইরিয়ার ছুটি হোল। একজন জ্বরের রোগীর রাতের পর আর জ্বর আসেনি। স্ট্রোকের রোগীটি অনেকদিন ভর্তি আছে। উন্নতি অবনতি কিছুই হচ্ছে না। একেও বাড়ি পাঠাই। দশটা ছুটি হোল। আরও গোটা পাঁচ ছয়েক ছুটি হলে ওয়ার্ডটা একটু খালি হবে।
একজন ত্রিশ বত্রিশ বছরের মহিলা ভর্তি হয়েছে। ভয়ংকর দুর্বলতা। মাথা তুলে বসতেই পারছে না। চোখের পাতা টেনে দেখলাম একদম সাদা। সিভিয়ার অ্যানিমিয়া। সংক্ষেপে ইতিহাস নিলাম। কোনও জায়গা থেকে রক্ত পরে না। মাসিক খুব কম হয়। জ্বর আসেনা। সেরকম উল্লখযোগ্য কিছু নেই। হিমোগ্লোবিন সহ দরকারি পরীক্ষা করতে দিলাম। মনে হচ্ছে দু-তিন বোতল রক্ত দিতে হবে।
একজন রোগীর পেছনে খুব বেশী সময় ব্যয় করা যাবে না। এখনও তিনটে ওয়ার্ড বাকি। পরের রোগীর কাছে চলে আসলাম। কিন্তু মনের মধ্যে একটা কিছু খচ খচ করছিল। আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলে দিচ্ছিল কিছু একটা গণ্ডগোল আছে। যেটা আমি ধরতে পারছি না।
দুপুর দুটো নাগাদ ছুটি লেখা শেষ করে ঐ মহিলা রোগীর কাছে গেলাম। এখন হাতে সময় আছে। একটু ভালভাবে দেখা যাবে।
রোগী এবং রোগীর আশপাশ ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে খচ খচানির কারণ বুঝতে পারলাম। খচখচানির কারণ একটি ধপধপে সাদা তোয়ালে।
মহিলাটিকে দেখলেই বোঝা যায় তার বসবাস দারিদ্রসীমার নীচে। পরনের শাড়ি রংচটা, ময়লা। অনেক জায়গায় ফেঁসে গেছে। চামড়ায় জায়গায় জায়গায় হাজা হয়েছে। গা থেকে বোটকা গন্ধ বেরুচ্ছে। চেহারায় অপুষ্টির ছাপ।
অথচ মেয়েটির পায়ের কাছে একটি নতুন ছোট সাইজের ট্রাভেল ব্যাগ। সেটির চেন খোলা। এবং তার থেকে উঁকি মারছে একটি ধপধপে সাদা তোয়ালে।
মেয়েটির সাথে এই ব্যাগ কিছুতেই মেলানো যায় না। বুঝলাম এরজন্যই আমার মনে অস্বস্তি হচ্ছিল।
মেয়েটিকে জিজ্ঞাসা করলাম, “এই ব্যাগ, এই তোয়ালে কোথায় পেলে?”
মেয়েটি কিছুতেই বলতে চাইছে না। আমি ভাবছি বেশি জোরাজুরি করা উচিৎ হবে কিনা। যদি বলে বসে, আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে আপনি এত মাথা ঘামাচ্ছেন কেন?
অবশেষে মেয়েটি বলল, গত পরশু এক স্বেচ্ছায়(!) রক্তদান শিবিরে রক্ত দিয়ে সে ওই দুটি মহার্ঘ্য বস্তু পেয়েছে।
গত এক বছরে সে বেশ কয়েকবার রক্ত দিয়েছে। এবং তার বিনিময়ে দেওয়াল ঘড়ি, টিফিন বক্স, কাপ সেট ইত্যাদি পেয়েছে। সঙ্গে বিরিয়ানির প্যাকেট।
কোনো মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে সে রক্ত দেয়নি। শুধু জিনিসগুলি পাওয়ার লোভে সে রক্ত দিয়েছে। এমনকি এক মাসে দুবার পর্যন্ত রক্ত দিয়েছে।
দীর্ঘশ্বাস চেপে ওয়ার্ড থেকে বেড়িয়ে এলাম। কাকে গালাগালি দেব। এই মেয়েটাকে, রক্তদান শিবিরগুলোর উদ্যোক্তাদের, নাকি মেয়েটির অভাবের কারণ যারা তাদের। তাদের মধ্যে কি আমি নিজেও পড়ি না।
গেটের সিকিউরিটির জয়ন্তদা অনেকদিন ধরেই হাসপাতালে একটা রক্তদান শিবির করার কথা বলছে। রক্ত দেওয়ার পর শুধু একপিস সেদ্ধ ডিম আর এক গ্লাস দুধ। ব্যাস।
আমিই বলেছিলাম, একটা মেমেন্টো অন্তত না দিলে লোকে রক্ত দিতে উৎসাহ পাবে কেন?
এখন দিনের আলোর মত স্পষ্ট বুঝতে পারছি জয়ন্তদাই ঠিক।