– একটা কথা জিজ্ঞাসা করবো ?
বুঝতে পারলাম না আদৌ তাঁর কানে কথাটা গেছে কি না। ভাবলেশহীন মুখ এবং নড়া-চড়াহীন শরীরটা একটা প্লাস্টিকের চেয়ারে আসীন। হাত চল্লিশেক দূরে সাগরের জল ছুঁয়ে যাচ্ছে অসংখ্য পূর্ণার্থীর পায়ের পাতা, গোঁড়ালি, কখনও বা হাঁটু অবধি। সফেন জলের ঢেউ এগিয়ে এসে আবার পিছিয়ে যাচ্ছে।
– আপনি কি শুনতে পেয়েছেন ? আমি আবার জিজ্ঞাসা করলাম।
মাথা ভর্ত্তি কাঁচা-পাকা চুলের হয়তো পাকা অংশটাই বেশি, কানে উজ্জ্বল দুইখন্ড ক্ষুদ্র হীরকের দ্যূতি। ধ্যানমগ্ন শরীরে মেদের বাহুল্য নেই। তবে আরো এক খন্ড অলংকার আছে তাঁর শরীরে, এক গাছি সোনার রুলি। উজ্জ্বল গৌরাঙ্গী, পরিচ্ছন্ন এই মহিলার বসে থাকার ঢংটাই দৃষ্টি কাড়ে। আমি গত তিন দিন ওই খানেই ওনাকে দেখছি। ভুল বললাম, আসলে খেয়াল করে দেখেছি গত বছর ও তার আগের বছরও তিনি ওখানেই , দুই নম্বর রাস্তা যেখানে সাগরে মিশেছে সেখানেই দেখেছি। কপিলমুনির মন্দিরটা এই রাস্তার উপরেই পড়ে। বঙ্গোপসাগরীয় বালুতট ও মন্দিরের মাঝে বালির ওপরে বিছানো ইটের রাস্তা দুই আড়াইশো মিটারের মত দীর্ঘ। রাস্তার দু’পাশে মেলার অস্থায়ী সব দোকান। রাস্তা এবং দোকান ছাড়িয়ে হোগলার ছাওনি। জেনারেটরের আলোয় দোকানগুলো ঝলমলে দেখায় রাতে । আর তার পিছনে অন্ধকারের মধ্যে বিভিন্ন প্রদেশের পুন্যার্থীরা মাথাগোঁজার ঠাঁই পায় হোগলার অস্থায়ী ছাওনিতে।
– একটু জল খাওয়াবে ?
– আপনি নিশ্চয় ডাবের জল খাবেন, সাপ্লাই এর জলও খেতে পারেন।
আমার দিকে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট এগিয়ে দিলেন। আর কোন কথা বললেন না। আমি দ্বিরুক্তি না করে টাকাটা নিয়ে কাছাকাছি একজন ডাবওয়ালার কাছ থেকে একটা কাটিয়ে স্ট্র সমেত ওনার হাতে তুলে দিলাম। বাকি টাকা ওনার হাতে ফেরৎ দিতে গেলে উনি বললেন,- তোমারটার দামও কিন্তু দিয়েছি।
আমি ফের ডাবওয়ালার কাছ থেকে আমার জন্য একটা নিয়ে এসে ওনার কাছাকাছি বালিতে বসলাম, চুপচাপ।
– কতদিন আসছো এই মেলায়, মানে কত বছর?
– নয় নয় করে ১০ বছর তো হবেই।
– তুমি সরকারি অফিসার, আমি কি করে তোমার নজরে পড়লাম? আর কেনই বা পড়লাম ?
– আমি যদি খুব ভুল না করি, আমি আপনাকে গত তিন বছর ধরে কয়েকটা দিনের জন্য, ঠিক এখানেই কয়েক ঘন্টার জন্য বসে থাকতে দেখেছি।
– হুঁ। হয়তো।
– আমার এক দশকের ওপরে হলো নিয়মিত এই মেলাতে আসা। মেলার সময়ে এখানে সর্বত্র ঘুরে বেড়ানোর অভিজ্ঞতা। সাধুবাবা, সরকারি ডিউটিতে আসা কর্মচারী,দোকানদার, সেবাদানকারি সংস্থা ও ভিখারিরা এখানে হয়তো বারে বারে আসে। কিন্ত লক্ষ লক্ষ মানুষের মেলায় কাউকে বিশেষতঃ কোন পুণ্যার্থীকে পরপর কয়েক বছর একই জায়গায় এভাবে হাজির হতে দেখিনি। অথবা আমার নজরে পড়েনি।
উনি প্রথমে কোন উত্তর দিলেন না। আমি আশা করে রইলাম এবং আবার বললাম,- তাই বোধহয় আমার কৌতূহল হয় আপনাকে নিয়ে। কি আছে এই মেলায় যা আপনাকে এতো টানে ?
সহজে উত্তর আশা করিনি তাও অপেক্ষায় করলাম।
বেলা পড়ে যাচ্ছে ,পশ্চিম আকাশে শীতের ক্লান্ত সূর্য্য দিগন্তের ওপারে নেমে পড়েছে। অস্থায়ী বাঁশের খুঁটিতে বাল্ব,টিউবের আলো জ্বলে উঠছে, বোমা ফাটানো জেনারেটরের আওয়াজ, মাইকে অনবরত নিরুদ্দিষ্টের জন্য ঘোষণা , দোকানীদের উচ্চৈঃস্বরে খরিদ্দারের প্রতি আহ্বান সব মিলিয়ে ব্যস্ত মেলা আরো ব্যস্ত হয়ে পড়ছে।
কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম।
এই পুণ্যভূমিতে মেলার সময়ে এত সাধারণ মানুষ ঠিক কি কারণে আসে বছরের পর বছর দশকের পর দশক ? সবাইকি পুণ্যার্থী ? তা তো নয়। মাকে পিঠে বয়ে পুণ্যার্জনে নিয়ে আসে তেমন সুসন্তান যেমন আছে, আবার বৃদ্ধ বাবা-মাকে মেলা বেড়াতে নিয়ে আসার ছলে ফেলে দিয়ে চলে গেছে তেমন কুপুত্রও আছে। তবে ঠগ, চোর-বাটপাড়ের সংখ্যা কম।
অন্যমনস্কতায় ছেদ পড়লো, যখন ভদ্রমহিলার দিকে একবার তাকালাম। এই প্রথম তাঁকে একটু অস্থির দেখলাম। পেছনে দুই নম্বর রাস্তার দিকে তাকাচ্ছেন আর হাতের ঘড়ির দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিচ্ছেন।
একটা সময় তাঁর দৃষ্টি স্থির হলো, চোখে মুখে কেমন যেন অভিব্যক্তির পরিবর্তন হলো। আমি নিষ্পলক দেখতে থাকলাম।
তাঁর প্রক্ষিপ্ত দৃষ্টি অনুসরণ করে আমার নজরে পড়লো এক দীর্ঘ দেহি দোহারা গড়নের মানুষ ত্রস্ত পায়ে এগিয়ে আসছে ভদ্রমহিলার দিকে, যার মুখ ভর্তি লম্বা দাড়ি আর মাথা ভর্তি অবিন্যস্ত ঝাঁকড়া জট পাকানো চুল । সাদা কাপড়ে তার শরীর ঢাকা খালি পায়ের বেশ অনেকটাই উন্মুক্ত। নাটকের দৃশ্যের মতো মনে হলো। লোকটি ভদ্রমহিলার পায়ের কাছে বসলো, কোন কথা বললো না,শুধু মাথাটা খুব বিনয়ের সাথে তাঁর কোলে স্থাপন করলো। আস্তে আস্তে ভদ্রমহিলা তাঁর হাতটা পরম মমতায় ছেলেটির ঝাঁকড়া মাথার চুলের ভিতরে বোলাতে থাকলো। এই মেলার মাঝে একান্ত ব্যক্তিগত আন্তরিকতার মেলামেশা আমাকে কুঁকড়ে দিলো। আমি ভিড়ের মধ্যে মিশে গেলাম। বলা যেতে পারে পালিয়ে গেলাম।
রাতে তাঁবুর বিছানাতে শুয়ে এপাশ ওপাশ করতে করতে ভাবছিলাম, কে ঐ আগন্তুক যাকে পরম আত্মীয়ের মতো মাতৃসম স্নেহে উনি আদর করছিলেন? আমাকে জানতেই হবে।
আগামী পরশু মেলা প্রথামাফিক শেষ হবে। এর মধ্যে এই রহস্যের কিনারা আমাকে করতেই হবে। না হলে হয়তো আরো এক বছর অপেক্ষা করতে হবে। হয়তো আর খুঁজে পাবোই না ওদের। এমনও হতে পারে আমার আর আসা হলো না। পৃথিবীর বুকে কে কখন কোথায় কতক্ষণ আছে, সে কেই বা বলতে পারে?
মকর সংক্রান্তির মাহেন্দ্রক্ষণে পুণ্যস্নান করার উদ্দ্যেশ্যে ভিনদেশী পুণ্যার্থীরা জমতে শুরু করেছে। সূর্য মাথার ওপর থেকে পশ্চিমে সরে যেতে আমার নিজের কাজ কর্ম সেরে পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম, মেলা পেরিয়ে দুই নম্বর রাস্তার শেষ প্রান্তে যেখানে রাস্তা নেমে গেছে সাদা জমাট সরু বালির সমুদ্রতটে। আজ চারিদিকে আরো ভিড়, আরো আওয়াজ, আরো আনন্দ । আমি অভীষ্টের সন্ধানে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম।
অবশ্য উতলা হওয়ার কোন দরকার ছিল না। তাঁকে নির্দিষ্ট স্থানেই পেলাম।
আমাকে দেখলেন, ইশারায় পাশে একটা ফাঁকা চেয়ারে বসতে বললেন। বসলাম।
– কাল পালিয়ে গেলে ?
– না, মানে আমার কিছু জরুরী কাজ ছিলো..।
– সে তো থাকতেই পারে। তবে তুমি আজও কি ঐ সময়ে ব্যস্ত থাকবে?
– হয়তো থাকতে হতো, কিন্তু আপনার আশ্বাসে সেই ভুলটা আজ করছি না। আজ আমাকে গল্পের শেষটুকু জানতেই হবে।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে ধীর ও মেদুর কন্ঠে বললেন,- গল্পই বটে, বুকের গভীরে লুকিয়ে রাখা অসহ্য বেদনার গল্প। কাউকে বলতে পারলে হয়তো হালকা হ’তাম। না, জনে জনে সবাইকে বলতে পারলেই আমি ভারমুক্ত হতাম।
– আমি কি আপনার পায়ের কাছে এই মাটিতে বসতে পারি।
উনি আপত্তি করলেন না।
প্রায় রূপকথার মতো গল্পের বাকি অংশটা ওনার মুখে শুনি, – ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনাতে আমি খুব ব্যস্ত থাকতাম। তাই বিয়ে থাওয়া হয় যখন, তখন আমি স্নাতকোত্তর করার পর কলকাতার একটা নাম করা মেয়েদের স্কুলের শিক্ষিকা হিসেবে যথেষ্ট প্রতিষ্ঠিত। যথেষ্ট পরিণত। বিয়েটা হলো। সম্বন্ধ করেই হলো । আমার স্বামীও সাংঘাতিক রকমের ভালো পাত্র, অন্ততঃ পাত্রী পক্ষের কাছে।
কিন্তু বছর ঘুরতে না ঘুরতে বুঝলাম আমি বেশ বিপদে পড়েছি। চূড়ান্ত ক্যারিয়ারিস্ট স্বামী কোন কারণে আমাকে পছন্দ করছেন না। এটা আমার আত্মসম্মানে লাগে। আমি কখনও এ ব্যাপারে কৈফিয়ত চাইনি কিম্বা কোন রকম ভালোবাসা জোর করে পাওয়ার চেষ্টা করিনি। তিনি তখন তোমাদের সরকারের একজন আন্ডার সেক্রেটারি ছিলেন। একজন তুখোড় আমলা। বলতে পারো কপাল আরো পুড়লো যখন চাকরি জীবনে আরো বড় সুযোগ পেয়ে বছর কয়েক বাদে তিনি দিল্লী চলে গেলেন। সম্পর্কের অবশিষ্টটুকুও শেষ হয়ে গেল।
বিপদ যে অধিকাংশ সময় একা আসেনা সেটা আমার টের পেতে দেরি হলো না। আমার বিপত্নীক বাবা, যিনি আমার একমাত্র আশ্রয়স্থল, তাঁকে হারালাম অতর্কিতে।
আরো আছে। আমি তখন মা হতে চলেছি। কান্নার বদলে আমি খুব উদাসীন হয়ে গেলাম। সুখ দুঃখের বোধটাই হারিয়ে ফেললাম। সহকর্মীরা জানতেন সবই, পরামর্শ দিতেন কোন সাইকিয়াট্রিস্ট দেখাতে। আমি কিছুই করতাম না। নার্সিং হোমে ডেলিভারির জন্য যাওয়ার আগের দিনও ক্লাসে মেয়েদের পড়িয়েছি। কাজের মাসিকে নিজের বাসস্থানের সব দায়ভার বুঝিয়ে স্কুলে চলে আসতাম আর কাজের মধ্যে বোধহয় ইচ্ছে করেই নিজেকে ডুবিয়ে দিতাম, যাতে দুঃখ অপমান অবহেলা বোধটা না আসে।
ছুটি পেলাম মাতৃত্ব কালীন কিন্তু ব্যবহার করলাম না। বাড়িতে আয়ার জিম্মায় বাচ্চাকে রেখে কাজে যোগ দিলাম। ছেলেটা আস্তে আস্তে কেমন অভ্যস্ত হয়ে গেলো। আমাকে যখন কাছে পেতো খুব জড়িয়ে থাকতো, আবার আমি স্কুলে যাওয়ার সময়ে ও আমাকে ঠিক ছেড়ে দিতো। দিন মাস বছর ঘুরে যায়। ছেলে বড় স্কুলে ভর্তি হলো। নিজের ক্ষমতায়। শুধু মাকে রাগানোর জন্য বলতো, – মা,বাবা তোমাকে খুব ভালোবাসতো, না ? আমি আসবো জেনেই তোমাকে ফেলে চলে গেলো ?
আসলে ওকে সব বলেছিলাম কোন রাখ ঢাক না করেই। ও বাবাকে চিনতো, হয়তো দেখেনি কখনো। তিনি তখন বিদেশমন্ত্রকের নামজাদা লোক।
একদিন যোগ্য সন্তান হিসেবে ছেলে আমার আই আই টি-তে ভর্তি হলো। আমি আস্তে আস্তে বৃদ্ধ হতে থাকলাম। ছুটিতে বাড়িতে এলে দুজন মিলে গঙ্গার ধারে বেড়াতে যেতাম। ফুচকা, আলু কাবলি, বাদাম ভাজা খেতাম, কখনো সখনো ডেকার্স লেনে চিত্তদার দোকানে ফিস্ ফ্রাই চিকেন পকোড়া, চা খেতাম। আর ভাবতাম এটাই বোধহয় জীবন। একজন সফল মানুষ আমাকে এতটা ঘৃণা করলো উপেক্ষা করলো, আর সেটা পুষিয়ে দিলো তারই উত্তরসূরী, তারই ঔরসজাত সুসন্তান । বি টেক শেষ করে ছেলে চাকরি পেলো, বেশ ভালো চাকরি, শুরুতে কলকাতার সল্টলেক সিটিতে। যেতে আসতে এক-দেড় ঘন্টা বাকি আট ঘন্টা কাজ। অফিসের গাড়িতেই যাতায়াত।
বেশ কিছুদিন কাজ করার পর, যেটা আশঙ্কা করেছিলাম সেটাই হলো। ছেলে একটা অফিসের প্রোজেক্টে সুযোগ পেলো অ্যামেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ায় যাওয়ার।
সবার ক্ষেত্রে যেটা খুব আনন্দের বিষয় হওয়া, আমার কাছে সেটা হয়ে গেল চূড়ান্ত বিচ্ছেদের ঘটনা । হয়তো দু চার বছর বা তারো বেশি সে সেখানে থেকে আবার ফিরে আসবে। কিন্তু আমার নিঃসঙ্গ জীবনে সেটা অনন্ত অপূরণীয়। কষ্ট পেলাম বটে মেনেও নিলাম।
পাঁচ সাত দিন বাদে সে তার এক বান্ধবীকে আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো , এক অফিসে কাজ করে। দক্ষিণ ভারতীয় মেয়ে কিন্তু কলকাতায় পড়াশুনা । পরিষ্কার বাংলা বলতে পারে। খুশি হলাম আবার দুঃখও পেলাম।
যেখানে আমিই ছিলাম তার জীবনে একমাত্র মানুষ, ভাগ বসালো আর একজন। অবশ্য এটাই তো স্বাভাবিক। মেয়েটা খুব বুদ্ধিমতি, কথাবার্তায় তুখোড়। সব ভাষাতেই অনর্গল।
খোকার বিদেশ যাত্রা নিয়ে সে ভীষণ খুশি, অতিশয় উচ্ছ্বসিত। সেও সেখানে ছিলো এখানে ছ’ মাসের জন্য এসেছিল, আবার চলে যাবে। আসলে ও ছেলের থেকে একটু সিনিয়র। নিজেই খোকার প্রজেক্টের ব্যাপারে উদ্যোগী হয়ে এত দ্রুত কাজটা বার করে এনেছে।
আমি মেয়েটার চোখের ভাষা পড়ার চেষ্টা করলাম। অনেক দিনের প্রধান শিক্ষিকা। ভুল হওয়ার কথা নয়। বন্ধুত্বের বাইরেও মেয়েটি কিছু অতিরিক্ত চাইছে।
জীবনে নির্লিপ্ত থাকার ব্যাপারটা কিছু বছরের জন্য চলে গেছিলো। মনে হলো আবার ফিরে আসছে। যা হোক নিরপেক্ষ ভাবে জীবন তো সবারই নিজস্ব। সেখানে খুব বেশি উঁকি মারা আমার স্বভাব বিরুদ্ধ।
একদিন দেখতে দেখতে তার বিদেশে পাড়ি দেওয়ার সময় এগিয়ে এলো। আমি জেদ করে স্কুলের কাজে সময় বাড়িয়ে দিলাম। মাঝে মাঝে ছেলে অফিস থেকে ফোন করে তার কাজের কথা বলে। আমি নির্লিপ্ত উদাসীন হতে চেষ্টা করলাম।
এভাবেই চলছিলো। কিন্তু আমার জীবনরেখা আবার বদলে গেলো একদিনের ঘটনায় ।
বাইশে শ্রাবণ, দিনটা সবার যেমন মনে থাকে সেই কারণে আমারও মনে আছে। আমার সকল দুঃখের সাথী রবি ঠাকুরের গান চালিয়ে বিছানাতে চোখ বুজিয়ে শুয়েছিলাম। আগামীকাল ছেলে ভোরের ফ্লাইট ধরবে দিল্লী হয়ে পাড়ি দেবে সুদূর ক্যালিফোর্নিয়ায়, হয়তো আরবের কোন এয়ারপোর্টে একটু দাঁড়াবে । কোন কিছু করার মানসিক উৎসাহ পাচ্ছিলাম না। বিমর্ষ লাগছিলো। কোন এক সময় বোধ হয় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম অবসাদের অভিঘাতে। দরজায় বেল বাজার শব্দে চটকা ভেঙে গেলো।
ছেলে আজ আগে এসেছে। তবে একা নয়, সঙ্গে শুভলক্ষ্মী আইয়ার মানে তার বান্ধবী, হয়তো উড্ বি ওয়াইফ্।
চা জলখাবারের ব্যবস্থা করলাম আর তিনজনে মিলে রাতের রান্না করলাম। হৈ-চৈ করলাম , আর অন্ত্যাক্ষরী খেললাম। মনে মনে ভাবলাম এটাই হয়তো শেষ একসঙ্গে থাকা । সময় কাটানো।
মেয়েটাকে আজ খুব প্রাণবন্ত মনে হলো।তবে তার উচ্ছ্বাসকে ছেলে সবসময় সামলে নেওয়ার চেষ্টা করছিলো । কোন একসময় ও ওয়াশরুমে গেলে কারণটা জিজ্ঞাসা করাতে ছেলে বললো আজ অফিসে ও ককটেল পার্টি থ্রো করেছিলো তার অনারে, আর অনেকটা মদ খেয়ে ফেলেছে মেয়েটি ।
– তুমি কিছু মনে করো না মা।
ছেলে বললো। আমি খুব থমকে গেলাম । মদ নেশা আমি চরম অপছন্দ করি সেটা ছেলে জানে।
সে ফ্রেশ হয়ে বেরনোর পর, তখন রাত দশটা হবে, আমি বললাম,– শুভ বেটে, লেট আস হ্যাব আওয়ার ডিনার, ইয়োর ড্রাইভার ইজ ওয়েটিং।
– ও কে আন্টি, ও কে..।
তিন জনে একেবারে পরম আত্মীয়ের মতো এক টেবিলে বসে খাচ্ছি। আর কি করে আমার মনে পড়ে গেল আড়াই দশক আগের একটা ঘটনা। আমার স্বামী, ঠিক আজ ছেলে যে জায়গায় বসে, ঐখানে বসে মাথা নীচু করে খাচ্ছিলেন। দিনটি মনে থাকার কারণ পরদিন তিনি কোন ঘোষণা না করে আমার জীবন থেকে চির বিদায় দিলেন। সব ছিন্ন করে দিল্লি চলে গেছিলেন ।
ঘটনাটা মনে পড়াতে প্রথমে কয়েক ফোঁটা জল চলে এলো চোখে, তারপর বাঁধনহীন জলের ধারায় আমি ঝাপসা দেখতে শুরু করলাম।
– মা, তুমি কাঁদছো ? আমি চলে গেলে তোমার এতটা খারাপ লাগবে, তবে আগে বলোনি কেন ? এঁটো হাতে ছেলে আমার পাশে এসে বাঁ হাত দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরলো ।
– খোকা, সবাই আমাকে ছেড়ে যায় কেন বলতো? কি পাপ করেছি আমি ? তোর বাবা, দাদু, দিদা আরো কত আত্মীয়স্বজন শুধু আমাকেই ছেড়ে চলে গেছে, কেন ? আমার কি দোষ বল? আজ তুই ও ছেড়ে চলে যেতে চাইছিস। আমি তবে কি নিয়ে থাকবো বল ?
এই অবধিই থেমে যেতে পারতো ঘটনাটা, কিন্তু আমার জীবনে সেটা হওয়ার নয়, কখনও হয়নি। ছেলে হঠাৎ প্রায় আঁতকে উঠে বলল,- তুমি কি বলছো মা, আমি কি সত্যিই এটা পারি, তুমি রাজি হয়েছিলে বলেই আমি অফারটা অ্যাক্সেপ্ট করেছি। নো ওয়াারি মম্, আই অ্যাম কুইটিং দা জার্নি। ডোন্ট ক্রাই মা, আই ক্যানন্ট টলারেট , মা জাস্ট লিসন্, আমি কাল ফ্লাই করছি না, ওকে…।
মেয়েটা তার প্রিয় চিংড়ির রেসিপি চিবোতে চিবোতে থমকে গেলো, চোখ বড় করে প্রায় চিৎকার করে বলে উঠলো,
– হোয়াট্ দা হেল আর আর য়ু টকিং সোম, ডাজ দা লেডি নো ইওর ক্যারিয়ার, হোয়াট্ ননসেন্স্ ? হিস্ হিস্ করে করে উঠলো তার গলা, কথাগুলো সে তার ‘ উড বি শাশুড়িকে’ বলছে। ভাবা যায় সে একজন শিক্ষিত মেয়ে!
তখনও শেষ হয় নি বিষ ঝাড়া। অনর্গল বলে চলেছে, হয়তো মদের ঘোরে, – য়ু ওল্ড, আ উইচ্, জেলাস, আ বাস্টার্ড!
কথাটা শোনার সাথে সাথে কান মাথা ঝাঁ ঝাঁ করতে শুরু করলো। দু হাতে কান দুটো চেপে ধরলাম। মাথাটা নীচু করে এই অপমান সহ্য করলাম। আমি সহ্য করলেও ছেলে বোধহয় পারছিলো না। আমাকে ছেড়ে দিয়ে ও শুভলক্ষ্মীর দিকে দ্রুত এগিয়ে গেল ওকে সামলাতে। মেয়েটা কি ভাবলো কে জানে চরম আক্রোশে একটা ভারী জলের জগ নিয়ে আমার দিকে তাক করে মাতালের মতো ছোঁড়ার চেষ্টা করলো। আমাকে বাঁচাতে দিগ্বিদিক জ্ঞান শূন্য হয়ে ছেলে একটা ধাক্কা মারলো শুভলক্ষ্মীকে। মুহুর্তে ঘট্ করে একটা আওয়াজ হলো আর মেয়েটাকে দেখলাম বেসিনের নীচে ঢলে পড়তে। আমরা দুজনে ছুটে গিয়ে ওকে তোলার চেষ্টা করলাম। ও কেমন নেতিয়ে পড়ে আছে। কেমন সন্দেহ হলো আমার। কোন সর্বনাশ হয়ে গেলো না তো?
আমার আতঙ্কিত চাউনি ও মুখের ভাষা বুঝে ছেলে মেয়েটির নিশ্বাস-প্রশ্বাস পরীক্ষা করলো, হাতের নাড়ি দেখার চেষ্টা করলো। বুকে কান দিয়ে হার্ট বিট শোনার চেষ্টা করলো।
– ও,মা একি হলো? তুমি একবার দেখো, আমি ডাক্তারবাবুকে কল করছি।
– এক মিনিট, আমি করছি।
আমি ওর নাড়ি ওর নিশ্বাস-প্রশ্বাস চেক করলাম। দুর্ভাগ্যের বিষয় আমি কিছুই পেলাম না।
জীবনের খারাপতম পরিস্থিতিতে পড়লাম। ডাঃ সাহা এলেন, আমাদের ফ্যামিলি ফিজিসিয়ান। ওনাকে বললাম মেয়েটা এখানে আমার সাথে দেখা করতে এসেছিলো।
ছেলের সাথে ওর সম্পর্কের কথা উল্লেখ করলাম না। অনেক প্রাক্তন ছাত্রীই যেমন আসে ও তাদেরই মতো একজন। উনি বিশ্বাস করলেন। আগেই ছেলেকে বলেছিলাম ও যেন ডাক্তারবাবুর সামনে না বার হয় ।
যেহেতু অস্বাভাবিক মৃত্যু, ‘ব্রট-ডেড ‘ হিসাবে ইমারজেন্সির খাতায় তোলা হলো, আমার জবানবন্দি নেয়া হলো। পাড়ার ছেলেরা অনেকটা সাহায্য করলো। ছেলেকে একা রেখে গিয়েছিলাম। বলে গেছিলাম তুমি রেডি থাকবে ভোর পাঁচটায় পাড়ার বলাই বলে একটা জানাশোনা ড্রাইভার ট্যাক্সি নিয়ে আসবে। সকাল সাতটায় ফ্লাইট। বাকিটা আমি সামলে নেবো।
সকল রকম অপরাধ বোধ থাকা সত্ত্বেও আমার চাকরিসূত্রে প্রশাসনগত যতটুকু সাহায্য পাওয়া যায় নিলাম এবং জীবনে এই প্রথম নিলাম। পোস্ট মর্টেম হবে। এনকোয়ারি হবে, কেউ কেস করলে তদন্ত গড়াবে।
ঘরে ফিরে মূহ্যমান ছেলেকে সামলানো তার ব্যাগেজের লাস্ট মিনিট প্যাক করা সবই করে দিলাম। প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও তাকে ভোরবেলা নিজে নিয়ে গেলাম এয়ারপোর্টে। ও ভিতরে ঢুকে গেলে আমি বাড়ি ফিরে এলাম।
এই শক্ত মাধবীলতা তখন আরো কঠিন হয়ে গেলো। স্নান করে চা বানিয়ে ডাইনিং টেবিলে বসলাম। কাল সন্ধ্যা থেকে
এই প্রথম নিজের মতো করে বসতে পেলাম।
আর তখনই মনে মনে আতঙ্কিত হলাম, হায় ঈশ্বর, এবার আমি কি করবো ?
পুরোনো ডায়েরিটা নিয়ে এলাম। একটা ল্যান্ড লাইন নম্বরে ফোন করলাম, – হ্যালো, হ্যালো।
ওপারে রিং হলো।অনেকক্ষণ রিং হওয়ার পর রিসিভার ওঠাবার শব্দ।
– আমি মাধবী..
কোন রেসপন্স করলো না। কিন্তু আমি আমার কর্তব্য করলাম। সব ঘটনা বললাম ধীরে ধীরে। – তোমাকে ঘটনাটা জানিয়ে দিলাম।
প্রত্যুত্তরের অপেক্ষা না করে আস্তে আস্তে রিসিভারটা নামিয়ে রাখলাম।
আমাকে আর অসুবিধায় পড়তে হয়নি। শুধু লোকাল থানায় কয়েকবার হাজিরা দিতে হয়েছিলো। আমার ডাক্তার বাবুকে ছাত্রী বললেও ইমারজেন্সিতে শুভলক্ষ্মীর অফিসের ঠিকানা দিয়েছিলাম। চাকরির কথা বলেছিলাম। অন্ততঃ বাড়ির লোক যদি খবর পায়। যদি দেখতে চায়।
অফিসের লোকজন খবর পেয়ে আমার সাথে কথা বলতে এলো। আমি বললাম ও বাথরুম থেকে বেরিয়ে বেসিনে আয়নার সামনে যখন নিজেকে দেখছিলো তখন সেন্সলেস হয়ে যায়। বাকি গল্পটা গল্পের মতো করে বললাম। ওরা কেরলে ওর বাড়িতে ফোন করার চেষ্টা করলো, পেল না।
আমি জানতাম এবং এখন সেটা প্রমানিত হলো। এই সব কর্পোরেট হাউসে কেউ কারো খোঁজখবর বিশেষ রাখে না।
ওরা চলে যেতে আমি স্কুলে গেলাম। একটু পালিয়ে থাকতে চাইছিলাম।
একটা মৃত্যুর সব খবরই চাপা পড়লো। কারণ শুভলক্ষ্মীর পরিবারের পক্ষ থেকে থানায় কোন কমপ্লেন জমা পড়েনি। চাপা পড়ার আরো বড় কারণ হয়তো ছেলের বাবা। ক্ষমতার অলিন্দে থাকা মানুষটি লম্বা হাতে দূর থেকে অনেকটা সাহায্য করলেন।
ছেলের সাথে যোগাযোগ হলো বেশ কিছুদিন বাদে। ও একটা ঠিকানা আমাকে পাঠালো কেরালার একটা সাবডিভিশন টাউনের । এটা শুভলক্ষ্মীর বাড়ির ঠিকানা। আমাকে খোঁজ নিতে বললো।
এটাই স্বাভাবিক তার পক্ষে এবং অবশ্যই আমার পক্ষে। মেয়েটা তো কিছু দোষ করেনি সে আমার ছেলেকে বিয়ে করতে চেয়েছিলো এবং আমার ছেলের একটা সুন্দর সম্ভাবনাময় উজ্জ্বল জীবনের ছবি আঁকতে চেয়েছিলো। মাতাল =অবস্থায় সে কিছু খারাপ কথা বলে ফেলেছিলো। আমি হয়তো ব্যাপারটা আরো স্পোর্টংলি নিতে পারলে, ছেলে ওকে ধাক্কা মারতে যেতো না। আর এই ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতো না। এটা তো পুরোপুরি একটা দুর্ঘটনা ছাড়া অন্য কিছু নয়।
কেরালায়, একা নয় একজন বান্ধবীকে নিয়ে গেলাম। মফঃস্বলে তাদের ছোট একটা বাড়ি। অনেক খোঁজ খবর নিয়ে জানা গেলো মেয়েটার বাবা বছর তিনেক আগে মারা গেছেন। মা একা এখানে থাকেন। দুঃখের কিম্বা সুখের বিষয় তিনি একজন স্কিজোফ্রেনিয়ার রুগী । সেই মূহুর্ত্তে তাঁর অবস্থা এমনই যে তাকে বাড়িতে বেঁধে রাখতে হয়েছে। আত্মীয়রা মেয়েটির দূর্ঘটনার খবর পেয়েছিলো কিন্তু কলকাতায় গিয়ে একটা কমপ্লেন করার মতো অবস্থায় তাদের জনবল বা মনোবল কিছুই ছিলো না। তারা মেনে নিয়েছিলো সবই নিয়তির খেলা ।
আমি খানিকটা আশ্বস্ত হয়ে কলকাতায় ফিরলাম। যে দিন ফিরে এলাম তার ঠিক একদিন বাদে গভীর রাতে খোকা ফোন করলো, – মা আমি ফিরে আসছি। কেন জানতে চাও, কাল রাতে আমি শুভলক্ষ্মীকে স্বপ্নে দেখলাম। ও আমাকে খুনি, কাপুরষ ও আরো অনেক রকম গালাগাল করলো। মা আমি সারেন্ডার করবো, সত্যি কথা বলবো। তুমি বাবাকে বলো, শুভলক্ষ্মীর ফাইলটা পুলিশ আবার ওপেন করুক। আমি বিবেকের কাছে কোন কৈফিয়ৎ দিতে পারছি না।
– কিন্তু তোর চাকরি, তোর ক্যারিয়ার ?
– তোমাকে বলা হয়নি মা, আমি ঐ চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছি। আমি ঠিক করেছি কলকাতায় ফিরে যাবো এবং পরবর্তী পরিস্থিতির উপর নির্ভর করছে বাকি জীবন।
গভীর হতাশায় ডুবে যাচ্ছি। মনে হচ্ছে তলিয়ে যাচ্ছি ঘোলা জলে। নিশ্বাস নিতে পারছি না। কিন্তু আমার এই মুহূর্তে কিছু করার নেই। শুধু যা ঘটবে সেটা মেনে নেয়া ছাড়া। ঘোলা জলের ঘূু্র্ণিপাক ফুঁড়ে বেরোনোর সব পথ বন্ধ। পরিস্থিতির কাছে আত্মসমর্পণ করা ছাড়া কোন গত্যন্তর নেই।
স্কুলে প্রথম হাফ কাজ করার পর একটু ফাঁকা পেয়ে ভাবছি কি করবো? থানায় যাবো? দিল্লিতে ফোন করবো? না খোকাকে ফোন করে বলবো, তুই যেখানে পারিস একটা চাকরি জোগাড় করে বিদেশে থেকে যা কলকাতায় আসিস না।
টেবিলে রাখা ফোনটা বেজে উঠলো অফিসের ফোন, হ্যালো বলার সাথে সাথে ওপাশ থেকে ভেসে এলো,- ম্যাডাম, আমি থানা থেকে বলছি,আপনার ফাঁকা সময়ে একবার দয়া করে দেখা করে যাবেন ।
-কি ব্যাপারে বলুন তো?
-ম্যাডাম, এটা শুভলক্ষ্মীর অস্বাভাবিক মৃত্যুর কেসটা। আসলে গত সপ্তাহে ওর এক ভাই যে সল্টলেকে আই টি সেক্টরে নতুন জয়েন করেছে। তার কমপ্লেন লেটারে এই মৃত্যুর পিছনে ‘ আপনার ছেলে জড়িত’ এমন একটা কমপ্লেন করেছে । তাই আপনাকে দেখা করার অনুরোধ করছি।
বিনয়ের সাথে ও সি কথাগুলো বললেও, এর মধ্যে একটা আদেশের সুর আছে। যেটাকে অস্বীকার করা যায় না। মাধবীলতার খারাপ লাগলো।
-ঠিক আছে স্কুলের পরে আপনার সাথে দেখা করে যাবো। আপনি নিশ্চয় থাকবেন?
– ঐ কেসটা আমার সেকেন্ড অফিসার ভবেন বিশ্বাস বাবু দেখছেন, ওনার সাথে দেখা করলেই হবে।
ফেরার পথে ভবেন বাবুর সাথে দেখা করলাম এবং সমস্যা যে আষ্টেপৃষ্টে বাঁধছে আমাকে, বুঝলাম।
– দিদি আপনাকে আবার বিব্রত করতে হচ্ছে, কিন্তু আমাদের সত্যি কিছু করার নেই। আমি জানি আপনি ব্যস্ত মানুষ। আগেও বলেছি আমার মেয়ে আপনার স্কুলে ক্লাস নাইনে পড়ে নীহারিকা বিশ্বাস..
– হ্যাঁ, ও খুব ভালো নাচে।
– হ্যাঁ দিদি, ওর তো মা নেই, আমাকেই সব দেখতে হয়।
– ও বলেছে আমাকে।
– দিদি আপনার সময় নষ্ট করবো না। যে কারণে আপনাকে আসতে হয়েছে সেটা বলি। মেয়েটির ভাই অশোক আপনার ছেলের অফিসে কিছু দিন হলো জয়েন করেছে। সেদিন এক নামজাদা ক্রীমিনাল ল ইয়ার ব্যারিষ্টার মিঃ ঘোষকে নিয়ে এসে একটা কমপ্লেন জমা করেছে। উনি দুঁদে উকিল, বয়ানে কোন ফাঁক ফোকর রাখেনি। অভিযোগ পত্রে সই করেছে মেয়েটির মা। বক্তব্য খুব পরিস্কার। এটা একটা ইচ্ছাকৃত খুনের ঘটনা। কোন মতেই এটা দুর্ঘটনা নয়। পরিকল্পনা মাফিক আপনার ছেলে খুনটা করেছে। বিদেশে যাওয়ার আগের সন্ধ্যেবেলা ওদের অফিসে যে পার্টি ছিলো সেখানে মেয়েটিকে জোর করে আপনার ছেলে অনেকটা মদ খাইয়েছিলো এবং বাড়িতে এনে ঠান্ডা মাথায় খুন করেছিলো।
মোটিভ ক্যালিফোর্নিয়ার অফিসে যাতে মেয়েটি ওর সিনিয়র হয়ে না জয়েন করতে পারে। ব্যারিষ্টার ঘোষ রাস্তার মোড়ের সি সি টিভির উল্লেখও করেছেন। ঘটনার দিন আপনার ছেলে সন্ধ্যেবেলা বাড়ি ছিলো এবং মার্ডারটা ওই করেছে। ও যে বাড়িতে ছিলো সেটা সি সি টিভি ফুটেজ পরীক্ষা করলে বোঝা যাবে।
– বিশ্বাস বাবু আমি আমার বয়ান দিয়েছি। এবার আপনারা ইনভেস্টিগেট করুন। যদি সত্যি ঘটনা বেরিয়ে আসে সবচেয়ে খুশি হবো আমি।
– দিদি ওর অফিসের থ্রু ক্যালিফোর্নিয়ার ষোগাযোগ করা হয়েছিলো। আপনার ছেলে তখন বেশ কয়েকদিন কাজে অনুপস্থিত। ফোন করে আগের কনট্যাক্ট নাম্বারে পাওয়া যায়নি। কিন্তু ওপর থেকে এতটাই চাপ যে ওকে অ্যাবস্কন্ডিং ঘোষণা করতে হবে। তাই বলছিলাম আপনি যদি তার সাথে আমাকে একটু যোগাযোগ করিয়ে দেন। তাহলে কেসটার চার্জশিট তৈরি করতে আমার সুবিধা হয়।
– আমার জানা থাকলে নিশ্চয়ই দিতাম বিশ্বাসবাবু। আসলে এই মুহুর্তে ছেলের সাথে আমার কোন যোগাযোগই নেই। আপনি কিছু মনে করবেন না।
– ঠিক আছে দিদি তাহলে হয়তো ইন্টারপোলের শরণাপন্ন হতে হবে। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। চা খাবেন?
-না। এই বলে রাস্তায় নেমে পড়লাম আর বিষাদগ্রস্থের মতো বাড়িতে এসে ঢুকলাম।
ছেলে আত্মসমর্পণ করতে চাইছে, অথচ সেটা করলে তার পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ তার নিশ্চয়ই জানা আছে। আমি আর কিছু ভাবতে পারছি না। শুধু মনে হলো আজ রাতে দিল্লিতে একটা ফোন করতে হবে। সব দ্বায়িত্ব এবং দায়ভার কেন আমি একা নেব ?
রাত তখন এগারোটা হবে। আমি ইতস্তত বোধ করছি ওনাকে ফোন করতে। ঠিক সেই সময়ে একটা ফোন এলো, চেনা গলা, – মা আমি তোমাকে যোগাযোগ করিনি কিন্তু আমার অফিসের মিঃ লি আমাকে ফোন করে সব ঘটনার ডিটেলস্ জানিয়েছে। আমি ভায়া চায়না একটা ফ্লাইটে সাতদিন হলো নেপালে এসে এক হিলি এরিয়ায় শেল্টার নিয়েছি। আমি বিদেশি পুলিশের হাতে ধরা দিতে চাইছি না। আমি দেশে ফিরে আমাদের লোকাল থানায় সারেন্ডার করবো।
– কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি পুলিশ তোর নামে লুক আউট নোটিশ দিতে পারে।
– চিন্তা করো না মা,আমি ধরা না দিলে আমাকে কেউ ধরতে পারবে না।
এভাবেই দিন যায়, রাত যায়, মাস যায়, আমি চরম হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ছি। মাঝে মাঝে ছেলের ফোন পাই তবে দু-এক মিনিটের জন্য। কোন খবরই পুরো পুরি সে দেয় না। হয়তো ধরে নিয়েছে তার কল্ ট্যাপ করা হচ্ছে।
বেশ কিছুদিন বাদে শুধু বললো,- শীতে দেখা হবে।
তখন শরতের শুরু। অপেক্ষার শেষ নেই। একটা রেজিস্টার্ড চিঠি পেলাম, ছাপ দেখে বুঝতে পারলাম নেপালের এক পোষ্টঅফিসে পোষ্ট করা চিঠি।একদিন শীত ও চলে এলো। তার দিক থেকে নির্দেশ এলো এখানে আসার। এর আগে কখনও এই দ্বীপে আমি আসিনি।
তিন বছর আগে ঠিক এখানে তার সাথে দেখা হয়, এইরকমই এক গোধূলির শেষ লগ্নে। এরকমই জনসমাগমে এই পবিত্র সাগর সঙ্গমে, যেখানে বাংলার পুরাণ, সাহিত্য, ইতিহাস মিশে আছে।
আমি চুপচাপ শুধু এই উজ্জ্বল নারীর জীবনের অন্ধকার কাহিনী শুনছি।
-আর কি তোমাকে বিশদে বলার আছে?
-না, শুধু একটা কথা।
আমি একজন সাধারণ সরকারি কর্মচারী। জীবনের মহৎ অথবা গভীর কালো দিক খুব বেশি দেখিনি। মনে হলো তাদের মা ও সন্তানের এই মহামিলনের কি কোন অবসান করানো যায় না?
আমি জিজ্ঞেস করলাম, – এর শেষ কোথায়? কোন ভাবেই কি এর পূর্ণচ্ছেদ হয় না ?
– হয়তো, হয়? হয়তো খুব তাড়াতাড়ি এর যবনিকা পতন হবে।
-কি ভাবে? যদি বলতে বাধা না থাকে।
তাঁর গলা ধরে আসছিলো। একটা চা ওয়ালাকে ডেকে দু কাপ চা নিলাম। উনি আপত্তি করলেন না।
এক চুমুক দিয়ে বললেন, – গত পরশু যখন বাড়ি থেকে সাগর দ্বীপের উদ্দেশ্যে বেরোতে যাবো ঠিক তখন দিল্লী থেকে ওনার ফোন, – মাধবী, তোমাকে আমি জীবনে কোন আনন্দই দিতে পারিনি, যা দিয়েছি তা শুধু দুঃখ আর অপমান। একটা কথা বলি, আমাদের খোকার জন্য মিঃ জেটমালানির সাথে কথা হয়েছে, উনি রাজি হয়েছেন কলকাতা হাইকোর্টে গিয়ে আমাদের হয়ে কেসটা লড়তে। আর আমি সামনের মাসে রিটায়ারমেন্টের পর কলকাতায় ফিরে যাচ্ছি। তুমি চিন্তা করো না। বাকিটা আমি সামলে নেবো। আমি সব রকম চেষ্টা করছি।
ভদ্রমহিলা হু হু করে কেঁদে ফেললেন। আমি চুপ করে রইলাম । পরিস্থিতির চাপে ন্যুব্জ অসহায় এক মা এবং স্বামী বিচ্ছিনা একজন সুশিক্ষিতা নারী হয়তো তাঁর চোখের জল সরাসরি না হলেও কপিলমুনির উদ্দেশ্যে বিসর্জন দিচ্ছেন।
সাদা বালির সমুদ্রতটে ফুলের ডালি হাতে নিয়ে পুণ্যার্থীরা ধীর পায়ে অনুচ্চারিত মন্ত্রপাঠ করতে করতে জ্বলন্ত প্রদীপমালা ভাসিয়ে দিচ্ছেন। মাইকে সুরক্ষার নিমিত্ত সাবধান বাণী ঘোষিত হচ্ছে।
আমি তাঁকে বললাম, – আমি অপেক্ষা করে থাকবো একটা বছর, সামনের মেলায় আমি তিনজনকে একসাথে দেখবো এই আশায়। কপিলমুনি কারো ইচ্ছা অপূর্ণ রাখেন না। জয়, কপিল মুনির জয় ।
(শেষ)