জয়ন্ত দাসের লেখা ‘বিবর্তন: আদি যুদ্ধ, আদি প্রেম’ বইটি পড়ে শেষ করলাম। এই বইয়ের লেখকের চিকিৎসক হিসেবে অন্য আরেকটি দীর্ঘ পরিচিতি আছে। আমি তাঁকে ব্যক্তিগতভাবেও চিনি কিন্তু এই পাঠপ্রতিক্রিয়া লেখার ক্ষেত্রে আমি সর্বান্তকরণে তাঁর অন্যান্য সব পরিচয় ভুলে শুধুই লেখক হিসেবে বিচার করবো।
লেখার শুরুতেই যেটা বলবো: এই বইয়ের জন্য কোনও বিজ্ঞাপন লাগা উচিত নয়। এই বই আপনার সংগ্রহে না থাকলে সেটা পাঠক হিসেবে আপনার ক্ষতি। হ্যাঁ, ক্ষতি। খুব বেশি বাংলা বইয়ের সম্পর্কে এই কথা বলা যায় না। বিবর্তন সম্পর্কে এ ধরনের তথ্যপ্রমাণ সহ প্রায় গবেষণাধর্মী লেখা বাংলা ভাষায় সম্ভবত আর একটিও নেই। তবে তাই বলে ভাববেন না, বইয়ের ভাষা সাংঘাতিক গুরুগম্ভীর। ভাববেন না, এই বইয়ের কথাবার্তা মাথার ওপর দিয়ে গিয়ে ছাদে বসা কাকের দলকে লক্ষ্য করবে। গল্পের ছলে বিবর্তনের আপাত জটিল বিষয়গুলো তিনি আমার মতো সাধারণ পাঠকের উপযোগী করে তুলেছেন। নইলে আমিই বুঝতে পারতাম না।
আসুন, বইতে কী আছে দেখে নিই-
প্রথম অধ্যায়: কেন আমি বাবা-মায়ের মতো
দ্বিতীয় অধ্যায়: চার্লস ডারউইন- চিন্তাজগতে বিপ্লব
তৃতীয় অধ্যায়: যৌন নির্বাচন
চতুর্থ অধ্যায়: মানুষের উদ্ভব ও বিবর্তন
পঞ্চম অধ্যায়: জটিলতার জিনচিহ্ন
ষষ্ঠ অধ্যায়: লাগামছাড়া জিন বদলের শৃঙ্খলা
সপ্তম অধ্যায়: স্বার্থপর জিন ও তারপর
অষ্টম অধ্যায়: জিন, সমাজ, আচরণ
নবম অধ্যায়: প্রজাতির উদ্ভব
দশম অধ্যায়: অস্ত্র দৌড়- জিনের লড়াই
একাদশ অধ্যায়: বিবর্তন কি সত্যি?
দ্বাদশ অধ্যায়: বিবর্তন নিয়ে ভুল ধারণা
বিবর্তন সংক্রান্ত অজস্র প্রশ্ন ও তার উত্তর গল্পের মতো করে লেখা হয়েছে। নিজের জিন পরবর্তী প্রজন্মে পাঠানোর লড়াই, যৌনতার হরেকরকম, প্রাণের সৃষ্টি ইত্যাদি অসংখ্য জিনিস যেভাবে সহজবোধ্য ভাষায় তিনি লিখেছেন সেটা অত্যন্ত কঠিন কাজ। বিজ্ঞানের কথা বলতে গিয়েও সাহিত্যের ছোঁওয়া একটুও কমে না।
বইয়ের বাঁধাই, কাগজের মান, প্রুফ রিডিং সবই খুব ভালো। বানান ভুল একেবারেই নেই। একটা জায়গায় সামান্য একটা ভুল আছে কিন্তু সেটা এতটাই অকিঞ্চিৎকর যে এড়িয়ে গেলেও চলে। বিবর্তনের বিরোধিতা করে ধর্মের ধ্বজাধারীরা যেসব কথা বলেন সেগুলোকে যুক্তি দিয়ে খন্ডন করা হয়েছে। কোনও অমিত-শক্তিশালী কেউ কয়েকদিনে পৃথিবী, জীবজন্তু, মানুষ সৃষ্টি করেন নি। সবই প্রকৃতি আর বিবর্তনের খেলা।
বইয়ের একটা জায়গা একটু তুলে দিই:
“পৃথিবীর সমস্ত ইতিহাসকে যদি একটিমাত্র দিনের মধ্যে স্থান দেওয়া যায় তাহলে আমাদের এই কল্পিত ২৪ ঘন্টার দিনটি ৪৫৪ কোটি বছরের সমান হবে। এই ঘড়ির হিসেব অনুযায়ী রাত বারোটায় পৃথিবী গঠিত হলো। তারপর কয়েক ঘন্টা ধরে তা অতি উত্তপ্ত গলিত অবস্থা থেকে শীতল হলো। তারপরে মহাসাগর তৈরি হলো। পৃথিবীর বুকে গ্রহাণু আছড়ে পড়া কমে গেল। আদিম জীবন আবির্ভূত হলো ভোর চারটের আগে। এককোষী সালোকসংশ্লেষ কারী জীব উপস্থিত হল সকাল পাঁচটার সময়। ৯ঃ৪৫ নাগাদ এককোষী ইউক্যারিওট জীব এসে গেল। মাঝদুপুরে বায়ুমণ্ডল অক্সিজেন সমৃদ্ধ হয়ে উঠল। এল প্রথম বহুকোষী জীব। প্রথম জলজ প্রাণী রাত আটটা নাগাদ জন্ম নিল। রাত ন’টা নাগাদ হল ‘কেম্ব্রিয়ান এক্সপ্লোশন’ বা জীব বৈচিত্রের দ্রুত বৃদ্ধি। ডাঙ্গায় গাছ এল রাত ৮ঃ১৫ নাগাদ। স্থলের জন্তু প্রথম দেখা গেল রাত ০৯:১৫ এর সময়। ডাইনোসরগুলো রাত ১০:৪০ থেকে ১১:৪০ এই ১ ঘন্টা পৃথিবী মাতিয়ে রেখে বিদায় নিল। মানবজাতির পূর্বসূরীরা বাকিদের থেকে আলাদা হলে রাত্রি ১১ঃ৫৮ নাগাদ। আধুনিক মানুষ এসেছে এইমাত্র সেকেন্ড পাঁচেক আগে। মিশর মেসোপটেমিয়া সিন্ধু সভ্যতা সমেত গোটা মানব সভ্যতার আয়ু হল এক সেকেন্ডের ১০ ভাগের একভাগ।”
চমকে উঠি! প্রতিদিনের অজস্র ঘাম, শ্রম, কথা, রাগ, প্রেম, অভিমান; এ সবকিছুই প্রকৃতির এই বিপুল অনন্ত কর্মযজ্ঞের তুলনায় একটি ধুলিকণামাত্রও নয়!
লেখকের কাছে একটাই অনুরোধ- এই বইয়ের একটা ছোট্ট প্রতিরূপ লিখুন। আরও সংক্ষিপ্ত আকারে। যাতে একদম স্কুলের ছেলেমেয়েরাও পড়তে পারে।
শেষে শুরুর কথাটাই আর একবার বলবো, এ বই হাতে না নিলে পাঠক হিসেবে আপনার ক্ষতি!
প্রকাশকঃ গা ঙ চি ল
দামঃ ৫০০ টাকা