Being Mortal Medicine and What Matters in the End Atul Gawande Penguin, 2014
আমরা, চিকিৎসকরা মানুষকে বাঁচিয়ে রাখতে শিখি, ততোদিন যতোদিন সম্ভব। আমাদের শেখানো হয় না কিভাবে মানুষকে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত করতে হয়। কিন্তু বার্ধক্যে আর নিরাময়-যোগ্য নয় এমন অনেক রোগে মানুষ অবশ্যম্ভাবী মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হতে চান। চিকিৎসাবিজ্ঞান কি এই মানুষদের প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আনবে না? পরিবর্তন যদি আনা হয় তাহলে কি রকম পরিবর্তন?
চিকিৎসাবিজ্ঞানের প্রগতির সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুহার কমেছে, মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে, বেড়েছে প্রৌঢ়-প্রৌঢ়া, বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের সংখ্যা। ১৭৯০ খ্রীষ্টাব্দে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৬৫ বছর বা তার বেশি বয়সী মানুষেরা ছিলেন জনসংখ্যার মাত্র ২%, বর্তমানে ১৪%। জার্মানী, ইটালি ও জাপানে এমন বয়সীদের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ২০%-এরও বেশি। চীনে বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের মোট সংখ্যা ১০ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। ১৯৪৫ খ্রীষ্টাব্দ নাগাদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বেশির ভাগ মানুষের মৃত্যু হতো বাড়িতে। গত শতকের ৮০-র দশকে মাত্র ১৭% মৃত্যু বাড়িতে হতো—বড় ধরনের হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক বা বড় দুর্ঘটনা, যে ক্ষেত্রে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সময় পাওয়া যায় নি। কিন্তু একই সময়ে বেড়েছে চিকিৎসার খরচও। তাই এই প্রশ্নগুলোকে এড়িয়ে গেলে আজ উপায় নেই।
অতুল গাওয়ান্ডে একজন মার্কিন সার্জেন। তাঁর বাবা-মা দুজনেই অভিবাসী ভারতীয় চিকিৎসক। বাবা মহারাষ্ট্রের উটি নামের এক কৃষিজীবী পরিবারের সন্তান, পেশায় ইউরোলজিস্ট। মা ভারতের অন্য প্রান্তের, পেশায় শিশুরোগবিশেষজ্ঞ। মেডিক্যাল স্কুলে অতুল অনেক কিছু শিখেছেন, কিন্তু মানুষের নশ্বরতা বা মৃত্যু সে শিক্ষার মধ্যে ছিল না। শিক্ষার প্রথম দিকে তিনি এক মৃতদেহ পেয়েছিলেন বটে, তবে তা ছিল কাটাকুটি করে শারীরস্থান (anatomy) শেখার জন্য।
মেডিক্যাল স্কুলে মৃত্যু নিয়ে প্রথম আলোচনা এক সাপ্তাহিক সেমিনারে, ‘রোগী-ডাক্তার’ শীর্ষক যে সেমিনারের লক্ষ্য ছিল মেডিক্যাল ছাত্র-ছাত্রীদের মানবিক করে তোলা। আলোচনা হয়েছিল টলস্টয়ের ‘দ্য ডেথ অফ ইভান ইলিচ’ নিয়ে। ইভান ইলিচ ৪৫ বছর বয়স্ক এক ম্যাজিস্ট্রেট, সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে তাঁর কোমরে আঘাত লাগে, তিনি প্রচন্ড ব্যথায় শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন। একের পর এক ডাক্তার ডাকা হয়, একেকজন একেক রকম রোগ-নির্ণয় করে চিকিৎসা বাতলাতে থাকেন। কিন্তু কোন লাভ হয় না, শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে ইভান মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যেতে থাকেন। তিনি জানেন যে তিনি মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন, কিন্তু না তাঁর বন্ধু বা পরিবার না তাঁর চিকিৎসকরা এই সত্যটাকে মানেন। ইভানের কাছে এটাই সবচেয়ে কষ্টের।
অতুল অনেক মৃত্যু দেখেছেন, দেখেছেন চিকিৎসক হিসেবে, দেখেছেন পরিবারে। সেই মৃত্যুগুলোর দিকে এগিয়ে যাওয়ার সুন্দর বিবরণ রয়েছে এই বইয়ে। যা থেকে বোঝা যায় কোন ধরনের মৃত্যু আমাদের কাম্য, কোন ধরনের কাম্য নয়। এই মৃত্যুগুলোর মধ্যে তিনটে লেখকের নিকটজনেদের।
অতুলের ঠাকুরদা সীতারাম গাওয়ান্ডে মহারাষ্ট্রের উটি গ্রামের এক ধনী কৃষক। ১৮বছর বয়সে তাঁর বাবা মারা যান দু’ একর জমি আর ঋণের বোঝা রেখে। সীতারাম পরিশ্রম করে ঋণ শোধ করেন, দু’ একর থেকে বেড়ে তাঁর জমির পরিমাণ হয় দুশ’ একরেরও বেশি। অতুল যখন ঠাকুরদাকে দেখেন তখন তাঁর বয়স একশ’ বছরেরও বেশি, কুঁজো হয়ে লাঠিতে ভর দিয়ে চলেন, শোয়া-বসা থেকে উঠতে সাহায্য লাগে, কানে শুনতে পারেন না ভালো। তবু পরিবারে তাঁর স্থান উঁচুতে, বিবাহ-জমিজমা সংক্রান্ত বিবাদ-ব্যবসা সব বিষয়ে তাঁর মত নেওয়া হয়। বহু বছরের অভ্যাস মতো রাতে ঘুমোনোর আগে কিন্তু তিনি ঘোড়ায় চড়ে একবার নিজের জমিজায়গা পরিদর্শন করে আসেন, এমনটা চলেছিল তাঁর ১১০ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু অবধি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাসিন্দা হলে কিন্তু সীতারামের স্থান হতো নার্সিংহোমে।
যেমন হয়েছিল অ্যালিস হবসনের। সম্পর্কে অ্যালিস অতুলের দিদিশ্বাশুরী, পত্নী ক্যাথলিনের ঠাকুরমা। সীতারামের চেয়ে বছর পঁচিশেকে ছোট অ্যালিস। তাঁর ৬০ বছর বয়সে তিনি হার্ট অ্যাটাকে স্বামীকে হারান। যদিও তাঁর ছেলে-বউ কাছেই থাকতেন তবু তিনি থাকতেন একা। এটাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দস্তুর। গত শতকের প্রথম দিকে ৬৫ বছরের বেশি বয়সী মানুষদের ৬০% থাকতেন কোনও সন্তানের সঙ্গে, ৬০-এর দশকে অনুপাত কমে হয় ২৫%, ১৯৭৫-এ ১৫%। অ্যালিস থাকতেন স্বাধীন ভাবে, নিজে বাগানের ঘাস ছাঁটতেন, সেলাই করতেন আত্মীয়-বন্ধুদের জন্য, বন্ধুদের সঙ্গে মেলামেশা করতেন, নিজের গাড়ী নিজে চালাতেন। এমনটাই চলছিল তাঁর স্মৃতিভ্রংশের লক্ষণ দেখা দেওয়ার আগে অবধি, তারপর তাঁর স্থান হল এক বৃদ্ধাবাসে। পড়ে গিয়ে জ্ঞান হারানোর পর তাঁর বন্দীজীবন শুরু হল নার্সিংহোমে। কোনো স্বাধীনতা নেই—কখন ঘুম থেকে উঠবেন, কখন স্নান করবেন, কখন খাবেন—সব অন্য কারুর ইচ্ছায়। ৮৬ বছর বয়সে মৃত্যু তাঁকে বন্দীদশা থেকে মুক্তি দিল।
এমন ভাবে মৃত্যুর মুখোমুখি হতে হয়নি লেখকের বাবাকে। যখন তাঁর সত্তর পেরিয়েছে তখন ধরা পড়ে তাঁর সুষুম্নাকান্ডের ক্যানসার হয়েছে, ছড়িয়েছে মস্তিষ্কের নীচের অংশ অবধি, অপারেশন করে টিউমার বাদ দেওয়া যাবে না, স্নায়ুর ওপর চাপ একটু কমবে। প্রথমে রোগের উপসর্গ দেখে মনে হয়েছিল সারভাইকাল স্পন্ডাইলোসিস হয়েছে। তখন তিনি ইউরোলজি প্র্যাকটিশে ব্যস্ত, প্রচুর অপারেশন করেন। সপ্তাহে তিনদিন টেনিস খেলেন। স্থানীয় রোটারি ক্লাবের সভাপতি হওয়ার সুবাদে অনেক দাতব্য ক্রিয়াকর্মের সঙ্গে যুক্ত। তাছাড়া ভারতে তাঁর গ্রামে একটা কলেজ চালান তিনি, তাঁরই স্থাপন করা, ছাত্র-সংখ্যা ২০০০-এরও বেশি। ক্যানসার ধরা পড়ার পর দু’জন নিউরোসার্জেন দেখেন তাঁকে। প্রথম জন অতুলেরই হাসপাতালের, তাঁর বক্তব্য ছিল তাড়াতাড়ি অপারেশন করিয়ে নেওয়া। দ্বিতীয় জন বিখ্যাত ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিকের, একই অপারেশনের কথা বলেন তিনি, কিন্তু তাড়াহুড়ো করতে বারণ করেন, কেন না এই ধরনের টিউমার বাড়ে আস্তে আস্তে। অবশেষে তিনি অপারেশন করান রোগ ধরা পড়ার সাড়ে তিন বছর পর। এরমধ্যে তিনি বাধ্য হয়েছেন ইউরোলজি প্র্যাকটিশ ছেড়ে দিতে, টেনিস খেলা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। কিন্তু রোটারির প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব তিনি পালন করেছেন সুচারু ভাবে, তিনি যখন থাকবেন না তখন গ্রামের কলেজ কেমন করে চলবে তার ব্যবস্থা করেছেন। অপারেশনের পর রেডিওথেরাপি-কেমোথেরাপিতে যখন ফল হল না তখন নতুন নতুন কেমোথেরাপির গিনিপিগ হতে অস্বীকার করেছেন। শেষটায় অসহ্য যন্ত্রণায় ভুগলেও নার্সিংহোমে ভর্তি হননি। বাড়ীতে থেকেছেন, দরকার মতো বেদনানাশক মরফিন নিয়ে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বৃদ্ধদের অধিকাংশের শেষদিনগুলো আগে কাটতো নার্সিংহোমে। তারপর এল অ্যাসিস্টেট লিভিং, হসপিস—এসব নিয়ে নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষা। সেসবের ভালোমন্দ নিয়ে মনোগ্রাহী আলোচনা রয়েছে ‘Being Mortal’-এ। ভারতের সম্বলহীন বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের জন্য ব্যবস্থা আছে যদি তাঁদের পয়সা থাকে। অসহায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধা বা মৃত্যুপথযাত্রীদের জন্য নয়া দিল্লীতে অতুলের দেখা নয়া দিল্লীর গুরু বিশ্রাম বৃদ্ধাশ্রমের মতো ব্যবস্থা—এক পরিত্যক্ত গুদামঘরে ৬০ থেকে ১০০ বছর বয়সী শতাধিক মানুষের অযত্নে দিনাতিপাত।
ডাক্তাররা মনে করেন মানুষকে সুস্থ রাখা আর বাঁচিয়ে রাখাই বুঝি তাঁদের কাজ। আসল কাজটা হলো ভালোভাবে বেঁচে থাকতে সাহায্য করা। চিকিৎসাবিজ্ঞানের যে শাখা বয়স্কদের ভালোভাবে বেঁচে থাকতে সাহায্য করার বিষয়ে শেখায় তার নাম জেরিয়াট্রিক্স (geriatrics)। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হিসেব হলো—৯৭% ডাক্তারী ছাত্র জেরিয়াট্রিক্সের পাঠ নেয় না, একটা কারণ বোধহয় এই পেশায় আয় কম। প্রতি বছর ৩০০ জনেরও কম জেরিয়াট্রিক্স বিশেষজ্ঞ পাশ করে বেরোন, যদিও প্রতি বছর এর চেয়ে অনেক বেশি সংখ্যায় জেরিয়াট্রিক্স বিশেষজ্ঞ অবসর নেন। এছাড়া জেরিয়াট্রিক মনোরোগবিদ, নার্স, সোশাল ওয়ার্কারের অভাব তো আছেই। আমাদের দেশে চিকিৎসাবিজ্ঞানের স্নাতক বা স্নাতকোত্তর কোনও স্তরেই জেরিয়াট্রিক্স স্থান পায় না।
ডাক্তার ও নার্সিং পাঠ্যক্রমের সমস্ত স্তরে বৃদ্ধ-বৃদ্ধা ও মৃত্যুপথযাত্রীদের যথাযথ যত্নের বিষয়টা গুরুত্ব পাক, নীতিনির্ধারণকারীদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাক—এমনটাই বলতে চাওয়া হয়েছে অতুল গাওয়ান্ডের এই বইতে।