প্রথম ছ’মাসে বাচ্চার জন্য বুকের দুধ আদর্শ ও একমাত্র আহার। আজকাল আকছার নবজাতককে বাইরের প্যাকেটের দুধ খাওয়ানো হয়। অনেকসময় পাড়ার হাতুড়ে বা ওষুধ দোকানদারের পরামর্শে আবার অনেক সময় বাড়ির লোকেরা নিজেরাই প্যাকেটের দুধ কিংবা গরুর দুধ খাওয়ানো শুরু করে দেন। এতে অর্থনৈতিক ক্ষতি তো হয়ই, উপরন্তু বাচ্চাদের পুষ্টির অভাবজনিত শারীরিক ক্ষতি ছাড়াও বৌদ্ধিক ও মানসিক বিকাশ ব্যাহত হয়। এ ব্যাপারে পাশ করা ডাক্তারদেরও অনেক সময় সচেতনতার অভাব দেখা যায়। অনেক নামকরা বেসরকারি কর্পোরেট হাসপাতালে ‘বেবি ফ্রেন্ডলি হসপিটাল’ (মা ও শিশুকে এক জায়গায় রেখে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ও স্তন্যদান) ধারণার অভাব দেখা যায়। ফলে প্রথম এক-দু’সপ্তাহ বাচ্চা সঠিকভাবে বুকের দুধ পায়না। এই আলোচনায় আমরা সংক্ষেপে বুকের দুধ ও স্তন্যদান সংক্রান্ত কিছু ভুল ধারণা ও জটিলতার বিষয়ে জেনে নেবো..
১. শিশুর জন্মের পরেই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব স্তন্যপান শুরু করা উচিৎ। সিজারিয়ান সেকশন হলে ব্যথার জন্য মায়ের সামান্য অসুবিধে হতে পারে, সেক্ষেত্রেও স্তন্যপান শুরু করা খুব গুরুত্বপূর্ণ। বাড়ির অন্যান্যরা মাকে শারীরিক ও মানসিক অবলম্বন দিন।
২. কোনোভাবেই মধু, বাবার আশীর্বাদী জল, চরনামৃত, গ্রাইপ ওয়াটার বা অন্য কোনোকিছু বাচ্চার মুখে দেবেন না। মনে রাখুন, শুধু এবং শুধুমাত্র মাতৃদুগ্ধ।
৩. বাচ্চা জন্মের পর প্রথম ৩-৪ দিন হলদেটে, ঘন, অল্প পরিমান দুধ (colostrum) বেরোয়। এটি অনাক্রম্যতা সৃষ্টিকারী পদার্থ ও ভিটামিনে ভরপুর। এটি বাচ্চার জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। অনেকে অজ্ঞানতাবশত এই দুধ ফেলে দেন যা সর্বোতভাবে ভুল।
৪. বাচ্চা প্রথম ৬ মাসে শুধুমাত্র বুকের দুধই খাবে। অন্য কিচ্ছু না, জলও নয়।বুকের দুধে ৮৮% জল থাকে, কাজেই গ্রীষ্মকালেও বাচ্চার কোনোরকম জলের ঘাটতি হয়না।
৫.মাতৃদুগ্ধ কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, ফ্যাট, ভিটামিন, অ্যান্টিবডি, অন্যান্য গ্রোথ-ফ্যাক্টর ও উৎসেচকে ভরপুর। মাতৃদুগ্ধপায়ী বাচ্চার অ্যালার্জি, কানের ইনফেকশন, দাঁতের সমস্যা কম হয়। মানসিক বিকাশ ভালো হয়।
৬. শুধু বাচ্চা নয়, মায়ের দিক থেকেও ব্রেস্ট ফিডিং খুব প্রয়োজনীয়। জরায়ুর আগের অবস্থায় ফিরে আসা, বাচ্চা হওয়ার পরবর্তী রক্তক্ষরণ রোধ, জন্ম-নিয়ন্ত্রন ইত্যাদিতে সাহায্য করে।
৭.ঘন ঘন দুধ খাওয়ানো বিশেষত রাতে দুধ খাওয়ালে বুকের দুধের পরিমান বাড়ে। মায়ের সুষম আহার, ঘুম ও মানসিক সুস্থিরতা বুকের দুধ বাড়ায়।
৮. বোতলে দুধ খাওয়ানো, চুষি ধরানো, চিনি-জল, মধু, গ্রাইপ ওয়াটার ইত্যাদি দিলে বুকের দুধ কমে যায়।
৯. প্রথম দু-সপ্তাহের পর mature milk আসা শুরু হয় যার প্রথমভাগে জলের পরিমাণ বেশি থাকে, বাচ্চার তৃষ্ণা মেটায়। শেষের ঘন দুধে ফ্যাটের ভাগ বেশি থাকে, এটি বাচ্চার শক্তি জোগায়। কাজেই দুটিই দরকারী। পাতলা দুধ চেপে ফেলে দিয়ে অনেকে শুধু ঘন দুধ দেন, এটা ভুল।
১০.দুধ পান করানোর সময় বাচ্চাকে সঠিক ভাবে ধরাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আরামদায়ক ভাবে পিঠের পেছনে কোনো একটা অবলম্বন দিয়ে বসুন। হেলান দিয়েও খাওয়ানো যেতে পারে। বাচ্চার মুখের ওপর স্তন চাপিয়ে দেবেন না, বরং বাচ্চাকে স্তনের দিকে আনুন। বাচ্চার মাথা, ঘাড় এবং শরীর এক সরলরেখায় রাখতে হবে, বাচ্চার পেট মায়ের পেটে স্পর্শ করে থাকবে, নাক স্তনবৃন্তের কাছে আসবে। শুধুমাত্র স্তনবৃন্ত নয়, পুরো কালো অংশের (অ্যারিওলা) বেশিরভাগটা বাচ্চার মুখের মধ্যে দিতে হবে। এভাবে খাওয়ার সময় বাচ্চার চিবুক স্তনে স্পর্শ করে থাকবে, নীচের ঠোঁট উলটে যাবে।
কয়েকটি মেসেজ..
* ধর্ম-বর্ন-জাতি নির্বিশেষে সব মা সমান দক্ষতায় স্তন্যপান করাতে পারেন।
*’বুকের দুধ হচ্ছে না’ এটি অধিকাংশ সময় ভুল ধারণা। যে বাচ্চা দুধ খেয়ে ২-৩ ঘন্টা ঘুমোচ্ছে, ওজন বাড়ছে এবং দিনে ৬-৮ বার পেচ্ছাব করছে তার দুধের অভাব হচ্ছে না। দয়া করে ‘দুধ হচ্ছে না’ বলে মায়ের মানসিক চাপ বাড়াবেন না,তাতে দুধ কমে যায়।
*পাড়ার হাতুড়ে, ওষুধ দোকানের কর্মচারীর পরামর্শে বাচ্চাকে বাইরের দুধ খাওয়াবেন না। এতে বাচ্চার ডায়েরিয়া ও অন্যান্য ক্ষতি হতে পারে। আর হ্যাঁ,
*রলিক্স-*মপ্ল্যান ইত্যাদি ইত্যাদি খাইয়ে অর্থ ধ্বংস হয়, তার ওপরে *বাচ্চা ও মায়ের ক্ষতি হয়।*
*বারেবারে সাবান দিয়ে স্তন ধুয়ে ফেলার কোনো দরকার নেই। স্নানের সময় একবার ধুলেই চলবে। বারে বারে ধুলে বা দুধ টানতে থাকা অবস্থায় জোর করে স্তনবৃন্ত ছাড়িয়ে আনতে গেলে স্তনবৃন্ত ছড়ে যেতে পারে। যদি ছড়েও যায়, কোনও মলম ইত্যাদি না লাগিয়ে বুকেরই ঘন দুধ ওই জায়গায় লাগিয়ে দিন।
*ঘন ঘন দুধ না দিলে দুধ জমে ব্যথা হতে পারে। একটু ম্যাসাজ করে, গরম জলের *সেঁক* নিলে ব্যথা কমবে। তারপর আস্তে আস্তে হাতে চেপে দুধ বের করে দিন।
শেষে আবার একবার বলি,
প্রথম ছমাসে শুধু এবং শুধুই বুকের দুধ। ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া কখনোই বাইরের দুধ নয়। মায়েদের বলি, বারবার বুকের দুধ খাওয়ান, রাতে ঘন ঘন বুকের দুধ দিন, নিজে বেশি করে জল খান, স্বাভাবিক পুষ্টিকর খাবার ও প্রোটিনজাতীয় খাদ্যের দিকে নজর রাখুন। আর অবশ্যই, মনে জোর আনুন। নিজের বাচ্চাকে সঠিকভাবে বুকের দুধ দিন। পাশের বাড়ির মা’কেও উৎসাহিত করুন।
©Soumyakanti Panda
Lovely
আপনার ল্যাক লেখাটা আগেই পড়েছিলাম
Darun sir bt 6 month er por ki bairer khabar dite pari