একজন লেখক হিসেবে আমাকে সবসময় সংলাপ রচনার ক্ষেত্রে সমস্যায় পড়তে হয়েছে। আমার লেখা পড়ে অনেকেই বলেছেন, সংলাপগুলো হয় অকারণ দীর্ঘ, নয়ত সেগুলো নিষ্প্রাণ বা ছদ্মবেশী- তাতে চরিত্রের ফুটে-ওঠা নেই। তাঁরা ঠিকই বলেছেন, কারণ আমি লিখতে লিখতেই বুঝেছি আমার লেখা সংলাপগুলো প্রাণ পায় নি। তারা আমার কথা হয়ে উঠেছে। আমার চরিত্রদের কথা হয় নি।
একজন লেখক যখন চরিত্র সৃষ্টি করেন তখন তারা শেষ পর্যন্ত লেখককে কোথায় নিয়ে যাবে তা স্বয়ং তাদের স্রষ্টাও জানেন না। তবে কখনও কখনও চরিত্রদের থেকে লেখকের সংসর্গ ত্যাগ করা দরকার। বিশেষত সংলাপ রচনার ক্ষেত্রে, না হয় তারা লেখকের ভাষায় কথা বলতে শুরু করে। আর সেই লেখকের যদি তেমন তীব্র জনসংযোগ না থাকে তাহলে সংলাপগুলো সুন্দর শান্তিপুরী বোল হয়। তারা ভাস্করের সুন্দর প্রতিমা হয় কিন্তু তাতে প্রাণ থাকে না।
আমার খুব সামান্য পড়াশুনো থেকে দেখেছি অনেক খ্যাতনামা লেখকেরই সংলাপ রচনায় ব্যর্থতা থাকে। অনেকে সেটিতে অবগত অনেকে নন। যিনি বোঝেন তিনি অনেক ক্ষেত্রেই সংলাপ এড়িয়ে যান। কারণ কথাসাহিত্যিকের সেই স্বাধীনতা থাকে। যেটা নাট্যকারের থাকে না। সংলাপ নাটকের প্রাণ। অন্যভাবে বলাই যায় যিনি সংলাপ রচনায় ব্যর্থ তিনি আর যাই হোন নাট্যকার হতে পারেন না।
বাংলায় ঔপন্যাসিক হিসেবে বঙ্কিম যে সুললিত, সাধু, রমণীয় শান্তিপুরী বাংলা ভাষার প্রচলন করেন রবীন্দ্রনাথ তাকেই অনুসরণ করেছিলেন। বঙ্কিম যে ইংরিজি সাহিত্যের দ্বারা প্রবলভাবে প্রভাবিত ছিলেন তাতে কোনো সংশয় থাকার কথা নয়। তবু তাঁর হাত ধরেই বাংলা উপন্যাসের সূচনা ও বিস্তার। বঙ্কিমের সেই উপন্যাসের কথোপকথন পড়লে, সেই সাম্যতা ও শুচিতা কানে এলে আমার মনে হয় চরিত্ররা কি সত্যিই সেই ভাষায় কথা বলছে? এগুলো কি চরিত্রদের ভাষা নাকি বঙ্কিমের মার্জিত বাংলা?
গুরুদেবের ‘ঘরে বাইরে’ এক প্রবল চর্চিত উপন্যাস। সেখানেও কখনও কখনও যখন বিমলা, নিখিলেশ, সন্দীপ তাদের আত্মকথনের মধ্যে সংলাপের স্মৃতিচারণ করছে সেই তীব্র মর্মভেদী এবং প্রবল মেধাবী সংলাপগুলো পড়লে আমার মনে হয় তখনকার দিনের অভিজাতরা কি আদৌ এই ভাষায় কথা বলত? তাদের কথায় কি সবসময় এত গভীরতা, এত মাত্রাজ্ঞান, এত চমৎকারিত্ব থাকত? যে কথা বুঝতে আমাকে সংলাপটা বেশ কয়েকবার পড়তে হচ্ছে তাকে সেই চরিত্ররা এমন অবলীলায় বলছে কী করে? তাদের মেধা বা বুদ্ধিবত্তা কি আমাদের থেকে অনেক বেশি ছিল? নাকি চরিত্রগুলো সুপার ইন্টেলেকচুয়াল? কিন্তু কোথাও কোথাও যেন আমার মনে হয়েছে তাদের মুখ দিয়ে তিনি যেন তাঁর নিজের কথাই বলছেন। কলম মুখে উঠে এসেছে, মুখ কলমে আসে নি।
সংলাপে দীর্ঘতার কথা যদি বলা যায় তবে দেখা যাবে আগের দিকের লেখা অনেক উপন্যাসেই এমন দীর্ঘ সংলাপ দস্তুর। দস্তয়েফস্কির ‘ব্রাদার্স কারমাজভ’ উপন্যাসের কথাই যদি ধরেন তবে দেখবেন তাতে বহু সংলাপ আছে যেগুলো বিরাট লম্বা। বক্তা বলে চলেছেন কিন্তু কেউ তাঁকে বাধা দিচ্ছে না। তার বক্তব্য শেষ না হলে কথায় ফুট কাটছে না। এটা একটা লক্ষ্য করার মত ব্যাপার। হতে পারে আজ থেকে দেড়শ কি দু’শ বছর আগের রাশিয়ার ও পৃথিবীর মানুষ অনেক ধৈর্যশীল ছিল। তারা অন্যের কথা অনেক মনোযোগ সহকারে শুনত। আজকের পৃথিবীতে এটা আশাই করা যায় না। আজকের দিনে কোনো লেখক যদি অমন দীর্ঘ সংলাপ লেখেন তবে বুঝতে হবে সংলাপ রচনার ক্ষেত্রে তিনি হয় ব্যর্থ নয়ত তিনি অন্য কোনো উপায় অবলম্বন করেছেন।
মুরাকামীর উপন্যাসেও এমন দীর্ঘ সংলাপ পাওয়া যায় মাঝে মাঝে। তবে বুঝতে হবে মুরাকামীর পৃথিবী আলাদা। তিনি এক কল্পিত পৃথিবীকে বাস্তবের সাথে মিশিয়ে তার উপন্যাসে উপস্থাপিত করেন। তার চরিত্ররা বিড়াল হত্যা করে তাদের হৃৎপিন্ড কেটে খায় অমরত্বের জন্য, কুয়োয় সারাদিন বসে থাকে আত্মোপলব্ধির উদ্দেশ্যে, বীর্য নিয়ে বালখিল্য করে, আকছার অলৌকিক ঘটনা ঘটায়- তাই তাঁর উপন্যাসে যেন পথপরিবর্তনটাই পথ। তবু সেই সংলাপ কানে লাগে। বারবার মনে হয় লেখকের বোল চরিত্রের বোল হচ্ছে না তো?
আরেক সংলাপ রচনার স্টাইল হল প্রাদেশিক শব্দকে লব্জের মধ্যে প্রবেশ করানো। লেখা ও সংলাপ অনেক আকর্ষণীয় হয় তাতে। বাংলায় দিকপাল সাহিত্যিকেরা অনেকেই সেটা করেছেন। মানিক তাঁর ‘পদ্মা নদীর মাঝি’-তে পদ্মাপারের জেলেদের মুখের ভাষা ব্যবহার করেছেন। অমিয়ভূষণ তাঁর ‘গড় শ্রীখন্ড’-তে পদ্মাপারের চাষিদের মুখের লব্জ ব্যবহার করেছেন। সতীনাথ তো ‘ঢোঁড়াই চরিতমানস’-এ বিহারের তাৎমাটুলির প্রান্তিক জনজাতির ভাষা ব্যবহার করে উপন্যাসটিকে ক্লাসিক করে তুলেছেন। ইলিয়াস সাহেব বা হাসান আজিজুল হক তাঁদের উপন্যাসেও সেই আঞ্চলিক কথকতাকে অনেকাংশে ব্যবহার করেছেন। কিন্তু সেই ভাষা ব্যবহার করা সহজ কথা নয়। লেখকের আঞ্চলিক ভাষায় স্বাভাবিক দক্ষতা না থাকলে তা সৃষ্টি করা এক অর্থে অসম্ভব।
অনেক বড় বড় লেখকেরা সংলাপ রচনায় কেন ব্যর্থ হন এই প্রশ্নটা আমাকে ভাবায়। আমার মনে হয় সংলাপ রচনায় পারদর্শিতা একজন লেখকের জনসংযোগের ওপর নির্ভর করে। কথাবার্তা বলা একটা স্বাভাবিক প্রতিবর্ত ক্রিয়া। তা সে ব্যক্তিগত জীবনেই হোক বা কথাসাহিত্য রচনাতে। কথা আসে, কথাকে সৃষ্টি করতে গেলে তাতে ছদ্মবেশ বেরিয়ে পড়ে। অনেক সাহিত্যিকই ব্যক্তিগত জীবনে নিভৃতচারী। এটা তাদের লেখালেখির প্রয়োজনেই এবং তারা বেশিরভাগই নির্বান্ধব। কারণ অধিকাংশ সৃষ্টিশীল মানুষই হয় একাচোরা নয়ত ঈর্ষাপরায়ণ। তাদের মানুষের সাথে কথাবার্তা কম। সংযোগ কম। তাই তাদের সংলাপ পড়লে মনে হয় সেগুলো টাগরা-তালু-মূর্ধা থেকে বেরিয়ে আসে নি, এসেছে লেখকের মস্তিষ্ক থেকে। তারা ভেকধারী, নকল। তাদের জড়তা তাই সহজেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যদিও এই সবটাই আমার অনুমানমাত্র। আমার কল্পনাও বলতে পারেন। এই বক্তব্যের দায়িত্বও তাই আমার।
শুধু কথাসাহিত্য নয় সেই কথাসাহিত্য আশ্রিত সিনেমাতেও সংলাপ মাঝে মাঝে বিরক্তিকর পরিশীলিত। সাজানো। সুন্দর সুন্দর পোশাক পরে সেইসব চরিত্ররা কিছু বাঁধাবুলি আবৃত্তি করে যায় যাদের কথা শুনে কানের আরাম হয় কিন্তু কখনই মনে হয় না তারা কেউ আমাদের সঙ্গে থাকে। ‘ঘরে বাইরে’ একটি তীব্র যৌন-মনস্তাত্বিক উপন্যাস। গুরুদেবের জায়গায় অন্য কেউ হলে তাকে নিশ্চই অন্যভাবে লিখতেন। তাতে যৌন ইশারাগুলো আরো প্রকট হত। রবীন্দ্রনাথ শুধু রবীন্দ্রনাথ বলেই সেটা পারেন নি কারণ তাঁর নিজের সৃষ্ট সাহিত্য রুচিবোধের কাছে তিনি দায়বদ্ধ ছিলেন। সত্যজিৎও সিনেমায় তাকে সেভাবে দেখাতে পারেন নি। কারণ তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, বাংলায় সিনেমা করার ক্ষেত্রে যৌন দৃশ্যগুলোতে সেন্সরশিপ একটা বড় বাধা। যে ক্ষেত্রে বিদেশি পরিচালকেরা অনেক বেশি ভাগ্যবান। সেন্সরের কাঁচি তাদের জ্বালায় না। তাই বিমলা যখন রাতে শোবার আগে সাজগোজ করছে তখন সামান্য কথাবার্তার পরই তাঁকে দেখাতে হয় নিখিলেশ ঘুমিয়ে পড়েছে। ক্যামেরায় ফুটে ওঠে বিমলার নির্লিপ্ত মুখ। আমার কখনও মনে হয়েছে সারা উপন্যাস জুড়ে যে দাম্পত্যের যৌনশৈত্য ছড়ানো আছে বিমলা-নিখিলেশ যেন তাদের ভাববাচ্যের সংলাপে সেই অপরাধবোধেরই প্রায়শ্চিত্য করে চলেছে। দুজনেই যেন সন্দীপকে সামনে রেখে এক খেলায় নেমেছে। আর দুজনেই নিজেদের গোপন রেখেছে সেই খেলায়। তাই তাদের সংলাপ মাঝে মাঝেই ছদ্মবেশ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
হতে পারে যে দু’শ বছর আগেকার মানুষ দীর্ঘ সংলাপই বলত আর অন্যেরা তা মনোযোগ দিয়েই শুনত। কার্ল ইয়ুং মনে হয় ঈশ্বর, ম্যাজিক, অলৌকিকতায় কিছু হলেও বিশ্বাস করতেন। একবার তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, আগেকার দিনে ভগবানকে ডাকলেই উনি চলে আসতেন, এখন আসেন না কেন? উনি বলেছিলেন, তাকে আহবান করতে হলে যতটা অবনত হওয়া প্রয়োজন এখন আমরা হয়ত ততটা অবনত হতে পারছি না। আগেকার মানুষ অনেক কিছুই পারতেন, আমরা পারি না। সময়ের সাথে সাথেই তাই সংলাপ ছোট হয়ে যাচ্ছে। আধুনিক সংলাপ আরো ছোট হচ্ছে। তাই যে লেখক এখনকার মানুষের কথা লিখছেন তাকে সংলাপ রচনা করতে হলে যে আরো মুন্সিয়ানা দেখাতে হবে তাতে কোনো সন্দেহই নেই।