চারিদিকে আকাশ থেকে নেমে আসছে টাকা… কালো মেঘ, সাদা আকাশ, পাখির মত টাকা। সাদা পায়রার মত টাকা। একটা কুহকী ডাক ঘনিয়ে আসছে, অরিন্দম! অরিন্দম! যার টাকা সে পাচ্ছে না। যে পাচ্ছে সেও পাচ্ছে না। খাচ্ছে কিন্তু গিলছে না। অনেক অব্যক্ত কান্না, ক্রোধ, ঘৃণা, অশ্রু পুঞ্জিভূত হচ্ছে। সেইসব তেজ থেকে জন্ম নিচ্ছে একজন নায়ক। হিরো। গায়ে সাদা পোষাক। হাতে তরবারি। মুখে বাণী। নিজের ক্রুশ সে ১ দিন নিজের পিঠেই বহন করে নিয়ে যাবে।
তারপর অনেক রক্তারক্তি। অনেক যুদ্ধ। অনেক ওঠানামা। প্রান্তিক মানুষদের ফোকলা দাঁতে হেসে ওঠার ছবি। ক্লিক্। ১ বালকের ‘স্বাধীনতা গণতন্ত্র সমানাধিকার’ লেখা পতাকা নিয়ে আদুল গায়ে রেল লাইনের দিকে ছুটে যাওয়া। ক্লিক্। ১ টা নীল পাড়ের বড় বাড়িতে অনেক লোকের ক্ষুধার্ত চোখে হিংস্র কন্ঠে ঢুকে পড়ার দৃশ্য। ক্লিক্। কেউ আটকাতে পারছে না। ক্লিক্। একটা ইওট। প্রাইভেট জেট। সাঁই, সাঁই। হুসস্। ক্লিক্। সবাই হিরোর রক্তে ভেজা দেহ ঘিরে আছে। সবার চোখে জল। নতুন নেতা বলছেন, ‘জয় হোক মহামানবের। আমাদের সংগ্রাম, নায়কের বলিদান ব্যর্থ হবে না’। ক্লিক্।
আবার ১ টা শহীদ দিবস। আবার ১ টা রেড দিবস। ক্লিক্ ক্লিক্ ক্লিক্…
এমন হতেই পারে একটা স্বপ্নদৃশ্য। ১ টা ভোরের স্বপ্ন। ১ টা ঢুলুনি স্বপ্নদৃশ্য। ১ টা জেগে থাকা স্বপ্নের দৃশ্য। আমাদের চেতনায় অবচেতনায় ১ জন নায়ক, আমাদের প্রত্যেকের মানসিক পরিণতির ও বিকাশের আধার হিসেবে গড়ে উঠছে ১ জন নায়ক।
১ জন নায়ক যাকে আমরা সারাজীবন লালন করে চলি। যে সারাজীবন আমাদের সঙ্গে থাকে। আমৃত্যু। সেই নায়ক এল কোথা থেকে? পন্ডিতেরা অনেক ভেবেছেন। অনেক লিখেছেন। নায়কের মিথ। হিরোর মিথ। আমাদের অবচেতনায় ১ টা চিহ্ন হয়ে, স্বপ্নের মধ্যে ১ টা দাগ হয়ে রয়ে গেছে। রয়ে গেছে মনেদের জিনে। আমাদের মনের বৃদ্ধির স্তরে স্তরে হিরো আমাদের ভাংছে। গড়ছে। হিরোকে আমরাও ভাংছি। গড়ছি। নিয়ত।
হিরো তাই বদলে বদলে যাচ্ছে। আমাদের সঙ্গে। আগের হিরোকে আমরা চিনতে পারছি না। তাকে হিরো বলে মানতে পারছি না। সে ভগবান। সে ভগোমান। সময় যত বইছে। আমরা যত ভুলছি। হিরো তত ঈশ্বর হয়ে উঠছে। উঠছেন। হিঁরো।
রাত কত হল?
উত্তর মেলে না। …
সংশয়ে আমরা তাকে অস্বীকার করেছি,
ক্রোধে আমরা তাকে হনন করেছি,
প্রেমে আমরা তাকে গ্রহণ করব,
আমরা তাকে গ্রহণ করলাম। তাকে স্বীকার করলাম। তাকে অস্বীকার করলাম। তাকে নির্যাতন করলাম। তাকে ক্রুশবিদ্ধ করলাম। সে বিপ্লবী। সে হিরো। কুমারী মায়ের গর্ভে তার জন্ম। গোয়ালঘরে। কারণ সাধারণভাবে তাঁর জন্মাতে বাধা আছে। তাঁর প্রেম আছে। প্রিয়তমা তাঁর নগরবেশ্যা। তাঁর রমণে বাধা আছে। তাকে মরতেই হবে। তাঁর বেঁচে থাকায় বারণ আছে। সে যে হিরো। ভগবান। তাই তাকে ফিরে ফিরে আসতে হবে। পুনরুত্থানে। প্রতি প্রতি ইস্টারে। যেদিন খরগোশ ডিম পাড়বে। প্যাগান প্রথা মিশে যাবে ক্যাথলিক প্রথার সাথে। প্যাগান প্রথা মিশে গেছে সুমেরীয় প্রথার সাথে। মিশে গেছে মিশরের সাথে।
নীলনদ যেমন। জর্দন যেমন। জল বয়ে গেছে আবার ফিরে ফিরে এসেছে। হারিয়ে যাওয়া অতীতে কোনো ১ শামান এমন বুঝেছিল। কোনো বড় বুড়ো গাছের নিচে বসে। ১ দিন যখন রাতের আকাশে উঠেছিল অলৌকিক ১ চাঁদ। সে তেমনই বুঝিয়েছে। যারা বুঝেছে। তারা ভেবেছে। কথা শ্রুতি হয়েছে। লোকশ্রুতি হয়েছে। রয়ে গেছে মনেদের জিনে।
এমন বীর তবু তাঁর রথের চাকা গেঁথে গেছে মাটিতে। হে অর্জুন, হে গান্ডীবী, তুমি কি জানো না, তুই কি জানিস না অস্ত্রহীন যোদ্ধাকে হত্যা করা যুদ্ধাপরাধ?
হে অর্জুন, হে সখা, হে পার্থ, তুমি কি জানো না যুদ্ধে পাপ-পুণ্য কিছু নেই? আজও তুমি মানবে না। আগামীতেও কেউ যুদ্ধে নীতি মানবে না। তোলো গান্ডীব। কাটো শির।
শুনিয়াছি লোকমুখে
জননীর পরিত্যক্ত আমি। কতবার
হেরেছি নিশীথস্বপ্নে জননী আমার
এসেছেন ধীরে ধীরে দেখিতে আমায়, …
কত হৃদয়ের কত অশ্রু। কত শৈশবের কত অপু। কত যুবকের যুবতীর বুকে আজো বিঁধে আছে সেই রথের চাকা। কর্ণ। মহাভারতের অশ্রুনায়ক। শ্রেষ্ঠ হিরো? তাঁর যে আঁতুড় ঘরে জন্মানো বারণ আছে। যুদ্ধে তাঁর বেঁচে থাকা বারণ আছে। ত্যাজিয়া হেলায় এক অনন্তজীবন সে যে চলে গেছে সপ্তাশ্বরথে। প্রতিদিন প্রত্যুষে তাঁর উন্মেষ। প্রতিদিন তাঁর অবসান। দিবাবসানে।
নায়কের গোড়ালি। রাজা পেলিয়াস। প্রেমে পড়লেন জলপরী থেটিসের। সমুদ্রযোনি। সুন্দরতম, বীরশ্রেষ্ঠ, সাহসীতম অ্যাকিলিস। মহাকাব্যের সন্তান। সুন্দরী মাছপরীর পেটে জন্ম। তাঁর যে সাধারণ যোনিতে জন্মাতে বাধা আছে। থেটিস তাকে স্টিক্স নদীর জলে গোড়ালি পর্যন্ত ডোবালেন। সেই গোড়ালিতে গেঁথে গেল প্যারিসের তীর। এত বড় বীর। এত বড় হিরো। কিন্তু তাকে যে মরতেই হবে।
কেন থেটিস তাকে নদীর জলে পুরো ডোবান নি? কেন দুর্যোধন লজ্জায় মার কাছে নিজের লিঙ্গকে পাতা দিয়ে ঢেকে এনেছিলেন? এর উত্তর সহজ। হিরোকে অলৌকিক জন্ম অতিক্রম করে ১ অলৌকিক মৃত্যুর দিকে হেঁটে যেতে হবে। একা নিঃশব্দে।
তোমারে বধিবে যে, গোকুলে বাড়িছে সে। মাথায় বাসুকির ফণা। যমুনা পার হয়ে ভয়ঙ্কর তুফানের সেই রাতে ঈশ্বর সন্তান বাসুদেব নিয়ে যান গোকুলে। ঘুমন্ত যশোদার পাশে তাকে রেখে তার সন্তানকে নিয়ে আসেন মথুরায়। তারপর বার্ষ্ণেয় বিজয়। সারা ভারতব্যপী এক তীব্র অনার্য বিজয়। আর্য সাম্রাজ্যের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করে নিজের সাম্রাজ্যকে সুরক্ষিত করে নেওয়া। কৃষ্টি, বীরত্ব, পৌরুষ, প্রেম, লীলা, মস্তিষ্ক। পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ হিরো। কালোমাধব। আজো অক্ষত তাঁর সিংহাসন।
তাঁকেও যে বাঁচতে নেই। তাঁর জন্মের মত মৃত্যুতেও গেঁথে যাবে অলৌকিকতা। অ্যাকিলিসের গোড়ালির মত ওই রাতুল পদতলে ডুবে যাবে বিষমাখা ব্যাধের তীর। হে প্রভু, আমি যে অজ্ঞানে এই পাপ করেছি। এই পাপ তো তুমি করো নি। এটা পূর্ব নির্ধারিত। এটা লিখিত। এটা হবে। এটা হতেই হবে। এটাই হয়। আমি আসি। আমি আসব। সম্ভবামি যুগে যুগে। এ তো একটা নাট্য। একটা অঙ্ক। আবার অঙ্ক। আবার আবার আমি। আবার আবার আমি। আমি হিরো। আমি নায়ক। আমি ভগবান। আমি ভগোমান।
সেই যে শামান কোনো একদিন তার অ্যানিমিজমের কল্পনায় বৃদ্ধ শমীগাছের পাতার ফাঁকে চাঁদ দেখে সেই অলৌকিক রাতে এমনই কোনো ভাবনা ভেবেছিল। যা ছড়িয়ে পড়েছিল হোমিনিডদের জিনে জিনে। আফ্রিকার সেই ঘাসে ঢাকা সাভানার প্রান্তর হয়ে মধ্য এশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া পার হয়ে সেই ধারণা কথায় কথায়, চরণে চরণে, লিপিতে ভাষায় লালিত হয়ে মিথের আদলে, স্মৃতির আড়ালে, বিস্মৃতির ঘেরাটোপে আমাদের মনেদের জিনে জিনে প্রবেশ করেছে তা থেকে আমাদের মুক্তি নেই।
জীবন যাকে বিদীর্ণ করেছে। বীরত্ব যাকে মহান করেছে। মরণ যাকে অমর করেছে। সেই মিথের কারাগারে হিরো বন্দী। তা থেকে তাঁর মুক্তি নেই। হিরোর আছে পার্শ্বজীবন। আছে সখা, সখী। যিশুর আছে ব্রুটাস, ম্যাগদালেন। রাধেয়র ছিলেন দুর্যোধন, দ্রৌপদী(?)। অ্যাকিলিসের প্যাট্রোক্লাস, ব্রাইসিস। কেশবের পার্থ, রাধিকা।
আসলে এইসব সাহচর্য প্রেম আশ্রয় সবকিছুই ১ জন মানুষের, ইগোর বড় হয়ে ওঠার গল্প। মানবিক মনের পরিপূর্ণ হয়ে ওঠার গল্প। যা কিনা হিরো মিথের মধ্যে দিয়ে আমরা প্রত্যেকে বহন করে চলেছি। তাই আমাদের স্বপ্নে জাগরণে আমরা রোজ ১ হিরোকে প্রত্যক্ষ করি। তাঁর আগমণের প্রত্যাশা করি। চাই তাঁর পুনরুত্থান। তাই সুভাষ বেঁচে থাকেন শতোত্তর বছর। চে বেঁচে থাকেন টি শার্টে।
কোনো একদিন তারাও হয়ে ওঠেন, হয়ে উঠবেন আমাদের ঈশ্বর। স্মৃতি যত বিস্মৃতির পথ ধরে তত তাঁদের ঐশ্বরত্ব প্রাপ্তি হয়। হিরোর দেবায়ন হয়।
আমরা এখন এমন ১ জন হিরোকে চাই। কারো কাছে তিনি অবতার। কারো কাছে তিনি ইস্টারের জেসাস। আমার কাছে তিনি হিরো। আমি তাই প্রতিদিন ১ জন হিরো হয়ে উঠি। আমার যত ব্যক্তিত্বের ঘাটতি তা ১ জন পার্থ, ১ জন জুডাস কে গ্রহণ করে পূর্নতা পায়। আমার যত পাপ, সিন, কামনা তা ১ জন রাধিকাকে ঘিরে গড়ে ওঠে। আমার প্রজাতিকে রক্ষা করার দায়বদ্ধতা আমার ‘শহিদ জিন’ বা ‘আল্ট্রুইস্টিক জিন’ এর মাধ্যমে আমাকে আত্মাহুতিতে প্রেরণা দ্যায়। আমি শ্রমিক মৌমাছি হয়ে শত্রুর গায়ে হুল ফুটিয়ে যুগেযুগে মরে যাই। বাঁচিয়ে রাখি রানীকে।
আজ আমাদের ১ জন মিথোলজির হিরো চাই। তারপর তাকে ধীরে ধীরে ভুলে যেতে চাই। তার দেবায়ন চাই।