দ্বিতীয় বর্ষপূর্তি বিশেষ ১৯
পেটের দায়ে মানুষ কি না করে! আজ একটা অদ্ভূত গল্প শোনাবো আপনাদের। গল্প? না ঠিক গল্প নয় বলা চলে।
খুব কঠিন সত্যকে গল্প গল্প খেলায় সাজিয়ে বলব আর কি!
হনুমন্ত সিং দিল্লিতে এসেছে সে প্রায় দু’যুগ কেটে গেছে। বিহারের ছোট্ট গ্রাম থেকে যখন সে দিল্লি এসেছিল তখন তার সম্বল ছিল একটা টিনের বাক্স, আর লাভলি। লাভলিকে হনুমন্ত বড্ড ভালবাসত। নিজের বাচ্চার মতো। তাই দেশ ছেড়ে আসার সময় সঙ্গে এনেছিল। অবশ্য শুধু যে ভালবাসে বলে এনেছিল সেটা বললে ভুল হবে। লাভলি ছিল হনুমন্তের লছমি। নাচে, খেলায় একদম মস্ত। ইন্ডিয়া গেটের সামনে দাঁড়িয়ে যখন লাভলিকে বলত, ” নাচ মেরে করিনা” তখন লাভলির উঠে ঘের মেরে নাচ দেখতে গোটা কুড়ি লোক দাঁড়িয়ে যেত চারপাশে। পায়ে বাঁধা ঘুঙুর ছম ছম বাজত। সারাদিন খেল দেখিয়ে সন্ধ্যেবেলা ফিরত ঝুজ্ঞিতে (বস্তি)। হঠাৎ করেই একদিন ভাগ্যটা বদলে গেল হনুমন্তের। ওর পাশের ঘরে থাকত সুলেমন। ও সিক্যুরিটির কাজ করত পার্লামেন্ট ভবনে। সুলেমন একদিন সন্ধ্যেবেলা ওর সঙ্গে বসে গল্প করতে গিয়ে কথায় কথায় বলল পার্লামেন্ট ভবনে নেতারা পড়েছে বড় বিপাকে। সেই বিপদ থেকে নাকি হনুমন্তের মতো লোকেরাই পারে মন্ত্রীদের বাঁচাতে। বলে কি লোকটা?
হনুমন্ত সাত পাঁচ ভেবেও বুঝে পায় না তার মতো একটা মাদারি কি করে দেশের মাথাদের বিপদ থেকে উদ্ধার করতে পারে! যাই হোক সুলেমনের অনুরোধে পরের দিন ইন্ডিয়া গেটের দিকে না গিয়ে সে পৌঁছল সংসদ ভবনের সামনে। সুলেমন পই পই করে বলে দিয়েছিল যেন লাভলিকে নিয়ে আসে। হনুমন্ত অনেক মাথা ঘামিয়েছে তবু ভাবতেও পারে নি সে কিভাবে রাজা উজিরকে বাঁচাবে আর তার লাভলিই বা এ ব্যাপারে কি করবে। সে যা হোক তারপরের ঘটনা যা ঘটল তা বেশ মজাদার। হনুমন্তকে বলা হল সে রোজ তার লাভলিকে নিয়ে নর্থ ব্লকের অফিসে এসে হাজিরা দেবে। তাকে মাস গেলে টাকা দেওয়া হবে। তার কাজ লাভলিকে নিয়ে যত বাঁদর আছে তাড়াতে হবে। এখানে একটা বিষয় জানিয়ে রাখা ভাল, বাঁদর শায়েস্তা করতে গেলে লঙ্গুর লাগে। লাভলি হল সেই লঙ্গুর জাতের হনুমান। বাঁদরের উৎপাতে সংসদ ভবনের কাজ বন্ধ হওয়ার দাখিল।
এ সব আজ থেকে বছর দশেক আগের কথা। তারপর যমুনার জল আরও কালো হয়েছে, দিল্লির বাতাসে বিষ বেড়েছে পরিবেশ মন্ত্রক থেকে লঙ্গুর নিয়ে বাঁদর তাড়ানোয় রোক টোক লেগেছে। তবে কি হবে উপায়?
হনুমন্তের হনুমানকে আনা বারণ কিন্ত হনুমন্তকে তো ছাড়া যায় না। বাঁদর তো তাড়াতেই হবে। পেটের দায় বড়ো বালাই। হনুমন্তও সেই বালাইয়ের শিকার। তাই অগত্যা হনুমন্তই লঙ্গুর সেজে বাঁদর তাড়ানোর কাজে লেগে গেল। ঠিক ওই রকম আওয়াজ নকল করে, ওই অঙ্গভঙ্গী করে নর্থ ব্লকের বাঁদর তাড়াতে লাগল সে রোজ। বিহারের হনুমন্ত পেটের দায়ে নিজেই হনুমান হয়ে গেল অবশেষে।
এটাকে আপনারা গল্প ভাবলে গল্প। কিন্তু একবিংশের দ্বিতীয় দশকে দাঁড়িয়ে এই গল্প চরম সত্যি সে কথা জানাতেই আমার এই ক’টা শব্দ টাইপ করা। এরপর হনুমন্ত যা করল তা আরও বিস্ময়কর। সে দু’ চারটে ছেলে যোগাড় করে তাদের এ কাজে ট্রেনিং দিতে লাগল। লাভলির মতো আওয়াজ করে বা তাড়া করে বাঁদর তাড়ানোর টেকনিক শেখাতে লাগল। ভারত সরকার রীতিমতো টেন্ডার করে কাজের বরাত দিল।
এবারে আসি এ বিষয় সংক্রান্ত সরকারি নোটিসের ব্যাপারে। রাষ্ট্রের কল্যাণকর মুখোশের আড়ালে যে ভয়ানক মানবাধিকার বিরোধী রূপ লুকিয়ে আছে তা যেন ছাপার অক্ষরে লেখা আছে এই নোটিসে। কি আছে তাতে?
হোম মিনিস্ট্রি থেকে জারি করা এই নোটিসে বলা আছে
১। সপ্তাহে সাতদিন কাজ হবে দিনে তিনটে করে সিফটে।
২। যদি বাঁদর তাড়াতে সন্তুষ্টজনকভাবে সক্ষম না হয় তবে কোনও নোটিস ছাড়াই চাকরি যাবে।
৩। Prevention of Cruelty to Animals Act, 1960
মেনেই কাজ করতে হবে অর্থাৎ কিনা বাঁদরদের শারীরিক ক্ষতি করা যাবে না। কিন্তু বাঁদর তাড়াতে হবে।
৪। ঘন ঘন লোক বদল করা যাবে না। যে লোক থাকবে তার মোবাইল ফোনের নং সব নেতা মন্ত্রী অফিসারদের দেওয়া থাকবে এবং ফোন এলেই তাকে দিন ক্ষণ নির্বিশেষে বাঁদর তাড়াতে যেতে হবে।
৫। এই কাজ করতে গিয়ে যদি মাঙ্কি হ্যান্ডলার নিজে আহত হয় তবে তার চিকিৎসার খরচ সরকার বহন করবে না।
৬। কর্মরত অবস্থায় কোনও শারীরিক ক্ষতির দায় সরকার নেবে না।
৭। মাঙ্কি হ্যান্ডলার কিন্তু বাঁদরকে কোনও ভাবে আহত করতে পারবে না।
“সত্য সেলুকাস কি বিচিত্র এ দেশ!” আলেকজান্ডার বলে গেছিলেন, আমরা প্রবাদে পরিণত করেছি। দুর্ভাগা এই দেশে হনুমন্ত সিং এ রা কাজ করে যাচ্ছে এভাবেই। কর্ম জীবনের সামান্যতম সুরক্ষা ও ভরসা ছাড়া। এত বড় নোটিসে কোনও পারসোনাল প্রোটেক্টিভ ইক্যুইপমেন্টের উল্লেখ নেই। অথচ হনুমন্তদের ছাড়া সংসদ অচল, নেতাদের সুরক্ষা বিপন্ন। বন্য প্রাণী তাড়াতে গিয়ে বিপন্ন হতে পারে তাদের জীবন অথচ নেই কোনও জীবন বীমা।
আচ্ছে দিন এসে পড়ল বলে।