#বই_কুণ্ঠের_জার্নাল
সম্বোধন ব্যাপারটা আমাকে বেশ ভোগায়। বিশেষ করে এই ফেসবুকে তো আরও।
পাশ্চাত্যে এই ভোগান্তিটা নেই। সেখানে বন্ধুকে, শত্রুকে, আপিসের বসকে,বাবার পিসেমশাই বা মায়ের সইকে, তার বরকে অনায়াসে নাম ধরে ডাকা যায়।
কাছের হলে, হাই জিমি ডার্লিং কিম্বা লিলি সুইটি।
বাঙালিরাও এই সব ইংরেজি নামে পরিচিত কাউকে কাউকে ডাকে বটে। কিন্তু তা’ কেবল পরিচিত পোষ্যকে। টাইগার, জিমি, টমি এইসব বিলিতি নামে কুকুরদের ডাকা হয়। শুধু পুরুষ কুকুরদের। মহিলা বাঙালি কুকুরকে আদর করে ভিক্টোরিয়া বা মার্গারেট ডাকতে সচরাচর শোনা যায় না। প্রসঙ্গের বাইরে গিয়ে বলি, আমার মতন শিক্ষিত বাঙালি মধ্যবিত্ত কুকুরকে হুকুম করে ইংরেজিতে। এটা মনের অন্তর্গত ব্রিটিশ-আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার একটা নির্দেশক বলে ভাবা যেতে পারে। অবশ্য শপিং মলে এই আমিই হয় তো ভাঙা হিন্দি কিম্বা অশুদ্ধ ইংরেজিতে কুঁইকুঁই করি।
হ্যাঁ, যা বলছিলাম, সমস্যা এই সম্বোধন নিয়ে। পরিচিত ছোট বড় সমবয়সী বন্ধুদের সঙ্গে একটু ঘনিষ্ঠতা বাড়লেই সম্বোধনের প্রশ্ন চলে আসে।
খুব ছোটদের বেলা ঝামেলা নেই। নাম ধরে ডাকলেই চলে। অল্প ছোট কিম্বা প্রায় সমবয়সী হলেও কাজ চলে যায় শুধু নামেই, যদি ঘনিষ্ঠতা থাকে।
কিন্তু অন্যদের বেলা? মানে যারা বয়সে বড় কিম্বা তত ঘনিষ্ঠ নয় তাদের কী বলে ডাকা যায়?
পুরুষ হলে নামের শেষে ‘বাবু’ যোগ করা যায়। কিন্তু মহিলা হলে নামের পরে ‘বিবি’ যোগ অননুমোদিত। আমি কর্মক্ষেত্রে বড় ছোট সব সহকর্মিনীকেই নামের পরে দিদি যোগ করে ডাকতাম। তাঁরা আপত্তি করলেও। আমার চেয়ে বছর দশেকের ছোট এক রুমাকে এই রকম রুমাদিদি বলে ডাকতাম। এ’বার তাঁরও বছর দশেকের ছোট একজনকে দিদি না ডেকে নামের পেছনে মা যোগ করায়, প্রথমজন আলগোছে আপত্তি জানালেন। তাঁকেও নাকি মা যোগ করে ডাকতে হবে। কী করা। কিন্তু নামের পেছনে দিদি তো আগেই যোগ করে ফেলেছি। এবার তার সঙ্গে ‘মা’টিও। নামটা হয়ে দাঁড়াল, রুমাদিদিমা। সবাই সমাধান বলল মা বিশেষনটা নামের আগে জুড়তে হবে। নামের আগে মা যোগ করারও বিপদ আছে বুঝেছিলাম পরে। কন্যার বয়সিনী সেই সহকর্মিনীর নাম ছিল সীমা। আগে মা জুড়ে ডাকতেই সে কী হল্লা।
কিন্তু ফেসবুকে এই সব করলে ফলাফল শুভ নাও হতে পারে। বিশেষ করে,সেই সব শিশির বিমল প্রভাতের ফল, শত হাতে সহি পরখের ছল যাঁরা অনেকেই। তাঁরা কিছুতেই বিকালবেলায় হেলায় বিকোতে রাজি নন, এ’রকম সন্দেহ জাগে। তাঁদের কী বলে ডাকব?
আমি ঠিক করেছি সরাসরি জিজ্ঞেস করে নেব পুরুষ মহিলা নির্বিশেষে, কী ডাক তাঁর পছন্দ।
আমার নিজের বেলা, ডাক্তারবাবু কিম্বা স্যার ডাকটি আমার অপছন্দ। আমি যে এককালে ডাক্তারি করেছি মানে অন্য কোনও কাজ জানতাম না বলে করতে বাধ্য হয়েছি, সেই স্মৃতি মনে পড়লে পীড়িত হই। আর নাইটহুডও বহু আগে ত্যাগ করেছি, শিক্ষকতায় না ঢুকে।
কাজেই আমাকে নাম ধরে ডাকা যেতে পারে। অন্য যে কোনও পারিবারিক ডাকে সম্বোধিত হতেও রাজি। দাদা,কাকু, জ্যেঠু, মামা, মেসোমশাই, পিসেমশাই, দাদু এমনকি তালই মশাইও হতে রাজি আছি।
বাপি? হ্যাঁ,তাতেও রাজি। এই কন্যাহীন পিতাকে যদি কেউ সত্যি সত্যি ছলনাহীন সেই সম্বোধনে ডাকে।
জনান্তিকে বলি, যৌবনবেলায় খুব আহত হয়েছিলাম যখন ক্লাস নাইনের এক মেয়ে কাকু বলে ডেকেছিল। এখন তো কোনও ব্যাপার নেই। বাসে সমবয়সী চুলে কলপ করা লোকও গম্ভীর ভাবে বলে,
– দাদু নামব, একটু চেপে দাঁড়ান!
এককালে প্রাইভেট প্র্যাকটিস করতাম। সেখানেও এই সম্বোধন সমস্যা বেগ দিত। তখন বয়স কম। মেয়েদের বেলা সমস্যা নেই। বয়স নির্বিশেষে রোগিণীরা প্রশংসায় বলাবলি করতেন,
– এই ডাক্তারের মুখে মা ছাড়া কথা নেই।
পুরুষদের বলতাম দাদা।
খুব সিনিয়র পুরুষদের বেলা? একটা মজার অভিজ্ঞতা বলে শেষ করি। রোগীর বাড়ি কলে গেছি। বৃদ্ধ রোগীকে দেখে উপদেশ দেবার সময় যেই না সম্বোধন করেছি মেসোমশাই বলে, শয্যাশায়ী রোগী হাহাকার করে হাতজোড় করেছেন, – আমায় ওইটি বলে ডেকো না। আমি সারাজীবনে ওই কী বলে, মাসীটি জোগাড় করে উঠতে পারিনি।
তাঁর গোপন ব্যথার জায়গাটি ছুঁয়ে অনুতপ্ত আমাকে তিনিই সম্বোধনটি বলে দিলেন, – ডাক্তার, তুমি আমাকে মামাবাবু বলে ডেকো।
অসামান্য।