গতকাল ছিল ক্যানসার কেয়ারগিভার ডে। এমনিতে দিবস-টিবস নিয়ে আমার বিশেষ মাথাব্যথা নেই – ফাদার্স ডে-তে বাবা বা মাদার্স ডে-তে মা-কে নিয়ে বিশেষ আদিখ্যেতা করেছি, এমনও মনে পড়ে না – তাই, এই দিন নিয়েও বিশেষ কিছুই লিখতাম না। তবু ক্যানসার-রোগীর যত্নআত্তি যাঁরা করে থাকেন, তাঁদের নিয়ে দু’কথা লেখার ইচ্ছে আমার অনেকদিনের। ভাবলাম, এই দিনটি উপলক্ষেই কথাগুলোর কিছুটা অন্তত লিখে ফেলা যাক।
ক্যানসার-আক্রান্তর যত্নআত্তি করেন কারা? এদেশে, মূলত, রোগীর পরিজনেরাই। যাঁদের আমরা পেশেন্ট পার্টি বলে চিনি। ক্যানসার যেহেতু অসুখ হিসেবে দীর্ঘমেয়াদি – রোগী-পরিজনকে বারবার চিকিৎসকের কাছে আসতে হয় – সেহেতু এই পরিজনদের সঙ্গেও ক্যানসার-চিকিৎসকের একরকমের চেনাজানা হয়ে যায়। এই চেনাজানার একটা বড় অংশই চিকিৎসকের পক্ষে দুঃখস্মৃতি – কেননা, তিলে তিলে একটি পরিবারকে মানসিকভাবে এবং আর্থিকভাবে শেষ হয়ে যেতে দেখার অভিজ্ঞতা খুব একটা সুখকর নয়। বিশেষত আমার মতো চিকিৎসকের পক্ষে সমস্যাটা আরও গভীর, যাদের হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরেও ‘পেশেন্ট পার্টি’-র মুখ মনে পড়ে – সেই মানুষগুলোর জীবনের অর্ধেক জেনে বাকি অর্ধেক গল্প নিজের কল্পনা দিয়ে সম্পূর্ণ করে মনখারাপ করে বসে থাকি (না, এটা আত্মপ্রচারের জন্য বলছি না। বস্তুত চিকিৎসক হিসেবে এটা দুর্বলতা। কেননা, একইসঙ্গে একটা দূরত্ব স্থাপন করতে পারা এবং রোগী/পরিজনের সমস্যা অনুভব করতে পারা – এটাই ভালো চিকিৎসকের গুণ হওয়া উচিত।) – এবং রোগীর অবস্থা উত্তরোত্তর খারাপ হতে থাকলে রোগী তো বটেই, পরিজনের চোখের দিকেও তাকিয়ে কথা বলতে সমস্যা হয়, প্রশ্নের উত্তরে কী বলব বুঝে পাই না (বলা বাহুল্য, দোষ তো বটেই, বস্তুত এটি ক্ষমার অযোগ্য দোষ) – আমাদের মতো ক্যানসার-চিকিৎসকের স্মৃতিগুলো প্রায়শই লেখার মতো নয়।
যেমন, সেই মানুষটার দৃষ্টি এখনও ভুলতে পারি না। বোকাসোকা চোখ। কথা বলতে পারেন না গুছিয়ে। প্রশ্ন করলে, উত্তর দেওয়ার সময় তাঁর জিভ জড়িয়ে যায়। একপাশে সঙ্কুচিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। তিনি নন, অসুস্থ তাঁর ছেলে। ছেলে বাবার পুরো উল্টো। সদ্য যুবক। তাগড়াই চেহারা, ছ’ফুটের উপর লম্বা। বোঝা যায়, এমন ছেলে বাবার প্রৌঢ়কালের সহায় হতে পারবে, এমন আশা খুব স্বাভাবিক। কিন্তু ছেলের ক্যানসার। পায়ের হাড়ে ক্যানসার। পা বাদ দেওয়া হয় – কিন্তু পরের মাসেই জানা যায়, সে অসুখ ছড়িয়ে গিয়েছে বুকে। মুম্বাই-চেন্নাই ঘুরে আপাতত বাঁকুড়ায় – কিছু কেমোথেরাপি দিয়ে আশাটুকু জিইয়ে রাখা। সে কেমো-তেও একসময় আর কাজ হয় না – বিশেষ কাজ হওয়ার কথা ছিল, এমনও না। বাবার চোখে দেখি বিরক্তি, একটু রাগও। কথা বলতে গিয়ে বুঝলাম, এতদিন ধরে এত চিকিৎসার সময় কেউ তাঁকে এটুকু জানায়নি, যে, তাঁর ছেলের ক্যানসার নিরাময়ের অযোগ্য – ছেলের আয়ু বছরে না গুনে মাসে গোনা-ই ভালো। একান্তে বসিয়ে তাঁকে যখন ধীরে ধীরে এই সত্যিটুকু জানালাম – তাঁর সেই বোকাসোকা চোখের দৃষ্টির শূন্যতা আজও আমায় তাড়া করে। এই ক্যানসার কেয়ারগিভার ডে-তে তিনি কেমন আছেন, কে জানে! শুধু এটুকু জানি, ছেলে এখন কেয়ারের অনেক অনেএএক উর্ধ্বে।
অথবা সেইসব মানুষগুলো, যাদের শরীরে ক্যানসার বাসা বাঁধলেও কেয়ারগিভার ছিল না কেউই। বা বলা উচিত, যারা কেয়ারগিভার হতে পারত, তারা তাদের ছেড়ে চলে গেছিল। যেমন, শাহিনা। যেমন, সরস্বতী। শাহিনা-কে যেদিন ওপিডি-তে দেখি, সঙ্গে একটি বাচ্চা ছেলে – ওরই ছেলে, ফুটফুটে সুন্দর দেখতে, সিনেমা-সিরিয়ালের বাচ্চাদের মতো – আরেকদিন তার চাইতেও সুন্দর একটি মেয়ে। দু’চারবার কথা বলতে বলতে জানলাম, বাড়িতে এমন কেউ নেই, যার কাছে ছেলেমেয়েদের রেখে আসা যায়। আলাপ আরেকটু বাড়তে জানলাম, স্বামী ছিল, বউয়ের স্তনে ক্যানসার হয়েছে জেনে অপারেশনের সময়ই হাসপাতালে রেখে বাড়ি থেকে পালিয়ে গেছে। শাহিনা বলেছিল, আমার কারও উপর কোনও রাগ নেই, দাদা – শাহিনা আমাকে দাদা বলে ডাকত, ওর জীবনের শেষ রাখিপূর্ণিমায় আমাকে রাখি পরিয়েছিল – শুধু একটাই খারাপ লাগে, হাসপাতালে ভর্তি থাকতে থাকতেই চলে গেল, আমার ছোট ছোট দুটো বাচ্চা, বাড়িতে খাবার ছিল না, বাচ্চাদুটো দুদিন না খেয়ে ছিল। আমাদের হাসপাতালে আসার আগেই শাহিনার ক্যানসার স্টেজ ফোর – কাজেই, বাঁচানোর কোনও আশা ছিল না – কিন্তু সে কথাটা শাহিনাকে আর বলা হয়নি। একসময় যখন, এমনকি পেটভরা জল নিয়ে হাঁফাতে হাঁফাতেও সে আর হাসপাতালে আসতে পারল না – তখন, সম্ভবত, শাহিনা সব বুঝে গিয়েছিল। সেই ছোট্ট ছেলেটি আর মেয়েটি কি মায়ের শেষ কয়েকদিনে কেয়ারগিভার হয়ে উঠতে পেরেছিল? কেমন আছে তারা?
অথবা, সরস্বতী। খুব জেদ ছিল মেয়েটার। স্তনে ক্যানসার। শ্বশুরবাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। বলত, ডাক্তারবাবু, আপনি আমাকে সারিয়ে দিন, তারপর ওরা-ই আমাকে সাধতে আসবে, তখন আমি আর ফিরে যাব না, তখন ওরা বুঝবে! সরস্বতীর ক্যানসার সারার পর্যায়েই ছিল। চিকিৎসা সম্পূর্ণ হলো। কিন্তু বছরতিনেকের মাথায় আবার অসুখ ফিরে এলো। এবারে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়েছে। শ্বশুরবাড়ির লোকজন তাকে ফিরিয়ে নিতে এসেছিল কিনা – তাদের মুখের উপর যোগ্য জবাব সরস্বতী দিতে পেরেছিল কিনা – সেসব কথা আমার আর জানা হয়নি। শেষের দিকটায়, কেমো নেবার সময়, সেই জেদী মেয়েটার চোখদুটো কেমন ক্লান্ত হয়ে গেছিল। কেয়ারগিভার কেউ যদি থাকত…
স্বল্প অভিজ্ঞতায় যেটুকু দেখেছি, তাতে ক্যানসার ডায়াগনোসিস হলে বউকে স্বামী ছেড়ে গিয়েছে, এমন নজির অনেক – কিন্তু বিপরীত উদাহরণ একটিও পাইনি। বরং বাড়ির একমাত্র রোজগেরে স্বামী ক্যানসারে শয্যাশায়ী হওয়ার পর বউ যে-করে-হোক সংসার চালিয়ে স্বামীর চিকিৎসা করাচ্ছে – সারার কোনও আশা নেই জেনেও মুখ বুঁজে যথাসাধ্য করছে, অসুস্থ হয়ে খিটখিটে হয়ে যাওয়া বরের বিরক্তি চুপচাপ হজম করছে – এমন উদাহরণ প্রচুর দেখেছি। সমাজতাত্ত্বিক নই, তাই এর আর্থসামাজিক ব্যাখ্যা দিতে পারব না – শুধু মনে হয়েছে, মেয়েরা ছেলেদের থেকে কোথাও একটা আলাদা (এমন রিগ্রেসিভ পর্যবেক্ষণের জন্য নারীবাদীরা চটে যাবেন না, প্লিজ)।
এক বুড়োর কথা মনে পড়ছে। যখনই দেখতাম, বউয়ের উপর খিটখিট করত। বউও প্রায় বুড়ি-ই – বুড়োর গঞ্জনা শুনে কিছুই বলত না। অসুখ সেরে যাওয়ার পর্যায়ে – এদিকে বয়সের কারণে গুছিয়ে কেমো দেওয়া মুশকিল, সাবধানে এগোতে হয়। হঠাৎ দেখি, বেশ কিছুদিন বুড়ো আর আসছে না। মাসকয়েকের ব্যবধানে যেদিন এলো, তুড়িয়ে গালিগালাজ করলাম। এত সাবধানে আপনার চিকিৎসা করি, এই বয়সে এমন স্বাস্থ্যে কেমো দেওয়া মুশকিল, তাও সারানোর আশায় লড়ে যাচ্ছি, আর আপনার কোনও দায়িত্ব নেই, জীবনটা আপনার আর দায় যেন আমাদের – এত কথার পরেও বুড়ো দেখি চুপ। ইন ফ্যাক্ট, তার পর থেকেই বুড়ো যেন কেমন একটা চুপচাপ। একদিন নার্সদিদি বললেন, এরকম একদিন বুড়োকে কেমো নিয়ে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার সময়ই বুড়ি আচমকা হার্ট অ্যাটাক হয়ে মারা গেছে। বুড়োকে এখন তার ছেলে বা বউমা নিয়ে আসে, কিন্তু বুড়োর আর বাঁচার ইচ্ছে-ই নেই! সঙ্গে করে নিয়ে আসা সহজ, কিন্তু কেয়ারগিভার হতে পারা?
এরকম কত গল্প যে লেখা যায়! শোনাতে বসলে শেষই হবে না। বাবা কিংবা মা অথবা জীবনসঙ্গী বা ছেলে/মেয়ে থেকে কেয়ারগিভার হয়ে ওঠার গল্প। কেয়ারগিভার হতে না পারার গল্পও শোনাতে পারতাম। বা, কেয়ারগিভার না থাকারও গল্প। বা কেয়ারগিভার-এর ক্লান্তির গল্প। অন্যরকম গল্পও। যেমন সেই ছেলেটা। বাবাকে নিয়ে চিকিৎসা করাতে আসত। তরুণ। হাতে বালা, গলায় স্টিলের চেন, রঙচঙে প্যান্ট। কথাবার্তায় বেশ র্যালা। একদিন জিজ্ঞেস করল, ডাক্তারবাবু, কী বুঝছেন? বাবা আর কতদিন লাস্টিং করবে?? উত্তরে প্রায় কাঁচা খিস্তি বেরিয়ে আসছিল। কোনওমতে মুখ সামলে বললাম – বাবা কি জুতো নাকি প্যান্টের বেল্ট, যে, লাস্টিং-এর কথা জিজ্ঞেস করছ!! ছেলেটি সত্যিই লজ্জা পেয়েছিল। সন্ধেবেলায় একা বসে ছেলেটির কথা ভাবছিলাম। কতই বা বয়স হবে! কুড়ি। বড়জোর বাইশ-তেইশ। বাবা অসুস্থ, আপাতত সংসারের দায়িত্ব ওরই। মাসে একবার কেমো নিতে আসা, একবার রক্তপরীক্ষার জন্য আসা, আরও একবার হয়ত রিপোর্ট দেখাতে আসা – মাঝে বাবার অসুস্থ হয়ে পড়লে আরও হয়ত একবার আসা – ওষুধপত্র পথ্যের খরচ আছে, যাতায়াতের খরচ আছে – কাজ কামাই মানে রোজগার শূন্য – সত্যিই কি এভাবে বেশিদিন চালিয়ে যাওয়া সম্ভব! কেয়ারগিভার-এর দিকটাই বা আমরা কখন ভেবে দেখি!!
লম্বা লেখা পড়তে পড়তে আপনি নিশ্চয়ই বিরক্ত হচ্ছেন এতক্ষণে। বা এতদূর আপনি পৌঁছানইনি, আগেই ছেড়ে দিয়েছেন। আপাতত আর একটা গল্প দিয়ে লেখাটা শেষ করব। একটি নার্সিংহোম থেকে ডাক পড়েছে, রোগী দেখতে গেছি (গল্পটা পুরনো, এখন আর এভাবে রোগী দেখার অভ্যেস নেই)। হঠাৎ দেখি একজন এগিয়ে এলেন। জিজ্ঞেস করলেন, ডাক্তারবাবু, ভালো আছেন তো? মুখটা চেনাচেনা লাগলেও মনে করতে পারলাম না। একগাল হেসে বললাম, হ্যাঁ হ্যাঁ, আপনি ভালো তো? রোগী দেখার সময়, শুনছি, তিনি বর্তমান রোগীর পরিজনকে আমার সম্পর্কে বলছেন – “খুব ভালো ডাক্তার। বিরাট বড় ডাক্তার। বাবাকে এঁর কাছে নিয়ে গেছিলাম। দেখেই বললেন, বাবার তো খুব বাড়াবাড়ি অবস্থা। বড়জোর আর মাসখানেক কি মাসদেড়েক। আর এদিক-ওদিক দৌড়িও না। বাড়িতে রাখো। কিছু ওষুধ লিখে দিচ্ছি, দরকারমতো ফোন কোরো, আবার ওষুধ বলে দেব। শেষ দিনগুলো বাড়িতে শান্তিতে থাকতে দাও। কী বলব, উনি মাসখানেক বলেছিলেন, ঠিক তেইশ দিনের মাথায় বাবা মারা গেল।” সত্যি বলতে কি, ওঁর এমন প্রশংসাবাক্যে বর্তমান রোগীর বাড়ির লোকজন – পেশেন্ট পার্টি-ই বলুন, বা কেয়ারগিভার – আমার ‘পরে তাঁদের ভরসা বেড়েছিল কিনা, আজও নিশ্চিত হতে পারিনি।
নভেম্বর ২, ২০২৩