প্রেস্ক্রিপসনে রোগীর নাম লিখছি সবে। রোগীর স্বামী জিজ্ঞেস করলেন “স্বাস্থ্য সাথী কার্ডে ট্রিটমেন্ট হবে তো?”
” অবশ্যই হবে” হিস্ট্রি নিতে নিতে (পেশেন্টের কথা অনুযায়ী ওনার সব সমস্যার শুরু মাস দুয়েক হল) দেখলাম ওনার ব্যাগ থেকে উঁকি মারছে টাটা মেমোরিয়াল হসপিটালের একটা ফাইলের মাথা। সেই চেনা ফরম্যাট, শুধু বছর বছর ফাইলের ওপর টানা লম্বা দাগগুলোর রঙ বদলে যায়। টাটার ফাইল দেখলেই আমার একটা এক্সাইটমেন্ট হয়, পুরনো কথা মনে হয়, এই ফাইলে রোগীর ওয়ার্ক আপ করার একটা প্রতিযোগিতা হত আমাদের (রেসিডেন্টদের) মধ্যে। কে কত সুন্দর ভাবে লিখতে পারে ওই ভিড়ে আর কত কম সময়ে। তাছাড়াও একটা স্বার্থ থাকে, এই ফাইলে রোগীর মোটামুটি সব তথ্য সুন্দর ভাবে পেয়ে যাই কাজেই পরিশ্রম অনেকটা কমে।
“টাটা তে গিয়েছিলেন? ফাইলটা দিন দেখি।”
রোগীর স্বামী ভারি বিরক্ত হয়ে বললেন “এটা এখানকার টাটা না, এটা মুম্বাইয়ের।” যেটা বললেন না কিন্তু বডি ল্যাংগুয়েজ-এ বোঝালেন তা হল “এর আপনি কি বুঝবেন? এ আপনার ধরা ছোঁয়ার বাইরে, কলকাতা টাটা হলে তবু একটা কথা ছিল”
হাসি চেপে বললাম “হ্যাঁ বুঝেছি আমিও কিছুদিন মুম্বাই টাটাতে কাজ শিখেছি, একবার দেখান প্লিজ”
নিতান্ত অনিচ্ছায় উনি ফাইলটা দিলেন। ফাইলটা ফেব্রুয়ারি মাসের। ওনারা ক্যান্সার ডিটেক্ট করে স্টেজিং করে ট্রিটমেন্ট লিখেছেন।
জিজ্ঞেস করলাম ট্রিটমেন্ট করালেন না কেন? এটা তো জুন মাস তাহলে পাঁচ মাস আগেই ক্যান্সার ডায়াগনোসিস হয়েছে। প্লিজ আমাকে সত্যি বলুন, কিছু লুকোবেন না।”
এবার রোগীর স্বামী একটু নরম হলেন। “হ্যাঁ ডাক্তারবাবু, ফেব্রুয়ারিতে টাটাতে যাই দুমাস থাকি কিন্তু ডেট পাইনি। তাই চলে আসি।”
আমি জানি টাটাতে সারাভারত থেকে ক্যান্সার রোগী আসেন তাই খুব কম সংখ্যক মানুষেরই ওনারা চিকিৎসা করতে পারেন। বেশিরভাগ রোগীকেই নিজের নিজের জায়গায় রেফার করে দেন। তাই জিজ্ঞেস করলাম “ওনারা রেফার করেননি?”
এইবার একটা চিঠি বেরোলো, ফেব্রুয়ারী মাসেই রেফার করা হয়েছে। স্টেজ টু বি সারভিক্স ক্যান্সার।
“তাহলে?”
“আমরা ওয়েট করলাম দুমাস যদি ডেট পাওয়া যায়”
“ওই সময় তো মুম্বাইয়ে খুব করোনা হচ্ছিল। খুবই রিস্ক নিয়ে ছিলেন।”
“হ্যাঁ ডাক্তারবাবু, আমাদের দুজনেরই করোনা হয়েছিল, হোটেলে খুব কষ্ট করে ছিলাম, ভাগ্য করে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়নি। তারপর ফিরে এলাম এপ্রিল মাসে।”
ক্যান্সার পেশেন্ট নিয়ে করোনায় আক্রান্ত হয়ে অন্য শহরে কি কঠিন পরিস্থিতিতে ওনারা পড়েছিলেন বুঝে শুধু একটা হুম ছাড়া কিছু বলতে পারলাম না।
সবশেষে একটা রিপোর্ট দেখতে গিয়ে আর একটা কাগজ বেরিয়ে এলো, এপোলো হাসপাতালেরই কিন্তু অন্য রঙ। উনি লুকোনোর আগেই হাতে নিয়ে দেখি ডিসেম্বর মাসের এপলো চেন্নাই-এর কাগজ, ডায়াগনোসিস ক্যান্সার সারভিক্স স্টেজ ওয়ান বি টু। আর চিকিৎসা করার পরামর্শ।
অবাক হয়ে তাকাতে উনি বললেন “প্রথমে আমরা চেন্নাই যাই, ওখানে ক্যান্সার ডায়াগনোসিস হলে সবাই বলল টাটা যেতে, তাই টাটা গেলাম।”
তার মানে সাতমাস আগে অসুখটা ডায়াগনোসিস হয়েছে। পুরো ওয়ার্ক আপ করে, এক্সামিনেসন করে প্রেস্ক্রিপসনে লিখলাম, ক্যান্সার সারভিক্স স্টেজ থ্রি বি।
রোগীর স্বামী বললেন “স্টেজ টু বি না? টাটাতে তো তাই বলেছে। ”
“ডিসেম্বর ২০২০ তে স্টেজ ওয়ান বি টু ছিল চেন্নাইতে, ফেব্রুয়ারিতে টাটাতে স্টেজ টু বি, জুন ২০২১ এ স্টেজ থ্রি বি। এখনো সময় আছে চিকিৎসা শুরু করুন। স্বাস্থ্য সাথী কার্ডে হবে একটি পয়সাও লাগবে না। ”
এই গল্পটা লেখার উদ্দেশ্য ইগো স্যাটিসফাই করা বা কাউকে ছোট করা বা ব্যঙ্গ করা নয়। ক্যান্সারের মতো অসুখ হলে মানুষ শ্রেষ্ঠ হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে চাইবেন এটা স্বাভাবিক। এতে কোন দোষ নেই। হায়দ্রাবাদে কাজ করার সময় দেখেছি প্রচুর রোগী আমেরিকার বিশ্ববিখ্যাত হাসপাতালে দেখিয়ে এসেছেন। দিল্লিতেও একই অভিজ্ঞতা। টাটা মেমোরিয়াল হসপিটাল পৃথিবীর সেরা হাসপাতালের মধ্যে একটা। কাজেই বাংলার মানুষ এখানে পরামর্শ নিতে যাবেন এটাই স্বাভাবিক।
যাঁরা বাইরে ক্যান্সারের চিকিৎসার উদ্দেশ্য যাচ্ছেন তাঁদের কয়েকটি টিপস।
১. ক্যান্সার চিকিৎসা সময়সাপেক্ষ। অনেক ক্ষেত্রেই অপারেশন, রেডিয়েশন, কেমোথেরাপি ও আরো অনেক চিকিৎসা প্রয়োজন হয়। কাজেই বাড়ি থেকে দূরে কয়েকমাস থেকে চিকিৎসা করানোর মতো সময় এবং সঙ্গতি থাকা প্রয়োজন। দূর শহরে চিকিৎসা করানোর সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে এইটা ভালো করে ভেবে নিন।অসমাপ্ত চিকিৎসা বা দেরি করে চিকিৎসা ক্যান্সারের সুস্থতা র সম্ভাবনা কমিয়ে দেয়। এতে ক্ষতি বেশি হয় লাভের চেয়ে।
২. সময়ে চিকিৎসা শুরু করা ক্যান্সার চিকিৎসার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ণ। অযথা দেরি করবেন না। ভালো চিকিৎসা আপনার বাড়ির কাছাকাছি হাসপাতালেও হয়। বিশেষজ্ঞের মতামত নিয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চিকিৎসা শুরু করুন। মতামতের জন্য যেতে চাইলে পৃথিবীর যে কোন শহরে যান কিন্তু তার জন্য চিকিৎসা শুরু করতে যেন দেরি না হয়।
৩, চেষ্টা করুন পুরো চিকিৎসা একটি হাসপাতালে করতে, যেখানে ক্যান্সার ডিপার্টমেন্ট আছে এবং সার্জারী, রেডিয়েশন, কেমোথেরাপি সব হয়। কেননা চিকিৎসার প্রতিটি ধাপে ডাক্তারদের মধ্যে কোলাবরেশন খুব জরুরি। আর এঁদের সাথে রেডিওলজিস্ট, প্যাথলজিস্ট সবার মতামত খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই যে হাসপাতালে মাল্টি ডিসিপ্লিনারি টিম আছে সেখানে চিকিৎসা করান।
ভালো হাসপাতালে দেখানোর চাইতেও জরুরি ঠিক সময়ে চিকিৎসা হওয়া। আসল উদ্দেশ্য তো রোগীর প্রাণ বাঁচানো তাই না? আমার গল্পটির রোগীর শুধু মাত্র সময় নষ্ট করার কারণে স্টেজ অনেকটাই বেড়ে গিয়েছে, তাই সুস্থ হবার সম্ভাবনা প্রায় ২০ থেকে ৩০% কমে গিয়েছে। কাজেই কোন ভাবেই মুল্যবান সময় নষ্ট না করে ক্যান্সার ডায়াগনোসিস হলে যতশীঘ্র সম্ভব চিকিৎসা করান।
ভালো লেখা। সৎ পরামর্শ। ভালো থাকবেন।