নিরাপদ বাবু একজন সাধারণ মানুষ। সাধারণ মানুষ হয়ে ওঠার জন্য যে যে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য দরকার প্রায় প্রত্যেকটিই তাঁর আছে। সাধারণ মানুষের যতটা ভিতু হওয়া উচিৎ, তিনি তাঁর চেয়ে অনেক বেশি ভিতু। লোকাল মস্তান, পার্টির স্বঘোষিত নেতা, খাঁকি পোশাকের পুলিশ সকলকেই তিনি ভয় পান। এমনকি পাড়ার মোড়ে দাঁড়িয়ে যে সব ছেলে ছোকরারা দু অক্ষর- চার অক্ষর সহযোগে কথা বলে, তাদেরও তিনি বিলক্ষণ ডরান।
সাধারণ মানুষের উচ্চাশা কম হয়। তিনি একেবারেই উচ্চাশা বর্জিত। পাঁচ বছরে একবার দীঘার সুনীল জলধি দেখলেই তাঁর জীবন সার্থক হয়ে যায়।
সাধারণ মানুষ ঝুট ঝামেলা থেকে দূরে থাকতে পছন্দ করে। তিনিও যাবতীয় ঝুট ঝামেলা থেকে শত হস্ত দূরে থাকেন। রাস্তায় অসুস্থ কাউকে পড়ে থাকতে দেখলে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে চলে যান। একবার অফিস যাওয়ার সময় ট্রেনে তাঁর পরিচিত একজন নিত্যযাত্রী অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তাঁকে সাহায্য করা তো দূরের কথা পরের স্টেশনে তিনি চুপিচুপি পাশের কামরায় গিয়ে উঠলেন।
মোদ্দা কথা এই পৃথিবীতে বেশ কয়েক লক্ষ লিটার অক্সিজেন, বেশ কয়েক কুইন্টাল শর্করা, প্রোটিন ও স্নেহপদার্থ ধ্বংস করা ছাড়া তাঁর বিশেষ ভূমিকা নেই। তার বিনিময়ে রোজ বেশ কিছুটা করে জৈব সার তিনি পৃথিবীতে ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন বটে, তবে সেপটিক ট্যাঙ্কের কল্যাণে কতটা যে সঠিক জায়গায় পৌঁছায় বলা মুশকিল।
সমস্যা হলো গরীবেরও ঘোড়া রোগ হয়। বামনও চাঁদের দিকে হাত বাড়ায়। খোঁড়াকেও হিমালয় হাতছানি দিয়ে ডাকে। নিরাপদ বাবুরও মতিভ্রম হলো। তবে মতিভ্রম বলতে যেরকম মহিলা ঘটিত বিষয় মনে হয় তাঁর ব্যপারটা মোটেই সেরকম নয়। বাসে ট্রেনে মহিলা দেখলে তিনি যতটা পারেন দূরত্ব বজায় রাখেন। ভিড়ের চাপে কোনো মহিলার গায়ে গিয়ে পড়লে কেলেঙ্কারি ব্যাপার। তাঁর মতো নিরীহ লোককে বাগে পেয়ে জনগণ হাতের সুখ করে নেবে। আর মেয়েদেরও বয়ে গেছে তার মতো একজন ছায়ায় মিশে থাকা ম্যাড়মেড়ে লোককে পাত্তা দিতে। ঘরে যিনি আছেন সেই একমাত্র স্ত্রীও তাঁকে পাত্তা দেন না। উঠতে বসতে শোনান, নিরাপদ বাবুর জন্যই তার জীবনটা একেবারে নষ্ট হয়ে গেল। এর থেকে বাপের বাড়ির পাড়ার টাবলুদা, যে বিয়ের আগে নিয়মিত ভুল বানানে তাঁকে প্রেমপত্র লিখতো তাকে বিয়ে করলে অনেক ভালো হতো। সে এখন পার্টির একজন মাঝারি মাপের নেতা। দুটো বাড়ি আর তিনটে গাড়ির মালিক।
ভূমিকা বাদ দিয়ে এবার সরাসরি গল্পে ঢোকা যাক। নিরাপদ বাবুর মতিভ্রম ঠিক কী করে হলো। একদিন রাতে অফিস ফেরত স্টেশন থেকে বাড়ি আসছেন, রাস্তায় দেখলেন প্রচুর পুলিশ। মুল রাস্তায় কোনো গাড়িও চলছে না। সব গাড়িকে পুলিশ অন্য রাস্তা দিয়ে ঘুরিয়ে দিচ্ছে।
নিরাপদ বাবু আর্ধেকটা লাউ কিনবেন ভাবছিলেন। রাস্তার ধারে অনেকেই প্লাস্টিক পেতে এসময় সবজি নিয়ে বসে থাকে। অনেক কম দামে সবজি পাওয়া যায়। আজ তারা কেউ নেই। সম্ভবত পুলিশ তাদের হটিয়ে দিয়েছে। তিনি এদিক ওদিক লাউয়ের খোঁজ করছিলেন। হঠাত তীব্র হুটারের আওয়াজে তাঁর শরীর শিউরে উঠল। পরপর কয়েকটি পুলিশের গাড়ি। তার পেছনে হুটার বাজাতে বাজাতে নীল আলো জ্বলা মন্ত্রীর গাড়ি।
নিরাপদ বাবু সেটা দেখে কেমন অভিভূত হয়ে গেলেন। একটা ঘোরের মধ্যে বাড়ি ফিরলেন। তারপর থেকে তাঁর স্বপনে জাগরণে এমন হুটার বাজানো গাড়ি। তিনি জেগে জেগে- ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছেন অমন আলো জ্বালা, হুটার বাজানো গাড়িতে করে ফাঁকা রাজপথে ছুটে চলেছেন। ব্যাপারটা তাঁর মতো ছাপোষা মানুষের জন্য বড়ই বিড়ম্বনার বিষয় হয়ে উঠলো।
তাঁর স্ত্রী, পুত্র-কন্যারা তাঁকে বিশেষ লক্ষ্য করেন না। তাই নিরাপদ বাবু যে বেশ অন্যমনস্ক হয়ে উঠছেন সেটা তাঁরা খেয়াল করলেন না। নিরাপদ বাবুর জীবনে কিছু না থাকলেও শান্তি ছিল। গরিবের ঘোড়া রোগে সেটাও গেল।
তিনি অনেকটাই বদলে গেলেন। আগে ভিখারি ভিক্ষা চাইলে এদিক ওদিক তাকিয়ে কপালে হাত ঠেকাতেন। এখন অন্যমনস্ক ভাবে পকেটে হাত ঢুকিয়ে যা খুচরো পয়সা পান, দিয়ে দেন। ট্রেনে উঠে কোথায় দাঁড়াচ্ছেন খেয়াল করেন না। একদিন অসাবধানতা বশত ভিড়ের ঠেলায় এক মধ্যবয়সী মহিলার গায়ের উপর পড়লেন। মহিলা তাঁর দিকে চেয়ে বললেন, ‘অভদ্র, ইতর, ছোটলোক। বাড়িতে মা বোন নেই? সব মেয়েকে নিজের বউ মনে করেন নাকি?’ নিরাপদ বাবুকে অপমান স্পর্শ করল না। তিনি তখন হুটার বাজানো, নীল আলো জ্বলা গাড়ির সওয়ারি।
নিরাপদ বাবু মাসের মাঝখানে গোটা ইলিশ নিয়ে বাড়ি ফিরলেন। যা দেখে চমকে গিয়ে স্ত্রীর বুকে ব্যথা শুরু হলো। স্ত্রীকে নিয়ে আবার মাঝ রাতে হাসপাতালে দৌড়াতে হলো। ডাক্তারবাবু সব দেখে শুনে জানালেন, ‘ভয়ের কিছু নেই। হার্ট এবসুলেটলি নর্মাল। সম্ভবত ইটস এ কেস অফ প্যানিক ডিজঅর্ডার। হঠাত করে মানসিক উত্তেজনা বেড়ে গেলে বা খুব ভয় পেলে এমন হতে পারে। ওনার কী হঠাত চমকে যাওয়ার মতো কিছু ঘটেছিল?’
স্ত্রী জবাব দিলেন, ‘যে লোকটার বাজারের ব্যাগ থেকে পুই ডাঁটা, কুচো চিংড়ি আর কানা বেগুন ছাড়া কিছু বের হয় না, সে যদি হঠাত করে দেড় কেজির ইলিশ নিয়ে হাজির হয় চমকে যাব না ডাক্তারবাবু?’
নিরাপদ বাবু অন্যমনস্ক ভাবে বললেন, ‘ইলিশ কিনেছিলাম নাকি? কই মনে পড়ছে নাতো!’
নিজের রোগ ভুলে নিরাপদ বাবুর স্ত্রী কেঁদে উঠলেন, ‘ওগো তুমি কি পাগল হয়ে যাচ্ছো? তুমি এমন উল্টোপাল্টা করছো কেন? বাবাগো, দেখে যাওগো কার সাথে তুমি আমাকে বিয়ে দিয়েছো’
তবে নিরাপদ বাবুর এই অন্যমনস্কতা তাঁর বাড়ির লোককে বেশিদিন ভোগ করতে হলো না। কয়েকদিন বাদেই অন্যমনস্কতার জন্যই অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পথে তিনি বাসের তলায় চাপা পড়লেন। এতদিন অত্যন্ত সাবধানে রক্ষা করা খুলি ফেটে ঘিলু বেরিয়ে গেল। গণধোলাই এর হাত থেকে বাঁচার জন্য বাসের চালক ও কন্ডাক্টর ঊর্ধ্বশ্বাসে পালালেন।
অনেক হাঙ্গামার পর মর্গ থেকে তাঁর বডি মা কালী সৎকার সমিতির গাড়িতে তোলা হলো। হুটার বাজিয়ে মাঝরাতের ফাঁকা রাজপথে গাড়ি ছুটে চলেছে। গাড়ির উপরে নীল আলো ঘুরছে। মেরামত করা মৃত নিরাপদ বাবুর মুখে আস্তে আস্তে হাসি ফুটে উঠলো। সাধারণ মানুষেরও কখনো কখনো শখ পূরণ হয়। তবে মরার পর।
ইহজীবনে আর হল না ??? ::