দশ মাস অপেক্ষার পর যখন কোন নতুন অতিথি আমাদের ঘর আলো করে এসে উপস্থিত হয়,পরিবারটি তখন খুশির আবেশে আবিষ্ট হয়ে পড়ে। গোটা পরিবারটি ভেবে উঠতে পারে না তারা কিভাবে নবাগতর যত্ন নেবে। তখন অনেক সময়ই পরিবারে পুরনো ও নব্যপন্থীদের মধ্যে বিরোধ শুরু হয়।শিশুটি কি খাবে, কি পরবে, কোথায় শোবে, ইত্যাদি নানা জিনিস নিয়ে নানান মতামত এর শেষ নেই। আমাদের পরিবারগুলিতে এটি নতুন কিছু না। এমন এক পরিস্থিতিতে আমাদের মনে হয় বিজ্ঞানের দেখানো পথেই হাঁটা ঠিক হবে। নবাগতের যত্ন কিন্তু শুরু হয়ে যায় ভূমিষ্ঠ হওয়ার ঠিক পর থেকেই।
শিশুটি যখন হাসপাতালে থাকে তখনকার যত্ন ডাক্তারবাবু, নার্স দিদিমণিরাই নিয়ে নেন। এ বিষয়ে এ তাঁরা যথেষ্ট দক্ষ। কিন্তু সমস্যা শুরু হয় বাড়িতে আসারপর থেকে।। একরাশ প্রশ্ন পরিবারের সবার মনে দানা বাঁধতে থাকে। এই সব ছোট খাট প্রশ্ন নিয়ে সব সময় ডাক্তার বাবু দের কাছে যাওয়া সম্ভব হয়ে ওঠে না।এই জন্য জরুরী কয়েকটি টিপস দিতে চাই।
প্রথমটি হলো উষ্ণতা। এটি সদ্যোজাতের জন্য ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। যেহেতু এদের ত্বক অপরিণত থাকে, তাই খুব সহযে ঠান্ডা হয়ে যাওয়ার একটা প্রবণতা এদের মধ্যে থেকে থাকে। সুতরাং সদ্যজাতের পরিচর্যা মনে হয় এটি দিয়েই শুরু হওয়া উচিত। হাসপাতাল থেকে ছুটির পর শিশুটিকে এমন ঘরে রাখুন, যেটি আলো-হাওয়া যুক্ত। তবে একটা জিনিস মনে রাখবেন শিশুটি থাকা অবস্থায় কামরাটিতে যেন ক্রস ভেন্টিলেশন না হয়। ঘরের উষ্ণতা এমন হবে যেন বাচ্চা ঠান্ডা না হয়ে যায় আর ঘেমেও না যায়।
সাধারণ ভাবে গরমকালে দুটি স্তরের পোশাক পরান ও শীতে তিনটি স্তরের পোশাক পরান। শীতকালে মাথা এবং পায়ে যথাক্রমে টুপি ও মোজা পরাতে ভুলবেন না। মাঝে মাঝে পায়ের তালু এবং পেটের তাপমাত্রা তুলনা করে দেখুন। যদি মনে হয় পায়ের তালু বেশি ঠান্ডা হয়ে গেছে ,সাথে সাথে অতিরিক্ত পোশাক পরিয়ে শরীরের তাপমাত্রা বাড়ানোর চেষ্টা করুন।
অনেকেরই মনে প্রশ্ন জাগে যে শিশুটিকে কি AC তে রাখা যেতে পারে? উত্তরে বলি অবশ্যই। কেবল একটু খেয়াল রাখবেন ঘরের তাপমাত্রা কখনই যেন ছাব্বিশ ডিগ্রীর কম না হয়। কখনও শরীরের তাপমাত্রা কমে গেছে দেখলে, অতিরিক্ত পোশাক পরান, নিজের শরীরের সঙ্গে স্কিন কন্টাক্ট করিয়েও শিশুটিকে গরম করা যেতে পারে।। বাচ্চার হাত পা ঠান্ডা থাকলে ওজন বৃদ্ধিতে সমস্যা হতে পারে। ওজনে ছোট সময়ের আগে জন্মানো বাচ্চাদের ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার দ্রুত ওজন বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।
এইবার আসি খাওয়ানোর প্রশ্নে। শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর থেকে প্রথম ছমাস বুকের দুধই শিশুর একমাত্র খাদ্য। এতে করে শিশুটির বুদ্ধির বিকাশ, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার বৃদ্ধি হয়, ফলে বড় রোগে ভোগার সম্ভাবনা অনেক কমে যায় এবং শিশুর সঠিক বৃদ্ধি হয়। অবাঞ্ছিত মেদের আধিক্য কমে যায়। নানা বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা গেছে ফর্মুলা দুধের তুলনায় মায়ের দুধ অনেকাংশেই এগিয়ে আছে। যে কথাটি না বললেই নয় জন্মের ঠিক পরেই একটি গাঢ় হলুদ রঙের দুধ স্তন থেকে নিঃসৃত হয় সেটিকে কোলোস্ট্রাম বলে। এটি শিশুর জন্য ভীষণ জরুরী একটি জিনিস। সব সদ্য হওয়া মায়েদের বলবো এইটি শিশুকে অবশ্যই খাওয়াবেন।
প্রত্যেকবার বুকের দুধ খাওয়ানোর পরে শিশুটিকে ঢেঁকুর তোলাতে ভুলবেন না।
এইবার আসি প্রস্রাব ও পায়খানার বিষয়ে। জন্মের প্রথম ২৪ ঘন্টার মধ্যে শিশুটি যদি সবুজ রংয়ের পায়খানা না করে ডাক্তারবাবুকে অবশ্যই জানান। জন্মের প্রথম ৪৮ ঘণ্টা বাচ্চা প্রসাব নাও করতে পারে,যদি তার পরেও না করে তাহলে অবশ্যই ডাক্তারবাবুর পরামর্শ নিন।
সাধারণত সিজারিয়ান সেকশনের পর দুধের স্রোত ঠিক আসতে ২-৩ দিন সময় লেগে যায়। তাই তারপর থেকে প্রসাবও বেড়ে যায়। তারপরও যদি কখনো দেখেন দিনে ছয় থেকে আট বারের কম প্রস্রাব করছে, তা হলেও ডাক্তারবাবুর পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন। পায়খানা ৮-১০ দিনে একবার বা দিনে ৮-১০ বারও যদি করে থাকে এবং শিশুটি যদি শুধুমাত্র বুকের দুধ খেয়ে থাকে, তাহলে খুব কিছু চিন্তার কারণ নাও থাকতে পারে।
তেল মাখানো হল অত্যন্ত জরুরী একটি বিষয়, আমাদের মত শিশু চিকিৎসকদের দৈনন্দিন এই সংক্রান্ত নানা প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়। প্রথমেই বলি সরষের তেল কোনভাবেই শিশুর ত্বকে লাগাবেন না। গরমের দিনে কোন তেল না লাগালেও চলে, শীতের দিনে চাইলে নারকেল তেল লাগানো যায়।
বর্তমান সময়ে প্রত্যেক শিশুকে প্রথম ছয় মাস থেকে এক বছর আমরা ভিটামিন ডি ড্রপ দিয়ে থাকি। এটি শিশুর হাড় ও মাংস পেশী সুঠাম করতে সাহায্য করে।
যদি মনে হয় কোন শিশুর ত্বক শুষ্ক লাগছে, তাহলে ডাক্তারবাবুর পরামর্শ নিয়ে ময়েশ্চারাইজার ক্রিম লাগানো যেতে পারে।
স্নান করানো নিযেও অনেক প্রশ্ন মায়েদের থেকে থাকে। যদি শিশুটি প্রিটার্ম না হয় অথবা জন্মের ওজন কম না হয় তাহলে জন্মের প্রথম দিন থেকেই হাতসওয়া গরম জলে গা মোছানো যেতে পারে। নাভিটি খসে গেলে স্নান করানো যেতে পারে। সপ্তাহে একদিন থেকে দু’দিন সাবান ও শ্যাম্পু ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে মনে রাখবেন, ঘরের মধ্যে যেন ক্রস ভেন্টিলেশন না হয় স্নান করানোর সময়। আর স্নান করানোর সাথে সাথেই শিশুটিকে শুষ্ক করে নিয়ে সঠিক পোশাক পরিয়ে গরম করে ফেলুন।
নাভির যত্ন খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়।। সাধারণভাবে নাভিটি ১০ থেকে ১৪দিনের মধ্যে শুকিয়ে পড়ে যায়। অনেকে কাটা অংশের উপরে বিভিন্ন রঙিন অ্যান্টিসেপটিক ওষুধ ব্যবহার করে থাকেন। এটি না করাই বাঞ্ছনীয়। এতে করে নাভির কোন ইনফেকশন হলে সেটি ওই রঙের আড়ালে ঢেকে যায়। নাভিটিকে একদম শুষ্ক রাখুন। কোন কিছু লাগানোর প্রয়োজন নেই যদি না ইনফেকশন হয়ে থাকে। যদি দেখেন নাভিটি ৩০দিন পরেও পড়ল না তাহলে অবশ্যই ডাক্তারবাবুর সাথে যোগাযোগ করবেন।
ভ্যাক্সিনেশন বা টীকাকরণ আরেকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। হাসপাতাল থেকে শিশুটির ছুটির আগে অবশ্যই বিসিজি, হেপাটাইটিস বি,ওপিভি প্রথম ডোজ দিয়ে তবেই বাড়ি নিয়ে যান। তারপর শিশুচিকিৎসক অথবা স্বাস্থ্যকর্মীদের পরামর্শ অনুযায়ী শিশুটিকে সমস্ত ভ্যাকসিন দেওয়ান। মনে রাখবেন শিশুটি যদি চারাগাছ হয় ভ্যাকসিন হচ্ছে বেড়া। বেড়াটা যত ভালো করে দেবেন, রোগরূপী গরু-ছাগলদের থেকে শিশুটিকে ততো নিখুঁত রূপে রক্ষা করতে পারবেন। রোগে ভোগার যন্ত্রণা থেকে রোগ প্রতিরোধ সমস্ত বাবা-মার কাছেই অনেক বেশি অভিপ্রেত।
সাধারণ যত্নের সাথে সাথে শিশুদের রোগ লক্ষণ জেনে রাখাটাও খুব জরুরী। যদি দেখেন
- শিশুটি কে খুব হলুদ লাগছে।
- শিশুটির ঠোঁট, নাকের ডগা, নখ, হাত ও পায়ের চেটো নীল হয়ে গেছে।
- যদি শ্বাসকষ্ট হয়।
- শিশুটির জ্বর আসে।
- যদি দেখেন শিশুটি অতিরিক্ত বমি করছে।
- যদি শিশুটি অতিরিক্ত পরিমাণ ঘুমায় অথবা অতিরিক্ত কান্না কাটি করে।
- মায়ের বুকের দুধ ঠিক করে টেনে খেতে না পারে।
- প্রস্রাব সারাদিনে ছয় থেকে আট বারের চেয়েও কমে যায়।
- পেট যদি স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ফেঁপে যায়।
- যদি গায়ের রঙ ফ্যাকাসে হয়ে যায়।
- পিত্তি রঙের বমি করে।
- যদি শরীরের কোন অংশ অস্বাভাবিক ভাবে কাঁপে।
- কান দিয়ে রস বেরোয়।
- এছাড়াও যে কোনো লক্ষণ বিপজ্জনক মনে হলে আপনার ডাক্তারবাবুর সাথে অবশ্যই যোগাযোগ করবেন।
আপনার লেখাটি পড়ে ভীষণভাবে সমৃদ্ধ হলাম।
বর্তমানে মোবাইল এবং wi-fi ছাড়া চলা
আমাদের পক্ষে প্রায় অসম্ভব । এগুলো দ্বারা নবজাতকের কোন ক্ষতিসাধন হয় কি? এগুলোর ব্যবহারে কি কি সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত?
এ বিষয়ে পরামর্শ দিলে খুবই উপকৃত হই।
অসংখ্য ধন্যবাদ ।
ধন্যবাদ। মোবাইল ও Wi-Fi একটি চরিপাশে electromagnetic field তৈরী করে। এই নিয়ে খুব বিশ্বাস যোগ্য গবেষণা শিশুদের উপর কম ই হয়েছে। শারীরিক ছাড়াও এগুলি থেকে হওয়া মানসিক ক্ষতি সর্বজনবিদিত। ছোটদের এগুলি থেকে যতটা দুরে রাখা যায় ততই ভাল।