আমি যে কেবলমাত্র ক্লাসিক সাহিত্যের অনুরাগী তা বলতে আমার বিন্দুমাত্র দ্বিধা নেই। এর জন্য কেউ আমাকে ফেবুর ট্যাঁশ ভাবতেই পারেন। করোনার দু’বছরে ঘরে বন্দি থেকে নেটফ্লিক্স ও প্রাইমের যে প্রবল নেশা হয়েছিল তা থেকে বাঁচতে গত এক বছর ধরে আমি সকল ওটিটির সাবস্ক্রিপশন বন্ধ করেছি। ধীরে ধীরে আমি আবার পড়ার জগতে, বইয়ের জগতে ফিরে আসতে পেরেছি। ওই শ্বাসরোধকারী উৎকন্ঠায় ঘণ্টার পর ঘন্টা বাজে সময়ের অপচয় বন্ধ করে আমি আবার ক্লাসিকের জগতে, আর্টের জগতে আমার মত করে ফিরে আসতে পেরেছি। কিন্তু নিজেকে সর্বদা প্রশ্ন করি ক্লাসিক ব্যাপারটা ঠিক কী?
কে জানে কী! হয়ত সংবেদনশীল চিরস্থায়ী কিছু। এমন কিছু যা মানুষের অন্তর্নিহিত সত্যের বিষয়ে কথা বলে। তার গায়ে হয়ত কখনো অবাস্তবতার একটা ছদ্ম আবরণ থাকে, তবে সেই আবরণ সত্যিটাকে মিথ্যে করে না বরং তাকে আরো বড় করে তোলে। মনে মনে স্বপ্ন দেখি ক্লাসিক লিখব একদিন। কিন্তু মানব চরিত্র বুঝি না। অবাক হয়ে যাই যখন লেখক এক চরিত্রের বর্ণনা দিয়ে তার মধ্যেকার এক তীব্র বিপরীতধর্মী সত্তার কথা বলেন। কই আমি তো এমন ভাবিনি! আমি তো এমন করে লিখতে পারতাম না!
মার্কেজ কলোনেল অরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার নিঃস্বার্থ বিপ্লবের কথা বলে যখন বলেন যে তিনি শুধু আত্মগৌরবের জন্যই কুড়ি বছর ধরে গেরিলা বিপ্লব করে গেছেন কিংবা তাঁর হৃদয়ে প্রেম বলে কোনো বস্তুই নেই। আমারান্তার প্রেমিকদের ধারাবাহিক প্রত্যাখ্যান ও ভার্জিনিটিকে আঁকড়ে ধরে থাকার কথা বলে তিনি যখন বলেন আমারান্তা শুধু তাঁর নির্জনতাকে সুন্দর ও সার্থক করে তোলার জন্যই সারাজীবন এই কৃচ্ছ্বসাধন করে গেছেন। তখন আমার মনে হয় ক্লাসিক ঔপন্যাসিকের এই অন্তর্দৃষ্টি আমার অন্তত নেই।
আচ্ছা যাঁরা এই ক্লাসিক লিখেছেন ধরুন মার্কেজ এই ‘ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ার অফ সলিচিউড’ লিখেছেন বা ফিটজেরাল্ড ‘দ্য গ্রেট গ্যাটসবি’ লিখেছেন- এখানকার চরিত্রগুলো কী সত্যিই সার্বিক মানবচরিত্রের ধারা বহন করছে? নাকি তারা একটি বিশেষ সময়ের, বিশেষ স্থানের কয়েকটি সম্ভাবনার প্রতিফলন? জ্ঞানী মানুষেরা কি তাদের ক্লাসিক সাহিত্য বলে মেনে নিয়েছে তাদের চমকদার বাগবিস্তারের জন্য নাকি সত্যিই তাদের ভেতরে একটা দগদগে মনুষ্যত্ত্ব আছে?
জানি না। হৃদয় সন্দেহে আচ্ছন্ন। অবিশ্বাস মজ্জাগত। তাই ক্লাসিক পড়ে যত উত্তেজিত ততটাই প্রশ্নশীল হই। একটা কথা মনে মনে জানি, সাহিত্য তা ক্লাসিকই হোক বা বটতলার তা কল্পনার ফসল। তাই তাদের ওপর অন্ধ বিশ্বাস না রাখাই ভালো । সব কিছুকেই তার ‘ফেস ভ্যালু’ হিসেবে গ্রহণ করার প্রয়োজন নেই। দিনের শেষে সাহিত্যপাঠে আমি আনন্দ পেলাম কি না সেটাই বিবেচ্য। যে সাহিত্য পাঠককে আনন্দ দিতে পারে না তা যত উচ্চ মার্গেরই হোক না কেন, তা ব্যর্থ।
ধান ভানতে শিবের গীত গাওয়ার প্রধান উদ্দেশ্য হল এটাই বলা যে মানব চরিত্র আমি বুঝি না। আমি যেভাবে ভাবতে চাই চরিত্র সবসময়ই তার উলটো পথে হাঁটে। সেই চরিত্রের যদি আবার আংশিক স্নায়বিক গন্ডগোল থাকে তবে তার গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করা আমার হাতের বাইরে।
শনিবার সকালে আমার চেম্বারের সামনে বেশ ভিড় হয়। কারণ সকালে রুগি দেখার পর আমি সপ্তাহে ওই একদিনই এক ঘন্টা এম. আর.-দের মিট করি। সপ্তাহে যেহেতু একদিন তাই তাদের জন্য চেম্বারের সামনে খুব ভিড় হয়। সেদিন অনেক্ষণ বসে থাকতে হয় তাই ওঠার জন্য ছটফট করি। সেদিনও তাই। উঠব উঠব করছি, এমন সময় একজন মহিলাকে দেখছি অনেক্ষণ ধরে চেম্বারে ঢুকব ঢুকব করছেন। ঢুকেও আবার বেরিয়ে যাচ্ছেন।
সবাই চলে যাবার পর আমি বাইরে বেরোতেই উনি চেম্বারে ঢুকে বসলেন। আমি বেশ বিরক্ত হয়ে তাকে বললাম, বলুন কী বলবেন?
– আপনার সাথে কি বাইরেই কথা বলব? এখানে খোলা জায়গায় কথা বলা কি ঠিক হবে?
আমি কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লাম। প্রবল অনিচ্ছাসত্ত্বেও ওনাকে বললাম, তাহলে ভেতরে আসুন। এদিকে আমার অ্যাটেন্ডেন্ট মেয়েটিও চলে গেছে। ভদ্রমহিলার ভাবগতিক আমার কেমন কেমন লাগছে। উনি কি বলতে চান আমাকে?
– আপনি একদিন আমাকে যা বলেছিলেন, আজ আবার তা বলুন। আমি আপনার কথা শুনব।
– আমি আপনাকে কি বলেছিলাম? কবে বলেছিলাম? আমি কবে আপনাকে দেখেছিলাম তাই তো মনে করতে পারছি না!
– কী বলছেন? আপনি আমাকে মনে করতে পারছেন না? চিনতে পারছেন না? আপনি ডাক্তার মানুষ। আপনি আমাকে কী বলেছিলেন সেটা আপনি মনে করতে পারছেন না এটা হতেই পারে না। আপনি মনে করে দেখুন।
আমি প্রবল আতান্তরে পড়লাম। প্রায় দুপুর দুটো বাজতে চলল। রাস্তাতেও তেমন লোক নেই। তার ওপর এই ভদ্রমহিলা এমন আচরণ করছেন। আমি চেম্বারের পর্দাটা তুলে দিলাম যাতে বাইরে থেকে অন্তত আমার চেম্বারটা দেখা যায়। বুঝতে পারলাম উনি সহজে উঠবেন না।
– দেখুন আমি সারাদিন এত পেশেন্ট দেখি। কবে কাকে কী বলেছি সেসব কি আমার মনে থাকে? আপনিই বরং বলুন না আমি আপনাকে কী বলেছিলাম। আর সকাল থেকে অনেক্ষণ বসে আছি। চেম্বার বন্ধ করতে হবে। আপনি যা বলার তাড়াতাড়ি বলুন।
– আপনি তাহলে সত্যিই বলবেন না আপনি আমাকে কী বলেছিলেন?
– জানলে তো বলব। আপনি একদিন আপনার স্বামীকে নিয়ে আসুন। (মহিলার মাথায় বেশ বড় করে সিঁদুরের টিপ)
– আপনি মিথ্যে কথা বলছেন। আর আমি আমার স্বামীর সাথে থাকি না।
আমি অত্যন্ত বিরক্ত হলেও চুপ করে রইলাম।
দেখলাম ভদ্রমহিলার চোখ ছলছল করছে। রুমাল দিয়ে চোখ মুছলেন। পরিস্থিতি প্রায় আয়ত্তের বাইরে চলে যাচ্ছে। আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে বললাম, – আজ আসুন। আমি ভেবে দেখছি আপনাকে কী বলেছিলাম।
– আপনার ভিজিট কত?
– ভিজিট আবার কী? আপনাকে তো আমি দেখলামই না। আসুন।
– এটা রাখুন। ডাক্তারকে কেউ আবার বিনে পয়সায় দেখায় নাকি? টেবিলের ওপর একটা পিয়ের কার্ডিনের পেন আর একটা সুন্দর বাহারি ডায়েরি রাখলেন।
– এটা নিয়ে যান। আমি রাখতে পারব না।
ভদ্রমহিলা কোনো কথা না বলেই কাঁদতে কাঁদতে ঝড়ের বেগে চেম্বার ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন।
বাড়ি ফিরে আমার মনে পড়ল উনি অনেকদিন আগে বেশ কয়েকবার কখনো একা কখনো ওনার স্বামীর সাথে আমাকে দেখাতে এসেছিলেন। উনি নানারকম মানসিক সমস্যায় ভুগতেন। আর সবসময় সন্দেহ করতেন তাঁর স্বামী অন্য কারো সাথে অবৈধ সম্পর্কে জড়িত। সবটাই তাঁর অনুমান ছিল নাকি তার মধ্যে কিছু সত্যি ছিল আমার পক্ষে জানা সম্ভব ছিল না কিন্তু আমি সেদিন তাঁকে কী বলেছিলাম যার জন্য তিনি এত বছর পরে আমার কাছে এসেছেন, তা আমি কিছুতেই মনে করতে পারলাম না।
হপ্তা দুই পরে তিনি আবার একদিন এলেন। এবারও সবার শেষে।
– আজ দেখাতে এসেছি।
– হ্যাঁ, বলুন।
– দেখুন তো হাতে কী হচ্ছে?
দেখলাম হাতে দুটো জায়গায় নীলচে রক্ত জমে আছে। অনেকটা পারপিউরিক স্পটের মতো।
– চোট-টোট লেগেছে নাকি? পড়ে-টরে গেছিলেন? চুলকোয়?
– না ওসব কিছুই হয় নি। আপনিই বলুন কী হতে পারে?
দেখলাম ভদ্রমহিলা একটা ব্যঙ্গাত্মক এবং কূট দৃষ্টি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমার কিছুটা নার্ভাস লাগছিল। প্রায় মুখে এসে গেছিল, আপনার বর কি আপনাকে মারধর করে? বলতে পারলাম না।
– কিছু টেস্ট লিখে দিন তাহলে। যদি ধরা পড়ে। ভীষণ অবজ্ঞার সাথে বললেন।
আমি কিছু টেস্ট লিখে দিলাম।
– এই দেখুন আপনার ভিজিটটাই আনি নি। আচ্ছা আপনি এই ঘড়িটা রাখুন। আমি পরে ভিজিট নিয়ে এসে ঘড়িটা নিয়ে যাব।
দেখলাম একটা টাইটানের ঘড়ি।
– অসম্ভব। আপনি এসব নিয়ে যান। আর আগের দিন পেন টেন দিয়ে গেছেন ওসবও নিয়ে যান।
সেগুলো দেবার জন্য যখন উঠেছি উনি আবার ঝড়ের বেগে বাইরে বেরিয়ে গেলেন।
টাইটানের ঘড়িটার দাম সাড়ে সাত হাজার টাকা। সোনালি রঙের। পেন আর ডায়েরির দাম কম করে পাঁচ-ছ’শ তো হবেই। তার আট হাজার টাকার সম্পত্তি আমার কাছে। যত্ন করে রেখে দিয়েছি। এরপর যদি আসেন ওসব দিয়ে পত্রপাঠ বিদেয় করব।
দুই হপ্তা হয়ে গেল এখনো ওনার দেখা নেই।
আমার কাছে কত মানুষ আসেন যারা নানা রকম দাম্পত্য সমস্যায় ভুগছেন। আগে দুজনেই আসতেন। পরে দেখি স্বামীটি অন্য একজনকে নিয়ে আসছেন। বউটি একা আসছেন। আবার এমনও হয়েছে কোনো একজন অন্যের বউকে তার স্বামীর সাথে দেখাতে নিয়ে এসেছেন। একবছর পরে বউটিকে নিয়ে এসে বলছেন, ডাক্তারবাবু আমার মিসেস। স্বামী-স্ত্রীর দূষিত সম্পর্কের মধ্যে পরকীয়া, সন্তান, মানসিক ব্যধি, আর্থিক অনটন- এসব নিয়ে সংসারগুলো কীভাবে যে চলতে থাকে তা ভাবলে মাঝে মাঝে আশ্চর্য হতে হয়।
এমনই এক সংসারের, বিবাহের দাগ কপালে নিয়ে বেড়াচ্ছেন এই মধ্যবয়স্ক মহিলা। আমি দুদিন ওনার সাথে যথেষ্ট ভদ্র ব্যবহার করেছি। কিন্তু ওনার মোটিভ আমার ভালো লাগছে না। পরেরবার আমাকে এই উপহারের ভার একেবারে টেনে নামাতে হবে।
আমার চেম্বারে জলদি সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো দরকার।