বয়স্ক ভদ্রলোক মাঝে মধ্যেই আসেন। কদিন আগে যখন এলেন অবস্থা সুবিধার না। বুক শ্লেষ্মায় ঘড়ঘড় করছে। আমার হাত দুখানা ধরে বললেন, ‘ডাক্তারবাবু, আর মাত্র ১১ টা মাস। আপনি যে করে হোক এই কটা দিন আমাকে বাঁচিয়ে রাখেন।’
এই ১১মাস ব্যাপারটার একটা হিষ্ট্রি আছে। সেটা বলে না নিলে বুঝতে অসুবিধা হবে। ভদ্রলোক প্রায় বছর তিনেক ধরে আমাকে দেখাচ্ছেন। এবং তখন থেকেই বলে যাচ্ছেন, ‘জীবনে তো কিছুই করে উঠতে পারলাম না। একটা জিনিসই শুধু করে যেতে পারি। সেটা হচ্ছে একশো বছর পার করা।’
আমি প্রথমবার যখন দেখি তখন হেসে বলেছিলাম, ‘এখনই ওসব নিয়ে চিন্তা করছেন কেন? এখনও তো অনেক দেরী।’
ভদ্রলোক বললেন, ‘মোটেও দেরী নেই। আর মাত্র তিন বছর আট মাস।’
আমি বললাম, ‘অসম্ভব, আপনার বয়স ৯৬ হতেই পারে না। কেন মিথ্যা বলছেন?’
ভদ্রলোক দুঃখিত মুখে বললেন, ‘মিথ্যা কেন বলব। আধার কার্ড সাথে আছে। দেখবেন?’
বললাম, ‘আধার কার্ডে যাই থাক আপনার বয়স কিছুতেই ৭৫ এর বেশি নয়। আপনার যদি ৯৬ হয় আমারও তাহলে ৬০ বছর।’
ভদ্রলোক বললেন, ‘আপনি যদি আধার কার্ড, ভোটার কার্ড বিশ্বাস না করেন তাহলে কিছু করার নেই। আপনার সাথে তর্ক করা বৃথা।’
তর্ক আমিও করতে চাই না। তাছাড়া ভদ্রলোক যদি জীবনে একটা লক্ষ্য নিয়ে বাঁচতে চান, তাতে আপত্তি করার কী আছে। বুড়ো বয়সে কোনো লক্ষ্য ছাড়া বেঁচে থাকা মুশকিল। কেউ বাঁচেন নাতির বিয়ে দেখার আকাঙ্ক্ষায়। কেউ আবার পুতির মুখ দেখার আকাঙ্ক্ষায়। ইনি একশো পার করার লক্ষ্য নিয়ে বেঁচে আছেন। সে লক্ষ্যে যতই জল মেশানো থাকুক না কেন, মানুষটির আবেগের কথা ভেবে বেনিফিট অফ ডাউট দেওয়া যেতেই পারে।
কদিন আগে যেবার এলেন সেবারও একাই এসেছেন। বললেন, ‘সেঞ্চুরি যতই এগিয়ে আসছে ততই ডিফেন্স নড়বড় করছে। দেখেন না কী বিচ্ছিরি ঠাণ্ডা বসে গেল। এর থেকে নিউমোনিয়া হয়ে মরে টরে যাবো নাতো?’
বললাম, ‘বিড়ি যদি বন্ধ না করেন, তাহলে নির্ঘাত মরবেন।’
উনি আমার হাত ধরে বললেন, ‘এসব বললে আমি ভয়ে হার্টফেল করে মরে যাব। আপনি যে কোরেই হোক আর ১১ টা মাস আমাকে বাঁচিয়ে রাখেন।’
বললাম, ‘আপনি বিড়ি ছাড়ুন।’
‘ছাড়লে ১১ মাস বাঁচাতে পারবেন তো?’
‘১১ মাস কেন, ১১ বছর হেসে খেলে বাঁচবেন। আপনি একেবারে নিশ্চিত থাকুন।’
‘তাহলে এই ১১মাস আর বিড়ি খাব না। সেঞ্চুরি করলে আবার খেতে শুরু করব। তখন যা হয় হবে। আপনি কিন্তু কথা দিলেন। আগে যদি আউট হই তাহলে ভূত হয়ে আপনার ঘাড়ে চাপব।’
ভদ্রলোক বেরিয়ে যাওয়ার পর গৌর উঁকি মারল। বলল, ‘ডাক্তারবাবু, সত্যি সত্যি কী ওঁর বয়স ৯৯?’
বললাম, ‘ধুর, ধুর… ‘
গৌর বলল, ‘বাইরে হেব্বি রং নিয়ে চলে গেলেন। এমন কী আধার কার্ড বের করে দেখালেন।’
বললাম, ‘আধার কার্ডের কথা আর বোলো না। আমার আধার কার্ডে যা একটা ছবি দিয়েছে, দেখে মনে হচ্ছে দুদিনের বাসি মড়া। ৯৯ বছরে কেউ একা একা ডাক্তার দেখাতে আসে? কেউ কানে এতো ভালো শোনে?’
গতকাল বাড়ির চেম্বারে ভদ্রলোকের ছেলে এসে হাজির। এই প্রথম ওনার ছেলেকে দেখলাম। উনি যতবারই এসেছেন একাই এসেছেন। ছেলের হাতে আমার একতাড়া প্রেসক্রিপশন। প্রেসক্রিপশন দেখেই চিনতে পারলাম, এই সেই সেঞ্চুরি প্রিয় ভদ্রলোকের ছেলে।
ছেলে জানাল বয়স্ক ভদ্রলোক ঘণ্টা খানেক আগে মারা গেছেন। হঠাৎ বুকে ব্যথা। গাড়ি জোগাড় করতে করতেই ভদ্রলোকের আর সাড়াশব্দ নেই। এখন যদি আমি একটা ডেথ সার্টিফিকেট লিখে দি।
বললাম চেম্বার শেষ করে ওনাদের বাড়ি যাচ্ছি।
ঘণ্টা দেড়েক বাদে আমার আরেক সহকারী পার্থ কে নিয়ে প্রথমবার ভদ্রলোকের বাড়ি গেলাম। বারবার মনে হচ্ছিল, আহা রে, আর ৬ টা মাস উনি বেঁচে থাকলে কার কী এসে যেতো। আমি কথা দিয়েছিলাম। ভদ্রলোক মারা যাওয়ার আগে নিশ্চয়ই ভেবেছেন আমার কথার কোনো দাম নেই।
ডেথ সার্টিফিকেট লেখার জন্য আধার কার্ড নিলাম। জন্ম তারিখ লেখা আছে ১ জানুয়ারি ১৯২৪। সেটা দেখতে দেখতে দুরুদুরু বুকে ওনার ছেলেকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আপনার বাবা কি ধূমপান বন্ধ করেছিলেন?’
চাইছিলাম, উত্তরটা যেন না হয়। কতো মানুষকে কতো কথা দিই। অনেক কথাই রাখতে পারি না। কতো জনের নির্ভরতার দাম দিতে পারি না। আর ভালো লাগে না।
ভদ্রলোকের ছেলে বললেন, ‘আপনাকে মাস চারেক আগে দেখিয়ে এসেছিলেন। তারপর পর থেকে একটাও বিড়ি খাননি। বলেছেন আপনাকে কথা দিয়ে এসেছেন বিড়ি খাবেন না। তার বদলে মাঝে মাঝে লবঙ্গ মুখে দিতেন। এই যে মাথার পাশেই লবঙ্গের কৌটো।’
মনটা বড্ড খারাপ হয়ে গেলো।