খুপরিজীবি ডাক্তারেরও মন খারাপ হয়। তবে সেই মন খারাপ নিয়ে বিলাসিতা করার সময় মেলে না। মোবাইলের এলার্ম যখন বেজে ওঠে, শীতের দিনে তখনো আলো ফোটেনা। দাঁত ব্রাশ করতে করতে দু-চারটে ফোন করি। পাড়ার বন্ধুদের কাছে ফোন, উঠে পর, সাড়ে পাঁচটা বাজে। আজ মেডিকেল ক্যাম্প আছে।
কেউ ফোন তোলে, কেউ আবার লেপের মায়া কাটাতে পারে না। কনকনে ঠাণ্ডা জলে মুখ ধুতে ধুতে মন খারাপটা আরও তীব্র হয়ে ফিরে আসে। এ এক আশ্চর্য মন খারাপ। ভিতরটা পর্যন্ত কাঁপিয়ে দেয়।
ক্লাবের সামনে রোগীদের লাইন দেখে ভেতরের কাঁপুনিটা কমে। এরপর আমার আর নিজস্ব ভালোলাগা, খারাপ লাগা নেই। আমার আর নিজস্ব বলে কিছু নেই। এই ভালো- ভোরের ঝকঝকে আলোয় আস্তে আস্তে কুয়াশা কেটে যায়, সাথে আমার মন খারাপও।
আমি রোগী দেখি, ওষুধ কাটি। পায়ের কাছে ওষুধের খালি বাক্স জমা হয়। ক্যালসিয়াম, ফ্যামোটিডিন, এম্লোডিপিন, টেলমিসারটেন, মেটফরমিন, গ্লিমেপেরাইডের হিসাব বুঝে নিয়ে, সেগুলো ব্যাগে ভরে কেউ কাজের বাড়ি ছোটেন, কেউ ভ্যান নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। আবার দু-সপ্তাহ বাদে ওঁরা লাইনে দাঁড়াবেন। আপাতত নিশ্চিন্ত- তাড়াতাড়ি কাজ মিটে গেছে। শুধু আমার নয়, আমার রোগীদেরও সপ্তাহে একটা দিনও ছুটি নেই, মন খারাপ নিয়ে বিলাসিতা করার সময় নেই।
প্রণবদা রোগীদের নাম লেখে। সঞ্জীবদা লাইন ভাঙা নিয়ে ঝগড়া করে। লাইনের পুরনো লোক ওষুধ নিয়ে চলে যান। নতুন লোক এসে দাঁড়ান। লাইনের দৈর্ঘ্য ধ্রুবক থাকে।
এক খটখটে শুকনো, বেশ গোলাপি গোলাপি রঙের বুড়ি আমাকে দেখে হাসে। ওষুধ হাতে পেয়েও যেতে চায়না। বলে, তোরে একেবারে আমার সেই মরে যাওয়ার ওনার মতো দেখতে। উনিও তোর মতো লম্বা ছিলেন। তোর মতোই চাপা গায়ের রঙ।
বুড়ি আমার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে। গালে হাত দিয়ে চুমু খায়। বুড়ির সাথে যে পুতি এসেছিল, সেই ছোটো ছেলেটি লজ্জা পায়। তাড়া দিয়ে বলে, তাড়াতাড়ি করো বড়োমা। এখনও কতো লোক দাঁড়িয়ে আছে।
বুড়ি ধমক দিয়ে ওঠে, তুই বক বক করিস নে পুকা। আর একটু ওনারে দেখি, কতকাল দেখি না।
ছেলেটি বলে, কতবার বলেছি, আমাকে পোকা বলে ডাকবে না।
ওমা,ছোঁড়ার কথা শোনো। পুকারে নাকি পুকা বলা যাবে না। তোর বাপে যখন পুকা পুকা করে, তখন তো কিছু বলিস নে।
ছেলেটি রেগে বলে, আমি চললাম। তুমি যা ইচ্ছে করো।
বুড়ি চেঁচায়, পুকারে যাসনে… যাসনে। হাতটা ধরে টেনে তোল বাপ আমার।
বুড়ি যাওয়ার পর ভাবি এক বুড়ো যদি মহিলা ডাক্তারকে দেখে বলতো, তোকে দেখে আমার বউয়ের কথা মনে পড়ে। তারপর তাকে আদর টাদর করার চেষ্টা করতো, তাহলে সে সম্ভবত অক্ষত দেহে বাড়ি ফিরতে পারতো না। ছেলেদের বুড়ো হয়েও শান্তি নেই।
নটার পর থেকে লাইনটা তার ধ্রুবকতা হারায়- আস্তে আস্তে ছোটো হয়। একজন মহিলাকে জিগ্যেস করি, কী হয়েছে?
ডাক্তারবাবু, একটা সার্টিফিকেট দরকার?
সার্টিফিকেট? কীসের সার্টিফিকেট?
ডাক্তারবাবু, মেয়েটা সাইতে সুযোগ পেয়েছে। ও রাজ্যস্তরে সাঁতারে নামে। ওখানে হোস্টেলে থাকার জন্য একটা সার্টিফিকেট দরকার।
বছর এগারো বারোর মেয়েটির দিকে তাকাই। একমাথা ঝাঁকড়া চুল। রোগা লম্বা শরীর। আমার মতোই গায়ের রঙ। হেসে বলি, বাহ্ তুই এতো ভালো সাঁতার কাটিস। কোথায় বাড়ি তোর?
মেয়েটি মাথা নিচু করে থাকে। কিছু বলে না। ওর মা জবাব দেয়, এই তো কাছেই, খাল পাড়ে।
আমি বলি, এখানে তো আমার প্রেসক্রিপশন প্যাড নেই। এখানে কী করে লিখবো। আপনি মেয়েকে নিয়ে দশটার পর বাড়ির চেম্বারে চলে আসুন। লিখে দেব।
মহিলা মাথা নিচু করে, ছেড়া শাড়ির আঁচল আঙুলে জড়ায়। আমি বুঝতে পারি সে কেন ইতস্তত করছে। না না, ভিজিট লাগবে না। ও সাঁতারে এতো ভালো- পরে যখন বিখ্যাত হবে তখন আমিও গর্ব করে বলতে পারব আমি ওকে সার্টিফিকেট দিয়েছিলাম।
মহিলা বলে, আসলে পাঁচ বাড়িতে কাজ করি তো। আপনার ওখানে খুব ভিড় হয়।
হেসে বলি, আপনি আসুন না। পার্থকে বলে রাখব। আপনাকে দাঁড়াতে হবে না।
মহিলা বলল, আপনি ওকে আশীর্বাদ করবেন। ওর বাবার ওর উপর এতো আশা ছিল, ওকে এতো ভালোবাসতো- ও যেন বাবার আশা পূরণ করতে পারে।
আমার আশীর্বাদ !!! আমি হাসলাম। বললাম, ওর বাবার কী হয়েছে?
মহিলা হঠাৎ কেঁদে ফেলল। বলল, ওর বাবা চলে গেছে মাত্র দু মাস আগে। টিবি হয়েছিল। এতো ওষুধ খেলো, কিছুতেই কিছু হলো না। আসলে শুধু ওষুধ খেয়ে কী হবে, পথ্যেরও তো দরকার। শেষ একবছর শরীরের যা অবস্থা হয়েছিল, কাজেই বেরোতে পারতো না। মাঝে মাঝেই রক্ত উঠতো। ওই অবস্থাতেও ওকে ডিম দুধ দিলে খেতে চাইতো না। বলতো কোনিকে দাও। কোনি খাক। সাঁতার কাটতে হলে এসবের দরকার।
আমি অবাক হয়ে মেয়েটির দিকে তাকালাম। বললাম, তোর নাম কোনি?
ছোটো মেয়েটি এই প্রথম মুখ খুলল, না, আমার নাম শম্পা। কিন্তু বাবা কোনি বলে ডাকতো। এখনও ডাকে, জলে নামলেই ডাকে। মেয়েটির গলার স্বরে দৃঢ় প্রত্যয়।
এবং এই দৃঢ় প্রত্যয় আমাকে বুঝিয়ে দিল আমার এই মন খারাপ কতো তুচ্ছ। আমি কিচ্ছু হারাই নি। কাউকে হারাই নি। সবাই আছে আমার সাথে। ছোটো মেয়েটির তীব্র অনুভব ক্ষমতা আমাকেও আচ্ছন্ন করছিল।
তোমার মহাবিশ্বে কিছু হারায় না তো কভু।