আমার প্রায় সব পেশারই রোগী আছে- ভিখারি থেকে মন্ত্রী পর্যন্ত। একেক পেশার রোগীরা একেক রকম হন। পরে সেসব নিয়ে বিস্তারিত লেখা যাবে। আপাতত গল্পে ঢুকে যাই।
আমার বেশ কয়েকজন পুলিশ রোগীও আছেন। তাঁরা মানুষ হিসাবে কেমন বলতে পারব না, কিন্তু রোগী হিসাবে অসম্ভব ভালো। খুপরিতে ঢুকেই এটেনশান মোডে দাঁড়ান এবং বলেন ‘গুড আফটারনুন সার।‘
নিজের শারীরিক সমস্যা এনারা কখনই সাতকাহন করে বলেন না। বরঞ্চ খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে সমস্যা বের করতে হয়। যা বলি অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে শোনেন। বিশেষ প্রশ্নও করেন না। এবং একটি নির্দিষ্ট সময় অন্তর শ্বাস যন্ত্রে অনেকটা চাপ দিয়ে বলেন, ‘সার।‘
গতকালই এমন একজন পুলিশ অফিসার এসেছিলেন দেখাতে। ইনি নিজেও আসেন। আবার স্ত্রীকে নিয়েও আসেন। স্ত্রীর রেক্টামে ক্যানসার। পেটের ডানদিকের তলায় ছাঁদা করে কলোস্টমি করা। মাঝে মাঝেই তাঁর ডাইরিয়া হয়। তবে এসব সমস্যা নিয়েও তিনি বেশ হাসিখুশি।
প্রত্যেকবার প্রেসক্রিপশন লেখা শেষ হলে পুলিশ অফিসার উঠে দাঁড়ান। তারপর বলেন, ‘গুড নাইট সার।‘ তারপর আর কথা না বলে উল্টোদিকে ঘুরে গটগট করে বেরিয়ে যান। গতকাল উঠে দাঁড়ানোর পর আমাকে অবাক করে বললেন, ‘আপনার সম্পর্কে একটি গুরুতর অভিযোগ আছে।‘
স্বয়ং পুলিশের মুখে গুরুতর অভিযোগের কথা শুনে বুক কেঁপে উঠল। কে জানে বাবা আবার কোন ঝামেলায় ফাঁসলাম। খুপরিজীবি চিকিৎসকের জীবনে তো ঝামেলার শেষ নেই। কেন যে মরতে ডাক্তার হয়েছিলাম।
ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করলাম ‘কী অভিযোগ? কে অভিযোগ করেছেন?’
পুলিশ অফিসার হাসলেন। অত্যন্ত বিরল দৃশ্য। তারপর বললেন, ‘আপনি নতুন কিছু লিখছেন না কেন? কী ভাবেন, পুলিশের লোকজন কী আপনার লেখার উপর নজর রাখছে না? পুলিশরা কী পড়াশুনো করে না? আপনার পাঁচ বোনের গল্পটা আমিই কতজনকে শেয়ার করেছি জানেন?‘
আমতা আমতা করে বললাম, ‘যে চক্রব্যূহের মধ্যে ঢুকে গেছি, লেখার সময় পাওয়াই মুশকিল। সারাদিন রোগী দেখে রাতে ঘুমানোর সময়েও রোগী দেখার স্বপ্ন দেখি।‘
পুলিশ ভদ্রলোক বললেন, ‘ওসব বললে তো শুনবো না। নতুন লেখা চাই। গুড নাইট সার।‘ তিনি পেছনে ঘুরে আর কোনো কথা না বলে চলে গেলেন।
তারপর থেকেই লেখার চিন্তা মাথায় ঘুরছে। প্লটের অভাব নেই। সময়ের অভাব। এই লিখতে বসেছি, রুপালী ডাক দিচ্ছে, ‘মাঝ রাত্রে আবার ল্যাপটপ খুলে বসলে কেন। ঘুমিয়ে পরো। কাল ভোরে কিন্তু তুমি রানীকে স্কুলের জন্য রেডি করবে।‘
‘ঠিক আছে করবো?’ বলে লেখায় মন দিলাম। কী নিয়ে লিখি? মাস-খানেক কিছুই লিখিনি। কত ঘটনা জমে গেছে। সব মাথার মধ্যে ভিড় করে আসছে। যে কোনো একটা ঘটনা নিয়ে লেখা শুরু করি।
পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের গ্রেফতার এবং টাকার পাহাড় উদ্ধার হওয়ার পর আমার ব্যক্তিগত সুবিধা হয়েছিল। সে সময় ভরা করোনার বাজার। শয়ে শয়ে জ্বরের রোগী নিয়ে নাকানি চোবানি খাচ্ছিলাম। অধিকাংশ রোগীই মনে করছিলেন তিনি ভয়ংকর এমারজেন্সির মধ্যে আছেন। তাঁকে আগে দেখে দিতে হবে। দেরী হলে তাঁর জীবন সংশয় পর্যন্ত হতে পারে। তিন- চারজন রোগী একসাথে চোখ- টোখ উলটে গোঁ গোঁ করতেন আর তাঁদের আত্মীয় স্বজনরা লাফালাফি জুড়তেন। আমি নিধিরাম ডাক্তার কারোর ঠ্যাং উপরে তুলে, কাউকে ও আর এস খাইয়ে, কাউকে বকাঝকা করে পরিস্থিতি সামলাতাম।
চেম্বারের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পার্থ (এটা অন্য পার্থ) রোগীদের সাথে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ঝগড়া করত, গৌর এসে সামলাতো আর আমি মাথা গুঁজে রোগী দেখে যেতাম আর বলতাম, ‘জ্বর যদি দুদিনে না কমে তাহলে হাসপাতালে গিয়ে করোনা পরীক্ষা করাবেন।‘
ইডির যখের ধন আবিষ্কারের পরে পরিস্থিতি কিছুটা পাল্টালো। রোগীরা ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছেন। অপেক্ষার পরও তাঁদের মেজাজ খারাপ হচ্ছে না। কারণ তাঁরা আড্ডা দেওয়ার মতো একটি পছন্দসই বিষয় পেয়েছেন। একজন প্রভাবশালী মন্ত্রী গ্রেফতার হয়েছেন, তাঁর মেয়ের বয়সী বান্ধবীর ফ্ল্যাট থেকে টাকার পাহাড় উদ্ধার হয়েছে। ঘণ্টা খানেক আলোচনার জন্য আর কী চাই?
সেদিনও রোগী দেখে যাচ্ছি। আগের দিনই বেলঘরিয়ার ফ্ল্যাট থেকে ইডি ৩০ কোটি টাকা উদ্ধার করেছে। ফলে পরিবেশ মোটামুটি শান্ত। মাঝে মাঝে শুধু মাস্ক না পরা নিয়ে পার্থর সাথে রোগীর ও রোগীর বাড়ির লোকের টুকটাক কথা কাটাকাটি চলছে। সেসব পাত্তা দেওয়ার মতো কিছু নয়। এতোটাই শান্তিতে রোগী দেখছি যে মাঝে মাঝেই আমার ঝিমুনি এসে যাচ্ছে।
একজন ত্রিশ- বত্রিশ বছরের মহিলা সাথে একটি ছোটো ছেলেকে নিয়ে খুপরিতে ঢুকলেন। দুজনেই আমার পরিচিত। এই মহিলার স্বামী আমার কাছে প্রায়ই আসতেন। তিনি প্রায় আমারই বয়সী ছিলেন। বড্ড ভালো মানুষ ছিলেন। সাজিরহাটের ভেতরে কোথাও তাঁর একটি ইলেকট্রিকের দোকান ছিল। প্রথম ও দ্বিতীয় লক ডাউনের সময়ে নিজের সীমিত সামর্থ্য নিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। কাউকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে, কারুর অক্সিজেন সিলিন্ডার দরকার, কারো বাড়িতে দুদিন রান্না হয়নি- অনেকেরই ভরসা হয়ে উঠেছিলেন তিনি।
কিন্তু দুঃখের ব্যাপার ২০২১ সালের মে মাসে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময়ে তিনি নিজেই করোনায় আক্রান্ত হন এবং মারা যান। দ্বিতীয় ঢেউয়ে বহু সাধারণ মানুষ পরের জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন। কিন্তু কেউ তাঁদের মনে রাখেনি।
স্বামী মারা যাওয়ার পর ভদ্রমহিলা বেশ বিপদে পড়েছেন। তাঁদের আর্থিক অবস্থা তেমন ভালো না। এ রাজ্যে মদ খেয়ে মরলে তবু কিছু ক্ষতিপূরণ মেলে, কিন্তু ভালো কাজের জন্য জীবন দিলে কেউ তাঁর পরিবারকে এক নয়া পয়সা দিয়েও সাহায্য করেন না। নৈহাটির শহীদ ডাক্তারবাবুর স্ত্রীকে বেসরকারি হাসপাতালে বিল মেটানোর জন্য স্বামীর ভিটে পর্যন্ত বিক্রি করতে হয়েছে।
ভদ্রমহিলা নিজেই ইলেকট্রিকের দোকানটি সামলাচ্ছেন। যখনই আসেন স্বামীর সম্পর্কে একগাদা নিন্দা করে যান। তাঁর বক্তব্য ওই একগুঁয়ে অপদার্থ লোকটার জন্য তাঁর জীবন শেষ হয়ে গেল। লোকটা তাঁর একটা কথাও শুনতো না। বাড়িতে সেসময় তাঁদের নিজেদেরই ঠিকমতো খাবার জুটতো না, আর তাঁর স্বামী করোনা রোগীদের বাড়িতে খাবার বিলি করে বেড়াতেন। ঝড় জলের মধ্যে অক্সিজেন সিলিন্ডার সাইকেলের ক্যারিয়ারে বেঁধে ছুটতেন। কী লাভ হলো- নিজে বেঘোরে প্রাণ দিলেন। যাদের জন্য এতো করলেন তাঁরা কেউ একবারও খোঁজ নিতে আসেননি কিভাবে আজ তাঁদের সংসার চলছে।
আমি চুপচাপ পতি নিন্দা শুনি। খারাপ লাগে, কিন্তু প্রতিবাদও করতে পারিনা। ভদ্রমহিলা তো মিথ্যা কিছু বলছেন না। কথা ঘোরানোর জন্য জিজ্ঞাসা করি, ‘আশরাফুলের কোন ক্লাস হলো?’
ভদ্র মহিলা বলেন, ‘ক্লাস ফাইভ। এই দোকান সামলানোর চক্করে ওর পড়াশুনোর দিকে আমি একেবারে নজর দিতে পারছি না। ওর পিসি ওকে পড়ায়। পিসির বিয়ের কথা চলছে। বিয়ে হয়ে গেলে কী হবে আল্লাই জানেন। ওর পড়াশুনোয় মাথা আছে। ক্লাসে প্রত্যেকবার ফার্স্ট হয়।‘
আশরাফুলের জ্বর আসছে। করোনা হওয়ার সম্ভাবনা যথেষ্ট। আমি এতো ছোটো ছেলেদের সাধারণত দেখিনা। তবে ওর ব্যাপারটা অন্য।
ভদ্রমহিলাকে বললাম, ‘চিন্তার কোনো কারণ নেই। এখন যে জ্বর হচ্ছে দু- তিন দিনেই কমে যাচ্ছে। তবে একটু দুর্বলতা থেকে যেতে পারে। তিন দিনের বেশি জ্বর থাকলে মধ্যমগ্রাম গ্রামীণ হাসপাতালে গিয়ে করোনা পরীক্ষা করবেন।‘
ভদ্রমহিলা উঠে দাঁড়িয়ে আমাকে টাকা দিতে গেলেন। আমি বললাম, ‘ওর চিকিৎসার জন্য আমি টাকা নিতে পারব না। নিলে সেটা ঘোরতর পাপ হবে।‘
ভদ্রমহিলা হঠাত কেঁদে ফেললেন। ফোঁপাতে ফোঁপাতে বললেন, ‘আপনি আশরাফের জন্য দোয়া করবেন ডাক্তারবাবু। ও যেন ওর আব্বার মতো হতে পারে।‘
আমি অবাক হয়ে চেয়ে রইলাম। ডাক্তার- ইঞ্জিনিয়ার নয়, বড় মাইনের চাকুরে নয়, এই মহিলা চান তাঁর সন্তান সেই মানুষটার মতো হয়ে উঠুক যাকে একটু আগে নিজেই অপদার্থ বলেছেন।
বাইরে তখন কোটি কোটি টাকার গল্প চলছে।