রোজ কত কিছু ঘটে যায়, লেখা হয় না। আসলে লেখার ইচ্ছেও হয় না। খুপরি জীবন ভয়ানক একঘেয়ে হয়ে উঠেছে। বিচিত্র কত অসুখ, মানুষের কত অসহায়তা, কত চোখের জল- আর তার বিপরীতে সীমিত ক্ষমতা নিয়ে একা ডাক্তার।
মেডিক্যাল কলেজ থেকে বেরনোর সময়ে নিজের উপর যেটুকু আত্মবিশ্বাস ছিল, সেটা অনেক আগেই তলানিতে চলে গেছে। এখন শুধু দিনগত পাপক্ষয়। অনেক বার ঠেকে শিখে গেছি অধিকাংশ রোগের চিকিৎসা আমার জানা নেই। জানা থাকলেও সেই চিকিৎসা করার ক্ষমতা নেই। ওষুধ দিয়ে সব রোগ সারানো যায় না।
তবু আমি মাথা নিচু করে শুধু ওষুধই লিখে যাচ্ছিলাম একের পর এক রোগীর। এটুকুই আমি পারি। এক অল্প বয়সী বউকে নিয়ে তার স্বামী ঢুকল। বউটিই রুগী। চুপচাপ বসে আছে, কেমন ফ্যালফ্যালে দৃষ্টি। জিজ্ঞাস করলাম, ‘কী সমস্যা?’
মেয়েটি কোনো জবাব দিল না। আদৌ আমার কথা শুনছে কিনা তাও বুঝতে পারলাম না। বললাম, ‘কী হয়েছে বলুন। চুপ করে থাকলে বুঝব কী করে?’
স্বামীটির বয়স ত্রিশ বত্রিশ হবে। নিকোটিনের ছোপ পরা দাঁত বের করে জানালো, ‘এটাই তো ওর সমস্যা। একশোটা কথা বললে একটা কথার উত্তর দেয়। বাড়িতে কোনো কাজ টাজ করে না। চুপচাপ বসে থাকে। রান্না বান্নাও ঠিক ঠাক করে না। মেলামেশার ব্যাপারেও কোনো উৎসাহ নেই। মরার মতো পড়ে থাকে।’
মেয়েটির সম্পর্কে এতো কথা বলা হচ্ছে, কিন্তু তার মুখের অবয়বের কোনো পরিবর্তন নেই। সেই একই ফ্যালফ্যালে দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। চোখের পাতা টেনে দেখলাম, বুকে স্টেথো বসিয়ে দেখলাম- তার মুখের একটা রেখারও কোনো পরিবর্তন হলো না।
বললাম, ‘আমাকে দেখিয়ে কোনো লাভ নেই। ওকে একজন সাইক্রিয়াটিস্ট দেখান। সাইক্রিয়াটিস্ট মানে বোঝেন, মানসিক রোগের ডাক্তার।’
ছেলেটি বলল, ‘আপনি দেখলেই ঠিক হয়ে যাবে। আসলে ওতো আগে এরকম ছিল না। হঠাৎ একটা আঘাত পেয়ে এরকম হয়ে গেছে।’
‘কী আঘাত?’
ছেলেটাকে ইতস্তত করতে দেখেই বুঝতে পারলাম কিছু গণ্ডগোল আছে। বললাম, ‘আঘাতটা আপনিই দিয়েছেন, তাই না?’
ছেলেটি আবার নিকোটিনে ছোপ লাগা দাঁত বের করে হাসল। বলল, ‘আপনি ঠিকই ধরেছেন। তবে সামান্য একটা ব্যাপার নিয়ে ও যে কেন এমন করছে সেটাই বুঝতে পারছি না?’
‘কী সামান্য ব্যাপার? আপনার সাথে অন্য কোনো মেয়ের সম্পর্ক আছে?’
ছেলেটি কুৎসিত হাসল। বলল, ‘অমন সম্পর্ক সব পুরুষ মানুষের দু- চারটে থাকে। বউ না জানলেই কোনো সমস্যা নেই। আসলে আমারই ভুল। হোয়াটসঅ্যাপে ছবিগুলো মোছা হয়নি। তাছাড়া বাইরের মেয়েদের সাথে তো আর মনের সম্পর্ক নেই, মনের সম্পর্ক তো একমাত্র ওর সাথেই। তাছাড়া যে মেয়ের জন্য আমি ফেঁসেছি, সে একেবারে বারোভাতারি। আপনি ওকে একটু বোঝান।’
রাগ চেপে কোনো রকমে বললাম, ‘তুমি ওকে নিয়ে আর জি কর হাসপাতালে মানসিক বিভাগে দেখাও। এক সাথে নিজেও দেখাও।’
ছেলেটি বলল, ‘ওসব কিচ্ছু করতে হবে না। আপনিই ওষুধ পত্র দিন। একটা সাধারণ ঘটনার জন্য এই মেয়ে আমারও মাথা খারাপ করে দেবে। আপনি একটু বুঝিয়ে বলুন। আমি যে তেমন কোনো দোষ করিনি…’
হঠাৎ মাথাটা গরম হয়ে গেল। চিৎকার করে বললাম, ‘আর একটা কথা বললে এক ঘুষিতে তোমার ওই নোংরা দাঁত গুলো ফেলে দেব রাস্কেল। বেরোও এক্ষুনি… এখান থেকে বেরোও।’
ছেলেটি ওর বউয়ের হাত ধরে এক টানে চেয়ার থেকে তুলল। তারপর অপ্রসন্ন মুখে বেরিয়ে গেল। পরের রোগী দেখতে দেখতে ভাবছিলাম, কাজটা কী আমি আদৌ ঠিক করলাম। ছেলেটি যতই জঘন্য কাজ করুক, আমার কি উচিৎ ছিল না মেয়েটির সুস্থতার জন্য চেষ্টা করা। মাথা গরম না করা।
এই রোগিণীও ক্রমাগত ঘ্যান ঘ্যান করে চলেছেন। ঘুম হয়না, খিদে হয়না। শরীরের সব জায়গায় ব্যথা করে। মাথা ঝিম ঝিম করে- ঘোরে। ভদ্রমহিলার বয়স ষাট পঁয়ষট্টি হবে। সব দেখে শুনে ওষুধ লিখতে যাচ্ছি; ভদ্রমহিলা বললেন, ‘ডাক্তারবাবু, এমন কোনো ওষুধ লিখবেন না, যাতে ঘুম পায়।’
‘আপনিই তো এখুনি বললেন আপনার ঘুম হয় না!’
‘হ্যাঁ, একেবারেই হয় না। কিন্তু সে তো টেনশনে। রাত তিনটেয় উঠে রান্না করতে হবে, এই টেনশনে সারা রাত্রি চোখের পাতা এক করতে পারি না। চমকে চমকে উঠি। এই বুঝি দেরী হয়ে গেল।’
‘রাত তিনটেয় উঠে রান্না করেন কেন? আপনাদের কী হোটেলের ব্যবসা?’
‘না না। ছেলের জন্য রান্না করি। ছেলে ভোর ছটায় খেয়েদেয়ে কাজে বেরোয়। একেবারে ভাত খেয়ে যায়। ওর আবার ফ্রিজের খাবার সহ্য হয় না। ভাত, মাছের ঝোল, তরকারি সব ফ্রেশ চাই।’
অবাক হয়ে বললাম, ‘আপনার ছেলের বয়স কতো?’
‘এই তো পঁয়ত্রিশ হলো।’
‘ছেলে বিয়ে করেনি?’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। ওর দুই ছেলেও আছে।’
বললাম, ‘তাহলে আপনি ছেলের জন্য খামোকা রান্না করেন কেন? ওর যদি ফ্রেশ খেতে ইচ্ছে করে সেটার ব্যবস্থা ও নিজেই করবে। দরকার হলে ছেলের বউ রান্না করবে। ওর জন্য আপনি খামোকা নিজের শরীর নষ্ট করছেন কেন? আর কতকাল ছেলেকে আঁচলে বেঁধে রাখবেন?’
ভদ্রমহিলা হাসলেন। বললেন, ‘কে কাকে আঁচলে বেঁধে রাখতে চায়। আপনার কি ধারণা আমি খুব ভালোবেসে রাত তিনটেয় উঠে রান্না করি। রান্না না করে উপায় নেই তাই করি। স্বামী মারা গেছেন, ছয় বছর হলো। তারপর থেকে অবস্থা আরও খারাপ হচ্ছে। সারাদিনের ঐ ঝিগিরির বিনিময়ে আমি থাকা খাওয়া টুকু পাই।’
বললাম, ‘আপনি একবার ছেলেকে আসতে বলুন। তাকে বুঝিয়ে বলি। এভাবে চলতে থাকলে আপনি কোনো দিনও সুস্থ হবেন না।’
ভদ্রমহিলা বললেন, ‘অসম্ভব, ছেলে কিছুতেই আসবে না। আপনি আমায় কম দামের একটা ভিটামিন টনিক লিখে দেন। খেয়ে দেখি।’
ভদ্রমহিলা চলে যাওয়ার পর মনটা আরো খিঁচরে গেল। আর রোগী দেখতে ভালো লাগছে না। দেখেই বা কী করব। যে রোগীদের চিকিৎসা করার ক্ষমতা আমার নেই, তাঁদের দেখে কী হবে?
কিন্তু চাইলেই তো আর খুপরি থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে না। অনেকে রোগী বহুক্ষণ বসে অপেক্ষা করছেন। এখন যদি বলি, ‘আমি আপনাদের সুস্থ করতে পারব না, তাই আপনাদের আর দেখব না…’ কেউ আমাকে ছেড়ে কথা বলবেন না। দ্রুত রোগী দেখছিলাম। বেশি কথা বলছিলাম না। কী দরকার- আবার যদি রোগের নানা রকম অপরিবর্তনীয় কারণ বেরিয়ে পড়ে।
একজন ষাটোর্ধ ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলা খুপরিতে ঢুকলেন। দুজনের শরীরেই নানা জায়গায় ক্ষতচিহ্ন- কালশিটে। ‘কী হয়েছে’ জিজ্ঞাস করতে বললেন, ‘পড়ে গেছেন’।
আমি বললাম, ‘আমাকে দেখে কী একেবারেই উজবুক মনে হচ্ছে। পড়ে গিয়ে এরকম ভাবে শরীরের নানা জায়গায় ক্ষত হতে পারে? তাও আবার একসাথে দুজনেরই। একজন ডাক্তার ফিজিক্যাল অ্যাসলট আর ফল ইনজুরির মধ্যে পার্থক্য করতে পারবে না? কে আপনাদের মেরেছে বলুন।’
ভদ্রমহিলা ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন। বললেন, ‘সে বড় লজ্জার কথা বাবা। আমাদের একমাত্র ছেলে আমাদের দুজনকে মেরেছে। শুধু আজ না- রোজই মারে।’
আমি বললাম, ‘রোজ মারে- আর আপনারা মুখ বুজে মার খান?’
‘কী করব বাবা? নিজের ছেলেকে পুলিশে ধরিয়ে দেব? আগে ও এমন ছিল না। দিব্যি চাকরি করত। আমরা ওর বিয়ের জন্য মেয়ে দেখছিলাম। কোত্থেকে কী যে হয়ে গেল। মদের নেশা শুরু করল। সাথে একটা সাদা গুড়োর নেশা। অফিসেও যেতো না। সারাদিন দরজা বন্ধ করে চুপচাপ শুয়ে থাকতো। কদিন বাদেই চাকরি চলে গেল। তখন আমাদের কাছে টাকা চাইত। না দিলেই মারত। ইদানীং শুরু করেছে বাড়ি বিক্রি করে সেই টাকা ওকে দিয়ে দিতে হবে। আমরা যে কী করব বুঝতে পারছি না। নিজের ছেলেকে এভাবে চোখের সামনে শেষ হয়ে যেতে দেখার থেকে মরে যাওয়াই ভালো ছিল।’
বললাম, ‘ইমিডিয়েট পুলিশে কমপ্লেন করুন। পুলিশ তুলে নিয়ে যাক। লকআপে অন্তত ড্রাগস পাবে না। এখুনি থানায় গিয়ে একটা এফআইআর করুন, তারপর সরকারি হাসপাতালে গিয়ে ইনজুরি রিপোর্ট করুন।’
ভদ্রমহিলা বললেন, ‘আজকে মারধোরের পরে ও দুজনের পা ধরে ক্ষমা চেয়েছে। বলেছে ভালো হয়ে যাবে- আর ওসব ছাই পাঁশের নেশা করবে না। আপনি আমাদের ওষুধ পত্র দিন- ডান হাতের কবজিটাতো নাড়াতেই পারছি না।’
আশায় মরে চাষা। আশায় মরে খুপরিজীবী চিকিৎসকও। মাথা নিচু করে ওষুধ লিখি। লিখে যাই…
অনেক দিন পর লেখা পেলাম ও পড়লাম। ভালো লাগলো। আজই সকালে ভাবছিলাম আপনার ঐ ঠাকুর মা রোগীর কথা যে আপনাকে গোপাল বলতো। কথা গুলো কানে বাজে। লেখা আরও কিছু থাকলে পাঠাবেন। এই নম্বরে 6297926930.। খুব মিস করি আপনার লেখা। আশিস। নবদ্বীপ।