দুপুরে খুপরিতে ঝিমাতে ঝিমাতে দিনগত পাপক্ষয় করছিলাম। শীতকাল চলছে। তাও রোগী দেখতে দেখতে ঘাম হচ্ছে। বাইরে পার্থর সাথে কারো ঝগড়া চলছে। যিনি ঝগড়া করছেন, তাঁর বক্তব্য, তাঁর ভয়ানক এমারজেন্সি, আগে ছেড়ে দিতে হবে। পার্থর বক্তব্য, মোটেও এমারজেন্সি নয়। এমারজেন্সি রোগীরা কোনোভাবেই এমন গলা ছেড়ে ঝগড়া করতে পারে না। ওনার যদি এমারজেন্সি হয়, তাহলে এখানকার সব রোগীরই এমারজেন্সি।
ভদ্রলোক ছাড়বার পাত্র নন। তিনি বললেন, ‘আমার বুকের মধ্যে কেমন ধুকপুক করছে। আমার বড়ো শালাবাবুর এমন ধুকপুক করেছিল। তারপর সে রাতেই বেচারা হার্ট এটাক করে মরে গেল।’
পার্থ বলল, ‘রাত নামার এখনও অনেক বাকি। রাত অবধি সময় আছে যখন চুপচাপ বসে থাকুন।’
ভদ্রলোক আরও খেপে চিৎকার শুরু করলেন। আমার রোগী দেখা মাথায় উঠল। তার থেকে পার্থ ভদ্রলোককে ছেড়ে দিলেই ভালো করতো। অনেক শান্তিতে রোগী দেখা যেত। এই মাছের বাজারের মধ্যে ডাক্তারি করতে ইচ্ছে করে? কী আর করা যাবে, যার যেখানে রোগী দেখার ভাগ্য।
একটা ঝামেলা থামতে না থামতেই আরেকটা ঝামেলা শুরু হয়েছে। আরেকজন তাঁর স্ত্রীকে দেখাবেনই। নাম লেখা নেই। পার্থ বলছে, ’আজ আর নাম ছাড়া আর হবে না। কাল সকালে আসুন।’
ভদ্রলোক নাছোড়বান্দা। আজ দেখে দিতেই হবে। খুব ঠাণ্ডা লেগেছে।
হই হট্টগোল শুনে গৌর পাশের ঘর থেকে চলে এসেছে। ও ঠাণ্ডা মাথার মানুষ। সহজে কারো সাথে ঝামেলা করে না। গৌর বলল, ‘দেখুন, আজ যা রোগী রয়েছে, এই দেখতে দেখতেই অনেক সময় লেগে যাবে। তাছাড়া ডাক্তারবাবুও মানুষ। সেই ভোর থেকে রোগী দেখে চলেছেন। ওনারও তো ক্লান্তি বোধ আছে। ওনারও তো পাঁচ মিনিট বিশ্রামের দরকার আছে।’
যাক কেউ আমাকে অন্তত মানুষ বলে ভাবে। গৌরের কথায় চোখে জল আসবে আসবে করছিল, কিন্তু ভদ্রলোক ছাড়ার পাত্র নন।
তিনি বললেন, ‘আজ একটু দেখে দিতেই হবে। আজ স্ত্রীয়ের জন্মদিন। ছেলেমেয়েরা বড় হয়েছে। খুব সখ করে এবছর মায়ের জন্মদিন পালন করছে। আত্মীয় স্বজনদের নিয়ে একটা ছোট্ট এরেঞ্জমেন্ট করা হয়েছে। রাত্রে অনেকে আসবে। তাদের সামনে নাক দিয়ে জল পড়লে আর বিচ্ছিরি কাশলে ভালো দেখাবে?’
আমি গৌরকে ডেকে বললাম, ‘চুপচাপ বসে থাকতে বলো। যদি ধৈর্য ধরে বসে থাকেন, তাহলে দেখে দেব। যা হট্টগোল শুরু করেছেন, তাতে এমনিই রোগী দেখতে পারছি না।’
কিন্তু শান্তিতে রোগী দেখা আমার ভাগ্যে নেই। একটু পরেই দরজার ওপার থেকে একজনের চিৎকার, ‘কী ব্যাপার দাদা। আপনি ওনাকে আগে ঢোকাচ্ছেন কেন? আমি তো আগে ছিলাম।’
একজন মধ্যবয়স্ক মানুষ খোঁড়াতে খোঁড়াতে ঘরে ঢুকছেন। পেছনে অন্যের প্রতিবাদ শুনে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন। গৌর শান্তভাবেই প্রতিবাদী লোকটিকে বলল, ‘একবার ওনার পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখুন, তাহলেই বুঝতে পারবেন কেন ওনাকে আগে যেতে বললাম।‘
একনজর দেখেই বোঝা যাচ্ছে, লোকটির একটি পা কৃত্রিম। প্রতিবাদী ভদ্রলোক বললেন, ‘ঠিক আছে দাদা, আমি বুঝতে পারিনি। উনিই আগে দেখিয়ে নিন।’
মধ্যবয়স্ক মানুষটিও দাঁড়িয়ে পড়েছেন। তিনি বললেন, ‘না না, আমি আগে দেখাবো কেন। এই নকল পায়ের জন্য আমার কোনো সমস্যা নেই। অকারণে লাইন ভাঙব কেন? আপনি আগে আসুন।’
‘না না দাদা, আপনি আগে দেখিয়ে নিন।’
‘থাক থাক, আমায় করুণা করার দরকার নেই। আপনি আগে ছিলেন। আপনিই আগে দেখান।’
এতো আরেক সমস্যা। নাক গলাতেই হল। বললাম, ‘ঢুকে যখন পড়েছেন, তখন দেখিয়েই নিন। সময় নষ্ট করে লাভ নেই।’
মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক বললেন, ‘আসলে ডাক্তারবাবু, কেউ করুণা করলে বড্ড গায়ে লাগে। আমি ট্রেনে হকারি করি। বারো বছর আগে, চলন্ত ট্রেনে উঠতে গিয়ে পা হারিয়েছি। দেড় বছর প্রায় বিছানায় পড়ে ছিলাম। তখন কেউ পাশে দাঁড়ায়নি। কেউ খবরও নেয়নি। বাড়িতে অসুস্থ মা ছিলেন, প্রায় বিনা চিকিৎসায় মারা গেছেন। বউ অন্যের সাথে পালিয়ে বেঁচেছে। এই কৃত্রিম পা নিয়ে আমি আস্তে আস্তে হাঁটা শিখেছি, দৌড়ানো শিখেছি, লাফিয়ে চলন্ত ট্রেন ধরা শিখেছি। আবার হকারিই করছি। এখন লোকের আদেখলে করুণা দেখলে গা জ্বালা করে।’
আমি হাসি মুখে বললাম, ‘আপনার করুণার দরকার নেই ঠিক কথা। কিন্তু আমাকে করুণা করেন। চুপচাপ বসে দেখিয়ে নিন। এমনিতেই অনেক সময় নষ্ট হয়েছে।’
খানিকক্ষণ বাদেই দেখি সেই জন্মদিনের মহিলা আর আর তাঁর স্বামী ঢুকছেন। গৌরকে নিশ্চয়ই মিষ্টি কথায় ম্যানেজ করেছেন। ভদ্রমহিলার নাম লিখলাম। বললাম, ‘বয়সটা এবার বলুন।’
ভদ্রমহিলা লাজুক ভাবে হেসে বললেন, ‘জন্মদিনটা তো জেনেই গেলেন। বয়সটা না জানলে চলবে না ডাক্তারবাবু?’
উফ… আর পারা যাচ্ছে না। কখন যে এই খুপরি থেকে মুক্তি পাব।