সাদা খোলে সবুজ লতা শাড়ি। জবজবে তেলে চুবোনো চুল টেনে বাঁধা খোঁপা। কানে ছোট মাকড়ি। পেশেন্টনি ঢুকেই একগাল পান সুপুরি হাসি দিলেন। দু এক ছিটে পিক ছিটিয়েই বললেন –হেই গো ডাক্তারদিদি ঝন্টু আমায় পাঠাইলেক, বললেক উ দিদির কাছে যাও, আমার নাম বললেই হবেক।
রোজ রোজ কত রুগী আসে যায়। সেই মুহূর্তে ঝন্টু নামে কাউকে মনে করতে পারলাম না।
একটু চুপ করে থেকে বললাম-আচ্ছা, আপনার কি সমস্যা?
আরো প্রশস্ত পানসুপুরি হাসি–আমি ঝন্টুর মা গো, আমায় কি আর কিছু বইলতে হবেক!
আপনার কষ্টটা কি, রোগজ্বালা কোথায়?
গালে হাত দিয়ে চোখ মাথায় তুলে হাহাকার করে উঠলেন –হা ভগবান। আমি ঝন্টুর মা গো –ঝন্টুকে চিনতে লারছ? ঝন্টু বলল, আর কিচ্ছুটি বলতে হবে না শুধু দিদিকে আমার নাম বললেই হবে।
আলমারী দেরাজ কোণা ঘুপচি খুঁজেও মনে করতে পারছি না ঝন্টুকে, তার চেয়েও সমস্যা পেশেন্টনিকে দেখে চামড়ার রোগ কিছু খুঁজে পাচ্ছি না আর উনি যেহেতু ঝন্টুর মা তাই প্রতিজ্ঞেবদ্ধ আমাকে আর কিছু বলবেন না। ঝন্টু তো আমাকে বড় দায়ে ফেলল। কবজি ধরে দেখি জ্বর বালাই কিছু নেই। যত বার জিজ্ঞাসা করি– কি হয়েছে? সেই এক উত্তর –আমি তো ঝন্টুর মা গো।
ধুত্তোরি ছাই!
এবার একটু উঁচু তারে গলা উঠিয়ে বলি– বলি হয়েছেটা কি?
তিনি ততধিক উঁচু তারে হেসে বলেন– সেই জানতেই তো আসা–হয়েছেটা কি?
বলি–আপনার হাতে পায়ে মাথায় পেটে কোথায় কি সমস্যা?
সেই জানতেই তো আসা মা গো, আমি ঝন্টুর মা। ঝন্টু আমায় বলল কিচ্ছুটি বলতে হবে না, দিদি দেখেই রোগ ধরে ফেলবে। আমাকে দেখেই বলে দিলেন বেটনোভেট মলম মাখো তাই মুখের এ দশা। আমি মেখেছি ঘরে দিদি জানলে কেমনে!
ও হরি! এই কথা! স্টেরয়েড মলম লাগালে মুখের এমন একখান বেয়াড়া চেহারা হয় যে সদ্যপাশ করা ডাক্তারও বোঝে। আমারতো প্রায় চল্লিশ বছর ডাক্তারি হতে চলল। আসল রোগের চাইতে এই ‘ম্যানমেড’ রোগের বড় ভীড় আমাদের কাছে। কিন্তু ঝন্টুকে যে আমার এখনো মনে পড়ল না। ঝন্টুকে মনে না পড়লে যে তার মা কিছুতেই আমাকে বলবেন না তাঁর কি হয়েছে। কি যে করি?
একটা কিছু ক্লু বের করার জন্য জিজ্ঞেস করি– তা ঝন্টু ভালো আছে তো এখন?
হ্যাঁ, ভালো মানে খুব ভালো। সেই জন্যেই তো আমাকে বললে —
ওরে বাবা! আবার সেই রিপিট টেলিকাস্ট শুরু হবে। ঝন্টু ছেলে না মেয়ে সেটাও যে মনে করতে পারছি না, নামটাও বাইজেন্ডার ফ্রেন্ডলি -ছেলে মেয়ে উভয়েরই চলিতে পারে।
ক্লু হাতড়াতে বলি– তা ঝন্টু কাজ কম্ম পড়াশুনো এখন করছে তো ঠিকমতো?
পানসুপুরি হাসি–হ্যাঁ গো। ওর কাজকম্মের জোরেই তো বেঁচেবত্তে আছি। দশ কেলাসের পর আর পড়াতে পারিনি সে তো জানো। তুমার সঙ্গে তো সব কথা হয়েছে। তুমি যে ছানকিন দিয়েছিলে তাই মেখে এখন দিব্যি কাজ করছে। প্লাস্টিকের থলে থেকে পাতা সুদ্ধ একটা এঁচোড় বার করে বললেন– এই যে ঝন্টু একটা কাঁঠাল পাঠিইছে তুমার লেগে।
ইউরেকা ইউরেকা! পেয়ে গেছি ক্লু। এবার কিন্তু আমি আপারহ্যান্ড নেব পানসুপুরি দিদি।
দাঁত বার করে বলি– আরে ঝন্টু তো আপনার খুব বাহাদুর মেয়ে। তাই বলুন -আপনি হলেন গিয়ে ঝন্টুর মা। তা আপনার তো সেই গেঁটে বাত -পা কমজোরি, কেমন আছেন এখন ? আপনার কষ্ট কি আর বলতে হবে না, ঝন্টু আমাকে সব বলেছে–পায়ে খুব হাজা। এই বাতে পায়ের আঙুল বাঁকা বলে ফাঁকে জল জমে থাকে– হাজা একটু বেশি হয়। ও ঠিক হয়ে যাবে ওষুধ দিয়ে দেব ভাববেন না। একটু দেখান পা টা —
ঝন্টুর মাকে শনাক্ত করতে পেরে আমি তখন একটু বেশি প্রগলভ। তিনি এখন মুখ টিপে হেসে মাথা বাঁ দিকে হেলিয়ে পা নাচাতে নাচাতে আমার প্রগলভতা উপভোগ করছেন, কারণ তিনি যে সত্যিই ঝন্টুর মা তা এতক্ষণে আমাকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন।
কিছুদিন আগে এসেছিল সেই রোগা কালো লম্বা মেয়েটি। রঙচটা চুড়িদার পরা। লম্বা বিনুনী। চোখে একটা অভাবী খেটেখাওয়া দেমাকের টুনি বাল্ব। দেখে কলেজ পড়ুয়া মনে হতেই পারে। বাবা মারা গেছে চার বছর। দাদা বিয়ে করে চলে গেছে। মা রুগ্ন– কাজ করতে পারে না। বাবার জমিতে সারাবছর ধরে একা হাতে তিন ফসলি চাষ চালায় মেয়ে। চাষের সব কাজ একা হাতে করে। বিয়ে করবে না প্রতিজ্ঞা করেছে। শীতের সবজির পর এখন চিনাবাদাম লাগিয়েছে। বন্ধুর কথায় ফর্সা হবার লোভে একটু ভুল করে ফেলেছিল–খুব বকেছি। আরে তুই হচ্ছিস গিয়ে দুনিয়াদারির রাণি– ঘাম ঝরিয়ে নিজের ভাত নিজে যোগাড় করিস। ভুঁই ফুঁড়ে যখন প্রথম বীজপত্র উঁকি মারে তখন কেমন আনন্দ হয় বল দেখি? তোকে আমি একটা সেরা লড়াকুর মেডেল দিলাম মনে মনে। ওসব নেকুপুষুদের ফর্সা হবার ভুয়ো ক্রীম তোর জন্য নয়, মাখবি না কক্ষনো। রোদে তোর চামড়াটা বড্ড পুড়ে গেছে –এই নে একটা সানস্ক্রীন। আরো কিছু দরকারি ওষুধ ফিসিশিয়ান স্যাম্পল থেকে বেছে দিলাম।
তা সেই ছানকিন মেখে মেয়ে ভালো আছে বলে মায়ের আসা। একটু গল্পগুজবের সৌজন্যে মেয়ের মনে হতে পারেই যে ডাক্তারদিদি তার নাম বললেই চিনতে পারবেন। প্রথমে মনে করতে যে পারিনি সে আমারই অপূর্ণতা, আমারই অক্ষমতা। আর এমন বাহাদুর মেহনতি মেয়ের মা যিনি, তিনি পি ভি সিন্ধু বা সাইনির মায়ের মতো “আমি তো ঝন্টুর মা” বলে কলার আপ করতেই পারেন।
এবার ঝন্টুর ভালোবাসার এঁচোড় নিয়ে কি করব? সব ভালোবাসারই তো সন্তান সন্ততি হয় –এঁচোড়েরও হবে। ক্রমশঃ প্রকাশ্য —