পরের দিন রবিবার। দেরি করে ঘুম ভাঙলে ক্ষতি নেই। সেইজন্যই দেরি করেই ঘুম ভাঙল বোধহয়। শেষ কয়েক মুহূর্তের আধোঘুম আধোজাগার মধ্যে সেদিনের আনন্দবোধটা আমার চিরদিন মনে থাকবে। আবার চোখ খুলে দেখব, বালিশে আমার পাশে শুয়ে রয়েছে মেরি লু।
চোখ খুলে পাশে তাকালাম। কেউ নেই। বালিশ খালি।
ধড়ফড় করে উঠে বসলাম। কোথায় গেল? বাথরুমে?
উঠে বাথরুমের দরজা খুললাম। “আর ইউ ইন হিয়ার?”
বাথরুম খালি।
শোবার ঘরের বাইরেই বসার ঘর। কেউ নেই। বসার ঘরের ওদিকে খাবার ঘর, তারও ওপারে রান্নাঘর — সব খালি। আবার ফিরলাম শোবার ঘরে। কাল রাতে মেরি লু পোশাক খুলে ভাঁজ করে রেখেছিল ওখানে — সাইডবোর্ডের ওপর।
নেই। পোশাক নেই, জুতো নেই, ব্যাগ নেই। কিচ্ছু নেই।
না। আছে। খাটে শুয়ে দু-হাত থেকে ছটা আঙটি, দুটো কানের দুল, নাকের মাকড়ি আর গলার হার খুলে রেখেছিল বেডসাইড টেবিলে। সবই রয়েছে ওখানেই। একটাও গয়না নিয়ে যায়নি। এর মানে কী?
কখন গেল? রোদ উঠেছে সবে। এখানকার হিসেবে খুব দেরি হয়নি। বাইরে আমার গাড়ি এখনও রয়েছে। নিয়ে যায়নি। তাহলে, হেঁটে গেল, না ট্যাক্সি সার্ভিস ডাকল? কেনই বা ডাকবে? আমিই তো পৌঁছে দিয়ে আসতাম। না কি শেষ মুহূর্তে এখানেই থেকে যাওয়ার কথায় ভয় পেয়েছে আবার? কেন? আমি তো খারাপ করে কিছু বলিনি…
গাড়ি নিয়ে বেরোলাম। যদি ট্যাক্সি নিয়ে গিয়ে থাকে তাহলে ধরতে পারব না। কিন্তু শহর অবধি হাঁটা অনেকটাই। পেলে বাকি রাস্তাটা পৌঁছে দেব।
ভোরের শিশির শুকোয়নি এখনও। দ্রুত গাড়ি চালালাম। যে রাস্তাটা শহর অবধি পাঁচ সাত মিনিটে পার করলাম, সেটাই হেঁটে যেতে অন্তত দেড় দু-ঘণ্টা লাগবে। অত আগে কি বেরিয়েছে মেরি লু? না বোধহয়।
রাস্তায় মেরি লু নেই। আস্তে আস্তে ফিরে এলাম গাড়ি নিয়ে। দু-গাল বেয়ে চোখের জল পড়ছে। জামার হাতায় মুছতে মুছতে চালাচ্ছি। কেন? কেন ঘুমিয়ে পড়লাম? কেন ঘুম ভাঙল না? কেন ডাকল না মেরি লু? কেন? কেন? কেন?
কত কেন… কোনও জবাব নেই।
বাড়ি ফিরে আবার শোবার ঘরে ঢুকলাম। কয়েকটা গয়না আমার স্মৃতির ভাণ্ডার উস্কে দেবার জন্য রয়ে গেল এবার। কিছুক্ষণ রুপোলি গয়নাগুলোর দিকে চেয়ে রইলাম। তারপরে তুলে নিয়ে ওই কার্ডবোর্ড কার্টনটার মধ্যেই রেখে দিলাম। প্রথমবারের জামাকাপড়, লিপস্টিক, দ্বিতীয়বারের ব্রা-প্যান্টির সঙ্গে। এ বাড়িতে ক্লোজেট স্পেস কম। তাই কার্টনটা গ্যারেজে রেখেছি।
ঘরে গিয়ে থুম হয়ে বসার ঘরে বসে রইলাম। কী যেন একটা করার ছিল, মনে পড়ছে না। রবিবার — তার মানে খুব জরুরি কাজ নয়। বাড়িরই কিছু হয়ত করব ভেবেছিলাম — কিছু সারাব, কিছু পরিষ্কার করব… যাকগে যাক, পরে দেখা যাবে।
প্রায় দুপুরবেলা যখন সেলফোনটা বেজে উঠল, বাবানের নাম দেখে বুকটা ধড়াস করে উঠল। মনে পড়ল কী ভুলে গেছিলাম।
“কী রে? কী করছিস? আমরা প্রায় পৌঁছে গেছি।”
বাবানরা আজ পৌঁছচ্ছে। ইউ-হল ট্রেলার নিজের বাড়ির সামনে খুলে রেখে আসবে। আমার লাঞ্চ রান্না করার কথা। সরঞ্জাম কাল কিনে এনেছি। ওটাই ভুলে গেছিলাম।
“চলে আয়।”
“ক্লান্ত শোনাচ্ছে কেন? রান্না করছিস অনেক?”
“আরে না, না। অনেক কেন রাঁধব? তোরা কত খাস তো জানি। চলে আয়, দেখবি।”
“ঘণ্টাখানেক লাগবে।”
ভেবেছিলাম তাক লাগানো রান্না করব। তা আর হবে না। পাতি চিকেন রোস্ট আর স্যালাড বানিয়ে দেব। স্যালাড গরম হতে হবে না, রোস্ট-টা একটু পরেই নাহয় বানাব।
ঠিক করেছিলাম ওদের কিছু বলব না, কিন্তু বাড়িতে ঢুকেই বাবান বলল, “কী হয়েছে?”
দু-চারবার ‘কিছু না’ বলার চেষ্টা করে বুঝলাম বাবান অত সহজে ছাড়বে না। বলল, “তোকে আমি এইটুকু বয়েস থেকে জানি। তুই ফোন ধরামাত্র বুঝেছি কিছু হয়েছে। কী হয়েছে বলবি, না ধরে ক্যালাব?”
বাধ্য হয়ে গতরাতের কথা বলতে হল।
দু-জনেই বজ্রাহতের মতো তাকিয়ে রইল আমার দিকে।
“কি বলছিস তুই, গুপি? মেরি লু? এখানে?”
আমি নিঃশব্দে ওপর নিচে মাথা নাড়লাম।
“তোর সঙ্গে রাতে ছিল? এখানে?”
ঘাড় হেলালাম।
“আর সকাল হতে না হতে চলে গেছে — আগের বারের মতো?”
এবার কিছু করলাম না, বললামও না। চেয়ে রইলাম মেঝের দিকে।
টুকু হঠাৎ বলল, “প্রথমবারও রাতেই গেছিল, না?”
এ কথা হঠাৎ কেন? বললাম, “হ্যাঁ। রাতে ঝগড়া হয়েছিল…”
বাবান বলল, “আগেরবারও ঝগড়া হয়েছিল।”
আমি বললাম, “আগের বার খুব ঝগড়া হয়েছিল। আমাকে মেরেছিল, মনে নেই বোতল দিয়ে…”
বাবান বলল, “ও, ইয়েস। অনেক দিনের কথা — ভুলে গেছিলাম। আর কাল?”
“কী কাল?”
“কাল কী হয়েছিল? ঝগড়া? মারামারি? কী নিয়ে?”
আমি জোর দিয়ে বললাম, “কিচ্ছু হয়নি। নাথিং। ইন ফ্যাক্ট খুব ভালো কেটেছিল। আমি কেয়ারফুলি কোনও বাজে কথা বলিনি, কোনও দোষারোপ করিনি, কোনও অ্যাকিউজেশন… কিচ্ছু না। বরং উই হ্যাড ওয়ান্ডার্ফুল… এনিওয়ে… শি ওয়াজ ভেরি হ্যাপি।”
“অথচ সকালে উঠে দেখলি নেই… চলে গেছে…”
আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে বললাম, “হ্যাঁ।”
রোস্টটা ওভেন থেকে বের করে টেবিলে সাজাতে সাজাতে শুনলাম, টুকু বলছে, “দু’বার মেরি লু এল, দু’বার গুপি যখন ঘুমোচ্ছে তখন বেরিয়ে গেল, ও কিছু জানতে পারল না — আর বাড়িতে মেরি লু আসার কোনও চিহ্নই নেই…”
“কি বলতে চাইছ, গুপি বাজে বকছে?”
“মেরি লু স্যাক্রামেন্টো থেকে সু সিটিতে এসেছে? কেন? গুপির পেছনে পেছনে?”
এবারে বাবান কিছু বলল না। টুকু আবার বলল, “দু’বারের একবারও কিন্তু ওর কাছে কোনও প্রমাণ নেই যে মেরি লু এসেছিল।”
বাবান বলল, “কী প্রমাণ থাকতে পারে?”
“কেন? মোবাইলে ছবি তুলে রাখতে পারত…”
“তা অবশ্য।”
মোবাইলে ছবি নেই যদিও, কিন্তু এক রাশ গয়না রয়েছে। আর আগেরবারের ব্রা আর প্যান্টি। কিন্তু সে আমি ওদের দেখাব না। বলবও না। ওরা আমার কথা বিশ্বাস করছে না।
পরের ঘটনাটা তিন দিন পর সন্ধেবেলা — বাড়িতেই ছিলাম। কিছু করার ছিল না। সারা দিন কাজ করে অফিস-ফেরতা বাবানের বাড়ি গিয়ে রান্নাঘরে তাক লাগাতে সাহায্য করেছি ঘণ্টা দুয়েক। টুকু যা খাইয়েছিল, তাতেই রাতের মতো পেট ভরা। প্রথম দিনই সন্ধেবেলা একটা হুইস্কির বোতল নিয়ে এসেছিলাম। তা-ই বসে বসে খাচ্ছিলাম, এমন সময়ে বাইরের দরজায় কে নক্ করল।
আমি উঠে দরজার দিকে যাব, এমন সময় দরজা ধাক্কা বাড়ল। সেই সঙ্গে একটা পুরুষ কণ্ঠ শুনলাম — দরজা খুলুন, পুলিশ।
পুলিশ? কেন? আমি পায়ে চটি গলাতে গলাতে জোরে বললাম, “জাস্ট আ মোমেন্ট্, আসছি।”
দরজায় গিয়ে ডোর ভিউয়ার দিয়ে দেখলাম, বাইরে চারজন। দুজন পুরুষ পুলিশ, একজন মহিলা। আর একটা মেয়ে মনে হল সিভিলিয়ান পোশাকে। কী রে বাবা। এইটুকু দেরিতেই আবার দরজায় ধাক্কা শুরু হয়ে গেছে, আমি তার মধ্যেই দরজা খুলে দিলাম।
যে ধাক্কা দিচ্ছিল, সে সবে “ওপেন আপ…” বলেছে। দরজা খোলায় আধ-পা পিছিয়ে গেল। বলল, “আপনি কি…?”
ঠিক। আমিই বটে। বলল, “আপনার সঙ্গে কথা ছিল। আমরা ভেতরে আসতে পারি?”
দরজা ছেড়ে সরে বললাম, “আসুন।” একে একে চারজন ঢুকল বসার ঘরে। বললাম, “বসুন। কী করতে পারি আপনাদের জন্য?”
বসল না। বলল, “গতকাল রাতে আপনি কী করছিলেন, জানতে পারি?”
বললাম। বার্-এ বসে ড্রিঙ্ক করছিলাম। তার পরে ফিরে এসে ঘুমিয়েছি। কেন? এটা কি ডি-ইউ-আই — বা ড্রাইভিং আন্ডার দি ইনফ্লুয়েন্স নিয়ে কিছু?
অফিসার উত্তর দিল না। বলল, “আপনি কি একাই ফিরেছিলেন?”
“না। বার্-এ আমার এক পুরোনো বান্ধবীর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। সে আমার সঙ্গে ফিরেছিল।”
পুলিশের সঙ্গে যে সিভিলিয়ান পোশাকের মেয়েটি ছিল, সে ছটফটিয়ে উঠে বলল, “কক্খনও না। ও-ই আমার বন্ধুর সঙ্গে বেরিয়েছিল। ওর বন্ধু না…” পুলিশ মহিলা ওর কাঁধে আলতো করে চাপ দেওয়ায় থেমে গেল। আমার খেয়াল হল, আরে! এই তো সেই মেয়েটা যার সঙ্গে মেরি লু বার্-এ এসেছিল। আমি জিজ্ঞেস করতে যাব, মেরি লু কোথায় জানে কি না, কিন্তু মেয়েটার পরের কথায় থমকে গেলাম।
“সুসান ওর সঙ্গে বেরিয়েছিল। তারপরে আর বাড়ি ফেরেনি।”
সুসান কে? মেরি লু? কী বলছে মেয়েটা?
পুলিশ নোটবুকে কী লিখল। বলল, “তিনি এখন কোথায়? সেই বান্ধবী?”
আমি মাথা নেড়ে বললাম, “তিনি নেই। আজ ভোরে, বা সকালে, চলে গেছে।”
“চলে গেছেন? কোথায় গেছেন?”
“জানি না। আমি ঘুমোচ্ছিলাম। সকালে উঠে দেখি নেই।”
“কী ভাবে গেলেন?”
“জানি না। হেঁটে… ট্যাক্সি ডেকে…”
মেয়েটা আবার জোর দিয়ে বলল, “তোমরা ওকে ঠিক করে জেরা করো। ও ঠিক বলছে না।”
আমি মেয়েটাকে বললাম, “আমি ঠিকই বলছি। আপনার সঙ্গে যিনি ছিলেন, তিনি আমার পূর্বপরিচিত। কিন্তু ওর নাম সুসান নয়। মেরি লু।”
সকলে মুখ তাকাতাকি করল। মহিলা পুলিশ মেয়েটার কাছ থেকে মোবাইল ফোন নিয়ে বলল, “দেখুন তো, একে চিনতে পারেন কি না?”
আবছা মিল আছে মেরি লু-র মুখের সঙ্গে? মেয়েটা বলল, “এরকম দেখতে লাগত না। মেক আপ নিয়ে বেরোই আমরা সন্ধেবেলা।” তা-ই তো। সেইজন্যই এই মেয়েটাকেও চিনতে সময় লেগেছে। মেক আপের জন্যই আলাদা দেখাচ্ছিল সেই রাতে।
বললাম, “দেখুন, একটা আপাত মিল আছে দুজনের। তবে মেরি লু-কে আমি বহু বছর চিনি। এ সে মেয়ে নয়।”
মেয়েটা বলল, “মিথ্যে! আপনি তো বললেন, আমার বন্ধু আপনার সঙ্গে বার থেকে বেরিয়েছে।”
মেয়ে পুলিশটা ওর হাতটা ধরে রেখেছে। বললাম, “আমি বার থেকে বেরিয়েছিলাম আমার বন্ধু মেরি লু-র সঙ্গে। আমি সেক্স ওয়ার্কারের সঙ্গে কিছু করি না।”
পুলিশ আর বিশেষ কিছু জানতে চাইল না। একবার ঘরগুলো উঁকি দিয়ে দেখল আর কেউ নেই, তারপর আমার ফোন নম্বর নিয়ে চলে গেল। যাবার আগে বলল আমি যে মহিলাকে মেরি লু বলে জানি, বা এই মেয়েটির বন্ধু সুসান — দুজনের কারও সম্বন্ধেই যদি কিছু জানতে পারি, যেন পুলিশকে জানাই। সঙ্গের মেয়েটা অবশ্য চিৎকার করছিল — ওরা আমাকে যেন গ্রেফতার করে — আমিই নিশ্চয়ই কিছু করেছি…
পরদিন ঘটনাটা শুনে বাবান রেগে গেল। বলল, “তোর এই মেরি লু অবসেশনটা ছাড়বি এবার? ফালতু ঝামেলা শুরু হল।”
আমি রাগের কারণ বুঝলাম না। অন্যায় তো কিছু করিনি। পুরোনো বন্ধু। এক সময়ে লিভ টুগেদার করতাম। মানছি দশ বছর আগে সন্দেহ করতাম বলে চলে গেছিল। কিন্তু এখন আবার দেখা হলে আবার বন্ধুত্ব হতে পারে না? আগের মতো আবার আমরা একসঙ্গে থাকতে পারি না? এতদিন তবে একা রইলাম কেন?
বাবান উত্তর দিতে পারল না।
পুলিশে ছুঁলে আঠেরো ঘা। আবার ক-দিন পরে বাড়ির দরজায় হাজির। সবে কাজ থেকে ফিরে জামাকাপড় বদলে রান্না চাপিয়েছি। এবারে জানতে চাইল মেরি লু-র বিষয়ে। কতদিন হল চিনি ওকে? কোথায় চিনতাম? কী সম্পর্ক ছিল? ওর কোনও ছবি আছে কি?
আছে। কম্পিউটারে। দেখালাম। পুলিশ জানতে চাইল, হারিয়ে যাওয়া সুসান আর এই মেরি লু-র মধ্যে মিল তো প্রায় নেই। তাহলে? আমি বললাম, “সেই জন্যেই তো বলছি — আমি জানি আমি মেরি লু-র সঙ্গে বার থেকে বেরিয়েছি, বাড়ি এসেছি, রাতে একসঙ্গে ছিলাম।”
পুলিশ একটু কিন্তু কিন্তু করে বলল, “এটা বলছেন প্রায় এগারো বছর আগেকার ছবি। অর্থাৎ আজকের মেরি লু সুসানের চেয়ে অনেক বড়ো।”
আমি বললাম, “আপনি মেরি লু-কে দেখলে বুঝতেন — ওকে দেখে বোঝা যায় না, ওর কত বয়েস। ওর রূপ আর চেহারা দুটোই ধরে রেখেছে।”
পুলিশ অফিসার বললেন, “পুরোনো ছবিতে শরীরে ট্যাটু নেই একটাও।”
আমি বললাম, “আছে। এই যে…” বলে আর একটা ছবি বের করে দেখালাম। পুলসাইড পার্টির ছবি। অনেকেই আছে — উল্কিটা দেখা যাচ্ছে না ভালো, ছবিটা জুম করাতে ঝাপসা হয়ে গেল…
বললাম, “তখন অত উল্কির চল ছিল না। আর এই উল্কিটা মেরি লু-র পছন্দ ছিল না। প্রায়ই বলত মুছে ফেলবে। ফেলেছেও।”
পুলিশ বলল, “অর্থাৎ এটা আর নেই?”
মাথা নাড়লাম। সেটা আগের বার-ও ছিল না।
আগের বার? পুলিশ ভুরু কোঁচকাল। আগের বার মানে? আগের বারের ছবি এটা নয়? এখানে তো উল্কি আছে দেখালেন।
আমি বললাম, “আগের বার মানে আজ থেকে বছর সাতেক আগে। তখনও এক রাতের… মানে এক সন্ধের জন্য এসেছিল — তারপরে চলে যায় আবার — এই সেদিন আবার দেখা পাই।”
পুলিশ ভাবিত হয়ে বলল, “সমাপতনটা অদ্ভুত নয়? এগারো বছর আগে আপনি স্যাক্রামেন্টোতে, মেরি লু-ও তাই। সাত বছর আগেও — সে নয় হতেই পারে… কিন্তু এখন আপনি সু সিটিতে, আর মেরি লু-ও এখানে…?”
আমি বললাম, “সাত বছর আগে আমি আর আমার বন্ধু স্যাক্রামেন্টোতে থাকতাম, কাজ করতাম। আজ আমরা দুজনেই এখানে থাকি, কাজ করি। ইউ-এস-এ-তে এখান থেকে ওখানে যাওয়া, চাকরি নেওয়া, থাকা — সবই সহজ… যে কেউ যেখানে খুশি যখন খুশি যেতে পারে, তাই না?”
তা-ই বটে। পুলিশ বলল, “আগেরবার উনি সারা রাত থাকেননি, কেবল সন্ধেটুকুই থেকে চলে গেছেন? কেন?”
বললাম, “বলতে পারব না। সম্ভবত ঘুমিয়ে পড়েছিলাম বলে। অনেক মদ খেয়েছিলাম সেদিন।” পুলিশ আবার অনেক কিছু লিখল, তারপরে চলে গেল।
এর পরে দিন সাত আট কিছু হল না। তারপরে হঠাৎ একদিন আমার দরজায় হাজির এক নতুন লোক। রবার্ট ফাউন্ডার, সু সিটি পুলিস ক্যাপ্টেন। সঙ্গে আর একজন পুলিশ — সে-ও নতুন, মোটাসোটা গোলগাল, হাসিমুখ, প্যাটি ফিশার।
হঠাৎ স্বয়ং ক্যাপ্টেন কেন হাজির?
“বলছি। ভেতরে আসতে পারি?”
ভেতরে এলেন, বসলেন। কথা বললেন ক্যাপ্টেনই। ফিশার মূক। ফাউন্ডার বললেন, “আসলে আমাদের একটা বিষয় বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে। আমরা একজন মিসিং পার্সনের সন্ধান করছি, তার নাম সুসান বেরেঞ্জার। সুসানের বন্ধু আমাদের জানিয়েছে…” ভদ্রলোক তাঁর নোটবই খুলে দেখলেন, তারপরে তারিখ বলে বললেন, “সেদিন আপনি সুসানের সঙ্গে সন্ধে সাতটার একটু পরে বার থেকে বেরিয়ে আপনার গাড়িতে চলে গেছিলেন — সম্ভবত সুসানের সঙ্গে আপনার কোনও একটা সমঝোতা হয়েছিল…”
আমি বললাম, “সুসান বলে কারও সঙ্গে…”
“এক মিনিট,” ভদ্রলোক আঙুল তুলে আমাকে থামালেন। তারপরে বললেন, “আমি বলে নিই, নইলে গুলিয়ে যাবে। সুসানকে শেষ দেখা যায় আপনার সঙ্গে বেরিয়ে আপনার গাড়িতে উঠছে। বার্ থেকে বেরিয়েছেন — তা দেখেছে বার্টেন্ডার এবং সুসানের বন্ধু, এবং সুসানের বন্ধু গাড়িতে উঠতে দেখেছে। মুশকিলটা হল, আপনি বলছেন, আপনি একজনকে নিয়ে বেরিয়েছেন, তিনি আপনার পুরোনো বন্ধু, যার নাম মেরি লু।”
আমার কিছু বলা বারণ, তাই চুপ করে রইলাম। ভদ্রলোক দুটো ছবির প্রিন্ট বের করলেন। একটা ওই সুসান বলে যে মেয়েটির ছবি আমাকে দেখানো হয়েছিল, আর অন্যটা মেরি লু। আমারই কম্পিউটার থেকে আমি পুলিশকে দিয়েছিলাম।
“আপনি বলেছেন, এই মেয়েটি আপনার কাছে সে রাতে ছিল না। এই মেয়েটি ছিল। আপনি সুসানের ছবি দেখে প্রথম দিন বলেছিলেন, দু-জনের মিল আছে। আমরা মনে করছি না মিল আছে। আপনি মিল দেখাতে পারবেন?”
দেখালাম। কপাল, কানের লতি, নাকের পাটা, আর হাসলে দুজনের মুখের কোনে কেমন চামড়ার ভাঁজ পড়ে… দেখে ক্যাপ্টেন বললেন, “হুম। এবং আপনি বলছেন, প্রায় এগারো বছর আগে তোলা মেরি লু-র এই ছবির সঙ্গে আজকের মেরি লু-র কোনও তফাৎই নেই?”
প্রায় নেই। তার ওপর এটা এগারো বছর না, তারও আগের। এগারো বছর আগে মেরি লু আমাকে ছেড়ে প্রথম চলে গেছিল। এটা হয়ত বারো বা তেরো বছর আগে তোলা।
“কতদিন একসঙ্গে ছিলেন?”
“প্রায় দু-বছর।”
“কেন ছাড়াছাড়ি হল?”
অ্যামেরিকায় এই প্রশ্নটা কেউ করেই না বলতে গেলে — আমাদের দেশের মতো নয় — কিন্তু পুলিশ তো যা খুশি জিজ্ঞেস করতে পারে। বললাম মেরি লু খোলামেলা জায়গা প্লেসারভিলে আমার মতো খুশি ছিল না, কেমন ও রোজই প্রায় স্যাক্রামেন্টো চলে যেত আমি যখন অফিসে থাকতাম, কেমন আমার মনে হত ও আমার সঙ্গে সুখী নয়, ও ওর আগের দুজন বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে — সেই নিয়ে ঝগড়া হত… আর হয়ত সে কারণেই…
“আর তিনবারই এই মেরি লু যখন চলে গেছে, তখন আপনি ঘুমিয়ে রয়েছেন — রাতের বেলায়?”
ঠিক। বললাম, “সম্ভবত যাতে মুখোমুখি সমস্যা না হয় — আমার একটু ঘ্যানঘ্যানে স্বভাব আছে। যেও-না, যেও-না, বলে অনুরোধ উপরোধ করতাম।”
“তাহলেও… আপনি যখন কাজে গেছেন তখন চলে গেলে আরও নিশ্চিন্তে যাওয়া যেত না কি?”
আমি কাঁধ ঝাঁকালাম। জানি না।
ভদ্রলোক এবারে ঝুঁকে পড়লেন সামনের দিকে। “দেখুন, আপনাকে বলি… এই সুসান মেয়েটির বন্ধু…” আবার নোটবুক খুলে তাকালেন, “চিন্ট্স্ বলে ডাকে সবাই… খুব জোর দিয়ে বলছে, যে সুসান আপনার সঙ্গেই সে রাতে বেরিয়েছে, আপনার সঙ্গেই ছিল, এবং আপনিই তার হারিয়ে যাওয়ার মূলে। আমরা মানছি, আপনাদের দুজনের একসঙ্গে বেরোনো ছাড়া ওর বাকিটা জানার কথা নয়… আন্দাজ। আর আপনার কাছেও কোনও প্রমাণ নেই যে সেদিন রাতে আপনার কাছে মেরি লু ছিল, সুসান না…”
ফাউন্ডার থামলেন। বোধহয় আমাকে ব্যাপারটা বুঝতে দেবার জন্য। আমি আস্তে আস্তে বললাম, “একেবারে প্রমাণ নেই, তা নয়। কিছু গয়না ফেলে গেছে। অর্নামেন্টস।”
দু-জনে একেবারে যাকে বলে তড়িদাহতের মতো চমকে উঠলেন। ফাউন্ডার বললেন, “অর্নামেন্টস! জুয়েলরি?”
আমি মাথা নাড়লাম। তেমন কিছু না। জাঙ্ক জুয়েলরি।
“সেগুলো কী করেছেন আপনি?”
বললাম। গ্যারেজে নিয়ে গেলাম। দেখালাম। আমাকে ধরতে দিলেন না আর। প্যাটি ফিশার একটা সিল করা প্যাকেট খুলে নীল রঙের গ্লাভস বের করে পরল। একটা একটা করে আংটি, গলার হার, কানের দুল — সব আমাকে দেখিয়ে দেখিয়ে একটা প্লাস্টিকের ব্যাগে ভরে সিল করল। তারপরে বলল, “আর এই জামাকাপড় আর লিপস্টিক?”
বললাম, “লিপস্টিক আর জামাকাপড়গুলো প্রথমবারে ফেলে গেছিল। দ্বিতীয়বারে ব্রা আর প্যান্টি। হয়ত লিপস্টিকগুলো ইচ্ছে করেই ফেলে গেছিল — কারণ ওগুলো ছিল ওয়েস্টপেপার বাস্কেটে। আর কাপড়গুলো ছিল কাপড় কাচার হ্যাম্পারে। হয়ত ভুলে গেছিল।”
“আর দ্বিতীয়বারের ব্রা আর প্যান্টি?”
পরিস্থিতিটা বর্ণনা করতে হল। বললাম, “আমি যেখানে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, সেখানেই পড়ে ছিল। হয়ত আমার ঘুম ভেঙে যেতে পারে সেই ভয়ে ও দুটো নেয়নি।”
হঠাৎ প্যাটি আমার দিকে চেয়ে বলল, “উড ইউ সে ইউ আর আ ভায়োলেন্ট ম্যান?”
ভায়োলেন্ট? আমি? হেসে ফেললাম। বললাম, “একেবারেই না।”
“তা হলে একজন মহিলা আপনাকে এমনই ভয় কেন পেলেন, যে অন্তর্বাস ফেলে রেখে চলে গেলেন?”
“সে রকম ভয় না, ম্যাডাম। মেরি লু আমার ঘ্যানঘ্যানানি ভয় পেত। অনেক বার বলেছিল, গড্, আই হেট ইউ হোয়েন ইউ বেগ…”
দুজনে একটু দূরে সরে গিয়ে কী আলোচনা করল। আমি একটু একটু শুনতে পাচ্ছিলাম, অন্য কাপড়, জামা, লিপস্টিকও কি নিয়ে যাবে? না সেগুলো এই কেসের সঙ্গে জড়িত নয় বলে রেখে যাবে? তারপরে ঠিক করল, নিয়ে যাবে, সবই আলাদা করে ‘ব্যাগ করবে’ — অর্থাৎ আলাদা আলাদা প্লাস্টিকের ব্যাগে নেবে। দু-একবার ‘কন্ট্যামিনেশন’ কথাটা শুনলাম। কেন, বুঝলাম না। তারপরে সব ব্যাগবন্দী করে আমাকে রসিদ লিখে দিল প্যাটি ফিশার। ফাউন্ডার বললেন, “আপনি কাল একবার পুলিশ স্টেশনে আসবেন? আপনার ফিঙ্গারপ্রিন্ট আর ডি-এন-এ নেওয়া হবে। এগুলোতে নিশ্চয়ই আপনার ফিঙ্গারপ্রিন্ট বা ডি-এন-এ আছে — সেগুলো চিনে বাতিল করা হবে।” বেশ কথা… আমি প্যাটির দেওয়া রসিদটা মানিব্যাগে ঢোকাতে ঢোকাতে বললাম, “একটা অনুরোধ করছি। আমি জানি আপনারা এই সবগুলো থেকে কেবল মেরি লু-র হদিস পাবেন। আপনারা যাকে খুঁজছেন, তার কিছুই পাবেন না। তাহলে আপনাদের কাজ হয়ে গেলে আমাকে এগুলো ফেরত দেবেন? মেরি লু-র এইটুকু স্মৃতিই আমার রয়েছে…”
ফাউন্ডার হঠাৎ এক পা এগিয়ে এসে আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন, “অবশ্যই। ডোন্ট ওয়ারি।”
আমি জানি এ দেশের পুলিশের পক্ষে এটা কত বড়ো জেশ্চার। মাথা নিচু করে সেটা মেনে নিলাম।
পরের রবিবার দুপুরে আমরা — মানে আমি, বাবান আর টুকু — ঠিক করেছিলাম স্টোন স্টেট পার্ক ওয়াইল্ড লাইফ স্যাংচুয়ারিতে পিকনিক করব। সকাল সকাল টুকু আর বাবান ওদের পিকনিক হ্যাম্পার নিয়ে হাজির হয়েছিল, আমি আমার হ্যাম্পারে ওয়াইন আর চিকেন প্যাক করছিলাম — এমন সময়ে হঠাৎ দূর থেকে পুলিশের গাড়ির সাইরেন শোনা গেল। টুকু বলল, “তোমার কাছে আসছে নাকি?”
আমি বরাভয় দিয়ে বললাম, “আমার কাছে অনেকবারই এসেছে। আমি ওদের সাসপেক্ট নই। এত সাইরেন বাজিয়ে কেন আসবে?”
আমরা বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলাম… সাইরেনের শব্দ কাছে আসছে… সারি দিয়ে প্রায় ছটা — না সাতটা পুলিশের গাড়ি — সবকটার মাথায় লাল-নীল আলো ঝলসাচ্ছে। দেখতে দেখতে ওরা এসে ক্যাঁচ ক্যাঁচ করে ব্রেক দিয়ে দাঁড়াল ঠিক আমারই বাড়ির সামনে। সাইরেনগুলো থামার পরে নিস্তব্ধ হয়ে গেল চারিদিক। গাড়িগুলো থেকে দু-জন করে পুলিশ বেরিয়ে গাড়ির আড়ালে লুকিয়ে বন্দুক উঁচিয়ে ধরল আমাদের দিকে। বিনা বাক্যব্যয়ে আমরা হাত তুললাম আকাশে।
মেগাফোনে ক্যাপটেন ফাউন্ডার আমার নাম করে জিজ্ঞেস করলেন আমাদের কাছে কোনও অস্ত্র আছে কি না।
আমি চেঁচিয়ে বললাম, “না।” আমাদের তিনজনকেই মাটিতে উপুড় হয়ে শুতে বললেন। শুনতে পাচ্ছিলাম আমার পেছনে টুকু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। হাঁটু গেড়ে বসতে বসতে বললাম, “আমাদের কোনও ভয় নেই। ওরা কিছু একটা ভুল করছে। শান্ত হয়ে ওরা যা বলে কর… দেখবি, সব ঠিক হয়ে যাবে।”
উপুড় হয়ে শুয়ে দেখলাম কয়েক জোড়া পুলিশের জুতো এসে আমার চারপাশে থামল। কেউ একজন আমার দু-হাত ধরে পেছনে নিয়ে হাতকড়া পরাতে গেলে আমি ব্যথায় চেঁচিয়ে উঠলাম, বললাম, “আমার ফ্রোজেন শোলডার আছে। পেছনে হাত নিতে গেলে খুব ব্যথা হয়।”
একটু পরে আমার দু-হাতের বাহু ধরে তুললেন ক্যাপ্টেন ফাউন্ডার আর একজন পুলিশ যাকে আমি আগে দেখিনি। সামনের দিকেই দু-হাতে হাতকড়া পরাতে পরাতে ফাউন্ডার বললেন, “আপনাকে আমি সুসান বেরেঞ্জারের খুনের দায়ে গ্রেফতার করছি। আপনি কিছু না-ও বলতে পারেন, কিন্তু যা-ই বলেন, বিচারের সময় আপনার বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হতে পারে। আপনি একজন উকিল পেতে পারেন, উকিলের খরচ দিতে না পারলে সরকার উকিল দেবে।”
কথাগুলো কত শুনেছি টিভিতে। মাথা নেড়ে বললাম, “ভুল হচ্ছে, কোথাও ভুল হচ্ছে। আমি সুসান বেরেঞ্জারকে চিনি না, কোনও দিন দেখিনি।”
দু-দিন, না তিন দিন জানি না, পুলিশ স্টেশনে লাগাতার জেরা। ‘সুসান বেরেঞ্জারকে খুন করেছ, তুমি তাকে খুন করেছ… স্বীকার করো, করেছ…’
শেষ পর্যন্ত বাবান এল একদিন। বলল, “তোর মাথা খারাপ হয়েছে? ল-ইয়ার নিসনি কেন?”
কেন নেব ল-ইয়ার? আমি কী করেছি?
“গুপি, তোকে গ্রেফতার করা হয়েছে তুই জানিস না? তোর বিরুদ্ধে খুনের মামলা, তুই জানিস না? চুপ করে বসে আছিস, উকিল চাইছিস না… সরকার শেষ পর্যন্ত কী হিজিবিজি উকিল দেবে তুই জানিস?”
আবার মাথা নাড়লাম। আমি কাউকে খুন করিনি। কার খুনের দায়ে আমাকে ধরবে পুলিশ?
বাবান সব বলল। পুলিশ আমাকে কিছুই জানায়নি। ওই সুসান বেরেঞ্জার না কে, তার মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছে। যেখানে আমরা পিকনিক করব ভেবেছিলাম, তারই কাছাকাছি কোথাও। মাটিতে একটা অগভীর গর্ত করে কেউ পুঁতে দিয়ে গেছিল। শেয়াল না ব্যাজার — জঙ্গুলে জন্তু খুঁড়ে বের করেছে।
“গলায় তার পেঁচিয়ে মারা হয়েছে। ওর ব্যাগের ওপর তোর আঙুলের ছাপ পাওয়া গিয়েছে। মাই গড্, তুই বুঝতে পারছিস তুই কী সাংঘাতিক বিপদে পড়েছিস? তুই মেয়েটাকে খুন করেছিস, গুপি?”
আমি বললাম, “অ্যামেরিকার পাসপোর্ট পাওয়ার পর থেকে তুই কেমন অ্যামেরিকানদের মতো চিন্তা না করেই হাত-পা ছুঁড়ে চেঁচাস আজকাল। একটু ভেবেচিন্তে কথা বল, বাবান। আমার সঙ্গে রাতে মেরি লু ছিল। ওই যার কথা পুলিশ বলছে, সে ছিল না। মেরি লু ওর আংটি, গলার হার, কানের দুল খুলে রেখে গেছে — সব আমি পুলিশকে দিয়েছি। পুলিশ তোকে বলেনি?”
আবার হাত-পা ছুঁড়ে ‘গড্’ বলে চোখ কপালে তুলল বাবান — ঠিক যেন হলিউডি সিনেমা। বলল, “ওই গয়নাগাটি সব সুসানের। টিভিতে বলেছে ওতে ওর ডি-এন-এ পাওয়া গেছে। কোনও মেরি লু সিনেই নেই। তুই কাকে কী গপ্পো বলছিস?”
আমি গল্প বলছি না, সুতরাং আমার কিছু বলার নেই। চুপ করে রইলাম।
বাবান বলল, “আমি তোর জন্য উকিল ঠিক করেছি। নামজাদা লোক। খরচা আছে। যা টাকাকড়ি জমিয়েছিস, সেগুলো কাজে লাগবে। তবে আমি হয়ত আর তোকে সাহায্য করতে পারব না। টুকু খুব আপসেট হয়ে গেছে। এত ভয় পেয়েছিল পুলিশ ওর দিকে বন্দুক তাক করেছিল বলে… ও আর এখানে থাকতে চাইছে না। আমি যদি বাধ্য হয়ে চলে যাই, তাহলে…”
অনেক দিন ধরে যে কথাগুলো বলিনি, সেগুলো বেরিয়ে এল। বললাম, “শোন, তুই চলে যাবি, তাতে আমার কোনও বক্তব্য নেই। বন্ধুরা চিরদিনই বন্ধুর বিপদের সময়ে পৃষ্ঠপ্রদর্শন করে। তুইও করবি, এ নতুন কিছু না। কিন্তু একটা কথা ভেবে নে। তোর পক্ষে চাকরি পাওয়া সহজ নয়। এখানে চাকরিটা জোগাড় করে দিতে গিয়ে আমাকে বেশ কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। সে-ও কিছু না। কিন্তু তুই এর পরে কোথায় চাকরি পাবি? মেথরের চাকরি করেছিস, এবারে কি করবি? ধাঙড়ের চাকরি? না ডোম-মুদ্দোফরাসের কাজ? ওই হারামি মাগি টুকু তোকে তখন বিছানায় শুতে দেবে? ভেবে দেখিস।”
কথাগুলো খুশি মনে বলিনি। বলতে বাধ্য হয়েছিলাম। আরও বলতাম, কিন্তু বাবানের মুখের অবস্থা দেখে বললাম না। কিন্তু বাবান তখনকার মতো উঠে চলে গেলেও, চলে যায়নি। তখনও না, আজও না। টুকুকে কী বলেছে আমি জানতেও চাইনি। চাইও না।
পরদিন বাবান এল উকিল নিয়ে। সিজার লুইস। লম্বা কালো ভদ্রলোক। অনেকটা উইল স্মিথের মতো দেখতে, কিন্তু অতটা ফ্ল্যামবয়ান্ট নন। ভদ্রলোক নানাভাবে কেস সাজানোর কথা বলছিলেন। আমার একটাই বক্তব্য। আমি খুন করিনি, আমি সুসান বেরেঞ্জারকে চিনি না, দেখিনি। আমার সঙ্গে সে রাতে আমার গার্লফ্রেন্ড মেরি লু ছিল, যে রাত থাকতেই চলে গেছে, কোথায়, জানি না। সুসান বেরেঞ্জারের ব্যাগে আমার আঙুলের ছাপ, আর মেরি লু-র গয়নাগাটিতে সুসানের ডি-এন-এ কোথা থেকে এল আমি জানি না — তবে আমি এক কথায় সবটাকেই ‘ভুল’ বলে অভিহিত করছি — কোথাও কারও ভুল হয়েছে।
সিজার লুইস বাবানের দিকে তাকিয়ে অস্ফূটে কী বললেন, আমি তেড়িয়া হয়ে বললাম, “আমি মোটেই ইনসেন নই। খবরদার যদি ইনস্যানিটির বাহানা বানিয়েছ, আমি তোমাকে বরখাস্ত করব।”
সিজার আর বাবান সেদিনের মতো বিদায় নিল।
পরদিন আমার অ্যারেইনমেন্ট। কোর্টে নিয়ে গেল আমাকে হাতকড়া পরিয়ে। অনেক কথা হল উকিল আর জজের মধ্যে। জজ আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “হাউ ডু ইউ প্লিড?” অর্থাৎ আমি নিজে কী বলব — আমি কি অপরাধী, না নই? আমি উঠে দাঁড়িয়ে নিচু গলায়, কিন্তু দৃঢ়ভাবে বললাম, “আই অ্যাম নট গিল্টি, ইওর অনার।” আরও কিছু বলতে পারতাম, কিন্তু এখন আর কিছু বলা বারণ।
বেল পেলাম। অনেক খরচ হল, কিন্তু বন্দীদশা থেকে মুক্তি। পরদিন সকালে বাবানের সঙ্গে গেলাম সিজার লুইসের অফিসে। বললেন, “তোমার সমস্যা তো আরও বাড়ল। গতকাল সন্ধেবেলা ডি-এ — ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নির অফিস থেকে ফ্যাক্স করে জানিয়েছে, তোমার দেওয়া ইনফরমেশন ভিত্তি করে প্লেসারভিল পুলিশ গত কয়েক দিন খোঁজাখুঁজি করে তোমার ওখানকার বাড়ির পেছনের জঙ্গলে দুটো মেয়ের মৃতদেহ পেয়েছে। তার মধ্যে একটা তোমার প্রাক্তন গার্লফ্রেন্ড, মেরি লু-র। ওটা প্রায় এগারো বারো বছরের পুরোনো। অন্যটা আর একজন মিসিং পার্সনের — তার নাম নিকোলেট মেরিংহ্যাম। সে সেক্স ওয়ার্কার ছিল। ওখানে পড়ে আছে কম করে বছর পাঁচ-সাত। দুজনেরই ফ্যামিলির সঙ্গে যোগাযোগ করে ডি-এন-এ জোগাড় করা হয়েছে। মেরি লু-র ডি-এন-এ তোমার দেওয়া লিপস্টকে পাওয়া গিয়েছে, আর নিকোলেটের ডি-এন-এ পাওয়া গিয়েছে তোমার দেওয়া ব্রা এবং প্যান্টিতে লেগে থাকা লোমে। এই দুজনকেও মারা হয়েছে যে ভাবে সুসানকে মারা হয়েছে, সেভাবেই। গলায় তার পেঁচিয়ে। প্লেসারভিল পুলিশ তোমার বিরুদ্ধে খুনের মামলা দায়ের করেছে। দুটো আলাদা স্টেট-এ অপরাধ হয়েছে বলে এখন এফ-বি-আইও এসেছে তদন্তে। তোমার কিছু বলার আছে?”
আমি লুইসের চোখে চোখ রেখে বললাম, “একটা কথাই বলব। মেরি লু মারা যায়নি। এই সেদিনও আমার সঙ্গে সারা সন্ধে আর রাত কাটিয়েছে। পুলিশ যদি সিরিয়াসলি খোঁজে, তাহলে ওকে পাবে। আর এই সব কী মৃতদেহ-টেহ বলছেন, তার রহস্য তার পরে সমাধান করবে।”
সিজার লুইস আমার দিকে হতভম্বের মতো তাকিয়ে রইলেন। বাবান বলল, “মিঃ লুইস, আমাকে একটু অনুমতি দেবেন — আমি ওকে মাতৃভাষায় কিছু বলি? ও হয়ত ব্যাপারটা ঠিক বুঝছে না।” বলে বাংলায় আমাকে বলল, “গুপি, তোর কী হয়েছে বল তো? তুই শুনলি না, মিঃ লুইস কী বললেন — পুলিশ মেরি লু-র ডেডবডি পেয়েছে, মৃতদেহ…”
আমি হাত তুলে বাবানকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, “তোকে যেন স্পোকেন ইংলিশ কে শিখিয়েছিল?”
জোঁকের মুখে নুন পড়ার মতো গুটিয়ে গেল বাবান। আমি বললাম, “আজ তুই আমাকে শেখাচ্ছিস, ডেডবডি মানে মৃতদেহ? তুই ওদের সঙ্গে ভিড়ে আমাকে বোঝাচ্ছিস মেরি লু মরে গেছে? আর আমি যে বার বার বলছি, মেরি লু বেঁচে আছে, তার কোনও দামই নেই তোর কাছে? এতদিনে অন্তত কাগজে বিজ্ঞাপন দিতে পারতিস একটা — ‘মেরি লু, তোমাকে খুন করার দায়ে গুপিকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে, তুমি যেখানেই থাকো, এখনই আমার সঙ্গে যোগাযোগ করো…’ একবার মেরি লু যদি এসে পড়ে, তাহলে তো আর চিন্তা নেই। সব কেসই ফেল করে যাবে।”
ওরা দুজন আর কিছু না বলে উঠে গেল।
পরদিন, আমার আপত্তি সত্ত্বেও, সিজার লুইস জজসাহেবকে বলল, “ইওর অনার, ডিফেন্ড্যান্টের সঙ্গে কথা বললেই বুঝবেন, উনি পরিস্থিতিটা মোটেই বুঝছেন না। উনি মানতেই রাজি নন যে মেরি লু সায়ানসি আর বেঁচে নেই। বার বার বলেই চলেছেন, মেরি লু মারা যাননি। ডি-এ তো বলবেনই ডিফেন্ড্যান্ট লুসিড। কিন্তু, আমার অ্যাপিল যদি খারিজ করেন, তাহলে হয়ত আমরা একজন ইনকম্পিটেন্টকে সাজা দেব। সেটা আমাদের কনশায়েন্সে বোঝা হয়ে থেকে যাবে।”
জজসাহেব কোর্ট মুলতুবি রেখে আমাকে আর দুজন উকিলকে নিজের চেম্বারে নিয়ে গেলেন। আমাকে বললেন, “আপনার কী বলার আছে, সেটা আমাকে বলবেন?”
নতুন করে আর কী বলব? একই কথার পুনরাবৃত্তি। তা-ও সবই বললাম। তারপর বললাম, “ইওর অনার, আপনার হাতে অনেক ক্ষমতা। আমি আপনাকে কী বলব? কিন্তু যদি দয়া করে পুলিশকে নির্দেশ দেন, মেরি লু-কে খুঁজে বের করতে, তাহলেই জানা যাবে আমি যা বলছি, সব সত্যি। একমাত্র মেরি লু-ই এই রহস্যের চাবি।”
জজসাহেব সিজার লুইসের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আই সি হোয়াট ইউ মিন।” তারপরে ডি-এ কে বললেন, “আই উইল আস্ক ফর অ্যান ওপিনিওন।” ডি-এ কাঁধ ঝাঁকালেন।
কোর্টরুমে জজসাহেব বললেন, “সামগ্রিক পরিস্থিতি বিচার করে আমি ডিফেন্ড্যান্টের মানসিক অবস্থার পর্যবেক্ষণের জন্য সাইকিয়াট্রিক সেন্টারে পাঠানো সাব্যস্ত করলাম। প্রশ্ন এই, যে সেটা কি সরকারি সংস্থা হবে, না ডিফেন্ড্যান্টের নিজের খরচে কোর্টের নির্দেশে কোনও প্রাইভেট ক্লিনিকে? ডিফেন্স কাউন্সেল কী বলেন?”
সিজার লুইস উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “কোর্টের হুকুম-মতো কোনও প্রাইভেট ক্লিনিক, ইওর অনার।” বুঝলাম বাবানের সঙ্গে আগেই আলোচনা করা ছিল।
কোর্টের ইচ্ছেতে তাই আমি গত তিন সপ্তাহ হল কর্নারস্টোন সাইকিয়াট্রি সেন্টারের বাসিন্দা। আমার ‘কেস’-এর তত্ত্বাবধানে ডাঃ মাইকেল গ্রুট। দু-চক্ষে দেখতে পারি না ভদ্রলোককে।
ক্রমশ (পরের রবিবার শেষাংশ)