দু-দিন আগে গ্রুট বাবান আর সিজার লুইস-কে রিপোর্ট দিয়েছেন। আমার দাবীতে আমি সেখানে ছিলাম। আমাকে নিয়ে আমার আড়ালেই আলোচনা হবে… সে আমি বরদাস্ত করব না। প্রথম থেকেই গ্রুটকে বিশ্বাস করিনি, এখন সিজার লুইসকে নিয়েও আমার সন্দেহ হচ্ছে। ওরা দুজনে বাবানকে কী বোঝাচ্ছে, আর বাবান ওদের কথায় নাচছে।
গ্রুট বলল, আমি নাকি মেরি লু-কে নিয়ে অবসেসড। ওকে মাথা থেকে বের করতে পারিনি বলেই এতদিন বিয়ে-থা করিনি, আর কোনও মেয়ের প্রতি আমার কোনও আকর্ষণ দেখা যায়নি।
এ পর্যন্ত আমার আপত্তির কারণ নেই।
মেরি লু-কে আমি খুন করেছি। সেই দশ-এগারো বছর আগেই। এটা অবশ্য প্রমাণিত সত্য নয়, এটা সন্দেহ, এবং বাকি দুজন মহিলার মৃতদেহ পরীক্ষা করে তা থেকে সূত্র পাওয়া…
যত বাজে কথা।
এর পরে যে কারণেই হোক, বছর তিনেক পরে একজনকে দেখে আমার মনে হয় এ-ই মেরি লু। এবং সেইজন্যই তাকে নিয়ে আসি বাড়িতে। মেরি লু মনে করেই তাকে খুন করি।
বাধা দিলাম। বললাম, “মেরি লু সেদিন আমাকে হুইস্কির বোতল দিয়ে মেরে মাথা আলু করে দিয়েছিল। চোখের পাশে কালশিটে পড়েছিল। আমি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম। বাবান সে আঘাতের চিহ্ন পরদিন আমার মাথায় দেখেছে। আমি ওকে প্রথমে বলেছিলাম মদ খেয়ে পড়ে গেছিলাম, পরদিন জ্ঞান ফিরেছিল যখন, তখন মেরি লু নেই…”
আমাকে থামিয়ে ডাঃ গ্রুট বললেন, “মেরি লু নয়। নিকোলেট। নিকোলেট মেরিংহ্যাম। নিকোলেটকেও গলায় তার পেঁচিয়ে মারা হয়েছিল, দেহাবশেষ যা পাওয়া গিয়েছে, তাতে সেই তার পেঁচানো ছিল তখনও। প্লেসারভিলে আপনার বাড়ির সরাসরি পেছনে যে জঙ্গুলে জায়গা আছে, আপনার বাড়ি থেকে পাঁচশো গজের মধ্যে মেরি লু আর নিকোলেটের দেহ পাওয়া গিয়েছে। পরস্পরের পঞ্চাশ গজের মধ্যে। আপনার কপাল ভালো ওদিকে কেউ যায় না। তাই বছরের পর বছর মৃতদেহ পড়ে থাকতে পেরেছে। পাওয়াও গেছে আপনারই কল্যাণে। আপনিই তিনজনের ব্যক্তিগত জিনিস পুলিশকে দিয়েছেন। পুলিশই তিনজনের ডি-এন-এ পেয়েছে। বাকি দু-জনও মিসিং পার্সন। মেরি লু-র সম্বন্ধে আপনি রিপোর্ট করেননি, কিন্তু বছর তিনেক আগে তার মা করেছিলেন। নিকোলেট আর সুসানের মিস্-পার্ রিপোর্ট তো তখনই করা হয়েছে, যখন তারা হারিয়ে গেছে।”
এইসব ধানাইপানাই গেয়ে ওরা আমাকে পুলিশের হাত থেকে রক্ষা করবে। তবেই হয়েছে।
ডাঃ গ্রুট নাকি আমাকে অবজার্ভ করে প্রাথমিক চিকিৎসা করার জন্য কোর্টের কাছে অ্যাপিল করেছেন। কিসের চিকিৎসা? আমার নাকি ডেল্যুশন আছে। আমি বিশ্বাস করি মেরি লু মারা যায়নি। ও ফিরে আসবে।
বাবান জানতে চেয়েছিল, “আর ও যদি তিনজনকেই মেরে থাকে, তাহলে স্বীকার করছে না কেন? কেন বার বার বলছে ও কাউকে মারেনি। ওর কথা শুনে তো মনে হচ্ছে ও জানেই না কিছু।”
ডাঃ গ্রুট এবারে একটু থমকালেন। বললেন, “আমার ধারণা ও খুনগুলো করেছে একটা ডিসোসিয়েটিভ স্টেটে। দ্বিতীয়বারে মাথায় চোটও খেয়েছিলেন, তবে সেজন্যেই ডিসোসিয়েট করেছিলেন কি না তা বলা এখন আর সম্ভব নয়। সেই অবস্থায় খুন করে, ভিকটিমদের বডিগুলো জঙ্গলে ফেলে দিয়ে আসেন। ওই অবস্থায় হাতের কাছে মেয়েগুলোর যা যা পেয়েছেন, সব একসঙ্গে ফেলে দিয়েছেন, কিন্তু এদিক ওদিক যা পড়ে ছিল, সেগুলো প্ল্যান করে গুছিয়ে নিয়ে যাননি। ফিরে এসে জামা-কাপড় বদলে শুয়ে পড়েন। ঘুম ভাঙে পরদিন… তখন ডিসোসিয়েটিভ স্টেট-টা কেটে গেছে, সব ভুলে গেছেন।”
আমি গুনগুন করে গাইলাম, “অংবংচং চবং চবং চং, গো…” বাবানকেই বোঝানোর জন্য গেয়েছিলাম কিন্তু ওর খেয়াল নেই। হঠাৎ কিছু মনে পড়ে গেছে ভাব করে বলল, “আচ্ছা, তাহলে কোনও খুনই ও নিজে হাতে করেছে তার প্রমাণ নেই? সবই সার্কমস্ট্যানশিয়াল?”
মাথা নাড়লেন সিজার লুইস। “আগের দুটো সার্কমস্ট্যানশিয়াল বললেও শেষেরটা অত সহজে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। আর সেখান থেকেই আগের দুটো লিঙ্ক করা হবে। একই রকম ভাবে তিনজনের মৃত্যু, তিনজনের মৃতদেহ একই ভাবে ডিসপোজ করা… এটাকে পুলিশ এম-ও বলে। মোডাস অপারেন্ডি। এতটা মিল সার্কমস্টানশিয়াল হলেও কাকতালীয় নয়। কোর্টকে কনভিনস করা সহজ হবে না।”
যারা আমায় নির্দোষ প্রমাণ করবে, তারাই যদি আমাকে খুনি মনে করে, তাহলে আমার রক্ষা পাবার উপায় কতটুকু? তিনজন একবারের জন্যেও মেরি লু-কে খোঁজার কথা ভাবেনি। আমি বলা সত্ত্বেও না। বরং আমার দিকে কৃপা করে তাকিয়েছে — ভাবখানা যেন, আমি পাগল হয়ে গেছি…
এখন আমাকেই খুঁজে বের করতে হবে মেরি লু কোথায়। কিন্তু আমি তো এখানে বন্দী…
“একা একা কেন দাবা খেলছ? এখানে আর কেউ খেলে না?”
রিক্রিয়েশন রুমে একাই খেলছিলাম। কেউ খেলে না নয়, আমার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কেউ পারে না। একবার ডাঃ গ্রুট নিজেই এসেছিলেন, সাত দানে হেরে গিয়ে সেই যে পালিয়েছেন, রিক্রিয়েশন রুমে আমি দাবার ছক নিয়ে বসে থাকলে আর ঢোকেনই না। মুখ তুলে তাকিয়ে বললাম, “আমি একাই…” বলতে গিয়ে থেমে গেলাম। বললাম, “খেলবে?”
বসে পড়ল আমার সামনে। বলল, “সাজাতে হবে না। এই বোর্ডেই কন্টিনিউ করি?”
খুব সাহস! আজ অবধি ক-বার আমাকে দাবায় হারাতে পেরেছ?
কাঁধ ঝাঁকালাম। বললাম, “তোমার দান। আমি এইমাত্র…”
আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “জানি। দেখেছি। আমি ওখানে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম।”
বটেই তো! দূর থেকে আমাকে লক্ষ করেছ, সেটাই তো স্বাভাবিক। দাবার বোর্ডের ওপর দিয়ে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “পরিচয় দিই। আমার নাম বার্নাডেট।”
বার্নাডেট? কাকে কী বলছে? তবে আমিও আজ অতিরিক্ত সাবধান। হাত বাড়ালাম। করমর্দন করে নাম বললাম। ও বলল, “তুমি এখানে কেন? তোমার কী হয়েছে?”
কী হয়েছে? আমার কী হয়েছে? কিছু তো হয়নি… তাহলে কী জবাব হবে?
তাকিয়ে রয়েছে আমার দিকে। কিছু বলতে হবে। বললাম, “ডাক্তাররা এখনও একমত হতে পারেননি। জুরি ইজ স্টিল আউট। আমাকে অবজারভেশনের জন্য রাখা হয়েছে।”
ও বলল, “আমার বর্ডারলাইন পার্সোনালিটি।”
সে কী… খায় না মাথায় মাখে আমি জানি না। কিছু না বলে আমি তাকিয়ে রইলাম বোর্ডের দিকে। ও একটা বোড়ে এগোল।
রানি পেছোলাম। সাবধানে। ওর দিকে বেশি তাকাচ্ছিও না। পাছে আমার মনোভাব প্রকাশ পায়, পাছে আবার ভুল কিছু বলে ফেলি…
শেষ পর্যন্ত আমার কথাই ঠিক হল তো? মেরি লু ফিরে এল। প্রথম থেকে বলেছিলাম, মেরি লু-কে পাওয়া গেলেই হবে। দেখা যাবে মেরি লু বেঁচে আছে, ও বলবে ও আমার কাছে ছিল, পরদিন চলে গিয়েছিল। তাহলেই হবে। খুন, পাগলামো — কোনও কথাই ধোপে টিঁকবে না আর।
মেরি লু চাল ভাবছে। আমি আড়চোখে তাকালাম। বদলেছে এ ক-বছরে, কিন্তু একই রয়ে গেছে মেরি লু। বয়সটাও মনে হয় যেন এই এগারো-বারো বছরে বাইশ-ই রয়ে গেছে। এক দিনও বাড়েনি। সেই চুলের লালচে আভা, সেই হাসি, ঠোঁটের কোনে সেই চামড়ার ভাঁজ…
কাল গ্রুটকে বলব। ততক্ষণে এমন কিছু করলে, বা বললে চলবে না যাতে মেরি লু আবার পালায়। কাল গ্রুট মেরি লু-কে দেখলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। তখন আমি এখান থেকে চলে যাব। ওকে সঙ্গে নিয়েই যাব। আর ওকে কোথাও যেতে দেব না। আমরা চিরদিন একসঙ্গেই থাকব।
কাল যখন মেরি লু-কে নিয়ে গ্রুটের অফিসে যাব, ওর মুখটা কেমন হবে ভাবতেই ভালো লাগছিল। বলব, “তুমি আর পুলিশ আর সিজার লুইস বাবানকে ভুলভাল বুঝিয়ে আমাকে ফাঁসানোর তাল করেছিলে… এখন দেখো… দাবায় তুমি আমার চেয়ে দড় নও। এই আমার…”
মেরি লু ওর রানিটা তিন ঘর এগিয়ে এনে বলল, “চেক-মেট।”
শেষ
১৪৩০ (২০২৩) শারদীয়া “প্রতিসৃষ্টি”-তে প্রকাশিত