যখন হায়ার সেকেন্ডারিতে আর্টস নিলাম, বাড়িশুদ্ধ সবাই অবাক হয়ে বাধা দিল। আমার চিরস্নেহময় পিতৃদেব অবধি ঘোষণা করলেন, ত্যাজ্যপুত্র করবেন।
দোষের মধ্যে দোষ, মাধ্যমিকের নম্বরটা ভালো ছিল। শুধু ভালো না, বাড়াবাড়ি রকমের ভালো। আমিও চিরকালের ঘাড় বেঁকা পাবলিক। ওই আপনাদের ভাষায় নিশ্চিত ভবিষ্যতের ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার সায়েন্টিস্ট হতেই হবে মার্কা যুক্তি না মেনে রাধাবিনোদ হায়ার সেকেন্ডারির আর্টসের ক্লাস ইলেভেনে গিয়ে সেঁধোলাম। লাভের মধ্যে লাভ যেটা হল, বাড়িতে তো বটেই, স্কুলেও বন্ধুহীন হয়ে গেলাম। আর্টস সেকশনের অন্য ছেলেমেয়েরা ভাবল আমি হয় পাগল নয় অন্য গ্রহের জীব। এ অঞ্চলের নিয়ম হল, যে করেই হোক দরকারে পয়সা দিয়ে বাঁকাপথে হলেও সাইন্স পড়তে হবে। না হলে কমার্স। তাও যদি না জোটে তা হলেই একমাত্র আর্টস।
নমো নমো করে হায়ার সেকেন্ডারির দু বছর পার করে ফের ধাক্কা। রেজাল্ট, আমি চেষ্টা করলেও খারাপ হবে না। খারাপ করবই বা কেন? সেই ঝকঝকে নম্বর নিয়ে সংস্কৃত অনার্সে ভর্তির ইচ্ছে বাড়িতে জানাতেই, আমার মাতৃদেবী, যিনি কিনা অদ্যাবধিও এইসব শিক্ষাসংক্রান্ত ব্যাপারে নিজেকে জড়াননি, তিনি অবধি হাউমাউ করে উঠলেন।- বাবু, তোকে তখন কিছু বলিনি। কিন্তু এবার অন্তত নিজের ভালোটা একটু বোঝ। ইকনমিক্স নে, তোর বাবা যেমন বলছে। অমর্ত্য সেনের মত হ। দেশে বিদেশে সবাই নাম জানুক তোর। কত ইচ্ছে ছিল, তোর সঙ্গে গিয়ে সেসব দেশ দেখা হবে আমার।
সবাইকে অসীম শোকসাগরে ডুবিয়ে, সেই সংস্কৃত অনার্সেই ভর্তি হলাম।
বিধুজ্যাঠা একমাত্র প্রশংসা করে বলল,- একেবারে বুদ্ধিমানের মতো সাবজেক্ট বেছেচিস। ঠিকঠাক চললে ইস্কুল মাস্টারির চাকরিটা বাঁধা। আর বাংলা ইস্কুল তো ক্রমে উটেই যাবে। একবার ঢুকে পত্তে পাল্লে কাজ ছাড়াই মাইনে, চাকরির শুরু থেকেই পেনশন।
বাধা দিয়ে ধ্রুবকাকা বলল,- কাজ না করে পেনশন? বলচ কি বিধুদা? ইস্কুলে কেলাস না থাক, মিড ডে মিলের কাজ, ভোটের কাজ, এসব করবে কেডা?
★
এ সব অনেক কাল আগের কথা।
মনে হয় যেন গত জন্মের কথা। ধাপে ধাপে সিঁড়ি পেরিয়ে আমি এখন মায়ের স্বপ্নে দেখা সেই বিদেশটিদেশ অনেক ঘুরে এখন আবার দেশেই থিতু হয়েছি। আইআইএসসি বেংগালুরুতে। ঠিক ওই ইনস্টিটিউটেই না। তার ছড়ানো ক্যাম্পাসের বাইরে একটেরেতে প্রফেসর হরিহরণের সঙ্গে কাজ করছি। গোপন একটা সিন্দুকের কাজ।
স্যারের ভাষায় কাজটা হল অতীত সংশোধনের কাজ। আমাদের দেশে আড়াই তিন হাজার বছর আগেও অনেক বৈজ্ঞানিক ছিলেন। অনেক কাজ করে গেছেন তাঁরা। কিন্তু এটাও অনস্বীকার্য যে আধুনিক অনেক বিষয়ই তাঁদের অজানা ছিল।
হরিহরণ স্যারের মত হল, এই আধুনিক বিষয়গুলি যদি সেকালে পাঠানো যায়, তবে সেই কালের বিজ্ঞানীরা আরও চটপট আরও অনেক কিছু আবিষ্কার করতে পারবেন। ফলশ্রুতিতে পালটে যাবে বিজ্ঞানের সামগ্রিক ইতিহাস। আর সারা পৃথিবীতে আধুনিক ভারতবর্ষ হয়ে দাঁড়াবে বিজ্ঞানে এক নম্বর দেশ।
★
কী করছি এখানে। ওই সিন্দুকেরই ব্যাপার। বানাচ্ছি। আজ্ঞে না, সিন্দুক বানাচ্ছি না। সিন্দুকের ভিতরে যা থাকবে, বানাচ্ছি সেই জিনিস।
আমার সেই অতীত কালের ভালো ছাত্রের তকমা আর সংস্কৃত নিয়ে পড়া, মায় ডক্টরেট পোস্ট ডক আর তার পরের গবেষণা কাজ দিচ্ছে এতদিনে।
আমার গবেষণার বিষয় ছিল, প্রাচীন ভারতের বিজ্ঞান চর্চা। আর সেই সূত্র ধরেই হরিহরণ পৃথিবী ছানবিন করে তুলে এনেছেন আমাকে।
আমাকে বিশুদ্ধ সংস্কৃত ভাষায় অনুবাদ করতে হচ্ছে আধুনিক বিজ্ঞানের সব শাখার বই। পদার্থ বিদ্যা, রসায়ন বিদ্যা, জটিল ক্যালকুলাস সমেত অঙ্কশাস্ত্রের বই, জীববিদ্যা আর জেনেটিকসের বই।
সমস্ত বই তো আর অনুবাদ করা এক জীবনে সম্ভব না। মোটামুটি স্যারের বেছে দেওয়া আকরগ্রন্থগুলি বছর পাঁচেকের দিনরাত খাটুনিতে অনুবাদ করেছি।
এই প্রায় পাগল মানুষটি সিন্দুক বানিয়ে ফেলেছেন আগেই। এইবার এই সিন্দুকে পুরে বিজ্ঞানের আধুনিক জ্ঞান পাঠানো হবে সুদূর অতীতে। সংস্কৃতে লেখা সেই সব বৈজ্ঞানিক তথ্য জেনে অতীতের সেই তাঁরা আরও অনেক আবিষ্কার করে ফেলতে পারবেন সেই অতীত কালেই। যার ফলে আমরা এখন যেটুকু যা অগ্রগতি দেখছি বিজ্ঞানের তা একলাফে অনেকখানি এগিয়ে যাবে।
শুনলে কেমন জটিল ধাঁধার মতো লাগে। যেমন, কণাদকে যদি জানানো যায় ডালটনের পরমাণুবাদ বা অ্যাভোগাড্রো সংখ্যার ব্যাপারটা তাহলে পরে অনেক পরে আরও কত না নতুন তত্ত্ব চটপট আবিষ্কার হয়ে যাবে। রাদারফোর্ড আইনস্টাইন হাইজেনবার্গ যা যা বলেছেন সেই সময়েই জানতে পারলে হয় তো বা স্ট্রিং থিয়োরির অনেক পরের কিছু বার করে ফেলবেন তাঁরা। মানে, পৃথিবী এখন যা জানে না সব জানা হয়ে যাবে।
★
আমার অনুবাদের কাজ প্রায় শেষ। এই বার সিন্দুকের ভেতরে সেই অনুদিত বইয়ের প্রিন্টগুলো রাখতে হবে গুছিয়ে। খুব ভালো এ-৪ কাগজে প্রিন্ট করে বাঁধানো।
গুছোনোর কাজটা হরিহরণ স্যার নিজে করছেন।
এত ভারি একটা সিন্দুককে অতীত কালে পাঠাতে বিরাট শক্তি খরচ হবে। সেই শক্তি, হরিহরণ স্যার বলেছেন লোকাল ইলেকট্রিক সাপ্লাই থেকে পাওয়া সম্ভব না। তার জন্য তিনি পারমানবিক শক্তির পাওয়ার এঞ্জিন ব্যবহার করছেন। আলাদা একটা টিম সিন্দুকটার সেই ব্যাপারটা দেখছে।
সিন্দুকটার টেকনিকাল দিকটা বোঝা আমার পক্ষে সম্ভব না। আমি তো সেই অর্থে সাইন্সের লোক না। তবু যেটুকু বুঝেছি বলেছি।
স্যারকে জিজ্ঞাসাও করেছিলাম,- এটাকে সময়যান না বলে সময়-সিন্দুক বলছেন কেন স্যার? আসলে তো সময়-যানই।
– না হে সুবিমল। যান মানে তো যাত্রী থাকবে কেউ। এটায় করে জীবিত কোনও যাত্রী যাবে না। শুধু যাবে বই কটা।
– মানে এই যেগুলো আমি সংস্কৃতয় অনুবাদ করলাম?
– হ্যাঁ, শুধুমাত্র সেগুলিই। আধুনিক বিজ্ঞানের তথ্য-ভাণ্ডার। আর সেই জন্যেই এটাকে বানানো হয়েছে হুবহু সিন্দুকের মত করেই। এটার যে ঢাকনি দেখছ, এইটি অটোলক। একবার বন্ধ হয়ে গেলে, নিউক্লিয়ার বোমা চার্জ করেও একে খোলা যাবে না। আর বন্ধ হওয়া মাত্রই চালু হয়ে যাবে এর শক্তিশালী টাইম এঞ্জিন। জানো বোধ হয়, নিউক্লিয়ার এনার্জি ড্রিভন এঞ্জিন সেটা। সেই এঞ্জিনই একে পৌঁছে দেবে আড়াই হাজার বছর আগের ডিজায়ার্ড টাইম পয়েন্টে। তখন আপনা থেকেই খুলে যাবে এই সিন্দুকের ঢাকনা। আর বইগুলো এসে যাবে সে কালের বৈজ্ঞানিকদের আওতায়।
★
সেই সব বই গুছোতে সময় লাগছে বেশ। স্যার যত্ন করে এক এক বিষয়ের বই আলাদা আলাদা করে গুছোচ্ছেন। যেন জীবকের জন্য পাঠানো বইয়ের সঙ্গে আর্যভট্ট-বরাহমিহিরের বই না মিশে যায়। কিম্বা কণাদের বইয়ের সঙ্গে ভাস্করাচার্যর বই। যদিও আমার মাথায় ঢুকছে না, এক এক সময়ের বিজ্ঞানীরা যাঁর যাঁর বই খুঁজে পাবেন কী করে।
প্রায় হয়ে এসেছে গুছোনো। আগামীকাল সিন্দুকের ডালা বন্ধ করিয়ে তাকে রওনা করানো হবে।
★
সেই আগামীকালের আগেই ভূমিকম্পটা হল। বই গুছোনো শেষ হয়ে গেছিল। স্যার বেরিয়েও এসেছিলেন। সিন্দুকের ডালার সেফটি লক খোলা হয়েছে সবে, এমন সময় স্যারের খেয়াল হল ডিএনএ-র ওপরে লেখা বইটা নিউক্লিক অ্যাসিড কথাটা থাকায় ভুল করে রসায়নের বইয়ের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। আসলে তো জেনেটিক্স। জীববিদ্যার বইয়ের সঙ্গে যাবে। স্যার ওই সিন্দুকের ভেতরে আবার ঢুকলেন।
এমন সময়ে থ্রি পয়েন্ট এইট রিখটার স্কেলের ভূমিকম্পটা হল। এমন কিছু বেশি মাপের নয়। এই বাড়ির একটা দুটো কাচের জানলায় চিড় ধরল শুধু। তার বেশি কিছু না।
কিন্তু বিপদ যেটা হল, সিন্দুকের ডালাটা আচমকা নড়ে উঠে ঝপ করে পড়ে গেল।
সর্বনাশ! হরিহরণ স্যার যে এখনও ভেতরে। আমি ছুটে গিয়ে ডালা তোলার ব্যর্থ চেষ্টা করলাম। অটোলক যে খুলবে না, স্যার আগেই বলেছিলেন। একটা গুম গুম আওয়াজ হচ্ছে। টাইম এঞ্জিন চালু হয়ে গেছে প্রোগ্রাম মেনে। তিন মিনিটের মধ্যে স্যারকে ভেতরে নিয়েই কুয়াশার মত মিলিয়ে গেল অত বড় সিন্দুকটা।
★
আমার পাসপোর্ট আটকে দিয়েছিল পুলিশের ইনভেস্টিগেটিং টিম। স্যারের মত আন্তর্জাতিক খ্যাতিমান মানুষ উধাও হওয়া তো মুখের কথা নয়। অনেক কষ্টে সিন্দুকের কাহিনিটা বিশ্বাস করিয়েছি ওদের।
দেশ ছেড়ে আবার বিদেশে। হার্ভার্ডের স্যাংস্কৃট অ্যান্ড ইন্ডিয়ান স্টাডিজ ডিপার্টমেন্টে।
★
কয়েকদিন আগে অনেক পুরোনো একটা পুঁথির ফোটোকপি এসেছে ডিপার্টমেন্টে। তার মর্মোদ্ধারের ভার পড়েছে আমাদের টিমের ওপর।
সেই পুঁথিতে লেখা,- রাজসভায় এক উন্মাদ সন্ন্যাসী উপস্থিত হয়েছে। সে অদ্ভুত তথ্য লেখা প্রচুর ভুর্জপত্র এনেছে। সেই ভুর্জপত্রগুলিও নতুন ধরণের। হরি নামের সেই উন্মাদটিকে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়েছে। অশৈলী জ্ঞানে ভূর্জপত্রগুলিকে অগ্নিতে নিক্ষেপ করা হয়েছে।
হরিহরণ স্যার বিজ্ঞানের ইতিহাস পাল্টাতে চেয়েছিলেন। খুব অল্প মাত্রায়ই পেরেছেন।
পাল্টাতে পেরেছেন শুধু তাঁর ব্যক্তিগত ইতিহাসটুকুই। প্রকৃতি ইতিহাসের ব্যাতিচার সহ্য করে না।