চোখ-কান-মন যদি খোলা রাখা যায়, তাহলে জীবনের বিভিন্ন দিক দেখার সুযোগ ডাক্তারি পেশায় যেমন করে ঘটে – ঘটে অনায়াসেই – তেমনটা খুব কম পেশাতেই সম্ভব।
বিশেষ করে সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থায় যুক্ত থাকলে, আরও নির্দিষ্ট করে বললে প্রত্যন্ত অঞ্চলে সরকারি চিকিৎসাব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত থাকলে, সত্যিকারের জীবন বিষয়ে জানার সুযোগ ঘটে, যে জীবনের খবর ‘জীবন মানেই জি-বাংলা’ তো দেয়ই না, আর পাঁচটা সংবাদমাধ্যম খুঁটিয়ে দেখলে/পড়লেও সে সুযোগ পাওয়া যায় না।
হাসপাতালে আসা রোগী-পরিজনের সঙ্গে গল্পগাছা করলে অনেক খবর জানা যায়, আবার প্রশাসক-আধিকারিকদের কাছে যেসব অভাব-অভিযোগ-সমস্যার কথা উঠে আসে, সেখান থেকে আরও বিভিন্ন ছবি ভেসে ওঠে। আমাদের মূলত কলকাতা-কেন্দ্রিক জীবন, মিডিয়াতেও তারই প্রতিচ্ছবি, তার থেকে এই বাস্তব এতখানিই দূরের দেখলেশুনলে মনে হয়, যে, এসব যেন এক অন্য গ্রহের ঘটনা।
আড্ডা মারার অভ্যেস আমার সেই ছেলেবেলা থেকেই। হাসপাতালেও কাজকর্ম যখন থাকে না, তখন আড্ডা মারতাম, এখনও মারি। মাঝেমধ্যে ক্যান্টিনে, বা সামনের চায়ের দোকানে – কখনও বা হাসপাতাল প্রশাসকদের ঘরে বা অন্য ডিপার্টমেন্টে – কাজ এবং কাজের ফাঁকে ফাঁকে আড্ডা।
এরকমই একদিন এক ঘনিষ্ঠ অনুজের সঙ্গে আড্ডা হচ্ছিল। সে ফরেন্সিক মেডিসিন পড়ায়। একটা পোস্টমর্টেম রিপোর্ট লিখতে ব্যস্ত ছিল, ফাঁকে ফাঁকে কথাবার্তা হচ্ছিল। পোস্টমর্টেম ও পুলিশ ইনকোয়েস্ট রিপোর্ট পড়াটা আমার কাছে চিরকালই ফ্যাসিনেটিং। গোয়েন্দা গল্পের উত্তেজনার সারাৎসার যেন লুকিয়ে থাকে তাতে। আবার অন্যান্য তথ্যও জানা যায়। যেমন, এ বছর হাতির আক্রমণে আশেপাশের গ্রামগুলোতে ঠিক কতজন মারা গিয়েছেন – সংখ্যাটা চমকে দেওয়ার মতো – তার কোনও খবর মিডিয়া না দিলেও পোস্টমর্টেম-এর সংখ্যা দিয়ে আন্দাজ পাওয়া যায়।
তো সেদিনকার রিপোর্ট অবশ্য খুবই সাধারণ। বছর পনেরোর একটি মেয়ে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। বাড়ি থেকে একটু দূরে একটা ফাঁকা জায়গায় গাছের ডালে ওড়না দিয়ে নিজেকে ঝুলিয়ে দিয়েছে। দুপুরবেলায়।
দেখে বড় মনখারাপ হয়ে গেল। আজকাল বাচ্চাকাচ্চারা এত অধৈর্য!! নিশ্চয়ই প্রেমঘটিত ব্যাপার, অথবা পড়াশোনা-পরীক্ষা নিয়ে বাড়িতে বকাঝকা – তার জন্য এই!! বাপমায়ের কথা একবারও ভাবল না!
ইনকোয়েস্ট রিপোর্ট পড়ে দেখলাম অন্য ঘটনা। মেয়েটির বিয়ে হয়েছিল। পাশের গ্রামে। থাকতে না পেরে বছরখানেকের মধ্যেই ফিরে এসেছে (শ্বশুরবাড়ির অভিযোগ, মেয়েটিরই নাকি মানসিক সমস্যা ছিল)। তারপর থেকেই বাড়িতে বিষণ্ণ হয়ে থাকত। আর তার পর এই…
আমার সেই অনুজ, ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞ, বলল – এরকম তো অনেকই হয়, কিন্তু ইন্টারেস্টিং ব্যাপারটা হলো, এই পার্টিকুলার কেসটা এখন হাই প্রোফাইল হয়ে গিয়েছে, কেননা বিডিও চাপে পড়ে গেছে।
বিডিও চাপে পড়ে গেছেন? কেন?
আরে বুঝতে পারছেন না? বিডিও তো রেগুলার রিপোর্ট দিচ্ছেন, যে, এই অঞ্চলে নাবালিকা-বিবাহ সম্পূর্ণ বন্ধ করে ফেলা গেছে। আর এদিকে এই মেয়েটার মৃত্যুই প্রমাণ, যে, নাবালিকা-বিবাহ, কমবেশি যা-ই হোক, কোনোমতেই জিরো হয়নি।
তো অবাক হয়ে গেলাম। পুরোটাই একটা নিষ্ঠুর রসিকতা বলে মনে হলো।
সদ্য জগদ্বিখ্যাত ল্যান্সেট পত্রিকায় এদেশের বিভিন্ন রাজ্যে নাবালক/নাবালিকাদের (১৮ বছরের কম বয়সী) বিয়ে বিষয়ে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে (লিঙ্ক কমেন্টে রইল, ফ্রি আর্টিকল, চাইলেই পড়ে দেখতে পারেন)। নাবালিকা বিবাহ যে এক অর্থে মানবাধিকার লঙ্ঘনের তুল্য এবং যৌন ও সামাজিক নির্যাতনের পথ প্রশস্ত করে, তা আন্তর্জাতিক মহলে মোটামুটি সর্বজনস্বীকৃত। তো গবেষণাপত্রে প্রকাশিত তথ্য স্তম্ভিত করে দেওয়ার মতো।
১৯৯৩-২০২১ – এই বিস্তীর্ণ সময়কালের তথ্য সেখানে রয়েছে। এই পুরো সময় ধরে লাগাতার লাল-রঙে দাগানো (হার চল্লিশ শতাংশের অধিক) নাবালিকা-বিবাহের হার বজায় রাখতে পেরেছে কেবলমাত্র একটিই রাজ্য – পশ্চিমবঙ্গ।
এই প্রায় তিনদশক সময়কালের মধ্যে দেশের প্রায় সব রাজ্যেই নাবালিকাদের বিবাহের হার কমেছে। কমেছে এই রাজ্যেও। কিন্তু সেই হ্রাসের হার বাকি রাজ্যের তুলনায় ঢের কম। সেই সুবাদেই, ১৯৯৩ সালে, নাবালিকা বিবাহের ব্যাপারে দেশের মধ্যে আমাদের রাজ্যটি ছিল আট নম্বরে – কিন্তু বর্তমানে আমরা শীর্ষস্থান অধিকার করতে সক্ষম হয়েছি।
আরও উদ্বেগের বিষয় – ২০১৬ থেকে ২০২১, অর্থাৎ সাম্প্রতিক পাঁচ বছরে – দেশের মধ্যে মাত্র গুটিকয়েক রাজ্যেই নাবালিকাদের বিবাহের হার বাড়তে শুরু করেছে। এবং সেই গুটিকয়েকের মধ্যে জ্বলজ্বল করছে এই রাজ্যের নাম।
অথচ সাম্প্রতিককালের এই বছরগুলোতেই রাজ্যে হইহই করে চালু হয়েছে ও চলেছে কন্যাশ্রী ইত্যাদি প্রকল্প। শুনতে পাই, সেসব সমাজকল্যাণমূলক প্রকল্প নাকি দেশবিদেশ থেকে প্রাইজও পেয়েছে। এবং এসব প্রকল্পের অন্যতম ঘোষিত লক্ষ্য ছিল নাবালিকা-বিবাহের হার কমিয়ে আনা। কিন্তু বাস্তবে তবে ঠিক কী ঘটেছে?