সকাল থেকে অগুনতি শুভেচ্ছাবার্তা পেয়েছি। খুব ইচ্ছে থাকলেও সবাইকে উত্তর দিতে পারিনি। আশা করি, অক্ষমতা মাফ করবেন। আমার মতো নিতান্ত ক্ষুদ্র মানুষ এত ভালোবাসা আর আশীর্বাদের যোগ্য কিনা সত্যিই জানি না।
আমি তো মাঝেমাঝেই আমার বন্ধুদের কাছে ইয়ার্কি করে বলি, শিশু-দিবসে যার জন্ম তাকে তো শিশু-চিকিৎসক হতেই হ’ত। শিশুর চিকিৎসা চিকিৎসাশাস্ত্রের অন্যান্য বিষয়গুলোর থেকে অনেকটা অন্যরকম। এখানে অধিকাংশ সময়েই রোগী নিজের অসুবিধের কথা বলতে পারে না। হয়তো স্রেফ কান্না! সেটা থেকেই হাজারো রোগের রহস্যভেদ! সুস্থ হওয়ার পর শিশুর হাসিটুকুর জন্যই চিকিৎসক হয়ে ওঠা সার্থক। ওয়ার্ডে বসে এসব সাত-পাঁচ ভাবছিলাম। হঠাৎ, পিঠে কারো হাত.. দেখি বিশ্বজিৎ (নাম পরিবর্তিত) দাঁড়িয়ে আছে..
– কী রে.. কিছু বলবি?
– আমার তো সকালে জ্বর নাই..
– হুঁ.. নেই তো..
– আমারে বাড়ি যেতে দিবা না ডাক্তার কাকু?
– বাড়ি যাবি? আচ্ছা, আমাকে নিয়ে যাবি?
– তুমি খেলবা আমার সাথে? আমার দুটা বল আছে.. খেলবা?
– হ্যাঁ রে বাবু, খেলবো। আচ্ছা.. তুই এখন বেডে যা। আমি একটু কাজ সেরে নিই.. তারপর তোর কাছে আসছি।
বিশ্বজিৎ দিন পাঁচেক আগে ভর্তি হয়েছে। সুন্দরবনের কোনও এক প্রত্যন্ত গ্রামে বাড়ি। বাবার সামান্য চাষবাস আর নদীতে মাছ ধরা জীবিকা। তিন সপ্তাহ জ্বর কাটে না দেখে শহরের বড় হাসপাতালে এসেছে। তিন সপ্তাহে শরীরের বিভিন্ন জায়গায় লাল-কালো ছোপ পড়েছে। সন্দেহের ভিত্তিতে হাড়ের রস নিয়ে পরীক্ষা করতেই ধরা পড়ে লিউকিমিয়া! রক্তের ক্যান্সার! বাবা-মাকে সব বুঝিয়ে বলা হয়েছে। সাত বছরের শিশু স্বাভাবিকভাবেই এতসব বোঝে না। শরীরে রক্ত কমে গেছিল মারাত্মকভাবে, সঙ্গে মাত্রাছাড়া ইনফেকশন। ওষুধপত্র, ইঞ্জেকশন আর রক্ত পাওয়ার পরে এখন অনেকটা ভালো আছে। তাই ওয়ার্ডের এ মাথা থেকে ও মাথা ছুটে বেড়াচ্ছে। যদিও আসল চিকিৎসা শুরু না হ’লে এই আপাত সুস্থতা বেশিদিন থাকবে না। লিউকিমিয়ার চিকিৎসা এখন অনেক উন্নত। অনেকেই সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যায়। কিন্তু, চিকিৎসায় যথেষ্ট সময় লাগে, শ্রম লাগে, টাকাপয়সা লাগে আর ভীষণরকম মানসিক জোর লাগে। বিশ্বজিতের বাবা-মা সবটা বুঝলো কিনা কে জানে.. ওই অবুঝ গ্রাম্য-সারল্যে ভরা চোখমুখের ওপর দিয়ে কী সাংঘাতিক একটা একটা ঝড় বয়ে যেতে চলেছে..
সমাজের উঁচু মিনারে বসে থেকে কল্পনা করা কঠিন- সুন্দরবনের অজ-পাড়াগাঁ থেকে কোলকাতায় এসে বড় হাসপাতালে ভর্তি করা আর চিকিৎসার পরবর্তী ধাপগুলো সামাল দেওয়া কতখানি কঠিন! এ ক’দিন রোজগার বন্ধ। অনিয়মিত খাওয়া। ঘুম নেই। তার সাথে দৌড়ে বেড়ানো.. বিশ্বজিতের ছোট্ট শরীরটায় অজস্র ছুঁচ ঢুকে যাবে নির্দয়ভাবে। চুল উঠবে, শরীর ভাঙবে, জীবাণুদের বৃষ্টি-রোদের খেলা চলবে.. অমানবিক যুদ্ধ! তারপর হয়তো বিশ্বজিৎ হাসপাতাল থেকে ছুটি পেয়ে বাড়ি ফিরবে। অথবা, হয়তো অন্যরকম ‘ছুটি’ পাবে.. চিরস্থায়ী ছুটি.. যেখানে মায়ের উষ্ণতা নেই.. পুকুরপাড় নেই.. খেলার বল নেই..
যখন প্রথম ডাক্তারি শিখছি সে সময় এসব ‘কেস’ ডায়াগনোসিস করতে পারলে নিজের পিঠ চাপড়ে দিতাম। রোগ ধরা তখন শুধুই গোয়েন্দাগিরি ছিল। এখন বয়স আর অভিজ্ঞতার ছাপ পড়ছে.. রোগ আর রোগীর দিগন্ত পিছিয়ে যাচ্ছে.. রোজ আরও দূর অব্দি দেখতে পাচ্ছি.. মারীর দেশ। যন্ত্রণার দেশ। আজকাল ঘুমের মধ্যে বড্ড মৃত্যু দেখতে পাই। ছেড়ে যাওয়া কাছের মানুষ স্বপ্নে ফিরে ফিরে আসে..
টেবিলের ধারের মেয়েটা এখন অনেকটা সুস্থ। জ্বর আর খিঁচুনি নিয়ে ভর্তি হয়েছিল। আর ক’টা টেস্ট হয়ে গেলেই ছুটি হয়ে যাবে। এখন বিছানায় বসে বই পড়ছে। আমার বাচ্চাদের বই পড়া দেখলেই একটু নাক গলানো স্বভাব..
– কী বই পড়ছিস রে?
– ঠাকুমার ঝুলি?
– ঠাকুমার ঝুলি? কই দেখি দেখি..
(একটা পাতলা, রঙচঙে বই বের করে দেখালো)
– না রে বাবা, এটা আসল ‘ঠাকুমার ঝুলি’ নয়। এটা নকল বই।
– আসল নয়?
– না। আসল ‘ঠাকুমার ঝুলি’ কার লেখা জানিস?
– এই তো সঞ্জয় দাস। লেখা আছে দেখো..
– না রে.. আসল বইয়ের লেখক দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার।
– কী কঠিন নাম!
– হ্যাঁ। আর সেই বইটার ভূমিকা কে লিখেছেন জানিস?
– কে?
– আমাদের রবি ঠাকুর। মনে থাকবে?
– হ্যাঁ।
বলে ঘাড় দোলালো। তারপর হেসে বললো..
– হ্যাপি দিওয়ালি কাকু..
– দিওয়ালি নয় বাবা। দীপাবলি। বাংলা ভাষাটা খুব সুন্দর আর খুব মিষ্টি। বাংলায় বললে আরও ভালো লাগে। মনে রাখিস, কেমন?
***
পরপর দু’দিন ২৪ ঘন্টা ডিউটি। বাড়ি যাওয়া হ’ল না। আমার বদলে আরশি মায়ের হাতে বানানো কেক কেটে, পায়েস খেয়ে বাবাকে ‘হ্যাপি বার্থডে’ গান শুনিয়ে দিয়েছে। আপাতত সেসব ভিডিও দেখতে দেখতেই এবারের জন্মদিন কেটে গেল। আরও একবছর বুড়িয়ে গেলাম।
যে শিশুরা বাড়িতে আছে, যারা এখনো বাড়ি ফিরতে পারে নি কিংবা যাদের বাড়িই নেই- তাদের সবার ভালো হোক। শিশু-দিবসে এর চেয়ে বেশি আর কীই বা চাওয়া যায়?
ভালো লেখা। ভালো থাকবেন।