আজকের কথা নয়, ক্যানসার অসুখটা চিরকালই গোলমেলে – এতটাই গোলমেলে, যে অসুখটার নাম শুনলেই অনেকে আশা হারিয়ে ফেলেন। শুধুমাত্র গত শতকটিতেই চিকিৎসাবিজ্ঞানের যে অগ্রগতি হয়েছে, মানবসভ্যতার বাকি সব বছরগুলো মিলিয়েও সম্ভবত ততোখানি হয়নি। সেই শতকের মোটামুটি দ্বিতীয়ার্ধ থেকে শুরু করলে, যে সময় থেকে ক্যানসার গবেষণা গতি পেয়েছে, এতগুলো দশক জুড়ে এত গবেষণার শেষেও, বাড়াবাড়ি পর্যায়ের ক্যানসারে যাঁরা আক্রান্ত, তাঁদের অধিকাংশেরই পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠার সম্ভাবনা কম। হ্যাঁ, ক্যানসারে আক্রান্ত মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে – কিন্তু, তার কতোখানি উন্নত পরীক্ষানিরীক্ষা করে তাড়াতাড়ি ডায়াগনোসিস হওয়ার কারণে, আর কতোখানি চিকিৎসার উন্নতির জন্য, নির্ধারণ করা মুশকিল। হ্যাঁ, ক্যানসার আক্রান্ত মানুষের সামনে চিকিৎসা করানোর চয়েস বা অপশন প্রচুর – কিন্তু, তার অধিকাংশই এমন ব্যয়বহুল, চিকিৎসা এমনই দীর্ঘমেয়াদি, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এতটাই বেশী, সেই চয়েসের মধ্যে বেছে নেওয়া সহজ নয়।
আর আজ থেকে চল্লিশ কি পঁয়তাল্লিশ বছর আগে? যেসময় লিনাস পলিং প্রাণপণ প্রচার করছিলেন ভিটামিন সি প্রচুর বেশী পরিমাণে খাওয়া হলে ক্যানসার ঠেকানো যায় তো বটেই, এমনকি সারিয়ে ফেলাও সম্ভব??
১৯৭১ সালে স্কটিশ সার্জেন ইউয়ান ক্যামেরনের ধারণায় ভর করে লিনাস পলিং ন্যাশনাল একাডেমি অফ সায়েন্সেস-এর জার্নালে একখানা গবেষণাপত্র পাঠিয়ে বসলেন (সহলেখক, অবশ্যই ক্যামেরন-সাহেব) – মুখ্য উপপাদ্য, দিনে দশ গ্রাম (মনে করিয়ে দেওয়া যাক, ভিটামিন সি-র দৈনিক ধার্যমাত্রা মাত্র ষাট মিলিগ্রাম) করে ভিটামিন সি খাওয়ানো গেলে ক্যানসার রোগীদের ক্ষেত্রে চমৎকার সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। আগের পর্বগুলোতেই বলেছি, পলিং স্বয়ং ন্যাশনাল একাডেমি অফ সায়েন্সেস-এর সদস্য হওয়া সত্ত্বেও, সেই পেপার প্রত্যাখ্যাত হয় – এবং, পলিং-এর মাপের প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানীর ক্ষেত্রে, সে এক চূড়ান্ত অসম্মান – বিজ্ঞানী হিসেবে তাঁর সুনাম এই একটি প্রত্যাখ্যানে অনেকটাই আহত হয়।
কিন্তু, পলিং ছাড়ার পাত্র নন – অঙ্কোলজি জার্নালে শেষমেশ পেপারটি প্রকাশ করেই ছাড়লেন – যার পাঠক, মূলত, ক্যানসার-চিকিৎসকেরা। সমস্যা এই, পেপার প্রত্যাখ্যানের চাইতেও এই পেপারের প্রকাশ পলিং-এর বেশী বেইজ্জতি ঘটালো। এমনকি যাঁরা ক্লিনিকাল ট্রায়াল ডিজাইনিং-এর খুঁটিনাটি তেমন বোঝেন না, তাঁরাও জানেন – ট্রায়ালে দুটো গ্রুপের রোগীদের মধ্যে তুলনা করতে হলে দু-ভাগের রোগীদের যথাসম্ভব তুল্যমূল্য হওয়া জরুরী – একমাত্র তাহলেই নতুন চিকিৎসা কার্যকরী কিনা, তার আন্দাজ পাওয়া সম্ভব। দেখা গেল, পলিং ও ক্যামেরনের ট্রায়ালে তেমন কোনো চেষ্টাই হয় নি – ট্রায়ালে যাঁরা ভিটামিন সি মেগাডোজ পেয়েছেন, তাঁরা চিকিৎসার আগেই অন্য গ্রুপের রোগীদের চেয়ে বেশী সুস্থসবল ছিলেন, স্বভাবতই, ভিটামিন সি খান বা না খান, এমনিতেই তাঁদের বাকিদের তুলনায় সেরে ওঠার সম্ভাবনা বেশী। এমন ট্রায়াল দিয়ে, আর যা-ই হোক, ভিটামিন সি-র কার্যকারিতা প্রমাণ করা সম্ভব নয়। এর আগে অন্যান্য ট্রায়াল দিয়ে ভিটামিন সি দিয়ে যে সাধারণ অসুখবিসুখ সারানো সম্ভব নয়, তার প্রমাণ মিলেছিল – পলিং-এর এমনতর গোঁজামিল দিয়ে উল্টো প্রমাণের চেষ্টায় সেই কথা যেন আরো বেশী নিশ্চিত হয়ে গেল – মাঝখান থেকে চিকিৎসক-গবেষক বিজ্ঞানীমহলে পলিং নিজের বিশ্বাসযোগ্যতা হারালেন।
কিন্তু, চিকিৎসক বা বিজ্ঞানীরা তাঁর কথা বিশ্বাস করুন বা না করুন, আমজনতার কাছে, সর্বোপরি মিডিয়ার কাছে পলিং-এর গ্রহণযোগ্যতা ছিল প্রশ্নাতীত। প্লাস, তাঁর একটা বড় সুবিধে ছিল, তিনি ছিলেন সুবক্তা, এবং সাথে ছিল অসম্ভব ক্যারিশমাটিক ব্যক্তিত্ব – জনসাধারণের বোধগম্য করে জটিল তথ্য পরিবেশনের ক্ষেত্রে তো বটেই, এমনকি রসায়নের অ্যাকাডেমিক বক্তৃতার ক্ষেত্রেও তাঁর বাচনশৈলী ছিল নাটকীয় ও আকর্ষণীয়। আর ঠিক এই সুযোগটাই কাজে লাগালেন তিনি। ভিটামিন সি মেগাডোজ খেয়ে ক্যানসার থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব, এই কথা বলে যেতে থাকলেন লাগাতার – বিভিন্ন জায়গায়, বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে, কারণে-অকারণে।
মাথায় রাখুন, ক্যানসার চিকিৎসা ব্যাপারটা সেসময় একেবারেই প্রাথমিক স্তরে। লিনাস পলিং যে বছর ভিটামিন সি খাইয়ে ক্যানসার নিকেশ করার দাবী করছেন, কাকতালীয়ভাবে ঠিক সেবছরেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ক্যানসারের বিরুদ্ধ যুদ্ধ ঘোষণা করছেন – ১৯৭১-এর ডিসেম্বরে ঘোষণা হল ওয়ার অন ক্যানসার – ১০০ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করেই ক্যানসারকে দুনিয়া থেকে ভ্যানিশ করে ফেলা যাবে – পলিং কিম্বা প্রেসিডেন্ট নিক্সন, দুজনের ঘোষণার ক্ষেত্রেই সদিচ্ছে আর উচ্চাশার অভাব না থাকলেও, তথ্যপ্রমাণ বা বাস্তববোধ ছিল না।
ক্যানসার রেডিওথেরাপির যেসব আধুনিক টেকনোলজি আজকাল দেখা যায়, তার কোনোটিই তখনও সম্ভব হয়নি। কেমোথেরাপি ওষুধ তো হাতে গোনা – বায়োলজিকাল থেরাপি সুদূর ভবিষ্যতের গর্ভে। ক্যানসার রোগীদের জন্য সে এক জটিল সময় – কেননা, তার আগে পর্যন্ত ক্যানসারে আরোগ্যের আশা প্রায় ছিলই না – এখন লাগাতার প্রচারের ঢক্কানিনাদে আশার আলো দেখা গেল, কিন্তু সেই আশার পিছনে যথেষ্ট যুক্তি রইল না।
লিনাস পলিং-এর দাবীর গ্রহণযোগ্যতার পেছনে পলিং-এর বিশ্বাসযোগ্যতা বাদ দিয়েও বড় কারণ ছিল, এক দুরারোগ্য ও চূড়ান্ত যন্ত্রণাদায়ক ব্যাধির খুব সরল সমাধান – সস্তা ও সহজলভ্য টোটকা – আর এমন তো নয়, যে, বাকি পদ্ধতিগুলো প্রয়োগ করে দারুণ কিছু সাড়া পাওয়া যাচ্ছিল!! অতএব, ক্যানসার রোগী ও পরিজনেরা ক্যানসার-চিকিৎসকদের জোরাজুরি করতে শুরু করলেন – প্রায় বাধ্য করলেন ভিটামিন সি প্রেসক্রাইব করতে।
অঙ্কোলজিস্টরা পড়লেন মহা বিপাকে। তাঁরা জানেন, নিশ্চিতভাবেই জানেন, যে, ভিটামিন সি দিয়ে ক্যানসার সারতে পারে না। বিভিন্ন ট্রায়াল থেকে ভিটামিন সি-র তথ্যই পাওয়া যায় নি – পলিং-ক্যামেরনের ট্রায়াল তো হাসিঠাট্টার পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে – কিন্তু রোগী-পরিজনকে সেকথা বুঝিয়ে ওঠা যাচ্ছে না। কিছু বলতে গেলেই, তাঁরা বলছেন, আচ্ছা, নোবেল লরিয়েট লিনাস পলিং ভুল বলছেন আর আপনি ঠিক!! তা, আপনার নোবেল প্রাইজখানা কোথায়??
যুগ বদলায়, দেশ বদলায় – কিন্তু, খেয়াল করুন, ডাক্তারবাবুদের আজও ঠিক এধরণের প্রশ্নই শুনতে হয় – দাক্ষিণাত্যে চিকিৎসা-পর্যটনের পর সেই প্রেসক্রিপশন হুবহু অনুসরণ করতে না চাইলে এইরাজ্যের ডাক্তারবাবুদের হামেশাই শুনতে হয় – কর্পোরেট হাসপাতালে খরচের ধাক্কা সামলাতে না পেরে সরকারি হাসপাতালের শরণাপন্ন পরিজনদের একাংশও সরকারি ডাক্তারবাবুদের ঠিক এই প্রশ্নটাই করে থাকেন – এত বড় বড় ডাক্তার যেকথা বলছেন, সেটা মানতে চাইছেন না!! ওঁদের চাইতে আপনি বেশী বোঝেন!! কিন্তু, সে ভিন্ন প্রসঙ্গ – আপাতত ভিটামিন সি-তে ফিরি।
প্রেসক্রিপশনে লাগাতার ভিটামিন সি লিখতে লিখতে তিতিবিরক্ত ডাক্তারবাবুরা নতুন করে ক্লিনিকাল ট্রায়ালের আয়োজন করলেন। মেয়ো ক্লিনিকের চার্লস মের্টেল বাছলেন দেড়শ জন ক্যানসার রোগী – যাঁদের সবারই অসুখ বাড়াবাড়ি পর্যায়ে – তাঁদের দুটো দলে ভাগ করা হল – এঁদের মধ্যে একটি দল পেতে থাকলেন পলিং-ক্যামেরনের তত্ত্ব অনুসারে দৈনিক দশ গ্রাম ভিটামিন সি, অপর দলটি বাদ। দেখা গেল, চিকিৎসকরা আগাগোড়া যা জেনে এসেছিলেন তা-ই – ক্যানসারের নিরাময় তো দূরের কথা, মৃত্যুহার কমানো, এমনকি উপসর্গের উপশমের সাথেও ভিটামিন সি-র কোনো যোগাযোগ নেই। ট্রায়ালটি প্রকাশিত হল চিকিৎসাবিজ্ঞানের সবথেকে জনপ্রিয় জার্নাল নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অফ মেডিসিনে।
কিন্তু, মানতে চাইলেন না পলিং। বেজায় খাপ্পা হয়ে জার্নাল কর্তৃপক্ষের কাছে একখানা চিঠি লিখে বসলেন – বললেন, ভিটামিন সি কাজ করে নি, কেননা করার কথা-ই ছিল না। ট্রায়ালটাই তো ভুল – মের্টেল তো গোড়ায় গলদ করে বসে আছেন। ট্রায়ালের রোগীরা আগে থেকেই কেমোথেরাপি পেয়েছেন – আর, ভিটামিন সি কার্যকরী হয় একমাত্র তাঁদের ক্ষেত্রেই, যাঁরা কিনা কেমোথেরাপি পাননি (যদিও, এমন কোনো কথা এর আগে পলিং জানান নি)।
মের্টেল দমলেন না। নতুন করে ট্রায়াল শুরু করলেন – এবং প্রমাণ করে দিলেন, না, কেমোথেরাপি পান বা না পান, কোনোধরণের ক্যানসার রোগীর ক্ষেত্রেই ভিটামিন সি-র বাড়তি কোনো ভূমিকা নেই – নিরাময় কিম্বা উপশম, ভিটামিন সি মেগাডোজ কোনোভাবেই কার্যকরী নয় – নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অফ মেডিসিন-এ ১৯৮৫ সালে প্রকাশিত হল ট্রায়ালের বিশদ রিপোর্ট।
লিনাস পলিং ব্যাপারটা প্রায় ব্যক্তিগত অপমান হিসেবে নিলেন। পরবর্তীকালে, সঙ্গী ক্যামেরন বিস্মিত হয়ে বলেছিলেন, বিজ্ঞানের দুনিয়ায় একজন ভুল প্রমাণিত হতেই পারেন – কিন্তু, পলিং-কে এত রেগে যেতে আমি কখনো দেখিনি – তিনি ব্যাপারটাকে প্রায় নিজের বিশ্বাসযোগ্যতা বা বৈজ্ঞানিক সততার প্রতি চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছিলেন। শোনা যায়, পলিং নাকি জার্নাল কর্তৃপক্ষ এবং চার্লস মের্টেলের বিরুদ্ধে জনসাধারণকে ইচ্ছাকৃতভাবে বিভ্রান্ত করা হয়েছে বলে মামলা করতে চেয়েছিলেন – শুভানুধ্যায়ীরা বুঝিয়েসুঝিয়ে তাঁকে নিরস্ত করেন।
ভিটামিন প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে লিনাস পলিং-এর গল্পের বাইরে বেরোনোই হচ্ছে না। আসলে, এ এমন এক সময়ের গল্প, যখন সদ্য ভিটামিনের গঠনপ্রকৃতি সদ্য আবিষ্কৃত হয়েছে – একটি একটি করে ভিটামিন কেমিকাল ল্যাবে তৈরী করা শুরু হয়েছে – প্রাকৃতিক উপাদান থেকে ভিটামিনযুক্ত নির্যাসের পরিবর্তে আসছে কারখানা-জাত কৃত্রিম ভিটামিন – মানুষের স্বাস্থ্য-বিষয়ক অনিশ্চয়তা আর দুশ্চিন্তাকে উসকে দিয়ে সেই বাজার বাড়ছে হু হু করে – কর্পোরেট বহুজাতিক প্রতিনিয়ত ভেবে চলেছে এই বাজার আরো একটু বাড়িয়ে নেওয়া যায় কোন পথে – আর সময়ের এই আশ্চর্য সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে রয়েছেন এক আশ্চর্য বিজ্ঞানী – যাঁর বিভ্রান্তিকে ব্যবহার করে আখের গোছাচ্ছেন কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষ।
তবু, দিনের শেষে প্রশ্ন এটাই – প্রথম থেকেই সবধরনের ট্রায়ালেই যখন বোঝা যাচ্ছে, যে, সাধারণ অসুখবিসুখ বা ক্যানসার, কোনোটা সারানোর ক্ষেত্রেই ভিটামিন সি-র কোনো ভূমিকা নেই, তখন লিনাস পলিং-এর মাপের বিজ্ঞানী এমন বিভ্রান্ত হলেন কী করে? আর বিভ্রান্ত যদি বা হলেন, এমন একবগগা হয়ে সেই বিভ্রান্তি আঁকড়ে রইলেনই বা কেমন করে??
(চলবে)
খুব সুন্দর সময়পযোগী লেখা হয়েছে।এ সময় এরকম ধরনের একটা লেখা খুব প্রয়োজন ছিল যখন সরকার থেকে বলা হচ্ছে যে হোমিওপ্যাথি ওষুধ,কি যেন একটা নাম, খেলেই করোনাভাইরাস সেরে যাবে বা গো চোনা তে আছে ক্যান্সারের ওষুধ, তখন এরকম লেখার খুব প্রয়জন।
অসাধারণ হচ্ছে। ?