তবে কি লিনাস পলিং একবারের জন্যেও বুঝতে পারেন নি, যে তিনি বড় ভুল করে ফেলছেন? ভুলের পর আরো ভুল করে চলেছেন? এমন অসামান্য বিজ্ঞানী – যাঁর সম্পর্কে স্বয়ং আইনস্টাইন বলেছিলেন, হ্যাঁ, সত্যিকারের জিনিয়াস বলতে হলে ওই লিনাস পলিং-ই – লাগাতার বিরুদ্ধ-প্রমাণ সত্ত্বেও নিজেকে শুধরানোর চেষ্টাটুকুও করলেন না??
আমরা যেমন বিশ্বাস করতে ভালোবাসি, বিজ্ঞান কিন্তু ঠিক সেরকম একটু একটু করে এগোয় না। বিজ্ঞান বা বিজ্ঞানের গবেষণা একটি বিশেষ সময়ে একটা প্রচলিত ভাবনাস্রোতের মধ্যেই ঘুরপাক খেতে থাকে – তারই মধ্যে সমস্যার সমাধান খোঁজা হতে থাকে – প্রচলিত বিজ্ঞানভাবনায় গলদ থাকলেও, দৈনন্দিন গবেষণা সেই ভাবনার বেড়া অতিক্রম করতে পারে না। তারপর, কোনো এক সময় আসে, যখন সেই প্রচলিত চিন্তাপদ্ধতি দিয়ে বেশ কিছু সমস্যার সমাধান আর পাওয়া সম্ভব হয় না। সত্যিকারের কোনো এক জিনিয়াস এসে ভাবনাক্রমটাকেই বদলে দেন – সে এক মস্তবড় ঝাঁকুনি – বিজ্ঞান ঐতিহাসিক টমাস কুন-এর ভাষায়, প্যারাডাইম শিফট – চিন্তার জগতেই এক মস্ত বদল। যেমন, পরমাণুর প্রচলিত ভাবনার পরে কোয়ান্টাম থিওরি, নিউটনের মেকানিক্স অতিক্রম করে আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার তত্ত্ব – রসায়নের জগতে পলিং-এর কেমিক্যাল বন্ড-এর তত্ত্ব-ও অনেকটা তেমনই।
স্বভাবতই, জিনিয়াসরা প্রচলিত ভাবনাকে অতিক্রম করেই অগ্রসর হন – বলা যায়, প্রচলিত ভাবনাপদ্ধতি যে এগোনোর পথে বাধা, এ অনুভব তাঁদের রক্তে। চিকিৎসকরা যখন বারবার বলছিলেন, যে, বাড়তি ভিটামিন সি দিয়ে কাজের কাজ কিছু হয় না, পলিং কি সে কথা নস্যাৎ করছিলেন স্রেফ এই অনুভব থেকেই?? অথচ, নিজের চিন্তার বিরুদ্ধে তো স্রেফ পুরোনো ভাবনা-ই নয়, প্রচুর তথ্যপ্রমাণ জড়ো হয়েছিল – সব প্রমাণই নির্দিষ্ট করে জানাচ্ছিল, পলিং যা বলছেন, তার মধ্যে সত্যের লেশমাত্র নেই – তবুও, পলিং সেকথা শুনতে পেলেন না?? নাকি, তাঁর তত্ত্বের বিপরীতে একের পর এক তথ্যের যে পাহাড় জমে উঠছিল, তিনি সবকিছুকেই ধরে নিচ্ছিলেন নতুন পথে ভাবতে না পারার প্রমাণ হিসেবে – বাকিদের অক্ষম দুর্বলতা হিসেবে??
জিনিয়াস বিজ্ঞানী হওয়ার সাথে সাথে লিনাস পলিং-এর একটা বড় দোষ ছিল, তাঁর অহমিকা – এবং, খানিকটা ঔদ্ধত্যও। ডাবল হেলিক্স-খ্যাত জেমস ওয়াটসন-ও বলেছিলেন – যে ওয়াটসন বৈষ্ণব বিনয়ের অধিকারি, এমন অভিযোগ তাঁর পরম শত্তুরেও করবে না – তিনিও বলেছিলেন, পলিং-এর মতো সুবক্তা পাওয়া মুশকিল – কেমিস্ট্রির জটিল গবেষণাও বিজ্ঞানীমহলে উপস্থাপনার মুহূর্তে তিনি সমান আকর্ষণীয়, প্রায় নাটকীয় – পেপার প্রেজেন্টেশনের মতো নিরস ব্যাপারকেও তিনি প্রায় স্টেজ পারফরম্যান্সের পর্যায়ে নিয়ে যাতে পারেন – সবাই চমৎকৃত হতেন – শুধু কয়েকজন বাদে, যাঁদের একটাই অভিযোগ, মানুষটা যদি আরেকটু নম্র হতেন!!
এর সাথে আরো একটা বড় সমস্যা, পলিং নিজের ভুল মানতে চাইতেন না।
তাঁর একসময়ের সহকর্মী, ম্যাক্স পের্যুজ, যিনি কিনা নিজেও নোবেলজয়ী রসায়নবিদ, পলিং সম্পর্কে বলেছিলেন, আইনস্টাইনকে কেউ যদি তাঁর ভুল নিয়ে বলত, আইনস্টাইন ব্যাপারটা খতিয়ে দেখতেন, আর যদি দেখতেন, হ্যাঁ, ভুলই হয়েছে, তাহলে খুব খুশী হতেন – যাক, ভুলটা আগেভাগেই ধরা গিয়েছে, খামোখাl বেইজ্জত হতে হল না – কিন্তু পলিং? তাঁকে যখন তাঁর অঙ্কের ভুল নিয়ে বলতে গেছি, তিনি উল্টে আমার ওপরই চটে গেছেন – তাঁর নিজের অঙ্ক তাঁর চাইতে কেউ ভালোভাবে কষেছেন, এ তাঁর সহ্য হত না। এটা খুব দুর্ভাগ্যজনক, যে, পলিং-এর পর্যায়ের বিজ্ঞানী জীবনের শেষ পঁচিশ বছর নষ্ট করলেন ভিটামিন সি নিয়ে – আর, বিজ্ঞানী হিসেবে নিজের সম্মান ধুলোয় মিশিয়ে দিলেন – কিন্তু, তাঁর পতনের মূলে তাঁর নিজেরই আকাশছোঁয়া অহমিকাবোধ।
যাক সেসব কথা। পুরোনো দিনে ফিরি।
সত্তরের দশকের শুরুতে, অর্থাৎ তাঁর ভিটামিন সি ও সর্দি-কাশি নামক বইটি প্রকাশের পরেপরেই লিনাস পলিং বুঝলেন, বিজ্ঞানী বা চিকিৎসক, কেউই তাঁর ভিটামিন সি-এর গুণাবলী বিষয়ক দাবী মানতে রাজি হবেন না। তাহলে পথ?
কিন্তু, আগেই যেকথা বলছিলাম, ভিটামিন সি বিষয়ে তাঁর দাবী বিজ্ঞানমহলে কল্কে না পেলেও, সাধারণ মানুষ বা মিডিয়ায় সে দাবীর গ্রহণযোগ্যতা ও জনপ্রিয়তা ছিল তুঙ্গে – আর, পলিং-এর ব্যক্তিগত ক্যারিশমা ছিল প্রশ্নাতীত। এমতাবস্থায়, জনপ্রিয়তার পাশাপাশি, পলিং-এর দাবীকে বৈজ্ঞানিক ভিত্তি জোগানোর জন্য বিকল্প পথ খোঁজা জরুরী হয়ে পড়ল – কেননা, এইসব ক্ষেত্রে, কথার পিছনে কিঞ্চিৎ বিজ্ঞান জোড়া গেলে দাবীটা বেশ পাকাপোক্ত হয়। আর, একটু ভেবে দেখুন, পলিং-এর দাবীকে যদি পাকাপাকিভাবে প্রতিষ্ঠা করা যায়, তাহলে লাভ কার? বা কাদের??
বিজ্ঞানের ইতিহাস, বিশেষত চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসের দিকে ফিরে দেখতে হলে, বিভিন্ন ভ্রান্ত ধারণা – বিপরীতে প্রচুর প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও – বহুবছর ধরে মান্যতা পেয়ে গিয়েছিল কেন, এই প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে, একটি ছোট্ট প্রশ্ন অব্যর্থ – এই ভুল থেকে লাভের গুড় পৌঁছাচ্ছিল কার ঘরে?
অতএব, লিনাস পলিং যখন ১৯৭৩ সালে চালু করলেন ভিটামিন বা ফুড সাপ্লিমেন্টের গুণাগুণ প্রমাণের জন্যে তাঁর নিজস্ব প্রতিষ্ঠান – ক্যালিফোর্নিয়ায় – ইনস্টিটিউট অফ অর্থোমলিকিউলার মেডিসিন (ভবিষ্যতে যা পরিচিত হয় লিনাস পলিং ইনস্টিটিউট নামে) – তাঁর মুখ্য স্পনসর হিসেবে হাজির হয় হফম্যান-লা রশ কোম্পানি – ভিটামিন ও অন্যান্য ডায়েটারি সাপ্লিমেন্ট প্রস্তুতকারক কোম্পানি – এই বিশেষ ক্ষেত্রে হফম্যান-লা রশ ছিল বিশ্বের একনম্বর কোম্পানি, এবং একসময় ফুড সাপ্লিমেন্টের বিশ্ববাজারের তিন-চতুর্থাংশ ছিল তাদের দখলে – এই কোম্পানির নামডাক ও তাদের ব্যাপারস্যাপার এই আলোচনায় আবারও আসবে, তবে এখুনি নয় – মোট কথা, পলিং-এর ভ্রান্তির সুফল কোন ঘরে পৌঁছোতে শুরু করেছিল, সে বিষয়ে আর সন্দেহের অবকাশ আছে কি?? আর সেই ভ্রান্তি জিইয়ে রেখে ব্যবসা জারি রাখতে, তাঁরা সে সর্বান্তকরণে পলিং-এর পাশে থাকবেন, তাতেও নিশ্চয়ই অবাক হওয়ার কারণ নেই!!
অতএব, চালু হয়ে গেল ইনস্টিটিউট অফ অর্থোমলিকিউলার মেডিসিন – পলিং একাধারে প্রেসিডেন্ট, ডিরেক্টর এবং বোর্ড-চেয়ারম্যান। খুঁজেপেতে নিয়ে এলেন আর্থার রবিনসন-কে – তরুণ রসায়নবিদ – সেসময়ের তরুণ রসায়নবিদদের মধ্যে সবচেয়ে প্রতিশ্রুতিবান বলে ভাবা হচ্ছিল তাঁকে। রবিনসন হলেন প্রতিষ্ঠানের সহকারি ডিরেক্টর, ভাইস-প্রেসিডেন্ট এবং ট্রেজারার। কাজ বলতে, ভিটামিন সি-এর উপকারিতার পরীক্ষাযোগ্য প্রমাণ জোগাড় করতে থাকা।
কিন্তু, পরিকল্পনামাফিক কিছুই এগোলো না। একটি বিশেষ ধরনের ইঁদুর নিয়ে গবেষণা শুরু করলেন রবিনসন, যাদের মধ্যে চামড়ার ক্যানসার হয় – এক দলকে দেওয়া হল ভিটামিন সি মেগাডোজ, অপরদলকে কিছুই না। পরীক্ষা চালাতে গিয়ে, ফলাফল দেখে রীতিমতো ঘাবড়ে গেলেন রবিনসন – বাড়তি ডোজের ভিটামিন সি ক্যানসার তো ঠেকাচ্ছেই না, উল্টে ক্যানসারের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দিচ্ছে বিপজ্জনকভাবে। আরেকটু পরীক্ষা করে নিশ্চিত হলেন তিনি – হ্যাঁ, ভিটামিন সি মেগাডোজ নিজেই হয়ে উঠতে পারে বিপজ্জনক মিউটেশন তথা ক্যানসারের কারণ – পরিভাষায়, পোটেনশিয়ালি মিউটাজেনিক।
উদবিগ্ন আর্থার রবিনসন ছুটে এলেন পলিং-এর কাছে – পরীক্ষার রেজাল্ট সামনে রেখে পলিং-এর কাছে একান্তে প্রকাশ করলেন নিজের বাড়তি উদবেগের জায়গাটা – সেটা ১৯৭৭ সাল, পলিং ও তাঁর স্ত্রী দুজনেই প্রায় এক দশক জুড়ে মেগাডোজ ভিটামিন সি খেয়ে চলেছেন – দিনে কমবেশী দশ গ্রাম – অতখানি যদি শরীর গ্রহণ নাও করে, মানে অতো বেশী যদি অ্যাবসর্বড নাও হয়, এই এতখানি পোটেনশিয়ালি মিউটাজেনিক উপাদানের সংস্পর্শে আসছে পাকস্থলীর ভেতরটুকু – সে-ও তো বড় বিপদ!!
রবিনসনের পরীক্ষার ফলাফল এবং তাঁর উৎকন্ঠা দেখে সচেতন হওয়ার পরিবর্তে বেজায় খাপ্পা হলেন পলিং – রেগে অগ্নিশর্মা হয়ে জানালেন, এটা তাঁর প্রতিষ্ঠান, কোন গবেষণা হবে আর কোনটা প্রকাশিত হবে, সেসবের বিচার করবেন এক এবং একমাত্র তিনিই। উল্টে রসায়নের দুনিয়ায় নিজের প্রতিষ্ঠাকে ব্যবহার করে আর্থার রবিনসনের ভবিষ্যৎ ও কেরিয়ার নষ্ট করে দেওয়ার হুমকিও দিয়ে বসলেন।
হুমকি সত্ত্বেও পিছু হটতে চাইলেন না রবিনসন – অতএব, চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হল তাঁকে, এবং তাঁর গবেষণার ফলাফল প্রকাশ্যে আনতে দেওয়া হল না। ছাড়লেন না রবিনসনও – ইনস্টিটিউট আর পলিং-এর বিরুদ্ধে মানহানির মামলা দায়ের করলেন – ক্ষতিপূরণ দাবী করলেন পঁচিশ মিলিয়ন ডলার। এদেশের উচ্চতায় পৌঁছাতে না পারলেও, মার্কিন দেশেও বিচারব্যবস্থা যথেষ্ট দীর্ঘমেয়াদী – মামলা চলল পাঁচ বছরেরও বেশী সময় ধরে – পলিং আর তাঁর সাধের ইনস্টিটিউট বাঘা আইনজ্ঞ নিয়োগ করলেন – স্রেফ আইনজীবীদের পিছনেই ইনস্টিটিউটের খরচা হয়ে গেল এক মিলিয়ন ডলারের বেশী – শেষমেশ কোর্টের বাইরে রবিনসনের সাথে পাঁচ লক্ষ ডলার ক্ষতিপূরণ দিয়ে রফা করা হল।
কিন্তু, রবিনসন ইঁদুরের উপর পরীক্ষা করে যা দেখেছিলেন, আস্তে আস্তে সেকথা জানা যেতে লাগল বিভিন্ন সূত্র থেকেই – লাগাতার হাই ডোজ ভিটামিন বা নিউট্রিশনাল সাপ্লিমেন্ট ভালো তো করে-ই না, উল্টে খারাপ করতে পারে বিলক্ষণ।
রবিনসন পলিং পরিবারের লাগাতার হাই ডোজ ভিটামিন সি খাওয়া নিয়ে উৎকন্ঠা প্রকাশ করেছিলেন – বলেছিলেন, অন্ত্র থেকে শরীরের ভিতরে রক্তে যদি না-ও আসে, রক্তের মধ্যে দিয়ে অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গে যদি না-ও পৌঁছায় – পাকস্থলীর ভেতরের পর্দা যে রোজ এতখানি পোটেনশিয়ালি মিউটাজেনিক উপাদানের সংস্পর্শে আসছে, তার বিপদ তো কম কিছু নয়!! সেকথাকে উড়িয়ে দিয়েছিলেন পলিং – অবজ্ঞা আর তাচ্ছিল্যের চোখে দেখেছিলেন। কিন্তু, তার কবছর বাদেই, তাঁর স্ত্রী আভা পলিং আক্রান্ত হবেন ওই পাকস্থলীর দুরারোগ্য ক্যানসারে – আভা পলিং-এর মৃত্যুর কারণ যে গ্যাস্ট্রিক ক্যানসার, তার পেছনে এতবছরের ভিটামিন সি মেগাডোজ কিনা, নিশ্চিত করে বলা যায় না, তবুও…
আর, নিয়তির পরিহাস ছাড়া আর কী-ই বা বলা যায় একে, ভিটামিন সি-র প্রয়োগে বিশ্ব থেকে ক্যানসার নির্মূল করে দেওয়ার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন যিনি, কয়েক দশক জুড়ে লাগাতার হাই ডোজ ভিটামিন সি খাওয়ার পরেও, তার মৃত্যুর কারণও শেষমেশ ক্যানসারই।
(চলবে)
বিষান দা,আপনার লেখা প্রবন্ধগুলো বই আকারে চা.. ই..চাই।
Like!! I blog frequently and I really thank you for your content. The article has truly peaked my interest.
I like the valuable information you provide in your articles.
Good one! Interesting article over here. It’s pretty worth enough for me.
I used to be able to find good info from your blog posts.