১৮ জুন ১৮৫৮, আজ থেকে ১৬৪ বছর আগে। ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামের শেষ লড়াই চলছে, বিশেষ করে আওধ, লখনৌ আর ঝাঁসিতে। লন্ডনে চার্লস ডারউইন নামক এক সম্ভ্রান্ত ইংরেজ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের এক প্রান্তের মালয় থেকে আরেক ইংরেজের চিঠি পেলেন। আলফ্রেড রসেল ওয়ালেস নামক কমবয়সী এক ভদ্রলোক লিখছেন… কী লিখছেন? ওয়ালেস লিখেছেন ডারউইনের নিজের অপ্রকাশিত বিবর্তন তত্ত্ব, যদিও ডারউইনের মত করে গুছিয়ে ওয়ালেস সে তত্ত্ব লিখে উঠতে পারেননি।
.
বিবর্তনের প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্ব ডারউইন ও ওয়ালেস দুজনের যৌথ অবদান। সেই মতবাদকে ‘ডারউইনবাদ’ (Darwinism) বলে আখ্যায়িত করে বই লেখেন ওয়ালেস নিজে—ওয়ালেসের মহত্ত্ব এখানেই! (পাদটীকা ১) আবার ডারউইন তাঁর চিঠিতে ওয়ালেসকে বলেছেন, এই তত্ত্ব তাঁদের দুজনের যৌথ অবদান। কিন্তু যৌন নির্বাচন তত্ত্ব ডারউইনের একার। তখনকার আর পাঁচজনের মতই ‘সমাজবাদী’ ওয়ালেস যৌন নির্বাচনে নারীর পছন্দ মেনে নিতে পারেননি।
.
ডারউইন যৌন নির্বাচন তত্ত্বে বলছিলেন, নারীরা তাদের নিজস্ব পছন্দ অনুসারে পুরুষ বেছে নেয়। নারীর পছন্দসই হতে গিয়ে পুরুষের বংশানুক্রমিক বদল ঘটে, এবং এই বদল মানুষের বিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে। মানুষের ক্ষেত্রে শুধু নয়, যৌন নির্বাচন অন্য অনেক জীবের ক্ষেত্রে একই ভাবে কাজ করে। জীবজগতে স্ত্রী-জীবেরা কিছু পুরুষকে যৌনসঙ্গী হিসেবে বেছে নেয়। যে সব পুরুষ স্ত্রী-দের ‘পছন্দ’-মাফিক হয়ে ওঠে, তাদের সঙ্গেই কেবল স্ত্রী-জীবেরা যৌনক্রিয়া ও সন্তান উৎপাদন করে। বাকি পুরুষেরা যতই শক্তিশালী, দীর্ঘজীবী বা ‘ফিট’ হোক না কেন, তাদের সন্তান হয় না। ফলে বংশধারায় তাদের প্রভাব পড়ে না। আজকের ভাষায় বলতে গেলে, তাদের জিন হারিয়ে যায়। টিকে থাকে স্ত্রী-জীবের পছন্দসই পুরুষের জিন।
.
ডারউইন ১৮৬০ সালে আসা গ্রে (Asa Gray)-কে চিঠিতে লিখেছিলেন, “যখনই আমি ময়ূরের লেজের পাখমের দিকে তাকাই, দৃশ্যটি আমাকে অসুস্থ (sick) করে তোলে। (তথ্যসূত্র ১)
.
আবার তার প্রায় চার বছর পরে আলফ্রেড রাসেল ওয়ালেস-কে ডারউইন লিখছেন, “ময়ূরের লেজ এইভাবে [যৌন নির্বাচনের মাধ্যমে] তৈরি হয় এটা বিশ্বাস করা খুব শক্ত, কিন্তু একবার এটা বিশ্বাস করার পরে আমার আরও বিশ্বাস হচ্ছে যে মানুষের ক্ষেত্রে এই নীতি কিছুটা পরিবর্তিতভাবে প্রযোজ্য।” (তথ্যসূত্র ২)
.
আলফ্রেড রাসেল ওয়ালেস এবং ডারউইন যুগ্মভাবে প্রাকৃতিক নির্বাচনের তত্ত্ব আবিষ্কার করেছিলেন। কিন্তু ডারউইনের যৌন নির্বাচনের তত্ত্বের চূড়ান্ত বিরোধী ছিলেন ওয়ালেস। তিনি এই তত্ত্বকে উদ্ভট মনে করতেন। পাশ্চাত্যের শিক্ষিত সমাজে সবাই জানতেন নারীর পছন্দের দাম নেই। সত্যিই তো চেঙ্গিজ থেকে শাহজাহান, ইংল্যান্ড থেকে আফ্রিকা, নারীর পছন্দের দাম কোথাও ছিল না। ডারউইনের আমলে ভিক্টোরিয়ান ব্রিটেনে পুরুষরা নারীদের বেছে নিত। ‘উত্তম’ পুরুষের পছন্দ-মাফিক হওয়াতেই ছিল নারীর সার্থকতা। এটা ডারউইনের ‘স্ত্রী-জীবের পছন্দ’-র ধারণার বিপরীত।
.
যৌন নির্বাচনের কথা বলার সময় মনে রাখতে হবে, আপাতদৃষ্টিতে যৌন নির্বাচনের দুটো ধরণ আছে। একটা ধরণে স্ত্রী-জীবরা নিস্ক্রিয় বলে ভাবা যায়। সেই ধরণের যৌন নির্বাচন নিয়ে কারও তেমন আপত্তি ছিল না। হরিণ বা ভেড়া জাতীয় শৃঙ্গী প্রাণীদের মধ্যে স্ত্রী-সঙ্গমের অধিকার নিয়ে দুই পুরুষ-প্রাণীর লড়াইতে যে জেতে সেই বংশধর রাখতে পারে। বিবর্তনের সাধারণ নিয়মেই বলশালী ও বড় শিংযুক্ত পুরুষদের বংশধর বেশি হয়, ও পরের প্রজন্মের পুরুষদের বেশি বড় শিং-এর বৈশিষ্ট্য বা জিন ছড়িয়ে পড়ে। একইভাবে, গরিলাদের দলে একজন পুরুষ দলপতি সেই দলের সমস্ত মেয়ে গরিলার ওপর অধিকার বজায় রাখে। অন্য সব প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ গরিলাকে গায়ের জোরে হারিয়ে দলপতির পদটি ধরে রাখতে হয়। দলপতিকে স্ত্রী গরিলারা নির্বাচন করে না, কিন্তু তারা কেবলমাত্র দলপতির সঙ্গেই মিলিত হয়। ফলে দলপতির শারীরিক শক্তি ও বিশাল চেহারা পরের প্রজন্মের পুরুষ গরিলার মধ্যে সঞ্চারিত হয়। এইরকম যৌন নির্বাচনের ফলে পুরুষ প্রাণীর বিবর্তন হয়, সেটুকু মেনে নিতে কারও আপত্তি ছিল না। পুরুষ প্রাণী পরিকল্পনা করে অন্য পুরুষদের তাড়িয়ে দেয় বা স্ত্রীদের নজরবন্দী করে রাখে। বেশি বলশালী পুরুষ প্রাণীর আধিপত্য কমজোরি পুরুষরা লড়াই ছাড়াই মেনে নেয়। অধিক উর্বর স্ত্রী-প্রাণীকে পুরুষ প্রাণী বেশিবার যৌনসঙ্গী করে। এ সমস্ত ব্যবহারকে পুরুষ-প্রাণীর স্বাভাবিক বোধবুদ্ধি বলে ভাবতে ভিক্টোরিয়ান সমাজের আপত্তি ছিল না।
.
কিন্তু ডারউইন বললেন, স্ত্রী-প্রাণী সক্রিয়ভাবে পুরুষদের মধ্যে কারোকে যৌন-সঙ্গমের জন্য নির্বাচন করে এবং অন্য পুরুষদের সক্রিয়ভাবে প্রত্যাখ্যান করে। ওয়ালেস এবং তাঁর মত অনেক বিজ্ঞানীর মত ছিল যে মানবেতর প্রাণীরা ডারউইন কথিত সঙ্গী নির্বাচন করতে পারে না। তার জন্য যে সমস্ত জটিল সিদ্ধান্ত নিতে হয় সেগুলো তাদের পক্ষে নেওয়া সম্ভব নয়। তার ওপর, ময়ূরের পালক দেখে ময়ূরী সঙ্গী নির্বাচন করে এ কথা মেনে নিলে এও মানতে হয় ময়ূরীর সৌন্দর্যবোধ মানুষের মত। কিন্তু সেটা অসম্ভব।
.
সেই সময়ের চালু ধারণা অনুযায়ী সৌন্দর্যবোধ মানুষের একচেটিয়া, আর সেখানেও কেবলমাত্র উঁচু সামাজিক স্তরের মানুষের মধ্যে এই বোধের বিকাশ হয়েছে। সাদা পশ্চিম ইউরোপীয় বাদে অন্য মনুষ্যগোষ্ঠীর সৌন্দর্যবোধ আদৌ আছে কিনা, বিশেষ করে ‘জংলি’-দের সৌন্দর্যবোধ সম্ভব কিনা, তা নিয়েও অনেকের প্রশ্ন ছিল। তদুপরি মহিলারা যৌনভাবে পুরুষকে কামনা করে অনেকের মধ্যে একজনকে বেছে নেবেন, এটা সেই সময়ে অনেকে ভাবতেই পারতেন না। যেন এই নির্বাচন রুচিবিরুদ্ধ। ডারউইনের সমালোচকরা বললেন, মানুষের ক্ষেত্রে স্বামী নির্বাচনের জন্য মহিলারা পিতামাতার ওপরে নির্ভরশীল। আর ডারউইন কিনা ভাবছেন, মানবেতর প্রাণীরা নিজে স্বামী নির্বাচন করে? তাদের বুদ্ধি কি মানবীর বুদ্ধির চাইতে বেশি?
.
সেই সময় অ-মানুষের সৌন্দর্যবোধ বা সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা নিয়ে তর্কে ডারউইনের জেতার কথা নয়। ডারউইন বললেন, স্ত্রী-জীবেরা যে যৌনসঙ্গী নির্বাচন করে সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই, তবে তারা সৌন্দর্যের মাপকাঠি মানুষের মত করে ঠিক করে না। এই অনুমান পরে অভ্রান্ত প্রমাণিত হয়েছে। ঠিক কীভাবে ময়ূরী বা স্ত্রী-নাইটিঙ্গেল পাখি তার যৌনসঙ্গী নির্বাচন করে সে তথ্য ডারউইনের কাছে ছিল না। ময়ূর-ময়ূরীদের সঙ্গী নির্বাচন খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করলে ময়ূরীই যে তার ‘সঙ্গী পছন্দ’ করে, সে নিয়ে দ্বিমতের অবকাশ থাকে না।
.
যৌন নির্বাচনে মানবীর ভূমিকা নিয়ে ডারউইন বললেন, বর্বর জাতি বাদে অন্য সব মনুষ্যগোষ্ঠীর মধ্যে পুরুষরাই সঙ্গী নির্বাচনে অগ্রণী ভূমিকা নেয়। যেন পুরুষের নারী সঙ্গী নির্বাচন করাই সভ্যতার পরাকাষ্ঠা। বর্বরদের মধ্যে নারীরা সঙ্গী নির্বাচন করে, এমন সম্ভাবনার দরজা ডারউইন খোলা রাখলেন। প্রাণিজগতের সঙ্গে মানুষের সরাসরি ধারাবাহিকতা ছিল ডারউইনের চিন্তার স্তম্ভ। বর্বরদের ওপর সভ্য মানুষ ও অ-মানুষের যোগসূত্র হবার যে দায়টি ডারউইন চাপালেন, সেটা কতটা তাঁর নিজের চিন্তা আর কতটা ভিক্টোরিয়ান ব্রিটিশকে তেতো তত্ত্ব গেলানোর কৌশল, সেটা বলা শক্ত।
.
এখানে তাঁর সঙ্গে ওয়ালেসের চিন্তার বিভেদ স্পষ্ট। ‘ডিসেন্ট অফ ম্যান’ প্রকাশের কিছুদিন আগে ওয়ালেস মানুষের বিবর্তনের ক্ষেত্রে দৈব হস্তক্ষেপ অবশ্যম্ভাবী মনে করেছেন, আর ডারউইনের সঙ্গে তাঁর সরাসরি মতবিরোধ হয়েছে। (তথ্যসূত্র ৩) যৌন নির্বাচন নিয়ে দুজনের বিপরীত দৃষ্টিভঙ্গি সেই মত-সংঘাতের সঙ্গে সম্পূর্ণ সামঞ্জস্যপূর্ণ।
এখানে একটি কথা স্মরণে রাখা উচিৎ। মত-সংঘাত সত্ত্বেও ডারউইনের অবদানকে ওয়ালেস খাটো করেননি, আর ডারউইনও তুলনায় অখ্যাত ওয়ালেসের ভূমিকাকে যথাযথ গুরুত্ব দিয়েছেন।
.পাদটীকা
১) ওয়ালেস-এর লেখা বইটির নাম Darwinism: An Exposition of the Theory of Natural Selection with Some of Its Applications, ১৮৮৯ সালে প্রকাশিত।
.
চিত্র পরিচিতি
১) ওয়ালেস ও ডারউইন
২) ‘নারীর পছন্দ’ ডারউইন-এপ ব্যাঙ্গচিত্র
.
তথ্যসূত্র
১) হার্ভার্ডের উদ্ভিদবিজ্ঞানী আসা গ্রে ছিলেন আমেরিকাতে ডারউইনের অগ্রগণ্য সমর্থক। আসা গ্রে-কে ডারউইনের লেখা চিঠি, ৩ এপ্রিল ১৮৬০ https://www.darwinproject.ac.uk/letter/DCP-LETT-2743.xml
২) আলফ্রেড রাসেল ওয়ালেসকে লেখা ডারউইনের চিঠি, ১৫ জুন ১৮৬৪
৩) ১৯৬৯ সালে ডারউইন-ওয়ালেস পত্রালাপ, https://www.darwinproject.ac.uk/letter/DCP-LETT-6684.xml