ডাক্তার তপ্পন বৈদ্য তাঁর আকৈশোর বন্ধু (যদিও বয়সে অনেক ছোটো) পাঁচু (পঞ্চানন মোড়ল)–এর সঙ্গে সমুদ্র সৈকতে এসেছেন।পাঁচু নামটার একটা নাটকীয় তাৎপর্য আছে- ডাকঘর নাটকে পঞ্চানন মোড়লের ভূমিকায় এঁকে এ্যাতো চমক্কার মানিয়েছিলো যে কালের চক্করে ওনার আসল নাম হারিয়ে যায়। যীশুদিবসের (যদিও যীশু এই দিনে জন্মেছিলেন, এর’ম কোনও প্রমাণ পাওয়া যায় নি, তবুও ধর্মীয় বিশ্বাস….) প্রবল জনসমাগমে সমুদ্রতীরে কোনও হোটেল খালি না পেয়ে, এই দুই গোবেচারা একটু দূরতম গ্রামে মাথা গুঁজেছেন।
মন্দ নয়, সে জায়গা ভালো। পাশে আছে ঝাউবন। সে ঝাউবন পেরিয়ে আরও দক্ষিণে গেলে, দুপাশে জঙ্গল সরিয়ে, একটা ছোট্ট শুঁটকির কারখানা রয়েছে। চারপাশে উপড়ানো ঝাউগাছেরা শেষ শয্যায়। ঝড়ের পরে ঝড়ে, তারা সব ভূমিহীন হয়ে পড়েছে। তপ্পন বৈদ্য একটি কাঠঠোকরার প্রসাধনী অবলোকন করছিলেন। পাঁচু শুঁটকির আকুল সুবাসে নাকে রুমাল চেপে দূরাগত তরঙ্গভঙ্গের শব্দে মন দিয়েছিলেন।হোটেলের অভিজিতবাবুর লাল ঝোলে লাল কাঁকড়ারা পেটে জানান দিচ্ছে। একটা রোগা মেয়ে তার থেকে পাঁচগু ণ ভারী একটা ঝাউগাছের গুঁড়ি নিয়ে বাড়ি চলেছে। মাছরাঙা গভীর মনোযোগে একটা শুকনো ডালে বসে’ মাছ জরীপের কাজ করছে। বৃদ্ধ তপ্পন, পাঁচুর সঙ্গে সমুদ্র পাড়ের চা-দোকানে চললেন। এখানে প্রচুর দন্ডবায়স (দাঁড়কাক)। দ্রিঘাংচুর মতো করে’ “কঃ কঃ” করছে।
চা-দোকানে বসে’ পাঁচু একটি সিগারেট ধরিয়ে প্রশ্ন করলেন “আচ্ছা ট্যাঁপাদা, গল ব্লাডার অপারেশনের পর কি কি খাওয়া বারণ হবে?” বেচারার গল ব্লাডার অপারেশন হবে। কিছুদিন পরে।
তপ্পন চায়ে চুমুৎকার করে’ বললেন “কিসুই না”
“বলো কি হে! পেটের একটা জিনিস বাদ হয়ে’ যাবে, অথচ কিছুই বারণ হবে না!”
তপ্পন একটু হেসে চা-পানে মন দ্যান। পাঁচুর চা আনমনা পড়ে’ থাকে। এমনকি সিগারেটও বাতাসে ছাই হয়ে উড়ে’ যায়। “বলো দেখি পাঁচু, গল ব্লাডারের কাজ কী?”
“হজমে সাহায্য করা…..?”
“না হে না… হজমের সঙ্গে কোনও যোগাযোগই নেই”
“সি কি হে?”
“এটার কাজ হলো পিত্ত বা বাইলকে ঘন করা। পিত্ত চর্বি শোষণ বা এ্যাবসর্পশনে সাহায্য করা। পিত্ত না থাকলে চর্বিগুলো ছোটো ছোটো গুল্লির মতো সব পটিতে বেরিয়ে যাবে”
“বলো কি হে! তাহলে তো পিত্ত না থাকলেই ভালো কোলেস্টেরল বাড়বে না….”
“তা বটে কিন্তু চর্বির সঙ্গে ভিটামিন এ,ডি ই,কে-যেগুলো চর্বিতে গুলে’ থাকে, সেগুলোর কী হবে…?”
“তা বটে তাহলে গল ব্লাডারের ঠিকঠাক কাজটা কি?”
“পিত্ত জমিয়ে রাখা, পিত্তকে ঘন করা, গল ব্লাডারের সঙ্কোচন করে পিত্তকে অন্ত্রে পাঠিয়ে দেওয়া”
“পোষ্কার বুঝলাম না। তাহলে গল স্টোন কেন হয়?”
ইতিমধ্যে সূজ্জি মামার চোখ ঘুমে লাল হয়ে’ এসেছে। কয়েকটা ফিঙে ছাড়া বাকি পাখিরা অন্ধকারের জন্য শরীরে মেলাটোনিন বেড়ে যাওয়ায়, ঘুমোতে বাড়ি ফিরে গ্যাছে। সমুদ্রের লোনা বাতাসে অভিজিতবাবুর কাঁকড়া বিলকুল হজম। ভেজা লবণাক্ত হাওয়ায় তপ্পনের কথা ভিজে যায়। “যদি গল ব্লাডার নন ফাংশানিং হয়, তাহলে কোলেস্টেরল আর বিলিরুবিন গল ব্লাডারে জমে থাকে, ওগুলো কেলাসিত মানে কৃষ্টাল ফর্ম করে’, সেখান থেকেই স্টোন হয়।”
ইতিমধ্যে ঝুপড়ি দোকানে চা আর পেঁয়াজি বলা হয়েছে। তারা এখন টেবিলের শোভা বর্ধন করছে। তপ্পন সদ্ব্যবহার করতে করতে বলেন “বৃদ্ধ, ক্ষতিগ্রস্ত আরবিসি যেখানে সেখানে ভাঙলে সেখান থেকে আয়রন বেরিয়ে আসবে, ওখানেই বাকিটা বিলিরুবিন আর আয়রন তৈরি হয়, এরা কিডনি, হার্টে জমা হবে। তখন ব্যাপার কেরোসিন হবে। আসলে প্রতি মুহূর্তে পাঁচ মিলিয়ন লোহিত রক্ত কণিকা ভাঙছে। এটা দায়িত্ব নিয়ে স্প্লীন বা প্লীহা বা পিলে ধ্বংস করে, সেখান থেকে লিভার, তাই সোজা লিভার থেকে বিলিরুবিন হয়ে সেটা পিত্তরসে মিশছে। আর হিম মানে আয়রন চলে যাচ্ছে অস্থিমজ্জায়। সেখানে আবার নতুন আরবিসি তৈরি হয়। যাই হোক না কেন, লিভার থেকে সব কিছু গল ব্লাডারের ভেতর জমা থাকছে। গল ব্লাডার ক্ষুদ্রান্ত্রে উৎক্ষেপণ করতে না পারলে, থিতিয়ে পড়ে স্টোন তৈরি হবে।”
“বুঝলুম, তখন গল ব্লাডার কাটতে হবে-কিন্তু তারপর তোমার ঐ ক্ষুদ্রান্ত পিত্ত কোথায় পাবে?”
ইতিমধ্যে চারপাশে জোড়ায় জোড়ায় সবুজ চোখের কিছু জন্তু চারপাশে ঘুরছে।দু একটা শিশু কান্নার মতো শব্দ করছে। পাঁচু ভয় পেলো। “এগুলো কি হে? সবুজ সবুজ চোখ…..”
“ছুঁচোলো মুখওয়ালা, মোটা লেজ বিশিষ্ট, একদল সর্বভূক চারপেয়ে শ্বাপদ…..জম্বুক তাদের নাম”
এরপর শুরু হলো রাতের প্রহর গোনা। একজন বলছে “ক্যা হুয়া হুয়া হুয়া হুয়া” দোহাররা ধরতাই দিচ্ছে “হুয়া হুয়া হুয়া”
পাঁচু একটুও ভয় পায়নি, কিন্তু একটু আফ্রেড।
এবেলার একমাত্র সিগারেটটা ধরিয়ে তপ্পন খেই ধরেন। “আরে ছাড়ো খ্যাঁকশেয়ালির কথা। গল ব্লাডার না থাকলে, লিভার সরাসরি অন্ত্রে পিত্তরস পাঠিয়ে দেবে। কিছু দিন একটা সময় বেঁধে খেতে হতে পারে। তারপর লিভার তোমার প্রয়োজন অনুযায়ী পিত্ত সিক্রিট করবে। তখন আগের মতোই সব খেতে পারবে।”
“ব্বাহ, এতো বেশ ভালো কতা হে, গল ব্লাডার কাটলেও কিছু খেতে বারণ নেই, চমৎকার, চলো হে হোটেলে ফিরে যাই বেজায় অন্ধকার, ঠান্ডাও জম্পেশ পড়েছে….”
এখানে এখনই বেশ অন্ধকার। জোনাকি মিসিং। শুধু শেয়ালের ডাক, ভীত ছাগলের ডাক। ঘন অন্ধকার ঝাউবন, আলোছায়ার খেলা। শীতকাল বলে ভরসা, নাহলে অহীকুল ফোঁসফোঁসিয়ে ফনা তুলে’ দাঁড়িয়ে থাকতো। শেষ গাড়িটাও চলে গেল। গত কদিনের বৃষ্টিতে এখানে ওখানে জল জমে আছে।। সেখানে কটকটি ব্যাং প্রিয়তমাকে উদ্দেশ করে’ কটকটি,আর গেঁয়ো ব্যাং কত কি যে বলে’ দিলে। দুজন মানুষ আবড়ো খাবড়ো বালিয়ারি পার হয়ে হুড়মুড়িয়ে চলেছে।
ঝাউবনের ভেতর থেকে পাঁচুর গলা শোনা যায় “জ্যাকেল মানে ফকশেয়ালী, জ্যাকেল মানে ফকশেয়ালী, জ্যাকেল মানে ফকশেয়ালী….”