কোভিড মহামারীর খুব সম্ভবত শেষ পর্যায়এসে পড়েছে আমাদের দেশ। এটা অবশ্য আমার ব্যক্তিগত ধারণা নয়। এই ধারণার স্বপক্ষে কিছু যুক্তিসঙ্গত ব্যাখাও রয়েছে। অন্তত ভারত সরকারের বিজ্ঞান আর প্রযুক্তি বিভাগের বৈজ্ঞানিকদের সমীক্ষায় তেমনটাই উঠে এসেছে।
দেশজুড়ে প্রায় সারাবছর ধরে বয়ে চলা সংক্রমণের প্রকোপে দীর্ঘদিন ধরে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা আর রুজিরোজগার। তবে এই মুহূর্তে অ্যাক্টিভ রোগীর সংখ্যা কমতে শুরু করায় ধীরে ধীরে সংক্রমণের ভয়কে দূরে সরিয়ে রেখে সবাই ফিরছেন দৈনন্দিন কাজের মধ্যে। ভীড় বাড়ছে রাস্তাঘাটে, খুলছে বন্ধ কল-কারখানা। শুরু হয়েছে লোকাল ট্রেন চলাচল, মেট্রোরেল আর বিমানের ওড়াউড়ি। কোভিডের ছোঁয়ায় শাপগ্রস্ত অর্থনীতি মুখ তুলে দাঁড়াচ্ছে ক্রমে ক্রমে, অন্তত স্টক মার্কেটের উচ্ছ্বাস সেই কথাটাই জানাবার চেষ্টা করছে।
সাম্প্রতিক সরকারি পরীক্ষার ফলপ্রকাশে এটা পরিষ্কার ভারতবর্ষে কোভিডের প্রকোপ অনেকটাই কমে এসেছে। প্রাত্যহিক কমছে অ্যাক্টিভ রোগীর সংখ্যা। দু একটি রাজ্য ছাড়া প্রায় সর্বত্রই গ্রাফ নিম্নমুখী। রোগের এই রকম নিম্নগামী চলন থাকলে সামনের ফেব্রুয়ারীতে কোভিড রোগীর সংখ্যা সারাদেশে ২০,০০০ বা তার নীচে চলে যেতে পারে বলেই ধারণা বিজ্ঞানীদের। এই বিজ্ঞানীরা মূলত জড়িত আছেন আই আই টি, আই এস আই এবং আই আই এসের সঙ্গে, যাদের মান নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করার অবকাশ নেই এই মূহুর্তে।
এর সঙ্গে এটাও জানানো হচ্ছে যে খুব সম্ভবত জনসংখ্যার প্রায় শতকরা ৬০ ভাগ, সংক্রামিত হয়ে গেছেন কোভিডে এবং যাঁদের বেশিরভাগের মধ্যেই কোন রোগের লক্ষ্মণ প্রকাশ পায় নি।
স্ট্যাটিস্টিকস বলছে প্রতিটি কোভিড রোগীর সাথে সংক্রামিত হয়েছেন আরো প্রায় ৯০ জন মানুষ। যাঁদের সিম্পটম না থাকায়, টেস্ট হয়নি। তাঁরাও স্বাভাবিকভাবেই ভারাক্রান্ত করেন নি অসুস্থ রোগীর সংখ্যাকে। সামগ্রিক ভাবে অন্যদেশের তুলনায় টেস্ট কম হওয়ার দরুন রোগ নির্ণয়ও হয়েছে অনেকটাই কম। এই টেস্ট কম হওয়ায় ফলে, রোগীকে আইসোলেট করা যায়নি তাই রোগ ছড়িয়েছে অনেক বেশি। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রোগ প্রকাশিত হয়নি সংক্রামিত মানুষের শরীরে। কোন একটা অনাক্রম্যতা বাঁচিয়ে দিয়েছে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে। তৈরী করে দিয়েছে হার্ড ইমিউনিটি। এটা শুধু ভারত সহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতেই নয়, একই ঘটনা ঘটেছে আফ্রিকাতেও।
ইউরোপ যখন ত্রস্ত সেকেন্ড বা থার্ড ওয়েভ নিয়ে, আমেরিকায় যখন পাল্লা দিয়ে দৈনিক বাড়ছে কোভিড সেখানে তুলনায় গরীব দেশগুলিকেকে যেন পরিয়ে দিয়েছে রোগ প্রতিরোধের এই অজানা রক্ষাকবচ। সত্যি বলতে কি আফ্রিকা বা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে মারণহার বাড়তে থাকলে পরিস্থিতি যে খুব ভয়াবহ হতো সে ব্যাপারে অন্তত কোন সন্দেহ নেই কারোরই।
তবুও কোথাও একটা আশার আলো যেন দেখা যাচ্ছে। বিজ্ঞানীরা আরো বলছেন যেহেতু হার্ড ইমিউনিটি অনেকটা তৈরী হয়ে গিয়েছে তাই ভারতে সেকেন্ড বা থার্ড ওয়েভ আসার সম্ভাবনাও নাকি কম। উৎসব মরশুমের পরে সংক্রমণের হার সেই অর্থে না বাড়ায় তাঁরা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পেরেছেন। আরো বলা হচ্ছে যে সাধারণ মানুষের সেই লকডাউনের প্রচেষ্টা কার্যত নস্যাৎ করে দেওয়ায় আর রাস্তাঘাটে মাস্ক ব্যবহারের তীব্র অনীহার জন্য নাকি তৈরী হয়ে গিয়েছে হার্ড ইমিউনিটি।
জানি না এই সব অনুমানই শেষ পর্যন্ত মিলবে কিনা! তবে মিলে গেলে অবশ্যই সুড়ঙ্গের শেষ দেখা যাবে। দীর্ঘতর হবে আশার আলো। তবে এখনই অহেতুক উত্তেজিত হওয়ার কোন কারণ নেই। সব রকম সাবধানতা এ যাবৎ যা মেনে চলা হয়েছে তাই চলবে।
অর্থাৎ মুখোশের আড়ালে, মুখোমুখি নয় এখনো।
স্বল্পসংখ্যক হলেও কার ক্ষেত্রে কোভিড আচমকাই বিপজ্জনক হয়ে উঠবে তা কিন্তু এখনো কারো জানা নেই। তাছাড়াও মনে রাখতে হবে এরমধ্যেই প্রচুর কাছের মানুষকে হারিয়েছি আমরা। পরিবার আর বন্ধুবান্ধবদের মধ্যেই রয়েছেন নিকটাত্মীয় হারানো শোকসন্তপ্ত মানুষজন। আমাদের পেশাদার সঙ্গীরা সংক্রামিত হয়ে মারা গিয়েছেন অনেকে। আমাদের নিজেদের ভবিষ্যৎও অজানা।
তবে এই মহামারী আমাদের অনেক কিছু শিখিয়ে দিয়ে গেল।
শিখিয়ে দিয়ে গেল কলকারখানায় ঘাম ঝরানো শ্রমিক আর ক্ষেতখামারে পরিশ্রম করা কৃষকের মূল্য।
ডাক্তার আর স্বাস্থ্যকর্মীর সমাজে স্থান ঠিক কোথায় হওয়া উচিত দেখিয়ে দিয়ে গেল সেটাও।
অভিনেতা, খেলোয়াড় যাঁদেরকে কারণে অকারণে অনেক বেশি মাথায় তোলা হয় তাঁদের সঠিক মূল্য ও নির্ধারিত করে দিল এই সংকট।
ঘরে বসেও যে অফিসের কাজ করা যায়, স্কুল কলেজ দিব্যি চালানো যায় তাও প্রমাণিত হয়ে গেল এই কঠিন সময়ে।
দূষণ না থাকলে প্রকৃতির রূপটান যে কতটা বদলে যেতে পারে তা চাক্ষুষ হয়ে থাকলো আমাদের।
বন্ধুত্ব আর সম্পর্কগুলোই যে বেঁচে থাকার মূল চালিকাশক্তি আবার মনে করিয়ে দিয়ে গেল এই মহামারী।
আর আরেকবার মানুষকে বুঝিয়ে দিয়ে গেল যতই শক্তিশালী যন্ত্র বানাও না কেন প্রকৃতির কাছে তুমি এখনো শিশু।
অণুবৎ অদৃশ্য ভাইরাসও পারে তোমার ঝাঁ চকচকে বড় বড় শহরের রাস্তা জনশূন্য করে তোমাকে গৃহবন্দী করে ফেলতে। মৃত্যুভয়ে কাঁপন ধরাতে তোমার শরীরে।
দেশের ভবিষ্যত বাজেটে স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে যে একদম নতুন করে ঢেলে সাজাতে হবে তার সাবধান বাণী শুনিয়ে দিয়ে গেল কোভিড। বারবার অজানা ইমিউনিটি কিন্তু দেশের মানুষকে বাঁচাতে পারবে না। মনে রাখতে হবে একশ বছর আগের স্প্যানিশ ফ্লুতে প্রায় দেড় কোটি লোক মারা গিয়েছিল ভারতবর্ষে। দেশের নদীনালা ভরে উঠেছিল মানুষের মৃতদেহে, পোড়াবার কাঠ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। লোক না থাকায় প্রিয় মানুষটির জন্য কবর খুঁড়তে হয়েছিল পরিবারের লোকজনকেই।
আমাদের জীবদ্দশায় আর কি কি দেখবো সেটার কথা তো ভবিষ্যতই বলবে, তবে একবছর ধরে বয়ে চলা এই দুঃসময় অনেক কিছু জানিয়ে গেল।
সারাজীবনের অভিজ্ঞতা দিয়েও যার নাগাল পাওয়া যাবে না। কিছু কিছু সময় এইরকমই আসে। ইতিহাস তৈরী হয়ে যায়।
ভ্লাদিমির লেনিনের প্রায় একশো বছর পুরনো কথাটি যেন মিলে গেল অক্ষরে অক্ষরে, “There are decades where nothing happens, and there are weeks where decades happen.”
দেখা যাক আমরা সবাই এর থেকে কি কি শিক্ষা নিতে পারি!
ভালো থাকবেন সক্কলে। আবার ফিরে আসবো অন্য আরেকদিন। অন্য কোন ঘটনা নিয়ে।
ভালো লেখা।